আজকের দেশব্রতী : ২৯ জুন ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-29-june-2023panchayat-election-2023-in-west-bengalpanchayat-election-2023

বন্ধু,

বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন-১৯৭৩ অনুযনুায়ী প্রথমবারের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলায় পঞ্চায়েতব্যবস্থা কায়েম হয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার হিসাবে এই ত্রিস্তরবিশিষ্ট বিকেন্দ্রীত ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি ছিল উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও রূপায়নে গ্রামীণ জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা। এই ক্ষমতায়নের ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে রোজগার, খাদ্য, আবাস, শিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য পরিষেবার নিশ্চয়তা প্রাপ্তির ভিতের ওপর। নারীর স্বাধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা এবং ধর্ম ও জাতপাতের বিভাজনের বেড়াজাল ভেঙে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে এক কার্যকরী প্রতিষ্ঠান হিসাবে একে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ছিল শুরুর দিনগুলিতে। ৮০-র দশকের শেষদিক থেকে শাসকদলের একাধিপত্য ও স্থানীয় দলীয় নেতৃত্বের ক্ষমতাকেন্দ্রে পর্যবসিত হতে থাকে নির্বাচিত পঞ্চায়েতগুলি। ক্রমে গ্রামীণক্ষেত্রে এক দাপুটে অংশের সুবিধাভোগী সম্পন্নতা অর্জনে ব্যবহৃত হতে থাকে এই ব্যবস্থা। ৯০'র দশকের মধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলি হয়ে উঠল শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে সন্ত্রাসের প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক হিংসা বহুকাল যাবত বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরিচিত অভিজ্ঞান হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস শাসকদল হিসাবে ক্ষমতায় বসে। এরপর ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়কালের মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করতে দলীয় বাহুবল ও পুলিশী সন্ত্রাসকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী বামেদের হাতে থাকা পঞ্চায়েতগুলিকে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভেঙে দিয়ে এক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করে শাসকদল। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আসর তৃণমূলের পরিকল্পিত সন্ত্রাসের নজিরবিহীন উন্মত্ততায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল। জনগণের হাতে যে ছিটেফোঁটা ক্ষমতার অবশেষ ছিল, তাও পার্টির দাদাদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ল। স্বশাসিত সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও জনতার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সেই পরিকল্পনাগুলি রূপায়ন করে গ্রামীণ জনতার ক্ষমতায়নের কাঠামোটিকে অকেজো করে তোলা হ’ল। উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ টাকার পুকুরচুরি, সংগঠিত দুর্নীতি ও লুঠপাটের আখড়া করে তোলা হয়েছে প্রতিটি পঞ্চায়েতকে। প্রতিটি পঞ্চায়েত সংসদে বছরে দুটি গ্রামসংসদ ও সেইসূত্রে প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে গ্রামসভার মাধ্যমে জনতার অংশীদারিত্বের আইনসম্মত অধিকার আজ ভূলুন্ঠিত। দুর্নীতিতন্ত্র কায়েম করে বুভুক্ষা পীড়িত গ্রামসমাজের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ১০০ দিনের কাজ, ফসলের ন্যায্য দাম, আবাস যোজনার সুবিধা; কৃষি সমবায়গুলিকে করা হয়েছে অকেজো, গ্রামীণ শ্রমিকেরা জীবিকার অভাবে ভিনরাজ্যে প্রবাসী শ্রমিক হতে বাধ্য হচ্ছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ন্যূনতম সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে, পঞ্চায়েত প্রধান, বিডিও ও স্থানীয় তৃণমূল বাহুবলী নেতৃত্বের সম্মিলনে এক গ্রামীণ ‘মোড়লতন্ত্র’ কায়েম করা হয়েছে – যার মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাতের এক মোলায়েম ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে।

এই বিরোধীশূন্য লুঠতন্ত্রের বিরুদ্ধে গ্রামীণ সমাজ ক্রমশ ক্ষিপ্ত ও আন্দোলনমুখি হয়ে ওঠায় ১২ বছর একাধিপত্যে আসীন সরকার ও ক্ষমতাশালী দলপতিরা শঙ্কিত হয়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিকে নামিয়ে এনেছে রাজ্য সরকার, যা অধিকারের প্রশ্নটিকে মান্যতা না দিয়ে প্রকল্প সুবিধাগুলিকে সহজলভ্য করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি তৃণমূলের যুবনেতৃত্ব জনগণের অসন্তোষকে প্রশমিত করতে ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মীবাহিনীকে আশ্বস্ত করতে ‘নবজোয়ার’ অভিযান সংঘটিত করেছে। এই কর্মসূচি তৃণমূলের সংগঠনের ভেতরে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সেইসঙ্গে বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হামলা বাড়িয়েছে, এমনকি মহিলারাও আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কিছু কিছু অঞ্চলে রাজ্য শাসকদলের পক্ষে পূর্বেকার সমর্থন আলগা হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলার মানুষ আজ ক্রমশই হতাশ ও আস্থাহীন হয়ে পড়ছে শাসকদল পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি সম্পর্কে। বিদ্রোহী অংশটিকে শায়েস্তা করতে মিথ্যা মামলা, পুলিশী সন্ত্রাস ইত্যাদি আজ শাসকের একমাত্র অস্ত্র। ২০২৩-এর দশম পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পেশ ও প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের প্রথমপর্বে ইতিমধ্যেই দলীয় সন্ত্রাসে প্রাণ হারিয়েছেন ৮ জন। সন্ত্রাস একমাত্র সম্বল হয়ে ওঠায় নির্বাচন সম্পন্ন না হতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিছু পঞ্চায়েত হাতে এসে গেছে শাসকদলের। এমনকি রাজ্য নির্বাচনী কমিশনারকে নিরপেক্ষতা বর্জন করে শাসকদলের প্রায় আজ্ঞাবহের ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি।

তৃণমূল সরকারের এই নিবিড় দুর্নীতি ও উদগ্র অপশাসনের বিরুদ্ধে জনরোষকে কাজে লাগাতে তৎপরতা বাড়িয়েছে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি। দুর্নীতির অভিযোগকে ব্যবহার করে বিজেপি সরকার ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই খাতে কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ ৩৩% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিনে দু’বার ডিজিটাল হাজিরা, আধার সংযোগ ইত্যাদি বিধিনিয়মের ফাঁদে ফেলে গ্রামীণ শ্রমিকদের বঞ্চনার এক পরিকল্পিত আইনি ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। ভোটপর্বে সন্ত্রাস, প্রাণহানির প্রেক্ষিতে শক্তিশালী বিরোধীপক্ষের প্রতিরোধ না থাকায় বিজেপির ক্রীড়নক কেন্দ্রীয়বাহিনী মোতায়েনের আদালতি সিদ্ধান্ত জনমানসে একমাত্র প্রতিকার হিসাবে মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে কোচবিহারের শীতলকুচিতে ৫ জন নিরীহ, দরিদ্র গ্রামবাসীর নির্মম হত্যালীলা আজ ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আদিবাসী ও দলিত দরিদ্র অধ্যুষিত গ্রামবাংলায় তাদের শাখার সংখ্যাবৃদ্ধি করে আরএসএস একদিকে বিজেপির পক্ষে মান্যতা আদায়ে তৎপর, অন্যদিকে হিন্দুত্বের ভুয়ো মতাদর্শকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় বিভাজন বাড়িয়ে দাঙ্গাসঙ্কুল অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে সদা সচেষ্ট। রাজ্যে নবনিযুক্ত রাজ্যপালের মাধ্যমে কেন্দ্র-রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে ধ্বস্ত করতে রাজভবনে ‘পীস রুম’ সংরচনা ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে বাধাদান সমানে চলছে। রাজভবনের এই অতিসক্রিয়তা ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পর তুলনামলূকভাবে দুর্বল বিজেপিকে অক্সিজেন যুগিয়ে চাঙ্গা করার অপচেষ্টা মাত্র। প্রতিপক্ষ হিসাবে তৃণমূল সরকারের অবিজেপি রাজ্যগুলি থেকে পুলিশ মোতায়েনের বাগাড়ম্বর কেন্দ্র-রাজ্যের শাসকদলের নিরন্তর কাজিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটদানের অধিকারকে প্রহসনে পরিণত করতে উদ্যত।

যযুধান শাসকদলগুলি শুধমুাত্র পঞ্চায়েতস্তরে দুর্নীতির আখড়াগুলিকে বাঁচিয়ে রেখে ক্ষমতা দখলের লড়াই চালিয়ে যাবে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার ফিরিয়ে এনে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত জনগণের স্বশাসন ফেরানোর কোনো দায় এদের নেই। বুভুক্ষা ও অধিকারচ্যুতির প্রসারিত মানচিত্র বদলাতে, জনগণের অসন্তোষকে জনবিদ্রোহে পাল্টে দিতে আজ তাই প্রকৃত বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও নির্ভয় প্রতিরোধ গড়ে তুলে জনগণের হাতে এক স্বচ্ছ, স্বাধীকারযুক্ত কার্যকরী পঞ্চায়েত ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিতে হবে। শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রচার শানানোর সাথে সাথে বৃহত্তর জনশত্রু বিজেপি-আরএসএসের গ্রামবাংলা দখলের সমস্ত অপকৌশলকে প্রতিহত করতে হবে।

election-2023-in-west-bengal

এই লক্ষ্যে সিপিআই(এমএল) দলীয় মনোনীত প্রার্থীদের সমর্থনে মাটি আঁকড়ে লড়াই করে তৃণমূল-বিজেপিকে পরাস্ত করে রাজনৈতিক মেরুকরণের মোড় ঘোরাতে সচেষ্ট থাকবে। আবারও একবার বাংলার যুব-ছাত্র ব্রিগেডকে শহর ছেড়ে গ্রামভিত্তিক প্রচারের মাধ্যমে সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বাধীকারের উজ্জ্বল মতাদর্শের ব্যারিকেড গড়ার নিবিড় কাজে ব্রতী হতে হবে। যে সমস্ত কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থী নেই সেখানে বাম-গণতান্ত্রিক প্রার্থীদের পক্ষে আমাদের নিঃশর্ত সমর্থন থাকবে।

আসুন আমরা এই অঙ্গীকার মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করি, ‘গ্রামবাংলার প্রতিটি পঞ্চায়েত জনতার হাতে ফিরিয়ে দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবো’। কোনো হুমকি, প্রতারণা, সন্ত্রাসের কাছে আমরা মাথা নোয়াবো না। ভুয়ো মতাদর্শ ও গদী-মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারকে খন্ডন করে আমরা কঠিন, সঙ্কটদীর্ণ পথে হেঁটে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলে বাংলার সংগ্রামী বামপন্থী ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনবো।

আসুন আমরা দাবি জানাই, সন্ত্রাসমুুক্ত শান্তিপর্ণূ নির্বাচন পরিচালনার দায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে ১০০ শতাংশ সুনিশ্চিত করতে হবে।

বাংলার গ্রামীণ জনগণের প্রতি আমাদের আবেদন সন্ত্রাসকে সাহসী প্রত্যয়ে রুখে দিন, নির্ভয়ে নিজের ভোট নিজে দিন।

আওয়াজ তুলুন -

(১) লুঠের পঞ্চায়েত হঠাও! জনগণের পঞ্চায়েত ফিরিয়ে আনতে সিপিআই(এমএল) প্রার্থীদের ভোট দিন।

(২) বিজেপি-আরএসএস’এর হিংসা ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণের সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলুন। সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতাদের দ্রুত শাস্তি সুনিশ্চিত করতে হবে।

(৩) পঞ্চায়েতকে দলতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের শাসন থেকে মুক্ত করো, গ্রামীণ জনতার অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করো। গ্রামসভার বৈঠককে প্রহসনে পরিণত করা চলবে না। দলবাজিমুক্ত-দুর্নীতিমুক্ত পঞ্চায়েত গড়তে হবে।

(৪) দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি চাই কিন্তু দুর্নীতির অজহুাতে ‘১০০ দিনের কাজ’ বন্ধ রাখা চলবে না। কেন্দ্র-রাজ্য বুঝি না; কাজ চাই, কাজ দাও। কাজ করেছি, বকেয়া মজুরি দাও।

(৫) প্রমোটার-জমি মাফিয়াদের হাতে কৃষিজমির লুঠ রুখতে হবে। অকৃষিজনিত প্রকল্পে গ্রামসভার ন্যূনতম ৮০ শতাংশ মানুষের সম্মতি নেওয়া কঠোরভাবে মানতে হবে।

(৬) পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নথিভুক্ত করে প্রত্যেক পরিযায়ী শ্রমিকের কল্যাণ ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে।

(৭) লিজচাষি-ভাগচাষিদের সরকারি সহায়তা সুনিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারকে ফসলের দামের গ্যারান্টি আইন করতে হবে।

(৮) মাইক্রো ফিন্যান্স কোম্পানিগুলির জুলুমবাজি বন্ধ করে, সুদের হার নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে ‘রাজ্য আইন’ করতে হবে। ঋণমকুব করতে হবে।

(৯) বাস্তু সহ আবাস যোজনায় সকলের ঘর এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের বিনাপয়সায় ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ দিতে হবে। বকেয়া বিদ্যুৎ বিল মকুব করতে হবে।

(১০) প্রত্যেক ৬০ ঊর্ধ্ব মানুষের বার্ধক্য ভাতা সুনিশ্চিত করতে হবে।

(১১) রেশন মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে।

(১২) যবুদের কাজ চাই, শিশুদের শিক্ষা চাই, নারীদের নিরাপত্তা চাই।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন            
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি

institution-of-democratic-decentralizationdemocratic-decentralization

“এতদিন পঞ্চায়েতের উপর আমরা গুরুত্ব দিইনি। দু’মাস আগে আমরা পঞ্চায়েত ঘিরে মানুষের মতামত নিয়েছি।... নির্বাচনের পর আমরা তৃণমূল স্তরে দুর্নীতিকে নির্মূল করব।” কুচবিহারে নির্বাচনী এক জনসভায় এই কথাগুলো বললেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও জানালেন, এরপর থেকে তিনিই পঞ্চায়েতকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। নির্বাচনের পরই তিনি দুর্নীতিকে নির্মূল করার কথা বলছেন, শিকার করেছেন যে পঞ্চায়েতকে তাঁর সরকার এতদিন গুরুত্ব দেয়নি।বাস্তু ঘুঘুর বাসা হয়ে ওঠা পঞ্চায়েতকে দুর্নীতিমুক্ত করার যে কোনো তাড়নাই মুখ্যমন্ত্রীর ছিল না তা তাঁর বক্তব্যেই ধরা পড়ল।

