বিজেপি-শাসিত মণিপুরে উপজাতিদের নিরাপত্তাহীনতা ও জাতি হিংসা
BJP-ruled-manipur

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ কর্ণাটকে ভোট প্রচারে গিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছিলেন, কংগ্রেস জিতলেই নাকি দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে। আর বিজেপি-শাসিত মণিপুরেই বিস্ফোরণ ঘটলো ভয়ঙ্কর এক জাতি হিংসার, যার মধ্যে এক সুপরিকল্পিত দাঙ্গার সমস্ত চিহ্ন বর্তমান। কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোকে বলে থাকে ‘ডবল ইঞ্জিনের সরকার’। সেই ডবল ইঞ্জিন-চালিত মণিপুরে, কেন্দ্রীয় সরকার ৩৫৫ ধারার সাহায্যে ক্ষমতা হাতে নিয়ে ‘দেখামাত্র গুলি’র নির্দেশ জারি করেছে যেখানে মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে বলে খবর; হিংসা ছড়িয়ে যাচ্ছে রাজ্য রাজধানী ইম্ফল সহ পাহাড়ী অঞ্চল থেকে উপত্যকায়। এমনকি শীর্ষস্থানীয় উপজাতি আধিকারিক এবং নেতারাও গণরোষের আঁচ থেকে রেহাই পাননি। বেশ কয়েকটি চার্চ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। অনতি অতীতে রাজ্যটিতে তুলনামূলকভাবে যে স্থিতি বিরাজ করছিল, নির্মমভাবে তা খান খান হয়ে গেল।

হিংসা-দীর্ণ মণিপুর থেকে যে খবর আসছে, তা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করছে যে এটা শুধু আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ব্যাপার নয়, সেখানে মণিপুরের সংবেদনশীল সূক্ষ্ম সামাজিক কাঠামোয় ধরা পড়েছে অনেক গভীর ফাটল। সাম্প্রতিক পর্যায়ের হিংসার পিছনে অব্যবহিত কারণ হল মণিপুর হাইকোর্টের এক নির্দেশ, যেখানে রাজ্য সরকারকে মেইতেই জনগোষ্ঠীর উপজাতি তালিকাভুক্তির আবেদনকে সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের এই আদেশ এখন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। শীর্ষ আদালতের এক মৌখিক মন্তব্যে জানানো হয়েছে, কোনো জনগোষ্ঠীর উপজাতি তালিকাভুক্তির সুপারিশ করা কোনো হাইকোর্টের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু এটা খুব পরিষ্কার যে কেবল এই একটি বিষয় এমন ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহের জন্ম দিতে পারে না, আগাম কোনো পরিকল্পিত প্রস্তুতি ছাড়া। আর সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ অবশ্যই আমাদের মণিপুরের অন্তর্নিহিত পরিস্থিতির দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে। এমনকি বিজেপির উপজাতি জনগোষ্ঠী থেকে আসা বিধায়করাও জাতিগত নির্মূলীকরণ ও উৎখাতের অভিযান লাগাতার চালিয়ে যাওয়ার জন্য বীরেন্দ্র সিং সরকারকে দোষারোপ করছেন।

মেইতেই, যারা সর্বাংশে মণিপুরের প্রভাবশালী সম্প্রদায়, তাদের উপজাতি তালিকাভুক্তির দাবি স্বভাবতই কুকি, নাগা, মিজো এবং মণিপুরের অন্যান্য উপজাতির মানুষদের ক্ষুব্ধ করেছে। মেইতেই’দের উপজাতির মর্যাদা তাদের শুধু শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী করবে না, এই ভূখণ্ডে তাদের জমির অধিকারও দেবে যা বর্তমানে উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত। ঘটনা হল, উপজাতি সম্প্রদায়ের জমিগুলিকে সরকার সংরক্ষিত অথবা সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করায় উপজাতি মানুষজন তাদের জমির ঐতিহ্য ও পরম্পরাগত দখলীসত্ত্ব থেকে ইতিমধ্যেই বঞ্চিত হয়েছেন। হিল এরিয়া কমিটি, যেগুলির হাতে পাহাড়ী অঞ্চলের প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকার কথা, তাদের থেকে ক্রমাগত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