২০২৩ হল সংবিধনের ৭৩তম ও ৭৪তম সংশোধনের ৩০তম বার্ষিকী। এই দু’টি সংশোধনী যথাক্রমে পঞ্চায়েতীরাজ ও পৌরসভাকে স্বশাষিত সংস্থা হিসাবে স্বীকৃতি ও আইনসিদ্ধ করেছে। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছরেও এই সংস্থাগুলোর ঘোষিত সাংবিধানিক লক্ষ্য তো অর্জনই করা যায়নি বরং তার অন্তর্নিহিত মর্মার্থকে ক্ষমতাসীন শাসক দল তিলে তিলে ধ্বংস করেছে। বাম জমানার ৩৪ বছর শাসনে যা চলেছিল, তৃণমূল জামানায় তার আরও গতিবৃদ্ধি হয়েছে। শাসক পার্টির খবরদারি, গ্রামীণ মোড়লতন্ত্র ও সরকারি আমলাতন্ত্রের সম্মিলিত আঁতাত হরণ করেছে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত এই স্বশাসিত সংস্থাগুলোর প্রাণশক্তি ও সজীবতা। নিচুতলার এই সমস্ত স্বশাসিত সংস্থাগুলোর দৈনন্দিন পরিচালনা, নজরদারি, নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করার বদলে আগামীদিনে মুখ্যমন্ত্রীই পঞ্চায়েতকে নিয়ন্ত্রণ করার চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বললেন। এটা পঞ্চায়েতের ক্ষমতাকে নিজের মুঠোয় কুক্ষিগত করে নেওয়ার নির্জলা অগণতান্ত্রিক হুঙ্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাজ্য সরকার যে সমস্ত ‘দান খয়রাতির’ প্রকল্প (যেমন, লক্ষীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী প্রভৃতি) চালু করেছে, তার প্রতিদান স্বরূপ তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার আবেদন মুখ্যমন্ত্রী রেখেছেন। এইভাবে, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যকার সম্পর্ককে নামিয়ে আনা হচ্ছে দাতা-গ্রহিতার সম্পর্কে। গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়ায় পঞ্চায়েতগুলোকে আরো ক্ষমতা প্রদান, এক একটা গ্রামের প্রয়োজন ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কী কী উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে, সেক্ষেত্রে গ্রামীণ মানুষের চাহিদা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিকে কেন্দ্রবিন্দুতে না রেখে একমেবাদ্বিতীয়ম এক নেত্রী সমস্ত মুশকিল আসানের যে প্রবঞ্চনাময় কথাবার্তা বলছেন, তার বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষ সমুচিত প্রত্যুত্তর দেবেন আসন্ন এই নির্বাচনে।

panchayat-system

দুর্নীতিগ্রস্ত পঞ্চায়েত কর্মকর্তাদের ‘গালে দু’টো চড়’ মারার যে দাওয়াই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান দিয়েছেন, তাও ডাহা এক ভাওতাবাজি। আগেও যে সমস্ত তৃণমূল নেতানেত্রী উন্নয়নী প্রকল্পের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কাটমানি নিয়েছিলেন, তা মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন তিনি অতীতে একবার করেছিলেন। তা ফেরত দেওয়া তো দূরে থাক, রাজ্যের মানুষ দেখলেন, মাথা থেকে পা পর্যন্ত রাজ্যের সমগ্র শিক্ষাদপ্তর দুর্নীতির এক প্রকান্ড প্রতিষ্ঠানে অধঃপতিত হয়েছে, যার জেরে প্রায় আস্ত শিক্ষা দপ্তরটি এখন জেলখানায়। রাজ্যের আপামর মানুষ দেখলেন, নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে তাবড় মন্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে দুর্নীতির বিশাল জাল কিভাবে ছড়িয়ে পাকাপোক্ত প্রণালীবদ্ধ ব্যবস্থাপনায় পরিণত হয়েছে। এতদিন ধরে এত বড় পরিসর জুড়ে যে এই কান্ডকারখানা চলে আসছিল তা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে থাকতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। এবারও দলের নেতা-বিধায়কদের একটা অংশ প্রকাশ্যেই জানালেন যে নেতৃত্বকে বিপুল টাকার বিনিময়ে পঞ্চায়েতের টিকিট কেনা হয়েছে।

এক বশংবদ নির্বাচন কমিশন, হাতের মুঠোয় থাকা পুলিশ প্রশাসনের দৌলতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে গিয়ে রাজ্য প্রশাসন এবার অতিসক্রিয় এক বিচারবিভাগের সম্মুখীন হল। বেশ কিছু অনিয়ম, বিরোধীদের ভোট প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাধাদানের নানা অপচেষ্টা সত্ত্বেও তৃণমূলের দাপট ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধের ঘটনা দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভরসায় নয়, ঐক্যবদ্ধতা ও নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার তাগিদই প্রতিক্রিয়ার দাপটের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারে প্রতিস্পর্দ্ধার নতুন অধ্যায়।

challenge-of-opposition-unityopposition-unity

আজ ভারতবর্ষে শাসনতন্ত্র কার্যনির্বাহী সংস্থার বিরামহীন আগ্রাসন দ্বারা চালিত হচ্ছে, যা এই আইন সভাকে আইন তৈরি করার এক বাধ্য হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বিচারবিভাগ কোনো সংশোধনমূলক পদক্ষেপের নির্দেশ দিলে তা কার্যনির্বাহী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে নিতান্ত তাচ্ছিল্যভরে খারিজ করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে কথিত সংবাদমাধ্যম কিন্তু আজ কারণ মিডিয়া আজ বেশ সাবলীলভাবে নিজেকে (সরকারের) এক সহযোগী হিসেবে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলেছে যার স্বেচ্ছা-দায়িত্ব হল সরকারি অ্যাজেন্ডার ওকালতি আর তার জাঁকালো প্রচার এবং ‘মহোত্তম’ নেতার বিজ্ঞাপনী মাধ্যম হিসেবে কাজ করা। ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা — যেগুলি ভারতে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের টিকে থাকার জন্য বিগত সাতটি দশক ধরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল — আজ তাকে আঘাতে আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে।

ক্ষমতার এই আগ্রাসী কেন্দ্রীকরণকে এগিয়ে নিয়ে নির্বাচনী মল্লভূমে এক বিরাট ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচিত ৫৪৩ সদস্যের সংসদে শাসক দল ও প্রধান বিরোধীদলের মধ্যে ব্যবধান ২৫০! রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে পরিস্থিতিতে তবু খানিকটা ভারসাম্য রয়েছে যেহেতু কয়েকটি নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছে বা তার কুর্সি দখল রুখে দেওয়া গেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে মোদী সরকার বারে বারে অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলোকে উল্টে দিয়েছে। আর যেখানে দল ত্যাগ ইত্যাদি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত না করতে পারছে, সেখানে নিরন্তর ক্ষিপ্ত প্রতিহিংসার লড়াই লড়ে যাচ্ছে এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সি বা রাজ্যপাল বা লেফটেন্যান্ট গভর্নর-এর অফিসের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। পূর্ণমাত্রার নির্বাচনী স্বৈরাচারের নেপথ্যে রয়েছে শাসকদল বিজেপি’র ৫০ বছর ধরে ‘রাজ’ করার আর বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কোণঠাসা করে একদলীয় কঠোর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার স্বপ্ন। সেই ভয়ঙ্কর দুর্বিপাক থেকে ভারতকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই চাই একটি ঐক্যবদ্ধ জেদী রাজনৈতিক বিরোধিতা।

১৯৭৭ পর্যন্ত কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে কংগ্রেস রাজত্ব করেছে। তিন দশক ব্যাপী দীর্ঘ কংগ্রেসী শাসনের শেষ কয়েকটি বছর দেশে জারি ছিল অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থার পরিস্থিতি। সাংবিধানিক গণতন্ত্র স্বৈরশাসনের বিপজ্জনক ফাঁদে রাহুগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। সেই রাহুমুক্তি ঘটলো ১৯৭৭-এর নির্বাচনে। দক্ষিণপন্থী আর মধ্য দক্ষিণপন্থী কয়েকটি দলের স্বল্প-স্থায়ী জোটের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জনতা দল কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসকে উৎখাত করে। ১৯৭৭ পরবর্তী পর্যায়ে ঘন ঘন সরকার পাল্টেছে। আর তখন থেকেই প্রভাবশালী এক-দলীয় শাসনের পরিবর্তে ক্রমশ মিলি-জুলি সরকারের যুগ ভারতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছিল। আরএসএস এই বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ধারাবাহিকভাবে কাজে লাগিয়ে তার প্রভাব ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক ক্রমশ বাড়িয়ে গেছে। ১৯৭৭এ জন সঙ্ঘ ভেঙে জনতা পার্টিতে মিশে যাওয়া এবং ১৯৮০র দশকে ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ নামে নব সজ্জায় তার আত্মপ্রকাশ, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি তার মূল অ্যাজেন্ডার সবচেয়ে বিতর্কিত কয়েকটি বিষয় সরিয়ে রাখা থেকে পর পর দু’টি লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর তার হিন্দুরাষ্ট্রের গোটা প্রকল্প প্রকাশ্যে বলবৎ করা – এই গোটা প্রক্রিয়ায় সঙ্ঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান শক্তি বাড়ানোর জন্য একদিকে যেমন সামাজিক আলোড়ন অন্যদিকে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের সব রাজনৈতিক পন্থাগুলিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়েছে।

তবে বিজেপি’র একতরফা রাজনৈতিক আধিপত্য শুধু যে এক স্বৈরাচারী শাসকের হাতে ক্ষমতার লাগামছাড়া কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়েছে, তা নয়। সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী তার নির্বাচনী জয়গুলিকে ভারতকে যেমন রাষ্ট্রগতভাবে তেমনই ভারতীয় সমাজকেও, নতুন করে ঢেলে সাজানোর লাইসেন্স হিসাবে ব্যবহার করে চলেছে। আর সেই কাজটা চলছে আরএসএস-এর বিশ্ববীক্ষা এবং হিন্দুত্বের বা হিন্দু আধিপত্যকামী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কাঠামো অনুযায়ী। আজ মোদী সরকার ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের জন্য যতটা চিহ্নিত ততটাই দায়ী হিংসার বিকেন্দ্রীকরণ অর্থাৎ দেশ জুড়ে হিংসাকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং বিদ্বেষমূলক অপরাধকে সমাজে জলভাত করে তোলার জন্য। বেলাগাম কর্পোরেট লুঠ, চরম রাষ্ট্রীয় উৎপীড়ন এবং তার সঙ্গতকারী নজরদারি সন্ত্রাস ভারতকে একটি ভয়ের প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছে যেখানে নাগরিকরা ক্রমশ এক নজরদার রাষ্ট্রে শৃঙ্খলিত সমাজের ভীত-সন্ত্রস্ত অধিবাসীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে সব সময় প্রতিহিংসামূলক আচরণ চলছে। মতাদর্শগতভাবে যারা বিরোধী তাদের লাগাতার নির্যাতন হেনস্থা কারাবাস অথবা ডাইনী-খোঁজের শিকার হতে হচ্ছে। দলিত, আদিবাসী মহিলা এবং নিপীড়িত দরিদ্র মানুষের ওপর নির্যাতন বেড়েই চলেছে। আর সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিমদের বিদ্বেষমূলক প্রচার, বহিষ্কার, এমনকি সরাসরি গণহত্যার হিংস্রতার নিশানা করা হচ্ছে। রাজনীতি যখন হয়ে ওঠে ক্ষমতার এক ঘৃণাবর্ষী অনুশীলনের হাতিয়ার, যে ক্ষমতায় মানুষের কল্যাণ চিন্তার লেশমাত্রও নেই, দেশ তখন এক সর্বগ্রাসী নৈরাজ্যের কবলগ্রস্ত হতে বাধ্য। মণিপুরে আজ যা ঘটছে তা আগামীকালের গোটা ভারতের জন্য এক সতর্ক বার্তা।

স্পষ্টতই, ভারতের গতিপথের সংশোধন অত্যন্ত জরুরি। সংবিধানে ঘোষিত সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে ভারতের স্বপ্ন, একশো কোটির বেশি মানুষের জন্য অধিকারের সনদসহ ব্যবহারিক গণতন্ত্র এবং সমস্ত নাগরিকের স্বাধীনতা, বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা ও মিশ্র সংস্কৃতির সামাজিক বুনোট এবং রাজ্যগুলির একটি ইউনিয়ন হিসাবে ভারতকে পরিচালনার জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো — কোনকিছুকে আর ‘নিশ্চিত’ হিসেবে ধরে নেওয়া চলবে না। আধুনিক ভারতের সাংবিধানিক অভিযাত্রা যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, যা আমরা উপলব্ধি করে এসেছি পঁচাত্তর বছর আগে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে — আজ তাকে বিপথগামী করার হুমকি নিয়ে সামনে হাজির ফ্যাসিবাদী হিন্দু আধিপত্যকামী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের এক বিকল্প গতিপথ।

আমাদের তাই আজ ভারতবর্ষের মানুষের জন্য চাই নতুন সামাজিক চুক্তি, নতুন ব্যবস্থা। এটা শুধু মোদী সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমে উৎখাত করলেই অর্জিত হবে না। ভারতকে অবশ্যই শাসনের প্রচলিত নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। এসব নীতি ও পদ্ধতির অনেকগুলি আবার মোদী সরকারের আগের আমলের, যার মধ্যে ইউপিএ-ও আছে। কর্পোরেট-মুখী অর্থনৈতিক ছাড়/অনুমোদন এবং বেসরকারিকরণ, আধার এবং জিএসটি অথবা ইউএপিএ এবং ‘ফেক এনকাউন্টার’ — মোদী-আমলের এইসব বিপর্যয় ও হামলার সূত্রপাত হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে অ-বিজেপি সরকারের আমলে।

বিরোধীদলগুলির বহু প্রতীক্ষিত প্রথম বৈঠককে এক দীর্ঘ চাহিদা তালিকায় ভারাক্রান্ত করাটা এক অর্বাচীন ভাবনা। বৈঠক যে হচ্ছে এটাকেই একটা ইতিবাচক সূচনা হিসেবে দেখা উচিত। ঘটনাক্রমে, চার মাস আগে, পাটনায় সিপিআই(এমএল)-এর ১১তম কংগ্রেস উপলক্ষে গত ১৮ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ‘গণতন্ত্র বাঁচাও, ভারত বাঁচাও’ কনভেনশনে এই রকম একটি বৈঠকের কথা জোরের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছিল। অ-বিজেপি রাজনৈতিক দলগুলোর এক ব্যাপক-ভিত্তিক বৈঠক হচ্ছে, নিজের শক্তিতে বেড়ে ওঠা ও টিঁকে থাকা এবং বিশ্বাসযোগ্য এক বিকল্প গড়ে ওঠার প্রথম ধাপ। এই বিকল্পকে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের পর পর দু’বারের শাসনে চাপিয়ে দেওয়া বিপর্যয় থেকে ভারতকে উদ্ধার করতে হবে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দ ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সুবিস্তৃত পরিসরের দলগুলোর এক প্রত্যয় জাগানো সমন্বয়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এর মধ্যে আছে কংগ্রেস ও তার শাখা প্রশাখা, সমাজবাদী ধারার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দল, পুরোনো লোক দল ও জনতা দলের শাখা-প্রশাখা সহ সামাজিক ন্যায়ের শিবির, বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি, কয়েকটি আঞ্চলিক দল এবং আম আদমি পার্টি, একটি স্বীকৃত জাতীয় দলের মর্যাদা অর্জনে সর্বশেষ সংযোজন। এই ধরনের একটি কোয়ালিশন কি টিঁকে থাকতে পারবে? বর্তমানে একই ধরনের কোয়ালিশন তামিল নাড়ু ও বিহারে সক্রিয়। আর আমাদের ভুললে চলবে না, ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ইউপিএ দু’টি পূর্ণ মেয়াদ বহালতবিয়তে কাটিয়ে ফেলেছিল। সুতরাং এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, মোদী সরকার যে জটিল বিপন্নতার জলাভূমিতে দেশটাকে ডুবিয়ে দিয়েছে, সেই পাঁক থেকে টেনে বার করে আনার জন্য এক স্থিতিশীল মতৈক্য গড়ে উঠতেই পারে, এক সমঝোতার পরিস্থিতি উদ্ভূত হতেই পারে।

এই মুহূর্তে, বিরোধী ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আছে এমন কিছু দল যাদের পরস্পরের মধ্যে অনেক বৈসাদৃশ্য আছে। আবার অনেকে একই রণাঙ্গণে পরস্পরের প্রতিযোগী। প্রতিযোগিতা থেকে সহযোগিতায় রূপান্তর —চাইলে একে সহযোগিতামূলক বিতর্ক বলতে পারেন — অবশ্যই একটি অনুকূল পরিবেশ এবং সক্ষম কাঠামো গড়ে ওঠা ও উদ্ভূত হওয়ার লক্ষ্যে কিছু উদ্যোগ নিতে চলেছে। একটি যুক্তিসঙ্গত ও পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য আসন-ভাগাভাগির ব্যবস্থায় কিছু ঝামেলা-ভাগাভাগির ব্যাপারও থাকে। কিন্তু ভারত বর্তমানে যে অভূতপূর্ব এবং অসাধারণ রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের মুখোমুখি তা ঐক্যকে আবশ্যিক ও বাধ্যতামূলক করে তুলেছে।

বহুদিক থেকেই এটা ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। ১৯৪৭-পূর্ব স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক রূপান্তরের আন্দোলনের কতগুলি প্রবাহ ও বৈচিত্র্য ছিল যেগুলি শেষপর্যন্ত এসে এক বিন্দুতে মিলেছিল এবং পরস্পরের সহযোগী হয়েছিল। এই টানাপোড়েনের, চড়াই-উতরাইয়ের ইতিহাস থেকেই বেরিয়ে এসেছে আমাদের সংবিধান। আর আম্বেদকরের সুদূরদর্শী ভবিষ্যৎ দৃষ্টি আমাদের সেই সব সংঘাত ও চ্যুতিরেখা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল, গণতন্ত্রকে সক্রিয় ও অর্থবহ করে তোলার জন্য ভারতকে যা অতিক্রম করতে হবে। আজ সাংবিধানিক দৃষ্টি এবং আধুনিক ভারতের বুনিয়াদ ভয়ঙ্করতম এক হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে। কয়েকবছর ব্যাপী এই ফ্যাসিবাদী হামলার পর গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার ও নব তেজে দীপ্তিমান করে তোলার জন্য আজ ভগৎ সিং, আম্বেদকর, পেরিয়ার, গান্ধী এবং নেহেরুর উত্তরাধিকারকে একসঙ্গে আত্মস্থ করে নিতে হবে আমাদের।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার ছাড়াও, সংসদীয় গণতন্ত্রের সাতটি দশক ‘আমরা, ভারতের জনগণ’কে বহুল পরিমাণে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছে। এই সাতটি দশকের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে নতুন নতুন বিভিন্ন দল, যেগুলোর অনেক ক'টির শিকড় আবার সামাজিক, আঞ্চলিক এবং জাতিসত্তাগত পরিচিতির মধ্য প্রোথিত। এই পার্টিগুলিকে বিচ্ছিন্ন এবং বিসদৃশ গঠনের হিসাবে দেখার পরিবর্তে আমাদের জরুরি দরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক পরিসরকে সামনে তুলে ধরা যেখানে সব দলগুলিরই অংশগ্রহণ থাকবে। অসাধারণ পরিস্থিতি অসাধারণ প্রতিক্রিয়া দাবি করে — আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের সত্যিই প্রয়োজন সব বিরোধীশক্তির একসঙ্গে কর্মসূচি নির্ধারণ করে সর্বোত্তম উদ্যোগে সামনে এগিয়ে যাওয়া। মানুষের মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে তাদের অধিকার, তাদের নিশ্চিত জীবিকা, তাদের মুক্তি ও ন্যায়ের তালাশ, স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে সেই খোঁজ। বিরোধী ঐক্যের প্রক্রিয়াকে প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হতে হলে যেতে হবে তৃণমূলস্তরের সেই সব মানুষের কাছে, তাদের লড়াই আর তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে তুলতে হবে। রক্ত-ঘামের উষ্ণতাভরা বন্ধন!

এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২০ জুন, ২০২৩

meeting-of-gun-and-shell-factory-workersfactory-workers-union

প্রত্যেক বছরের ন্যায় এবছরেও ২৪ জুন ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ধিক্কার দিবসের ডাক দেয়। এবং ২৩ জুন বিবি বাজার মোড়ে ধিক্কার সভার আয়োজন করে। এই সভায় যেমন গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরির প্রত্যেকটি ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন, তেমনি এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সভাপতি ও এনপিডিইএফ-র সাংগঠনিক সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী এবং ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলনের নেতা সুজিত ঘোষও উপস্থিত ছিলেন।

গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরিতে ২০১৭ সালের ২৪ জুন শ্রমিকদের উপর এক ভয়ংকর হামলা নেমেছিল। শ্রমিকদের উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা কর্তৃপক্ষের আমলাতান্ত্রিক, অশালীন আচরণ, আর্থিক অবিচার সহ্য করতে না পারা কারখানার সমস্ত শ্রমিকদের সতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভকে সে সময়ের জেনারেল ম্যানেজার বরদাস্ত করেনি। কারণ তার কাছে এটা ছিল ‘অশনি সংকেত’। “রুল ১০এ”-র মাধ্যমে ৮ জন শ্রমিককে, যার মধ্যে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রথম সারির ৩ জন নেতা ছিলেন, অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড করা হয় এবং আরও ১৭ জন শ্রমিকের উপর একাধিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রতি বছর ২৪ জুন “ধিক্কার দিবস” পালন করার শিকড় রয়েছে অতিতের এই ঘটনায়।

এই ধিক্কার সভায় গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ও অঙ্গীকার বেরিয়ে এসেছে তা হল —

১) যে “রুল ১০এ” প্রয়োগের সময় কোনো কারণ দর্শানোর প্রয়োজন হয় না, এক কলমের খোঁচায় সরকারি কর্মচারীকে সাসপেন্ড করা যায়, তা শ্রমিক কর্মচারীরা মেনে নিতে পারে না। তাই “রুল ১০এ” সরকারকে বাতিল করতে হবে।

২) অতিতের ঐ ভয়ংকর হামলা রোখা যায়নি, কারণ শ্রমিকদের মধ্যে সার্বিক ঐক্য গড়ে তোলা যায়নি। এর জন্য সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ হতে হতো।

৩) আজকের পরিস্থিতিতে আবারও কর্তৃপক্ষের আস্ফালন বাড়ছে, এমতাবস্থায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনকে গণতান্ত্রিক করার লক্ষ্যে কারখানার সমস্ত ইউনিয়নেকে এক হয়ে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে পিস্তল সেকশনের “শোকজ” প্রাপ্ত শ্রমিকদের সপক্ষে সব ইউনিয়নের এক সাথে দাঁড়ানোর সাম্প্রতিক উদ্দ্যোগকে এই সভা স্বাগত জানাচ্ছে।

৪) প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্পোরেশন বিরোধী ধর্মঘট লড়াইয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমস্ত ইউনিয়নগুলো এবং সাধারণ শ্রমিকরা রুখে দাঁড়িয়ে ছিল, একইভাবে অপশন ফর্মে প্রত্যেকটি শ্রমিক কর্মচারীকে সরকারি ক্ষেত্রে থেকে যাওয়ার সম্মিলিত ইচ্ছা ব্যক্ত করতে হবে। এই ধিক্কার সভা এবিষয়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকার দিক নির্দেশ করছে।

৫) এনপিএস বাতিল করে সমস্ত কর্মচারীদের ওপিএস-এর আওতায় আনাতে হবে। এই দাবি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরাসরি কর্মচারীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয় উঠেছে। কিছু জনপ্রিয় আন্দোলন ও গড়ে উঠেছে। কাশীপুরে নতুন প্রজন্মের কর্মচারীদের এই আন্দোলনে যুক্ত করার কর্তব্যটিও এই সভা স্বীকার করছে।

৬) “ইডিএসএ” কার্যত প্রতিরক্ষা কর্মীদের অধিকারহীন করে রেখেছে। ধিক্কার সভা এই আইন প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে। ধিক্কার সভা খুবই প্রাণবন্ত ছিল এবং শ্রমিক কর্মচারীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

aialaj-aisa

২৬ জুন গড়িয়া মোড়ে অল ইন্ডিয়া লইয়ার্স এসোসিয়েশন ফর জাস্টিস, উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া, পিইউসিএল, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ, গণফ্রন্ট এবং অরিজিৎ মিত্র স্মারক কমিটি-র পক্ষ থেকে "অঘোষিত জরুরি অবস্থার অবসান হোক’ — শীর্ষক অবস্থান ও সভা হয়।

culture-council

গত ২৫ জুন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য কাউন্সিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয় আগাড়পাড়া জেলা অফিসে। মোট ৩৮ জন কাউন্সিল সদস্য সভায় উপস্থিত হয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত রাখেন। মূলত উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলি, কলকাতা, পশ্চিম বর্ধমান, নদীয়া থেকে প্রতিনিধিরা আসেন। কেন্দ্রীয় ও শাখা সংগঠনগুলির কাজের রিপোর্ট ও আগামী কর্মসূচি সম্পর্কে কিছু ভাবনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচিত হয়। সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে এই সভার কাজের মধ্যে দিয়েই কয়েক মাস পরে রাজ্য সম্মেলনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা সুনির্দিষ্ট করার আবেদন রাখা হয়। যেমন, সংগঠনগুলোকে গুছিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে নতুন সদস্যদের সামিল করা, নতুন শাখা গঠনের সম্ভাবনা, ঘরের সাথে পথে নেমে কাজ করা, গ্রামে যাওয়া, দু’টি পত্রিকা বিষয়ে আলোচনা ইত্যাদি। কার্যকরী কমিটির সদস্য বাদে সকলকেই বলার পরিসর দেওয়া হয়। আর তারফলে অনেক ভালো ভালো প্রস্তাবে সভা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। যেমন, ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি নিয়ে ওয়ার্কশপ, সমস্যার মুখে শাখা সংগঠনগুলিকে রাজ্যের তরফে দেখভাল করা, নতুন প্রজন্মের উপর বিশেষ নজর দেওয়া, গান ইত্যাদি প্রয়োগ সংস্কৃতির মানোন্নয়ন, যৌথ কাজ, আম্বেদকার নিয়ে ক্রোড়পত্র, বুকলেট করা, অঞ্চল ধরে কাজ করা ইত্যাদি। এভাবে ২০ জন মতামত দেন। দ্বিপ্রহারিক আহারের পর দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় নির্দিষ্ট হয় — আগামী পঞ্চায়েত নির্বচনে পরিষদ বামগণতান্তিক শক্তির পক্ষে প্রচারে নামবে, গণসংস্কৃতি পত্রিকার সম্পাদক হলেন অনুপ মজুমদার। এর সাথে তিনি ও শোভনা নাথ এলাকায় গণসংস্কৃতি পৌঁছে দেওয়া ও মূল্য তুলে আনার দায়িত্বে থাকবেন। নাটকের সেন্ট্রাল টিম এখনই না করতে পারলেও যারা উৎসাহিত তারা দু’তিন জন মিলে ছোটো নাটক করতে পারেন। ‘সংযোগ কলকাতা’ একটি নাটক তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে। আম্বেদকার নিয়ে বুকলেট হবে — দায়িত্বে অসিত রায়, শায়ন বিশ্বাস ও বর্ণালী রায়। অনেক সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু পরিষদ তার মতামত স্পষ্ট জানাচ্ছে না। সেটা এবার করতে হবে। রাজ্য সম্পাদক এটা দেখবেন। প্রতিমাসে ঘরে একটি ও রাস্তায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। একটি সেন্ট্রাল ফাণ্ড তৈরি করতে শাখা ও ব্যক্তিরা প্রতি মাসে সামান্য হলেও কিছু টাকা দিতে দায়বদ্ধ থাকবেন। অশোকনগর, ঠাকুরনগর, অগ্নিবীণা, থিয়েটার লিবার্টি — এদের সাথে রাজ্য প্রতিনিধিরা বসবেন। সব শেষে আত্মসমীক্ষার কথা হয়। সংকীর্ণতা কাটিয়ে, ব্যক্তির ঊর্ধ্বে উঠে, বৃহত্তর স্বার্থে কাজে সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে।

recruitment-wages-and-allowancesgovernment-projects

ভারতের নানা রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও কৃষিক্ষেত্রে এখন ব্যাপক সঙ্কট। আর এই সঙ্কটের মুখে গ্রামীণ অকৃষি কর্মকাণ্ডর গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। এই কর্মকাণ্ডর একটা বেসরকারী উদ্যোগের দিক আছে — যেমন নির্মাণ শিল্প, যেখানে গ্রামীণ শ্রমিকরা পরিযায়ী হয়ে শহর, শহরতলী বা দূরের মহানগরে কাজ করতে চলে যান। আছে গ্রামের মধ্যেই বা কাছাকাছি গড়ে ওঠা বিড়ি শিল্প, জড়ি শিল্প, ভেড়ী, পোলট্রি, ডেয়ারী, ইঁটভাটা, বিভিন্ন রকম খাদান বা ছোট মাঝারী শিল্প উদ্যোগ — যেমন আলমারি, রঙ, গ্রীল কারখানা ইত্যাদি। গ্রামীণ অকৃষি কাজের এই প্রধান ক্ষেত্রটির পর্যালোচনা পরবর্তী একটি লেখায় আলাদাভাবে করার আগে আমরা এই লেখায় দেখে নিতে চাই সরকারী উদ্যোগ পোষিত গ্রামীণ অকৃষি ক্ষেত্রের চেহারাটা।

সরকার পোষিত গ্রামীণ অকৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে প্রধান হল আশা প্রকল্প, মিড-ডে-মিল প্রকল্প, অঙ্গনওয়ারী প্রকল্প, সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্প, এনআরইজিএ প্রকল্প প্রভৃতি।

ভারত সরকারের পরিবার ও স্বাস্থ্যকল্যাণ দপ্তরের উদ্যোগে ২০০৫ সাল থেকে ভারতের গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে মহিলাদের নিয়োগ করা শুরু হয়। আশা কর্মী নামে পরিচিত এই মহিলাদের কাজ হল এলাকায় স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা। জননী যেন হাসপাতালে প্রসব করেন সেটা দেখা, নবজাতক ও নবজাতিকার টীকাকরণ যেন সঠিক ও নিয়মিত হয় সেদিকে লক্ষ রাখা, পরিবার পরিকল্পনায় উৎসাহ দেওয়া, সাধারণ অসুখ ও আঘাতে প্রাথমিক চিকিৎসা করা, গ্রামীণ পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর রাখা, জন্ম মৃত্যুর হিসেব রাখার মতো নানাবিধ কাজ আশা কর্মীদের করতে হয়।

আশা কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই বঞ্চনার শিকার। একসময় তাঁদের মাসিক ভাতা ছিল না। কাজভিত্তিক কিছু ভাতা ছিল। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে অবশ্য সামান্য মাসিক ভাতা এখন চালু হয়েছে।

বর্তমানে আশা কর্মীদের প্রাপ্তি এরকম বলে সরকারী ঘোষণা জানিয়েছে,

  • আশা কর্মীরা মাসিক বেতন স্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে ৪৫০০ টাকা পাবেন। মাসিক বেতন ছাড়াও তারা আরো কিছু অতিরিক্ত ভাতা পাবেন।

  • সরকারি হাসপাতালে গর্ভবতী মহিলার সন্তান প্রসব, প্রতি সন্তান ৩০০ টাকা।

  • পালস পোলিও প্রোগ্রাম, দৈনিক ৭৫ টাকা।

  • মিসেলস্ রুবেলা ভ্যাকসিন-১, (১ বছর বয়সী শিশু) ১০০ টাকা।

  • মিসেলস্ রুবেলা ভ্যাকসিন-২,‌ (২ বা তার কম বছরের বয়সী শিশু) ৭৫ টাকা।

  • ডিপিটি ভ্যাকসিন, (১.৫ বছর বয়সী শিশু) ৭৫ টাকা।

  • ডিপিটি ভ্যাকসিন, (৫ বছর বয়সী শিশু) ৫০ টাকা।

  • যক্ষা রোগাক্রান্ত রোগীদের ওষুধ ডেলিভারি, প্রতি রোগী পিছু ১০০০ টাকা।

  • সার্ভে সংক্রান্ত কাজ, ৩০০ টাকা।

এছাড়াও বলা হয়েছে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য তারা এবার থেকে ২০০ টাকা করে উৎসাহ ভাতা পাবেন।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধীকরণে সহায়তার জন্য তাদেরকে সপ্তাহে একদিন করে উপস্থিতির জন্য ৬০ টাকা করে দেওয়া হবে।