মণিপুরের উপজাতি সম্প্রদায়ের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও ক্রোধ নতুন করে বাড়িয়ে তুলেছে আরেকটি বিষয় — বিজেপি লাগাতার মণিপুরের জন্য অসম ধাঁচের এনআরসি’র কথা বলে চলেছে এবং মায়ানমারে প্রতিকূল পরিস্থিতির তাড়নায় যে উপজাতীয় শরণার্থীরা, পাশেই মণিপুরের পাহাড়ী অঞ্চলে উপজাতি সম্প্রদায়ের বসতিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। কুকিরা এবং মণিপুরের অন্যান্য উপজাতির মানুষেরা সীমান্তের ওপারে মায়ানমারে তাদের স্বজাতির মানুষদের সঙ্গে গোষ্ঠীগত বন্ধনে ও গভীর আত্মীয়তায় আবদ্ধ। তাই মণিপুরের বিজেপি সরকার যখন এই শরণার্থীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক নীতি নিয়েছে, মণিপুরের উপজাতি সম্প্রদায় যে তাদের অসহায় ভাই-বোনেদের প্রতি গভীর সহানুভূতি বোধ করবেন সেটাই স্বাভাবিক। মণিপুরে চার্চের ওপর আক্রমণে দেশের অন্যত্র সঙ্ঘ বাহিনীর খ্রিস্টান-বিরোধী, ধর্মান্তর-বিরোধী আগ্রাসী প্রচারের ছায়া স্পষ্ট। এই ঘটনায়, মণিপুরের উপজাতিদের বিচ্ছিন্ন ও প্রান্তিক করে তুলে ‘নিজ ভূমে পরবাসী’ তথা বহিষ্কার করার বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল।

বিজেপি দাবি করে তারা উত্তর পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে দায়বদ্ধ। আসলে তারা ‘অসমের রাজনীতি’র বর্মে নিজেদের সুরক্ষিত করে ফেলেছে — যে রাজনীতি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আর ‘পরিচয়কে’ নিজেদের ইচ্ছে ও প্রয়োজন মতো কাজে লাগানোর কারসাজির এক চতুর সমন্বয়। অসমের পর, দলটি দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে ত্রিপুরা ও মণিপুরে। মণিপুরে দলটির বিস্তার ঘটেছে প্রাথমিকভাবে উপত্যকাবাসী মেইতেই’দের মধ্যে। তবে বিজেপি তার বহুল ঢক্কানিনাদিত ‘পাহাড় চলো ২.০’ প্রচারাভিযানের আড়ালে উপজাতি সংযোগ প্রসারের নীতি অনুসরণের ছলনা করে চলেছে। জাতি হিংসার সাম্প্রতিক ভয়াবহতা উত্তর পূর্বাঞ্চল নিয়ে বিজেপির অশুভ ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণ উন্মোচিত করে ফেলেছে। উপজাতি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সাংবিধানিক অধিকার ও আশা আকাঙ্ক্ষার সুরক্ষা হচ্ছে উত্তর পূর্বাঞ্চলের শান্তি গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মূল শর্ত। আর বিজেপির হিন্দত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের অ্যাজেন্ডা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের জাতিসত্তাগুলির সূক্ষ্ম বুনটের গভীর অনুভূতিপ্রবণ উজ্জ্বল বহুবর্ণ সমাহারের উচ্ছল প্রাণময়তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে, উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির আগ্রাসী অ্যাজেন্ডা এবং ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের অশনি সংকেত আমাদের বুঝে নিতে হবে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৯-১৫ মে ২০২৩

খণ্ড-30
সংখ্যা-15