শিশুদের টিকাকরণের তালিকা তৈরি ও আপডেট করার জন্য তাদের একই পরিমাণে উৎসাহ ভাতা দেওয়া হবে।

গর্ভবতী মহিলাদের তালিকা তৈরি ও আপডেট করার কাজের জন্যও সপ্তাহে একদিন তারা ৬০ টাকা করে উৎসাহ ভাতা পাবেন।

নির্দিষ্ট দিন সরকারি ছুটি থাকলে অন্যদিন ওই একই কাজের জন্য আশা কর্মীরা একই হারে ভাতা পাবেন।

জননী সুরক্ষা যোজনায় গর্ভবতী মহিলাদের নাম নথিভুক্ত করা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আশা কর্মীদের ১০০ টাকা করে উৎসাহ ভাতা দেওয়া হবে।

ওই প্রকল্পে নথিভূক্ত গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভকালীন পরিষেবা দেওয়ার জন্য মহিলা পিছু আশা কর্মীরা ২০০ টাকা করে উৎসাহ ভাতা পাবেন।

ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী মহিলাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে সহায়তা করার জন্য তাদের মহিলা পিছু ৩০০ টাকা করে উৎসাহ ভাতা দেওয়া হবে।

এই ধরনের ঘটনায় শিশু জন্মের ৪৫ দিন পর্যন্ত প্রসূতি মা ও নবজাতক সুস্থ থাকলে আশা কর্মীদের ৫০০ টাকা করে উৎসাহ ভাতা দেওয়া হবে।

এছাড়া জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি, ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রমক রোগ নির্ণয় প্রকল্পে সহায়তা, ক্যান্সার ডায়াবেটিস কার্ডিওভাসকুলার রোগের নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে কাজ করার জন্য তারা বর্ধিত হারে উৎসাহ বাধা পাবেন বলে স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে জানানো হয়।

আশাকর্মীদের নিয়ে তৈরি সংগঠনগুলি বারেবারে জানিয়েছে যে মাসিকভাতা ও উৎসাহভাতা বাড়ানো দরকার। এই সামান্য আয়ে এই মূল্যবৃদ্ধির দিনে সংসার কিছুতেই চালানো সম্ভব নয়। তাঁরা এও জানিয়েছেন যে ভাতাগুলি পাওয়া নিয়ে তাদের মাঝে মধ্যেই নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়াও আশা কর্মীদের প্রায়শই হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নানারকম দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়। দীর্ঘ সময় হাসপাতালে অপেক্ষা করতে হলেও ন্যূনতম কোনও ঘর মহিলা আশা কর্মীদের জোটে না। এই সব সমস্যার প্রশ্নেও দ্রুত সুরাহার দাবি তাদের দিক থেকে রয়েছে।

প্রাক প্রাথমিক শিশুদের শিক্ষার জন্য নিযুক্ত রয়েছেন অঙ্গনওয়ারি কর্মীরা। সম্প্রতি অঙ্গনওয়ারি শিক্ষিকা আর সহায়িকাদের বেতনও কিছু বেড়েছে, যদিও তা দাবির তুলনায় বেশ কম। তবে স্থায়ীকরণের মূল দাবিটি নিয়ে সরকারের তরফে কোনও হেলদোল নেই। কিন্তু মূলত ছোট শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা যে অঙ্গনওয়ারি মাধ্যমে, সেখানে বেশিরভাগ জায়গাতেই নেই উপযুক্ত কোনও আস্তানা। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা চলে গাছের নিচে বা এমনকি গোয়াল ঘরেও। এই সমস্যা থেকে মুক্তির দাবিটি দীর্ঘদিন চালু হওয়া এই প্রকল্পটিতে এখনো প্রবল উপেক্ষিত।

শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে মিড-ডে-মিল প্রকল্প চালু হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন এবং ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টির প্রশ্নে এই ধরণের একটি প্রকল্পের উপযোগিতা শিক্ষামহলে সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় এই প্রকল্পটি চলছে রন্ধনকর্মীদের চূড়ান্ত শোষণের বিনিময়েই। রবিবার ব্যতীত সপ্তাহে ছ’দিন তারা সকালবেলা হাজির হন বিদ্যালয়ে, অনেক জায়গাতেই বাজার করার সময়সাপেক্ষ কাজ সেরে। তারপর সারাদিন চলে রান্না, পরিবেশন, বাসনপত্র থেকে খাবার জায়গা সাফসুতরো করার কাজ। বিকেলের দিকেই অবসর মেলে বাড়ি ফেরার। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর মাসিক বেতন মাত্র দেড় হাজার টাকা, যা যেকোন মানদণ্ডেই চূড়ান্ত শোষণের নিদর্শন। এরপরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা শাসক দল ক্ষমতার দাপটকে কাজে লাগিয়ে আবার অনেক জায়গায় বেশি রন্ধনকর্মী ঢুকিয়ে দেন প্রকল্পে, আসা টাকা ভাগ হয়ে যায়, মাত্র দেড় হাজার টাকাও রন্ধনকর্মীরা পান না। ইদানিং নয়া বিধি অনুসারে তারা বারো মাসের মাইনেও পাচ্ছেন না, মিলছে দশ মাসের। যদিও পুজোর ছুটি বা গরমের ছুটি একমাসের বেশ কমই থাকে, কিন্তু একমাসের বেতনটুকু কেটে রাখা হয়। ভাতা বৃদ্ধির অতি জরুরি দাবির পাশাপাশি বোনাসের সঙ্গত দাবিও রন্ধনকর্মীরা রেখেছেন সরকারের কাছে।

গ্রামীণ শ্রমজীবী জনগণের একটা বড় অংশ সরকারি প্রকল্পে কর্মরত মহিলারা। শ্রমিক আন্দোলন ও মহিলা আন্দোলনের সৃজনশীল সমাহারের মধ্য দিয়ে এই কর্মীদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করা আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ কাজ। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি তাদের অসংগঠিত শ্রমিকের সাধারণ আন্দোলনের অংশ করে তোলাও অগ্রণী রাজনৈতিক কর্মীর দায়িত্ব। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ রাজনীতিতে তাদের কী মাত্রায় সক্রিয় করে তোলা যাচ্ছে, তা গ্রামীণ রাজনীতির অন্যতম নির্ণায়ক সূত্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনায় উজ্জ্বল।

শহরের পাশাপাশি গ্রামের প্রাথমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে কর্মরত পার্শ্বশিক্ষকদের বড় রকমের বাহিনীটি আজ বিক্ষুব্ধ। অনেক বছর হল তাদের সামান্য দক্ষিণা/বেতন স্থবির। নেই ডিএ, বা অসুস্থতা জনিত চিকিৎসার কোনও ভাতা। নিয়মিত শিক্ষকদের মতো সব কাজ সামলানোর পর তাদের বরাতে জোটে বিডিও অপিস থেকে আসা জনগণনা সহ হাজারো কাজ, যার চাপে তাদের একদিকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরেকদিকে বিডিও প্রভৃতি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষর জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়। শিক্ষক হয়েও তাদের ঠিকা-কর্মীর চরিত্রটা বেশ স্পষ্ট। শিক্ষক হিসেবে তাদের মর্যাদার আন্দোলন চলছে ঠিকাকর্মীর বাস্তব অবস্থানে দাঁড়িয়েই। তাদের সঙ্গবদ্ধ করে নিজস্ব দাবিভিত্তিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাধারণভাবে সরকারি প্রকল্পে ঠিকাকর্মীদের সংযুক্ত আন্দোলনে তাদের সামিল করানো ও স্বাভাবিক শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে তাদের আগ্রহী অংশটিকে অগ্রণী সংগঠক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা জরুরি। বিহার ঝাড়খণ্ড সহ যেসমস্ত জায়গায় এই কাজে বেশ কিছু সাফল্য পাওয়া গিয়েছে, তার থেকে পশ্চিমবঙ্গেও এ’বিষয়ে আমরা বেশ কিছু শিক্ষা ও প্রেরণা নিতে পারি।

ভারতে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পটি বৃহৎ সামাজিক প্রকল্প হিসেবে ব্যাপকভাবে চর্চিত। কিন্তু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে তার বাস্তব রূপায়ণে ফারাক আসমান জমিন। নামে একশো দিনের প্রকল্প হলেও বাস্তবে কাজ মেলে কুড়ি পঁচিশ দিন। কোথাও বা আরেকটু বেশি। ফলে বছরে ষাট দিন মতো ক্ষেতমজুরের কাজ পাওয়া গ্রামীণ মেহনতি মানুষের বার্ষিক দিন গুজরানের ক্ষেত্রে এই প্রকল্প বাড়তি সুবিধা সামান্যই দেয়। দিন পঁচিশের বেশি কাজ পাওয়া সম্ভব হয় না, পাশাপাশি এ’নিয়ে দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক। কাজ না দিতে পারলে ভাতা দেবার যে নিয়ম আছে, সেটা প্রায় মানাই হয় না। কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মুরুব্বিয়ানা ভালোরকম সক্রিয় থাকে। যতজন কাজ করে, তার চেয়ে বেশি লোকের নাম মাস্টার রোলে দেখিয়ে গ্রামীণ মুরুব্বি সরকারি কর্তাব্যক্তিদের গাঁটছাড়া অতিরিক্ত টাকার ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেয়। খাতায় কলমে কর্মসংস্থান আর বাস্তবের হিসেবে তৈরি হয় ব্যাপক গরমিল। এই গরমিলের অভিযোগ এনেই কেন্দ্রের সরকার এই বাবদ রাজ্যের মজুরি বাবদ টাকা আটকে রেখেছে। কারোর বা দশ হাজার, কারোর আবার পঁচিশ তিরিশ হাজার। কাজ করেও মজুরি না পাবার বিরুদ্ধে আমরা আওয়াজ তুলেছি, “কেন্দ্র রাজ্য বুঝি না। কাজ করেছি মজুরি দিতে হবে।” দুর্নীতি হয়ে থাকলে তার তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেওয়া হোক, কিন্তু গ্রামীণ গরিব মানুষের হকের টাকা আটকানো চরম অবিচার।

সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পর দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ রাজনীতিতে একটি বিশেষ রাজনৈতিক মাত্রাও সংযুক্ত হয়েছে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সম্পন্ন হলেও উল্লিখিত প্রকল্পগুলি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প হওয়ায় এ’নিয়ে সামগ্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর একটা আদল গ্রামীণ জনগণের কাছে স্পষ্ট করার সুযোগ ও প্রয়োজনিয়তা আছে। সরকারি আধিকারিক ও কর্তাব্যক্তিরা বহুক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যবস্থা ও ব্যাপক দুর্নীতির মদতদাতা ও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। গ্রামীণ মুরুব্বি, পঞ্চায়েতের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে মিলিতভাবে সমস্ত প্রকল্পগুলি তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। শুধু পঞ্চায়েত কাঠামোর মধ্যে থাকা ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতি বা নির্দিষ্ট পঞ্চায়েত বোর্ডের দুর্নীতির বাইরে গোটা সামাজিক রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অকর্মণ্যতা ও দুর্নীতিপরায়ণ ছবিটি স্পষ্ট করে তোলা একটি জরুরি রাজনৈতিক কাজ। গোটা ব্যবস্থার পচন আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার দিকটিও গ্রামীণ জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। এর চলমান প্রয়াস গ্রামীণ রাজনীতিকে অর্থনীতিবাদের ওপরে স্থাপন করতেও নিশ্চিতভাবে সাহায্য করবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে এই সমস্ত প্রচারের মঞ্চ করে তুলতে হবে আমাদের।

- সৌভিক ঘোষাল

in-the-hands-of-humanoid-robotshumanoid-robots

ভবিষ্যতের অর্থনীতি ও প্রযুক্তির রূপরেখা কেমন হতে চলেছে, তা নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ একটি প্রতিবেদন ‘ফিউচার অফ জব রিপোর্টস্ ২০২৩’ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, যে দু’টি প্রধান ক্ষেত্রে বিস্তৃতি ও প্রসার হতে পারে বলে অনুমান তা হল — মনুষ্যরূপী রোবট (humanoid robot) ও অমনুষ্যরূপী রোবট (non-humanoid robot)। অর্থাৎ, আগামীদিনে উৎপাদনের পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত রোবট।

অনেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগকে শুধুমাত্র পরিষেবা অথবা তথ্যের আদানপ্রদানের পরিপূরক বলে মনে করেন। তাঁরা ভুলে যান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল এমন এক স্বয়ংচালিত প্রোগ্রাম বিশেষ যা যেকোনো কার্যাবলীতেই প্রয়োগ হতে পারে। এমনকি কৃষিতেও। আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এমন সব ট্রাক্টর ও যন্ত্রানুষঙ্গ এসে পড়েছে, যা কোনও মনুষ্যশ্রম ব্যতিরেকেই জমিকে উপযুক্তভাবে পড়ে নিয়ে যথাযথভাবে তার পরিচর্যা সেরে সেখানে ফসলের বীজ রোপণ থেকে তার যত্নআত্তি অবধি সমস্ত কাজের দায়ভার গ্রহণ করতে সক্ষম। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পেও উৎপাদনের যে কাজগুলি যন্ত্র সহযোগে শ্রমিক দ্বারা এতদিন সম্পন্ন হয়ে এসেছে, তার পুরো দায়িত্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মনুষ্যরূপী ও অমনুষ্যরূপী রোবট আজ নিয়ে নিতে পারদর্শী। উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে বিপুল কর্মভার তা নিপুণভাবে সে সম্পূর্ণ করতে পারে, মধ্যবর্তী প্রতিটি সমস্যাকে উপযুক্ত ভাবে মোকাবিলা করে। সর্বোপরি, সর্বোচ্চ পারদর্শিতার নমুনা রেখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি উৎপাদনক্ষমও বটে।

in-the-hands-of-humanoid-robots

এই বাতাবরণেই শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক নতুন পরিসর — যেখানে বিশেষভাবে মনুষ্যরূপী রোবট ও ‘অবতার’ এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বলীয়ান হয়ে যাবতীয় কাজগুলি মানুষের মতোই সম্পন্ন করে ফেলতে অসম্ভব পটু। অনুমান, এই দশকের শেষে ‘অবতার’ ও মনুষ্যরূপী রোবট তৈরির বাণিজ্য ৫২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। ইতিমধ্যেই লন্ডনে অবস্থিত কোম্পানি ‘সিনথেসিয়া’ এই রোবট তৈরিতে ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং ম্যাকডোনাল্ডস, অ্যাকসেঞ্চুয়ার, এমনকি ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’ সহ ১৫০০’র বেশি সংস্থার জন্য মনুষ্য ‘অবতার’ নির্মাণে নিযুক্ত রয়েছে। একেকটি ‘অবতার’এর দাম বর্তমানে ১০০০ ডলারের মতো। কিছু কিছু উৎপাদিতও হয়েছে এবং তা বিভিন্ন সংস্থার কাজে ইতিমধ্যে লেগেও গেছে।

তাহলে কি নিকট ভবিষ্যতে মনুষ্যশ্রমকে প্রতিস্থাপিত করতে থাকবে মনুষ্যরূপী রোবট? সেই কারণেই কি কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই এখন চল হয়ে দাঁড়িয়েছে? গত নভেম্বর ২০২২’এ মেটা (ফেসবুক) ১১,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে, এই বছরের মার্চে আরও ১০,০০০। অ্যামাজন ইতিমধ্যেই ২৭,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। এলন মাস্ক যখন ট্যুইটার অধিগ্রহণ করেন তখন তাদের কর্মী সংখ্যা ছিল ৮,০০০, যা এখন এসে ১,৫০০’এ দাঁড়িয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাম্প্রতিক হাতিয়ার ‘ওপেন এআই’এর চ্যাটজিপিটি, মাইক্রোসফট’এর বিং ও গুগল’এর বার্ড আসার পরে এই বছরের মে মাসেই প্রায় ৪,০০০ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। ‘বিজনেস ইনসাইডার’এর একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এ’বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে সারা বিশ্বে ৪ লক্ষ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে এই প্রবণতা জারি থাকবে। উল্লিখিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে ৭৫ শতাংশেরও বেশি কোম্পানি বিগ ডাটা, ক্লাউড কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তাদের কাজকর্মে পূর্ণ মাত্রায় লাগু করবে। সবথেকে বড় কথা, চলতি দক্ষতাগুলি আস্তে আস্তে অকেজো হয়ে যাবে এবং আগামী পাঁচ বছরে ৪৪ শতাংশ চালু দক্ষতার আর কোনও কার্যকারিতাই থাকবে না। প্রতি দশজন কর্মীর মধ্যে ছ’জন কর্মীকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে।

hands-of-humanoid-robots
কর্মক্ষেত্রের চালচিত্র

অচিরেই হয়তো দেখা যাবে, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের প্রোডাকশন ফ্লোরে একজন মাত্র মানুষ দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন — সারি সারি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মনুষ্যরূপী রোবট বোতাম টিপে অথবা হাত-পা চালিয়ে প্রোডাকশন বেল্টে মানুষের মতো কাজ করে চলেছে। উৎপাদিত পণ্যগুলিকে সংগ্রহ করা ও তাকে গুছিয়ে পরবর্তী কাজের ফ্লোরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এরাই কাজ করছে। এমনকি সেগুলির সর্টিং ও প্যাকেজিং’ও তারা সেরে রাখছে।

উপরন্তু, মানুষের জায়গায় মনুষ্যরূপী রোবট এসে মানুষের মতোই — বরং আরও বেশি নিপুণতা ও দক্ষতায় — যাবতীয় কাজ অধিক গতিতে সম্পন্ন করে উৎপাদনশীলতা ও মুনাফার হারকে যথেষ্ট বাড়িয়ে ফেলছে। এই বাজারের বৃদ্ধি মূলত যে ক্ষেত্রগুলিকে ধরে বিকাশমান — খুচরো বাণিজ্যে ব্যক্তিগত সহচর হিসেবে নানা ধরনের রোবট, শিক্ষা জগতে শিক্ষামূলক কাজে ব্যবহৃত রোবট, চিকিৎসা জগতের প্রাথমিক কাজ করতে সক্ষম রোবট। ২০২২ থেকে ২০২৭’র মধ্যে মনুষ্যরূপী রোবটের বার্ষিক যৌগ বৃদ্ধির হার ৬৩ শতাংশের উপরে থাকবে বলে প্রতিবেদনটি মনে করেছে।

ইতিমধ্যে অনেকেই সোফিয়া নামে এক মনুষ্যরূপী রোবটের পরিচয় পেয়ে গেছেন। সোফিয়া সৌদি আরবের নাগরিক (২০১৭ সাল থেকে) এবং মহিলার আদলে তৈরি এমন এক রোবট যে আপনার প্রায় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর নিখুঁতভাবে দেওয়ার চেষ্টা করে আপনার ভাষাতেই। এইরকম নানাবিধ রোবট — কেউ কথায় চোস্ত, কেউ কোনও নির্দিষ্ট কাজে চৌখস অথবা কেউ ব্যক্তিগত সাহচর্যে কর্মপটু, নানাবিধ কর্মক্ষেত্রের চৌহদ্দির মধ্যে ভালো মতোই জায়গা করে নিয়েছে। হয়তো দেখা যাবে, আগামী পাঁচ কী দশ বছরে, কর্মরত হাতগুলির অধিকাংশই হয়ে উঠছে রোবটের, যেখানে বহু পরিশ্রমসাধ্য ও কষ্টকর কাজগুলি আর মানুষেরা করছে না, সেগুলির দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন রূপের রোবট সমাজ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এরফলে কি মানুষ এক ব্যাপক কর্মচ্যুতি ও বেকারত্বের কবলে পড়বে? এই প্রশ্নটির উত্তর এখুনি স্পষ্ট করে দেওয়া মুশকিল। ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর অন্য একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে যদিও ৮.৫ কোটি কাজ মানুষের হাত থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে চলে যাবে কিন্তু একইসঙ্গে ৯.৭ কোটি নতুন কাজও তৈরি হবে। এই একই ধরনের বার্তা গত ৭ জুন ভারতে এসে ‘ওপেন এআই’এর কর্ণধার স্যাম অল্টম্যানও দিয়েছেন। এই নতুন কাজগুলি কী ধরনের এবং তারজন্য যথাযথ মানবসম্পদ প্রস্তুত কিনা, সেও এক বড় প্রশ্ন। তাই, পুরো প্রক্রিয়াটি ও এর সম্ভাব্য অভিঘাতগুলি এখনও গবেষণা, বাস্তবতা ও দূরদৃষ্টির পরিসরে পথ খুঁজে বের করার অনুশীলনের মধ্যে রয়েছে।

পাশাপাশি, আজকের চলমান দুনিয়ায় এমন এক অর্থনীতির বয়ান তৈরি হয়েছে যেখানে কর্মবিন্যাসগুলি অতি দ্রুত কয়েক বছরের মধ্যে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে এবং তৎসংলগ্ন যথার্থ কর্মী-চাহিদার চিত্রটিও বারবার করে পুনর্নির্মিত হচ্ছে। যেমন, ২০২৫ সালের মধ্যে ৯.৭ কোটি নতুন কাজ তৈরি হবে বলে যে অনুমান, সেই কাজগুলি এবং সে কাজে পারদর্শী কর্মীদের শিক্ষা ও দক্ষতার কারিকুলামগুলিই বা কেমন হবে, তা কিন্তু এই মুহূর্তে স্থির-নিশ্চিত নয়। ফলে, যখন সত্যি সত্যিই তেমন কাজের উদয় হবে ও সেই কাজের জন্য কর্মী খোঁজা হবে, তা কি তখন হাতের কাছে রেডিমেড পাওয়া যাবে? এই সমস্যাটা কিন্তু এখনও বিদ্যমান। সেই কারণেই শিক্ষাব্যবস্থারও খোলনলচে বদলে ফেলার প্রসঙ্গ বারবার আলোচিত হচ্ছে। হয়তো সে জন্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ বেশি বেশি করে বড় বড় উদ্যোগপতিদের হাতে চলে যাচ্ছে। যেহেতু প্রযুক্তির এক অসম্ভব ঘোড়দৌড়ের অভিঘাতে যে কোনও কর্মপ্রক্রিয়ারই স্থায়িত্ব খুব বেশিদিনের নয়, তাকে প্রতিস্থাপিত করে ফেলছে আরও নতুন ধরনের কোনও উন্নত প্রযুক্তি-প্রয়োগ, অতএব, শ্রমিক-কর্মীদের কাজের স্থায়িত্বও বেশি বেশি করে অস্থায়ী চরিত্র লাভ করছে। এমতাবস্থায় এটা খুব স্বাভাবিক যে, কর্মীরাও নতুন নতুন কাজের তল্লাশে নিয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং সেই সব কাজে নিযুক্ত হওয়ার জন্য নিজেদের বার বার প্রশিক্ষিত করে তুলবেন।

এই সামগ্রিক পরিবর্তন যে নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির বয়ান নির্মাণ করছে, তা একদিকে যেমন সমাজ জুড়ে এক তীব্র অনিশ্চয়তা, বিচ্ছিন্নতা ও বিপন্নতা গড়ে তুলছে, অন্যদিকে পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থার মধ্যে এক নতুন গতিপথ নির্মাণ করছে। অর্থাৎ, যে কর্মী হন্যে হয়ে দুয়ারে দুয়ারে কাজের তল্লাশে ঘুরে ফিরে অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাইছেন, তিনিও কাল নিজের দক্ষতার দৌড়ে প্রযুক্তির দৌলতে স্ব-উদ্যোগী এক সফল কর্মপরিসর তৈরি করে নিতে পারেন। পারেন তো বটে কিন্তু পারছেন কি? আবার, পারছেন না, তাই বা বলি কেমনে! সে এক অন্য গল্প বটে। সেখানেই ওত পেতে রয়েছে আজকের পুঁজিবাদের নির্মম সংকট।

- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

‘‘একক মাত্রার’’, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত

progress-in-gender-inequalitygender-inequality

ওয়ালর্ড ইকনমিক ফোরাম প্রকাশ করল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট, ২০২৩। তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২৭। আগের তুলনায় ভারত আট ধাপ উপরে উঠেছে। গতবছর ভারতের স্থান ছিল ১৩৫। যে চারটি সূচকের উপর এই সারণি তৈরি হয়, তা হল, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ এবং সুযোগ সুবিধা, শিক্ষা অর্জন করতে পারা, স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকার অন্যান্য শর্তাবলী এবং রাজনৈতিক সক্ষমতা। প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী, শিক্ষার সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে আগের তুলনায় উন্নতি এবং রাজনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকে নানান স্বশাসিত সংস্থাগুলোতে মহিলা প্রতিনিধিত্ব ৪০ শতাংশের একটু বেশি হলেও ভারতের সংসদ মাত্র ১৫.১ শতাংশ মহিলা সাংসদকে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ড ভারতের এক রাজ্য হিসাবে প্রথম স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০২৩ সালে নাগাল্যান্ড পেল তার প্রথম দু’জন বিধায়ক!

কিন্তু আর্থিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে ভারত অনেকটাই নিচের দিকে আর এই প্রশ্নে তার রেকর্ড মাত্র ৩৬.৭ শতাংশ। শিক্ষাক্ষেত্রের সমস্ত স্তরেই মহিলাদের সমান সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এই রিপোর্ট। সারণিতে প্রতিবেশি দেশ পাকিস্থান ১৪২, বাংলাদেশ ৫৯, চীন ১০৭, নেপাল ১১৬, শ্রীলঙ্কা ১১৫ এবং ভুটান ১০৩। অর্থাৎ, পাকিস্থান ছাড়া অন্য সমস্ত প্রতিবেশি দেশগুলো রয়েছে ভারতে উপরে। লক্ষণীয়, প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গসাম্যের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের স্থান সবচেয়ে ভালো।

বেশ কয়েক দশক পর খুব ধীরে হলেও ভারতে কন্যা শিশুর জন্মহারে ১.৯ শতাংশ বিন্দু উন্নতি হয়েছে। রিপোর্ট জানিয়েছে, অতিমারির আগেকার অবস্থার তুলনায় আশাপ্রদ উন্নতি হলেও বর্তমানে জীবন যাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং শ্রম বাজারে অস্থিরতার প্রকোপ বেশি মহিলাদেরই ভুগতে হচ্ছে দুনিয়ার সর্বত্র। এ’প্রশ্নে অগ্রগতি ঘটছে খুবই ঢিমেতালে।

মোট ১৪৬টি দেশকে নিয়ে ২০২৩’র বৈশ্বিক লিঙ্গ অসাম্য বা গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সমস্ত দেশগুলোর সমষ্ঠিগত লিঙ্গ অসাম্য প্রায় ৬৮.৪ শতাংশ। ২০২২-এ এই হার ছিল ৬৮.১ শতাংশ, যা ২০২৩-এ দাঁড়িয়েছে ৬৮.৪ শতাংশ। অর্থাৎ, গতবছরের তুলনায় মাত্র ০.৩ শতাংশ বিন্দু উন্নতি হয়েছে। এই ফোরামের অনুমান, বর্তমানের এই হার বজায় থাকলে পূর্ণ সাম্যতা আনতে লেগে যাবে আরও ১৩১ বছর!

রিপোর্ট জানাচ্ছে, বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ মাত্রায় লিঙ্গ সাম্য অর্জন করতে পারেনি। তবে শীর্ষে থাকা ন’টি দেশ ( আইসল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি, নিকারাগুয়া, নামিবিয়া, লিথুয়ানিয়া) অসাম্যকে প্রায় ৮০ শতাংশ কমিয়ে এনেছে আর আইসল্যান্ড রয়েছে শীর্ষ স্থানে — এই দেশে অসাম্য কমিয়ে ৯২.২ শতাংশ হয়েছে। এটাই একমাত্র দেশ, যারা ৯০ শতাংশের বেশি কমিয়ে এনেছে অসাম্য।

শ্রমবাজার ও বিভিন্ন শিল্পের উচ্চপদে আসীন মহিলা কর্মকর্তার সংখ্যাও অনেক কম। ২০১৩ সালে ১৬৩ দেশে লিঙ্কড-ইন’এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সমগ্র শ্রমশক্তির মাত্র ৪১.৯ শতাংশ মহিলা, শিল্প সংস্থার উচ্চপদে আসীন মহিলা আধিকারিকদের হার মাত্র ৩২.২ শতাংশ।

অর্থনৈতিক ভাবে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এখনও কর্মক্ষেত্রে এবং মজুরির প্রশ্নে বড় ধরনের লিঙ্গ অসাম্যের শিকার।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত — এই উচ্চহারের বেতন ক্ষেত্রগুলো আগামী দিনে আরও প্রসারলাভ করবে। কিন্তু, এই পেশাগুলোতে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম, মাত্র ২৯.২ শতাংশ। ২০২২-২৩’র মধ্যে শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ সামান্য বেড়েছে ৬৩ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশ। মহিলারা এখনও পুরুষদের তুলনায় অধিক সংখ্যায় কর্মহীনতার শিকার। আর, কাজের সুযোগ পেলেও মহিলাদের ঠাঁই হয় নিম্নমানের কাজের ধরনে। দেখা যাচ্ছে, ২০২০’র পর থেকে কাজের বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণে সামান্য উন্নতি হলেও তা হয়েছে ইনফর্মাল কাজে — প্রতি পাঁচটি ইনফর্মাল কাজের মধ্যে চারটিতেই মহিলারা যুক্ত, আর পুরুষদের অনুপাত হল প্রতি তিনটির মধ্যে দু’টো।

ইনফর্মাল ক্ষেত্রে, সামাজিক সুরক্ষা বিহীন, স্বল্প মজুরি এখনও মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রধান প্রবণতা হয়ে রয়েছে।

- অতনু চক্রবর্তী

to-make-india-a-follower-of-us-foreign-policyus-foreign-policy

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ২১-২৪ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর ছিল ‘রাষ্ট্রীয় সফর’। মোদী এরআগে পাঁচবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করলেও সেগুলোর কোনোটাই রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। সাধারণ সফরের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রীয় সফরের’ ফারাক হলো এই যে — এই সফরকে সর্বোচ্চ সফরের মর্যাদা দেওয়া হয়, সফরকারী রাষ্ট্রপ্রধানের দেশের সঙ্গে মিত্রতা ও জোট প্রভূত গুরুত্ব পায়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ককে গভীরতর করে তোলাটাও লক্ষ্য হয়। নরেন্দ্র মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্রীয় সফর’এর বিষয়সূচির মধ্যে অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো ছিল, তবে সার্বিক বিচারে অগ্রাধিকারে ছিল ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা। অর্থাৎ, মার্কিনের বিদেশ নীতির চরিতার্থতায় ভারতকে শামিল করাটা যদি এই ‘রাষ্ট্রীয় সফর’এর একটা লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে নরেন্দ্র মোদীও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘মৈত্রী’ ও পারস্পরিক ‘সহযোগিতা’র বকলমে মার্কিন বিদেশ নীতির পক্ষ অবলম্বনকেই স্পষ্ট করেছেন।

রাশিয়ার সঙ্গে শীতল যুদ্ধের অবসানের পর যে একমেরু বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটেছিল, যখন গোটা দুনিয়ার ওপর ছড়ি ঘোড়নোটাকে আমেরিকা তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য করে তুলেছিল, আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিটা তার থেকে আলাদা। আজ বিশ্বে কয়েকটা মেরুরই উদ্ভব ঘটেছে, আমেরিকা-সহ ন্যাটোর প্রতাপের পরোয়া না করে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, আর শক্তিধর অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভাব ঘটেছে চীনের। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সামরিক শক্তির দিক থেকেও আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে চীন। বিশ্বে তার আধিপত্য ফিরে পেতে চীনকে রোখা, চীনের অর্থনীতিতে সংকোচন ঘটানো, চীনের প্রভাবকে খর্বিত করাটা আমেরিকার বিদেশ নীতির গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে রয়েছে। বর্তমানের মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বকে অনেক ভাষ্যকারই দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা বলে অভিহিত করছেন। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধ ও সেখানে অস্থিতিশীলতা রয়েছে। এছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারত চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই মনে করে। দু’দেশের মধ্যে এই ধরনের বিরাজমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তির নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার চোখে ভারত প্রতিরোধের এক শক্তি হয়ে উঠতে পারে। চীন সম্পর্কে ভারতের বৈরিতাকে বাড়িয়ে তোলা এবং চীনকে বিপদ জ্ঞান করে সেই বিষয়ে সহমত গড়ে তোলাটাও মার্কিনের এক অভিপ্রায়। এবারের মার্কিন সফরে মোদী এই বিষয়ে ইতিবাচক সাড়াই দিয়েছেন।

আমেরিকা চারটে দেশকে নিয়ে কোয়াড নামে একটা জোট বানিয়েছে, আমেরিকা ছাড়া জোটের অন্য সদস্যরা হলো ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। চরিত্রগত ভাবে এটা একটা সামরিক জোট যার ঘোষিত লক্ষ্য ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয়’ অঞ্চলে চীনের প্রভাবের মোকাবিলা করা। মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে বাইডেন তাঁর ভাষণে বললেন, “ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে মুক্ত, অবাধ, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধশালী হিসাবে গড়ে তুলতে” আমেরিকা ভারতের সহযোগিতায় কোয়াড জোট তৈরি করেছে। এরসাথে সুর মিলিয়ে মোদী অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতায় বললেন, “এই অঞ্চলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে সংঘাত ও বলপ্রয়োগের মেঘ। এখানের সুস্থিতি আমাদের সম্পর্কের মূল উদ্বেগগুলির একটি।… কারও একচেটিয়া আধিপত্যকে আমরা স্বীকার করি না।” কোয়াড নিয়ে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলে যাওয়া মোদীর চীন-বিরোধী এই বচন বাইডেন ও মার্কিন কংগ্রেসের অন্য সদস্যদের কানে নিশ্চয় অমৃতবর্ষণ করেছিল!

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে আমেরিকা যে দ্বিচারিতায় সিদ্ধহস্ত, মোদীর মার্কিন সফর তাকে আরও একবার প্রতিপন্ন করল। যে রাষ্ট্রগুলো আমেরিকার বশ্য হতে অস্বীকার করে, তাদের ওপর অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে মার্কিনের হাতিয়ার হয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। কিন্তু রাষ্ট্র মার্কিনের অনুগত হলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের হাজারো পীড়ন ও নিয়ন্ত্রণকে দেখা হয় উপেক্ষার চোখে। দেশদ্রোহ ও ইউএপিএ আইনের নির্বিচার প্রয়োগ বিরোধী স্বরের কেমন কণ্ঠরোধ করছে, সরকার তার সমালোচকদের কিভাবে জেলে পুরছে, ভারতবাসী তার ভুক্তভোগী। আর এই ইতিহাস বিশ্বের কাছেও অবিদিত নয়। মার্কিন কংগ্রেসের ৭৫ জন সাংসদ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে চিঠি লিখে জানালেন — তিনি যেন ভারতে মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বহুত্বর ওপর আক্রমণের বিষয়গুলো মোদীর কাছে তুলে ধরেন। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওবামা বললেন, “আমার যুক্তি হল, ভারতে যদি এমনকি সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা না হয় তাহলে সে দেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ যদি বিরাট আকার ধারণ করে, তাহলে কী হতে পারে তা আমরা দেখছি।” ওবামার এই বিবৃতির উৎস সম্ভবত মণিপুরে ঘটে চলা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সংঘাত ও তার পরিণামে মর্মান্তিক বিপর্যয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে দু’বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রগতিবাদী প্রার্থী বার্ণি স্যান্ডার্সও বললেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকার সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ওপর দমন নামিয়েছে, রাজনৈতিক বিরোধীদের জেলে পুরছে, এবং আগ্রাসি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উস্কিয়ে তুলেছে যা ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো পরিসর রাখেনি। মোদীর সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এই বিষয়গুলো তুলতে হবে।” ভারতে গণতন্ত্রের এই নিকৃষ্ট পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কয়েকজন মার্কিন সাংসদ কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন বয়কট করেন। তাদের অন্যতম রাশিদা তালেব বললেন, “মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র বিরোধিতার দীর্ঘ ইতিহাস যাঁর রয়েছে, আমাদের দেশের রাজধানীতে সেই মোদীকে একটা মঞ্চ দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত লজ্জার।” হোয়াইট হাউসের বাইরেও মোদী বিরোধী প্রতিবাদ সংগঠিত হতে দেখা গেছে এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল — মোদী ভারতকে নাৎসি দেশ বানিয়ে তুলেছেন। কিন্তু যাঁর কাছে এই সমস্ত আবেদন হয়েছিল, সেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনের কাছে কি বিষয়গুলো আদৌ গুরুত্ব পেয়েছিল?

মোদী তাঁর ন’বছরের শাসনে ভারতে কোনো সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। কিন্তু যেকোনো কারণে বা চাপেই হোক, ইচ্ছা না থাকলেও তাঁকে দুই সাংবাদিকের কাছ থেকে প্রশ্ন নিতে হয়েছিল। গণতন্ত্রের সংকট প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে মোদী বলেন, “ভারতের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে গণতন্ত্র। ভারত বাঁচে গণতন্ত্রে। পূর্বসূরীরা গণতন্ত্রের বয়ানেই লিখেছিলেন সংবিধান। মোদী সরকারও গণতন্ত্রেরই উপাসক। জাতি ধর্মের কোনও বৈষম্য সেখানে নেই।” ভারতে প্রতিদিনই যা ঘটে চলেছে এই উক্তিতে তার সম্পূর্ণ বিপরীত উপস্থাপনা। এর হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে, মুসলিম নিগ্ৰহের একেবারে হালফিলের একটা নিদর্শন উল্লেখ করা যাক। গত ২৫ জুন কাশ্মীরের পুলওয়ামার একটা মসজিদে ঢুকে রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের জওয়ানরা সেখানে উপস্থিত উপাসকদের বন্দুকের ডগায় ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বাধ্য করলেন। গণতন্ত্র ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী ও প্রতিবাদী কণ্ঠের দমন নিয়ে প্রশ্নের কোনো উত্তরই মোদী দিলেন না।

মোদী সফরে অর্থনৈতিক দিক থেকে কয়েকটা চুক্তি আমেরিকার সঙ্গে হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটো চুক্তির মধ্যে একটা হল, ভারত আমেরিকার কাছ থেকে ৩১টা হানাদার ড্রোন কিনবে যার মূল্য হবে ৩.১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, প্রতিটি ড্রোনের ক্রয়মূল্য হবে ১১০ মিলিয়ন ডলার। অথচ, প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, জেনারেল অ্যাটোমিক্স কোম্পানির তৈরি এই ড্রোন মার্কিন সরকার বাজার থেকে প্রতিটি কেনে ৫৬.৫ মিলিয়ন ডলারে। এইভাবে বাজারের দামের থেকে অনেক বেশি দামে এই ড্রোন ভারতকে মার্কিন সরকারের কাছ থেকে কিনতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল লাভের বিনিময়ে ভারত সরকারের তহবিলের নয়ছয় ছাড়া এটাকে অন্য কিছু কী বলা যায়। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানি হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতে যুদ্ধ বিমানের জেট ইঞ্জিন তৈরি করবে। চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার প্রযুক্তিতে ভারতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যও এরমধ্যে রয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত।

বাইডেন বলেছিলেন, “গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে লড়াই” হবে তাঁর জমানার নির্ধারক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মোদীকে লাল কার্পেট বিছিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন, আমেরিকার আধিপত্যবাদী রণনৈতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা একেবারেই অন্তঃসারশূন্য বাগজাল। ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর সরকারের নিষ্ঠা নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে মোদী যে মিথ্যাচার করলেন, বাইডেনদের কাছে সেটাই শিরোধার্য হল। মোদী যখন বললেন যে, “দিল্লী ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি শক্তিশালী ও গভীর”, সেই সম্পর্কে নিহিত উপাদানগুলো হলো প্রভুত্বকামী মার্কিন বিদেশ নীতির প্রতি মোদী সরকারের আনুগত্য, চীনকে নিয়ন্ত্রণের পারস্পরিক অভিপ্রায়। বিশ্বে শান্তি স্থাপন ও দারিদ্র্য মোচনের কোনো অভিলাষ ঐ ‘শক্তিশালী ও গভীর’ সম্পর্ককে প্রণোদিত করেনি। অতএব, ট্রাম্প বা বাইডেন, মার্কিন রাষ্ট্রের শীর্ষে যাঁরাই থাকুন না কেন, বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চালিত মার্কিন বিদেশ নীতির স্বার্থে নরেন্দ্র মোদীর মতো গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিধনকারী ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্র প্রধানরা তাঁদের কাছে সর্বদাই স্বাগত!

manipur-needsneeds-now

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং মণিপুরের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং দাবি করেছেন যে ১৩ জুন থেকে মণিপুরে জীবনহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা কিন্তু মণিপুর শান্ত হওয়ার কোনো নির্দেশক নয়। জীবনহানি না ঘটলেও হিংসা শুরু হওয়ার পর ৫৫ দিন পেরিয়ে গেলেও একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। এবং মণিপুরের অশান্ত পরিমণ্ডলের কেন্দ্রে রয়েছে মেইতেই জনগোষ্ঠী ও কুকি জনজাতির মধ্যে যে সংঘাত, সেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে আসার কোনো লক্ষণই চোখে পড়ছে না। নরেন্দ্র মোদী তো মণিপুরের সংকট নিয়ে আজ পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। অমিত শাহ ও বীরেন সিং’দের কাছেও ঐ রাজ্যের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তোলার কোনো উপায় আছে বলে দেখা যাচ্ছে না।

মণিপুর সংকটের সমাধান অধরা থেকে যাওয়ায় এবং মণিপুর নিয়ে সর্বস্তরে প্রশ্ন উঠতে থাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত ২৪ জুন দিল্লীতে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। সেই বৈঠক থেকে কোনো সমাধান সূত্র বেরোয় নি, বরং প্রশ্ন ওঠে — নরেন্দ্র মোদী যখন বিদেশ সফরে তখন এই বৈঠক ডাকা হল কেন। নরেন্দ্র মোদীকে অপ্রীতিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া থেকে রেহাই দেওয়ার জন্যই কি তাঁর অনুপস্থিতিতে এই বৈঠকের আয়োজন? ঐ বৈঠক থেকে দাবি উঠল সর্বদলের প্রতিনিধিদের ইম্ফলে যেতে দিতে হবে। আরও বলা হলো যে, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী শুধু পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতেই ব্যর্থ নন, তাঁর মেইতেইপন্থী মানসিকতা রাজ্যের সমস্ত জনগোষ্ঠীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া থেকে তাঁকে বিচ্যুত করেছে। অতএব, মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বীরেন সিং থাকলে সমাধানের সন্ধান দুরাশা হয়েই থেকে যাবে।

মেইতেই ও কুকিদের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা কতটা গভীর আকার নিয়েছে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে অরুণাভ সইকিয়ার লেখা, ‘রিপোর্টারের ডায়েরিঃ আমি দু’পক্ষের মধ্যবর্তী এলাকা পেরোলাম’ শীর্ষক নিবন্ধে। ঐ নিবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন, ইম্ফলে কোনো কুকি আর নেই, পার্বত্য এলাকাতেও নেই কোনো মেইতেই মানুষ। যার যার পরিচিতির যে অঞ্চল সেখানে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে — পার্বত্য অঞ্চলের মেইতেইদের ইম্ফলে এবং ইম্ফলে থাকা কুকিদের পার্বত্য জেলায়। এটাই নাকি শান্তি প্রক্রিয়ার ইতিবাচক পদক্ষেপ! তাঁর নিবন্ধ জানাচ্ছে, “সচিবালয় থেকে থানা, সমস্ত স্থানেই রয়েছে খালি চেয়ার। মানুষের দল ব্যাঙ্কগুলোতে ভিড় করে জানতে চাইছেন এক শাখা থেকে আর এক শাখায় অ্যাকাউন্ট বদলের প্রক্রিয়াটা কী।” খালি চেয়ারগুলো যে স্থানান্তরে চলে যেতে বাধ্য হওয়া কুকি কর্মীদের তা বোধহয় না বললেও চলবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, কুকি কর্মী না থাকায় ৩ মে থেকে সরকারি বেতারে কুকি ভাষায় কোনো সম্প্রচার সম্ভব হয়নি।

what-manipur-needs-now_0

মোদী মণিপুর নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটলেও আরএসএস কিন্তু মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অভিমত জানিয়েছে। আরএসএস নেতা দত্তাত্রেয় হোসবালে তাঁর সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, “গত ৪৫ দিন ধরে মণিপুরে যে হিংসা চলছে তা অত্যন্ত উদ্বেগের। লাল হারাওবা উৎসব চলার সময় ৩ মে ২০২৩ চুড়াচাঁদপুরে সংগঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে মণিপুরে যে হিংসা ও অনিশ্চয়তার শুরু, তার নিন্দা করতে হবে।… বর্তমান সংকটের যে কারণ, অর্থাৎ প্রত্যেকের মধ্যে আস্থার অভাবকে কাটানোর আবেদন আরএসএস সবার কাছে জানাচ্ছে। এরজন্য প্রয়োজন উভয় সম্প্রদায়ের সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টা।” এই বিবৃতির মধ্যে দিয়ে হোসবালে পরিস্থিতির অবনতির দায় কুকিদের ঘাড়েই চাপালেন। কুকি ও নাগারা চুড়াচাঁদপুরে ৩ মে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিল মেইতেইদের জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার হাইকোর্টের সম্মতির বিরুদ্ধে। ঐ রায়ে মণিপুর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এম ভি মুরলীধরণ মেইতেইদের জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ কেন্দ্রের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন (সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য বলেছে যে ঐ নির্দেশ দেওয়ার অধিকার হাইকোর্টের নেই)। এই রায়ের লক্ষ্য স্পষ্টতই ছিল কুকিদের সুবিধাকে খর্ব করা এবং মেইতেইদের অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান। ঐ সংগঠিত প্রতিবাদের আগেই কিন্তু কুকি-বিরোধী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিল বীরেন সিং প্রশাসন। ২৬ এপ্রিল শুরু হয়েছিল বনাঞ্চল থেকে কুকিদের উচ্ছেদ অভিযান। বীরেন সিং নিজে মায়ানমার থেকে পার্বত্য অঞ্চলে অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুবাদী আওয়াজ ওঠাচ্ছিলেন। সংখ্যায় খুব অল্প, মায়ানমার থেকে আসা সম্ভবত কয়েকশ মাত্র শরণার্থী কুকি জনজাতিদের সঙ্গে মৈত্রীতে আবদ্ধ। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আস্ফালনের আসল লক্ষ্য ছিল কুকিরাই। কুকিদের মাদক চাষের অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। কুকি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যে যুদ্ধবিরতি বলবৎ রয়েছে তাকে বাতিল করা, অর্থাৎ কুকিদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের আওয়াজ ওঠাচ্ছিল মেইতেই সংখ্যাগুরুবাদী বাহিনী। এই সমস্ত কিছুকে বিবেচনায় নিয়ে গুয়াহাটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল সামাজিক কেন্দ্রর ডিরেক্টর ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ তাঁর ‘অশান্তিতে পড়া এক ভূখণ্ড’ নিবন্ধে যথার্থভাবেই বলেছেন, “এই ঘটনাগুলো থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটা যুক্তিসঙ্গত হবে যে, এই সংঘাত ছিল সুপরিকল্পিত, তাতে অর্থ জুগিয়েছিল এবং তাকে নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত করেছিল ক্ষমতায় থাকা লোকজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা বাহিনী নীরব দর্শক হয়েই ছিল।… আদালতে মামলা, উচ্ছেদ, সংঘাত এবং আলোচনা ভেঙে পড়ার মধ্যে স্পষ্টতই সংযোগ রয়েছে।” অনেকের জানা থাকলেও এখানে এর উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মেইতেইরা হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করে, আর কুকি-নাগারা হল খ্রিস্টান। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে বিপর্যস্ত বেশি হয়েছে কুকিরাই। এখনও পর্যন্ত ১৩০’র বেশি নিহতের অধিকাংশই কুকি, তাদের বসবাসের ২০০টারও বেশি গ্রামে আগুন লাগানো হয়েছে, ৬০,০০০ বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থী শিবিরে থাকাদের মধ্যে তারাই ব্যাপক সংখ্যাধিক, তাদের প্রায় ২৫০টা চার্চকেও পোড়ানো ও ধূলিসাৎ করা হয়েছে। এগুলো সম্পর্কে দত্তাত্রেয় হোসবালেরা কি আদৌ অবহিত নন? আর ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষোদগার অব্যাহত রেখে কি আস্থা-বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব?

মণিপুর সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে সেখানে যা চলছে তাকে গৃহযুদ্ধ বলে মেনে নিয়ে তার পিছনের কারণগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। বহু সংস্কৃতির যে রাজ্য মণিপুর এবং যাকে ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছে, সেই বহুত্বকে অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে আলোচনা ও বার্তালাপের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে হবে। এরজন্য রাজ্য সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। অমিত শাহর সঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠকে আরজেডি নেতা মনোজ ঝা সঠিকভাবেই বলেছেন, “সবাই এই ধারণার ওপর জোর দিয়েছেন যে, মণিপুরের প্রয়োজন উপশমের এক স্পর্শ, তার এমন এক মুখের দরকার যা ঐক্যবদ্ধ করবে এবং বিভেদ সৃষ্টির মুখ নয়।” অনেকে সমাধানের পথ হিসাবে সেনাশাসন এবং মণিপুরে আফস্পা বা সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রত্যাবর্তনের কথা বলছেন। ভারতীয় জনগণের অভিজ্ঞতায় আফস্পা’র ওপর ভর করা সেনাশাসন জনগণের চরম দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের কারণই হয়, মনোরমার ধর্ষণ ও হত্যা-সহ সেনা নির্যাতনের কয়েক হাজার ঘটনার সাক্ষী মণিপুর নিজেই। অতএব মণিপুর সমস্যা সমাধানের নির্ধারক শর্ত হতে হবে প্রশাসনের অলিন্দ থেকে সংখ্যাগুরুবাদী মানসিকতার বিসর্জন, সমস্ত সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি, ঘৃণা-বিদ্বেষ বচনের পরিহার, সম্মান ও মর্যাদার পারস্পরিক প্রদান। এক কথায়, সংখ্যাগুরুবাদী বিদ্বেষ ও বিভাজনের আরএসএস এজেন্ডাকে ঝাড়ে-মূলে বিদায় জানানো।

- জয়দীপ মিত্র

those-who-divide-and-plunder-the-countrytheir-own-benefit

আরএসএস নিজেকে একটি জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন বলে দাবি করে, এবং এর সম্মুখ সংগঠন, বিজেপিও গর্ব করে যে, তারাই দেশের একমাত্র আদর্শ জাতীয়তাবাদী দল। উপরন্তু, ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে আরএসএস-বিজেপি আদর্শ জাতীয়তাবাদের শংসাপত্র বিতরণের জন্য স্বঘোষিত সংস্থা হয়ে উঠেছে। কে জাতীয়তাবাদী আর কে নয়, সে’বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত!

পুলওয়ামা হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক এই দাবির বাস্তবতা এখন জনগণের সামনে উন্মোচিত করেছেন। তবুও, আরএসএস-বিজেপি দেশপ্রেমী-জাতীয়তাবাদী হওয়ার ভান করে।

নিজেদের সৎ দেখানোর জন্য বিজেপি’কে দুর্নীতিবিরোধী বিজ্ঞাপন ও প্রচারে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্লোগান দিয়েছেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’ (ঘুষ নেব না, অন্য কাউকে নিতেও দেব না)। দেশের ব্যাঙ্ক থেকে যারা লাখ লাখ বা কোটি টাকা লুট করেছে তারা খোদ প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ প্রিয়জন। এখন তাদের হাতেই দেশের সমস্ত সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে।

গত কয়েক বছরে এমন অনেক ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে যা প্রমাণ করে যে, যারা দেশকে বিভক্ত ও লুট করে, দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করে ও গণতন্ত্রকে চূর্ণবিচূর্ণ করে, তারা সবাই বিজেপির বড় আপন এবং প্রিয়।

সম্প্রতি ডিরেক্টর অব রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান, বিজ্ঞানী প্রদীপ কুরুলকরের ঘটনাটি আমাদের সামনে এসেছে। পাকিস্তানে সংবেদনশীল তথ্য সরবরাহের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী দল (এটিএস) তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। গ্রেফতারের সময় প্রদীপ কুরুলকর ডিআরডিও’র গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার্স) ছিলেন। যদি তিনি গ্রেপ্তার না হতেন, তাহলে আগামী নভেম্বরে তিনি অবসরে যেতেন। প্রদীপ কুরুলকর একজন অসামান্য বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচিত। আমরা সবাই জানি যে ডিআরডিও শুধু কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা নয়; এটি একটি প্রতিরক্ষা সংস্থা যা প্রতিরক্ষা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন কৌশল এবং ডিভাইসগুলি গবেষণা এবং নতুন ডিভাইসের বিকাশ করছে। একজন প্রবীণ বিজ্ঞানীর পক্ষে দেশের প্রতিরক্ষা গোপনীয়তা অন্য দেশের সাথে শেয়ার করা কোনও সাধারণ ঘটনা নয়।

কে এই প্রদীপ কুরুলকর যিনি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার অভ্যন্তরে, আরাম করে বসে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করছেন? পুনে থেকে আসা প্রদীপ কুরুলকরের বাবা, পিতামহ, প্রপিতামহ সকলেই সক্রিয়ভাবে আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও, তিনি আরএসএস দ্বারা আয়োজিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমনকি, শীর্ষস্থানীয় সারসঙ্ঘ চালকের সাথে মঞ্চ ভাগ করেছিলেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আরএসএসের তাবেদারির পর, এখন আমাদের সামনে পর্দার আড়াল সরিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে যে তিনি আসলে জাতীয়তাবাদী সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

একজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, কিন্তু টিভি উপস্থাপকেরা যারা কিনা নিজেরাই স্ব-প্রত্যয়িত জাতীয়তাবাদী এবং যারা অন্য সময় জাতীয় নিরাপত্তা এবং জাতীয়তাবাদের বিষয়ে সোচ্চার, তারা এ’বেলায় আপেক্ষিক নিরবতা বজায় রেখেছেন। দর্শকদের জন্য চাঞ্চল্যকর তথ্য ‘উন্মোচন’ করার জন্য কোনো প্রাইম টাইম বিতর্ক বা বিশেষ অনুষ্ঠান ছিল না। কেন? কারণ গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে গ্রেফতার হওয়া বিজ্ঞানী একই স্বঘোষিত জাতীয়তাবাদী শিবিরের সদস্য, যার সামনে বেশিরভাগ মিডিয়া ইতিমধ্যেই বিকিয়ে গেছে।

তবে প্রদীপ কুরুলকরের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ’বছর জম্বু-কাশ্মীরের পুলিশ, কিরণ প্যাটেল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। যিনি ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে কাশ্মীরে ‘ভ্রমণ’ করছিলেন এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে যুক্ত একজন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও, সরকারি খরচে তিনি শুধুমাত্র রাজ্যের সংবেদনশীল এলাকাগুলোয় সফর করছিলেন না, বহু মাস ধরে সামাজিক মাধ্যমে তার ‘অফিশিয়াল’ সফরের ভিডিও ছড়ানোর কাজও করছিলেন। এই ঘটনা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার উপর গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। কিরণ প্যাটেলের গ্রেপ্তারের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক ছবি উঠে এসেছিল যা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ বিজেপির অনেক বড় নেতার সাথে কিরণ এবং তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ককে স্পষ্ট করে। যখন সেই ছবিগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন অমিত শাহ বা ভারত সরকার কেউই সেই ছবিগুলির দ্বারা প্রকাশিত সত্যকে অস্বীকার করে সঠিক কোনও বিবৃতি জারি করার জন্য মাথা ঘামায়নি। মজার বিষয় হল, কিরণ প্যাটেলের সাথে আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের কোনও কারণ ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে একজন হলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর অতিরিক্ত জনসংযোগ আধিকারিক হিতেশ পান্ডের ছেলে অমিত পান্ডে, যিনি ২০০১ সাল থেকে গুজরাট সরকারের হয়ে কাজ করছিলেন৷ তিনি তার ছেলের বিতর্কিত গ্রেপ্তার এবং মুক্তির পরে পাবলিক রিলেশনস্ অফিসারের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন৷ অমিত পান্ডে এবং তার বন্ধু জয় সীতাপাড়াকে যেভাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, জম্বু-কাশ্মীর পুলিশের হিতেশ ও সীতাপাড়াকে নির্দোষ প্রমাণের যুক্তি, এবং একইসাথে হিতেশ নিজেই এই পুরো পর্বটি সম্পর্কে সন্দেহ আরও বৃদ্ধি করে।

কিরণ প্যাটেলের পক্ষে জেড সুরক্ষার অধীনে সংবেদনশীল এলাকায় ভ্রমণ করা কীভাবে সম্ভব হল? আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই নির্দোষ এবং অসহায় যে, এখানে কাউকে সত্যতা যাচাই না করেই প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অফিস থেকে পাঠানো কারোর জন্য লাল গালিচা ফেলে দেবে — এও বিশ্বাসযোগ্য? যে ব্যক্তি আইএএস এবং আইপিএসের মধ্যে পার্থক্য জানেন না তিনি তাদের কয়েক মাস ধরে বোকা বানাতে পারবেন? অঙ্ক এখানে কিছুতেই মিলবে না। কিরণ প্যাটেলকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ছবিতে দেখা গেছে। তিনি বিজেপি এবং আরএসএসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিভিন্ন কর্মসূচি, প্রচার এবং সমাবেশের আয়োজন করেছেন। যদি মিডিয়া রিপোর্টগুলি বিশ্বাস করা হয় তবে বলা যায়; রাজস্থানে আরএসএস প্রচারক, ত্রিলোক সিং কিরণকে জম্মু ও কাশ্মীরে প্রাথমিক যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন।

এই প্রতারণার সাথেও নিঃসন্দেহে আরএসএসের সংযোগ রয়েছে। মিডিয়ার বড়সড় মাথারা এধরনের বিষয়গুলোতে তুলনামূলকভাবে নিশ্চুপ থাকার পন্থা নিচ্ছেন। যার থেকে বোঝা যায়, এই পর্বে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই তাদের পূজনীয়। তাই মুখ বন্ধ রাখুন।

কিরণ প্যাটেলের ঘটনাটি যখন মনের মধ্যে টাটকা, তখনই ঘটল অনুরূপ আরও একটি ঘটনা। এই নতুন নাটকের নতুন চরিত্রটি ছিলেন সঞ্জয় শেরপুরিয়া, যিনি উত্তরপ্রদেশ এসটিএফ দ্বারা গ্রেপ্তারের পরে সকলের কমবেশি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। পিএমও’র ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করার পর তার এনজিও যুব গ্রামীণ উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশনের জন্য ‘অনুদান’ হিসাবে বড় শিল্পপতিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। এই এনজিও’র উপদেষ্টা বোর্ডে অবসরপ্রাপ্ত আইএএস, আইপিএস এবং প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সাথে তার ছবি দেখিয়ে তাদের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে গর্ব করেন। সঞ্জয় দৈনিক ভাস্কর ও অমর উজালার মতো দৈনিকে কলাম লেখেন। গ্রেপ্তারের পর টেলিভিশনের সাংবাদিকদের কাছে তাঁর বই উপস্থাপনের ছবি ভাইরাল হয়। তিনি একটি বই লিখেছেন ‘দিব্য দৃষ্টি মোদী’ (মোদির ঐশ্বরিক দৃষ্টি)। ২০১৯ সালে বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী প্রচারের অংশ ছিলেন! এমনকি সিবিআই’এর আধিকারিকরা যারা সুবিধামতো ট্রান্সফার-পোস্টিং চান তারা ‘শীর্ষ নেতৃত্বের’ সামনে তাদের নাম সুপারিশ করার জন্য সঞ্জয়ের কাছে যেতেন এবং কর্মীদের দাবি অনুযায়ী তিনি সর্বদা সহায়ক ছিলেন! সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে এসটিএফ জানিয়েছে যে, এই মামলাটি এখন আইবি এবং ইডি দ্বারা তদন্ত করা হচ্ছে। শীর্ষস্থানীয় এজেন্সিগুলোকে ঠগী-বৃত্তির খোলা ও বন্ধ কেসগুলো কেন দেওয়া হয়না তা কারও বোধগম্য নয়! একটা বিষয় স্পষ্ট যে এই মামলার সঙ্গে আরএসএস, বিজেপি এবং পিএমও’র কিছু স্পষ্ট যোগসূত্র রয়েছে!

২০২০ সালে দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাম এলাকায় গ্রেপ্তার হওয়া জম্বু কাশ্মীর পুলিশের ডিএসপি দবিন্দর সিং’এর নাম মানুষ হয়তো ভুলে গেছে। গ্রেপ্তারের সময় দবিন্দর সিং’এর সঙ্গে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত এবং লস্কর-ই-তৈবা ও হিজাবুল মুজাহিদিনের সঙ্গে যুক্ত দুই ব্যক্তি ছিলেন। দবিন্দর সিংয়ের গাড়ি থেকে দুটি একে-৪৭ রাইফেলও উদ্ধার করা হয়েছে। পার্লামেন্ট হামলা মামলায় উঠেছিল দবিন্দর সিংয়ের নাম। আফজাল গুরু, যাকে এই মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তার আইনজীবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে, বদগামের হুমহুমায় নিযুক্ত একজন ডিএসপি তাকে সংসদে হামলার সাথে জড়িত মোহাম্মদকে দিল্লীতে নিয়ে যেতে এবং একটি বাড়ি ও একটি গাড়ি কিনতে বাধ্য করেছিলেন। দবিন্দর সিং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন সিমের নম্বর ব্যবহার করতেন। গ্রেফতারের সময় তিনি গ্রেফতারকারী ডিআইজি’কে বলেছিলেন, “স্যার, এটা একটা খেলা। নষ্ট করবেন না।” সন্ত্রাসী যোগসাজশের সাথে একজন ডিএসপি কী খেলা খেলছিলেন স্ব-প্রস্তাবিত চরম জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে? আর কেন সেই খেলার সম্বন্ধে আমাদের কিছুই জানানো হল না? কেন দবিন্দর সিং’এর বিষয়টি ধীরে ধীরে স্মৃতির প্রান্তের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল? দেশপ্রেমের সার্টিফিকেটের স্বঘোষিত পরিবেশকদের ছাড়া আর কাকে আমরা এই প্রশ্নগুলো করব?

বিজ্ঞানী, পুলিশ অফিসার, ভুঁয়ো প্রশাসনিক অফিসার এবং দালাল ছাড়াও বিজেপির কিছু অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি পাকিস্তানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’এর জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭-তে মধ্যপ্রদেশ এটিএস ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের একজন ধ্রুব সাক্সেনা, ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার ভোপাল জেলার আইটি সেলের দায়িত্বশীল। এই জাতীয় দলের কর্মকর্তারা অন্যান্য দেশে সংবেদনশীল তথ্য সরবরাহ করে জাতীয় নিরাপত্তার সাথে আপোষ করেছে। এতকিছুর পরেও নির্লজ্জ বিজেপি নিজেদের সাচ্চা জাতীয়তাবাদী প্রমাণের জন্য চারিদিকে ঢাক পিটিয়ে চলেছে।

২০২১ সালে যখন একটি ক্রুজ জাহাজ কর্ডেলিয়া থেকে শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খানকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশিত হয়েছিল তখন মিডিয়া চাঞ্চল্য তৈরি করতে কোনও সময় ব্যয় করেনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ব্যুরোর জোনাল ডিরেক্টর সমীর ওয়াংখেড়েকে একজন নায়ক হিসেবে প্রজেক্ট করা হয়েছিল, যিনি চলচ্চিত্র শিল্পে মাদক ব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারেন।

প্রাক্তন নারকোটিক্স ব্যুরো অফিসার ওয়াংখেড়েকে মিডিয়া নায়ক বানানোর দু’বছর পর, তিনি এখন সরব। খবর সূত্রে জানা গেছে, ছেলের মুক্তির জন্য শাহরুখ খানের কাছে ২৫ কোটি টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন ওয়াংখেড়ে। ঘটনা জটিল হওয়ায় ওয়াংখেড়ে এখন সিবিআই তদন্তের মুখোমুখি।

এখানেই শেষ না! ওয়াংখেড়ের বিরুদ্ধে জমি, আবাসন এবং গয়না সহ তার পরিচিত আয়ের উৎসের তুলনায় অসম সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মালদ্বীপে তার বিদেশী সফর (যেখানে তিনি ৫৫ দিন ছিলেন) স্ক্যানারের আওতায় রয়েছে। তিনি দাবি করেছেন যে, বিদেশ ভ্রমণের জন্য তিনি মোট ৮.৭৫ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু রিপোর্টে উল্লিখিত টাকার পরিমাণে দেখা যাচ্ছে এই গন্তব্যগুলির শুধুমাত্র বিমান ভাড়া সমীর ওয়াংখেড়ের দেওয়া হিসেবের চেয়ে বেশি।

ওয়াংখেড়ে হয়তো মোদীর কাছ থেকেই এসব শিখেছেন, তাই এখন জাতীয়তাবাদী হওয়ার ঢাল সামনে রেখেছেন! তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন বলেছেন যে, তিনি একজন সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী-দেশপ্রেমী বলেই তাকে লক্ষ্য বানানো হচ্ছে। জাতি জানতে চায় — কেন মোদীজি এখনও তাকে জাতীয়তাবাদের সার্টিফিকেট দিয়ে আইনের হাত থেকে বাঁচাননি? কিন্তু এও ভাবার বিষয়; প্রদীপ কুরুলকারের মতো প্রত্যয়িত জাতীয়তাবাদীরা যখন আইনের সুরের মুখোমুখি হচ্ছেন তখন সমীর ওয়াংখেড়ে আর কে!

বিজেপি-আরএসএসের স্কুল থেকে শিক্ষা নেওয়া জাতীয়তাবাদীদের ক্রমবর্ধমান দেশবিরোধী কার্যকলাপ, যেমন দবিন্দর সিং থেকে কুরুলকর, দেখায় যে সার্টিফিকেটটি আসলে কী! প্রাক্তন RAW অফিসার বি রমনের ২০০৭ সালে প্রকাশিত বই ‘The Kaoboys of RAW’তে এই বিষয়ে কিছু মজার গল্প রয়েছে। ১৯৮৯ সালে যখন বিজেপি ভিপি সিং’এর নেতৃত্বে জনমোর্চাকে বাইরে থেকে সমর্থন দিয়েছিল, তখন তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’কে জম্বু ও কাশ্মীরে আরএসএস সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। যদিও রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং প্রাথমিকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তবে শেষমেশ প্রচণ্ড চাপের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করে এবং প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা তৈরি করতে জম্বুতে আরএসএসের সাথে একটি বৈঠক করে। ভিপি সিং এবং বিজেপির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় পরবর্তীকালে পরিকল্পনাটি বাতিল করা হয়েছিল। তবে এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, বিজেপি ক্ষমতায় না থাকলেও আরএসএস’কে সশস্ত্র করতে কত কী করতে পারে!

বর্তমানে বিজেপি ক্ষমতায় থাকার কারণে বি রমনের গল্পগুলি আমাদের কাছে এক একটি দুঃস্বপ্নের সতর্কবাণী হয়ে উঠেছে। আমরা যদি দবিন্দর সিং-প্রদীপ কুরুলকারের মতো ‘প্রত্যয়িত জাতীয়তাবাদী’দের দেশবিরোধী কার্যকলাপের দিকে তাকাই, তাহলেই আমরা ভারতে ঘনিয়ে আসা বিপদকে কাছ থেকে দেখতে পাব।

- ইন্দ্রেশ মাইখুরী,  
লিবারেশন, মে ২০২৩  
(ভাষান্তরঃ ত্রিয়াশা লাহিড়ী)

water-of-burigangaburiganga

নদীর পিঠও দেওয়ালে ঠেকে। তখন কোনো কোনো নদী হারিয়ে যায়। আবার কোনো কোনো নদী ঘুরে দাঁড়ায়। প্রশ্ন তোলে,

“...কি দেইনি তোমাদের — 
জলের জীবন, ইস্টিমার, 
পাল তোলা নাও, 
গাভীন রাত্রির ভাটিয়ালী, 
কুমারীর স্নান, 
শক্ত মাটির ভিটা, ঝিল, 
প্রশাখার বিস্তার।

তোমরা কি না ভাসাও — 
বস্তা বন্ধী লাশ, 
মৃত পশুর অণুজীব, 
গুম খুন ক্ষুধা 
ইত্যাদির দিনলিপি 
ট্রাকের মূত্র, জিঞ্জিরার জঙ্গল, অ্যাসিড।...”

এই কবিতার নদীটির নাম বুড়িগঙ্গা। বাংলাদেশে তার বাস। আমাদের রাজ্যেও নদীয়া জেলার চাকদহে রয়েছে আর একটি বুড়িগঙ্গা। তবে তা নদী নয়, খাল। তাতে কী? এই খালই তো চাকদার প্রাণ। কিন্তু বিগত বহু বছরের উদাসীনতায় নিষ্ঠুরতায় তারই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিন্তু মানুষ আর নদীর সখ্যতা আদিঅন্তহীন। কিছু মানুষ তাই এগিয়ে আসেন। হাত ধরেন বুড়িগঙ্গার। চিকিৎসার দাবি তোলেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দাবি পেশ হয়ে চলেছে। সেই দাবি অবশেষে মান্যতা পেলো। মে মাসের তীব্র দাবদাহের মধ্যেই মাটি খুঁড়ে তোলা হলুদ রঙের বিশাল মেশিন এসে হাজির। তারপর খালের বুকে জমা মাটি ঝপাঝপ কেটে তোলা। আর দেখতে না দেখতেই আবার ছলাৎ ছল। বুড়িগঙ্গার স্তব্ধ জল।

ভাগীরথী প্রবাহিণী প্রাচীন জনপদ চাকদহ। এই নদীতে যেখানে চূর্ণি নদী মিশেছে, সেই মোহনা থেকে বুড়িগঙ্গা খাল ৮ কিলোমিটার বয়ে গিয়ে মুকুন্দনগরে আবার ভাগীরথীতে মিশেছে। ফলে ভাগীরথীর চাপ যেমন কমেছে তেমনি বুড়িগঙ্গা হয়ে উঠেছে চাকদহ শহরের একমাত্র নিকাশি ব্যবস্থা। কিন্তু সংস্কারের অভাবে বুড়িগঙ্গা ভরাট হয়ে যাচ্ছিল, শহরের বর্জ্য, আবর্জনা, জঞ্জাল, প্লাস্টিকে। গজিয়ে উঠেছিল কচুরিপানার জঙ্গল। এভাবে একসময় ভাগিরথী থেকে ছিন্ন হয়ে গেলো এই জলধারা। ফলে চাকদার আবর্জনা আর ভাগীরথীতে পড়তে পারছিল না। আর এভাবেই বুড়িগঙ্গা মলমূত্র মৃত পচা প্রাণী ও অন্যান্য আবর্জনার স্তুপে ভরা এক বদ্ধ নালাতে পরিণত হয়েছিল। অথচ এই নদীই একসময় দুহাত ভরে ফসল দিয়েছে চাষিকে, মৎসজীবীদের নৌকো ভরে দিয়েছে কত না সব মাছ। জলজ প্রাণীদের আশ্রয় হয়েছে তার স্বচ্ছ বহমান জলধারা। একসময় এর তীরে বেশকিছু সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। যেমন আনন্দগঞ্জ। সেখানে নদীবন্দরকে কেন্দ্র করে নৌবাণিজ্য চলত বছরভর। ছিল প্রসিদ্ধ নৌশিল্পাঞ্চলও। কত রকমের মেলা বসেছে তখন। গনেশজননীর মেলা, চড়ক মেলা, হাজরা উৎসব। গ্রামের মানুষের জীবনে তখন ছিল কত না রঙ। কিন্তু যার উপরে এত জীবনের ভার তার নিয়মিত সংস্কারের ব্যবস্থা হচ্ছে না। অগভীর খাতে চর জেগে উঠছে। সেই চর বিক্রিও হয়েছে। কিন্তু চাষিরা “লাঙল যার জমি তার” দাবি তুলে, জমির অধিকার অর্জন করেন। রাস্তার ধারে জমা জলে পাট পচাতেন পাট চাষিরা। তাও দখল করে দোকান দাঁড়িয়ে গেল। এভাবে এখানে ওখানে ভরাট হওয়া চলতেই লাগল। তার মাঝে মাঝে জলস্রোতও থমকে গেল। জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ভগ্নাংশে নেমে গেল। মাছ সহ জলজ জীবকূল মরতে লাগল। বৃষ্টি হলেই দুকূল ছাপিয়ে বিষাক্ত জল জমিতে পড়ল। চাষিদের চাষ মাথায় উঠল। মৎসজীবীরা হলেন রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক। বা পরিযায়ী উড়ান দিলেন ভিনরাজ্যে। বিপদের উপর বিপদ। বলাগড়ে গঙ্গার চরে সিইএসসি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিল। তা থেকে নির্গত কার্বনে ফসল ও মাছচাষ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগল। চাকদার জলে আবার আর্সেনিক প্রবণতা। ওই বিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে সেই জল শোধন প্রকল্পও বাধাপ্রাপ্ত হল। প্রতিবাদে সে প্রকল্প বন্ধ হল শেষমেশ। ওদিকে জল জমা শুরু হল চাকদা শহরাঞ্চলে। নাগরিকদেরও সেই জল নাকানি-চোবানি খাওয়াতে লাগল।

৬০-৭০’র দশক থেকেই বুড়িগঙ্গা এভাবেই ক্রমশ রুদ্ধ গতির শিকার হয়ে চলেছে। ২০০৪ সালের বন্যায় বাস্তুহারা মানুষের দুর্দশা চাকদাবাসীর চোখ খুলে দেয়। বাম আমলে সুনীল চন্দ্র দাস, অজয় নন্দী, বিপুল রঞ্জন সরকার, অভয় বিশ্বাস, নন্দদুলাল বিশ্বাস সহ আরও কিছু বুদ্ধিজীবী মানুষ বুড়িগঙ্গার সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তাঁদের বেশিরভাগই আজ প্রয়াত। কিন্তু তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘চাকদহ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা’ বুড়িগঙ্গা বাঁচানোর লক্ষ্যে কর্মসূচি নিতে শুরু করে। স্থানীয় বহু বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষও সমবেত হলেন। কিন্তু আসলে নদীকে বাঁচাতে গেলে নদীর দুই পাড়ের মানুষ ও যারা নদীর উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করেন তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এ আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে না। তাই ক্রমে ক্রমে ৪০০ মৎসজীবী ও ১৫০০০ ব্যবসায়ীও যুক্ত হলেন।

এখন বহু কৃষকও তাদের সাথে পা মিলিয়েছেন। ২০১৪-১৫-তে এই আন্দোলন তীব্র মাত্রা পায়। সেমিনার, পথসভা, পোস্টারিং, পথনাটক, পদযাত্রা, সাইকেল মিছিল চলতে থাকে। সাথে বিডিও অফিস, সেচদপ্তর, জলসম্পদ দপ্তরের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে ও রাজ্যের মুখ্য সচিবের কাছে তাঁরা লিখিতভাবে তাদের দাবি পেশ করেন। ২০১৭-তে চাকদায় বিদ্যুৎ চুল্লী উদ্বোধন করেন তৎকালীন মন্ত্রী মুকুল রায়। তখন এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মাননীয় বিবর্তন ভট্টাচার্য মহাশয় তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “চুল্লী তো হল, অস্থি বিসর্জন কোথায় হবে? সেখানে যেতে তো তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়।” মুকুল রায় বলেন, “আমাকে তিনমাস সময় দিন”। ২০২২-এ ১০০০ লোকের সই নিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁরা জমা দেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে চাঁদা তুলে গ্রামবাসীরা খালের মাটি কাটা শুরু করেন। ইতিমধ্যে এই সংস্কারের দাবিতে ৩০ বছর গেছে বিবর্তনবাবুর। হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। ক্যামেরার সামনে তিনি বলেছেন, “আমার জীবন দিতে হলে দেবো, কিন্তু আন্দোলন ছাড়বো না।” এই নাছোড়বান্দা আন্দোলনই তো জিতে নেওয়ার পাসওয়ার্ড। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, “চাকদা থানার চিঁড়ের কল এলাকা থেকে তিন কিলোমিটার সংস্কারের জন্য ৩২ লক্ষ টাকা অনুমোদিত হয়েছে।” সেচদপ্তরের বাস্তুকার শ্রী স্বপন বিশ্বাস মহাশয় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আগামী মে মাস থেকে কাজ শুরু হবে”। স্বভাবতই এলাকার মানুষ খুশী।

বুড়িগঙ্গার সংস্কার হলে এলাকার ছবিটাই বদলে যাবে বলে মনে করেন শ্রী ভট্টাচার্য। স্তব্ধ স্রোত সচল হলে চাকদায় জল জমার সুরাহা হবে। শশ্মানঘাটেই অস্থি বিসর্জন দেওয়া যাবে। প্রবল বৃষ্টি বা জোয়ারের ফলে ভাঙন ও বন্যা রোধ হবে। মৎসজীবী, চাষি ও পাটচাষিরা তাদের জীবিকা ফিরে পাবেন। নেমে যাওয়া জলস্তর উঠে আসবে। বলাগড়ে নৌশিল্পে আসবে জোয়ার। জলপথে পর্যটন বৃদ্ধি পাবে। দুই তীরে পার্ক ও মেরিন ওয়াকিং’এর ব্যবস্থা হলে যা আরও বিকশিত হবে। বুড়িগঙ্গার জীববৈচিত্র্য উন্নত হলে সন্নিহিত এলাকাগুলির জীববৈচিত্র্যও উন্নত হবে। সবমিলিয়ে চাকদার এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে আবারও রঙ ছড়াবে। এই ঘনঘোর রাজনৈতিক সামাজিক দূর্যোগে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে এক স্বপ্ন সত্য হয়ে নেমে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। যা আরও একবার প্রমাণ করল আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।

- বর্ণালী রায় 
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শ্রী বিবর্তন ভট্টাচার্য। 
কবিতাঃ বুড়িগঙ্গার চোখে জল, কবি ইকবাল হোসেন বাল্মিকী)

===000===

খণ্ড-30
সংখ্যা-21