জর্জ ভবনের সভায় ধ্বনিত হল দেশ, গণতন্ত্র, সংবিধান বাঁচানোর আওয়াজ
democracy-constitution-was-heard

আয়োজক দুই সংগঠন উই দ্য পিপল অফ ইণ্ডিয়া এবং আইনজীবীদের সংগঠন আইলাজ গত কয়েক মাসে রাস্তায় নেমে গণতন্ত্র, দেশ এবং সংবিধানের সঙ্কটে উদ্বিগ্ন হয়ে পরপর ৬টি পথসভা করার পর এবার ৭ মে জর্জ ভবনে সভা করলেন। সমাজের সমস্ত স্তরে সচেতনতা ও সম্প্রীতির বাতাবরণ গড়ে তোলা ছিল উদ্দেশ্য। আর তার প্রেক্ষিত সবারই জানা। এই শাসনেই কর্পোরেট পুঁজিপতি আদানি বিশ্বের ৬০৯ নম্বর সম্পদশালী থেকে তিন নম্বরে এক অস্বাভাবিক হারে পৌঁছেছে। মূল্যবৃদ্ধি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। উচ্ছেদ হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ দলিত, গরীব, আদিবাসী। বেকারির হার ব্যাপক। বেসরকারিকরণের মাধ্যমে সার্বভৌম ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে হিমঘরে পাঠানো হচ্ছে। মিডিয়া এখন প্রায় সম্পূর্ণ গোদি মিডিয়া এবং রাষ্ট্র শাসকের নিয়ন্ত্রণে।

একটা দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল যেমন আগে ইহুদিদের ক্ষেত্রে হত। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া চালু হল। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা মানুষদের জন্য সিএএ চালু হতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে শাহীনবাগের মতো বিশাল আন্দোলন সংগঠিত হল। সেই ঐক্যের ভিত্তি ছিল সংবিধানের প্রস্তাবনা। কৃষি ব্যবস্থায় তিনটি কালা আইন প্রত্যাহার করার আন্দোলনেরও ভিত্তি ছিল সেই সংবিধানের প্রস্তাবনা। বিরোধী কন্ঠস্বর ও গণআন্দোলনের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে। দানবীয় আইনে প্রতিবাদীদের জেলে পচানো হচ্ছে। ভারতীয় সমাজের বর্ণময় বহুত্ববাদ অস্বীকার করে এক হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের মরিয়া চেষ্টা চলছে যা রামনবমীর সশস্ত্র ও সহিংস মিছিলে দেখা গেল। সাম্প্রদায়িক অস্থিরতায় এবং মানুষের ক্ষয় ক্ষতির সংবাদে পাওয়া গেল। বিনা বিচারে আটক, বুলডোজার এবং এনকাউন্টার হত্যা এখন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কথায়, সংবিধান এবং গণতন্ত্র বিপন্ন। দেশকে এদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। হিটলার যুগের হাইপার ন্যাশনালিস্ট মতাদর্শ, সংহতি কৌশল এবং গণহত্যার নীল নকশা থেকে শেখা পাঠে সজ্জিত ধর্মকে কাজে লাগানোর এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। এবং গণতন্ত্র সচেতন ঐক্যবদ্ধ মানুষই পারে তার মোকাবিলা করতে। সভা শুরু হয় নীতিশ রায়ের অনবদ্য গান দিয়ে।

সভা সঞ্চালনা করেন আইনজীবী সেলের দিবাকর ভট্টাচার্য। বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন আইপিএস নজরুল ইসলাম, কলকাতা হাই কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী সুজয় ভট্টাচার্য, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনিল নৌরিয়া, সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, সমাজ সংগঠক তায়েদুল ইসলাম, পরিবেশ কর্মী বিবর্তন ভট্টাচার্য, যাদবপুরের প্রাক্তন অধ্যাপক মৃদুল বোস, অধ্যাপক সৌম্য শাহিন প্রমুখ। বিশিষ্ট উপস্থিতি, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, ইমতিয়াজ আহমেদ মোল্লা, প্রদ্যোত নাথ, ডঃ বর্ণালী রায়, অধ্যাপক রবিউল ইস্লাম, কবি প্রদীপ নন্দী, অম্লান ভট্টাচার্য, আইনজীবী অভিজিৎ দত্ত, শৈবাল মুখার্জী, অমিতাভ সেনগুপ্ত প্রমুখ।

প্রথম বক্তা নজরুল ইসলাম উদাহরণ দিয়ে বলেন জরুরি অবস্থায় ও সিএএ বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। শেষোক্ত আইনের ১৪নং ধারায় সাম্যের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সমস্ত ধর্মের মধ্যে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের লোকেরা হবে অনুপ্রবেশকারী। বিচার ব্যবস্থার সর্ব স্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্য। আড়াই শতাংশ একই ধরনের পরিবার থেকে আগত। স্পষ্টত, রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ গণজাগরণের প্রয়োজন অনেকেই বললেন। বোলান গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, আক্রান্তকারী এবং আক্রান্ত প্রায়শই হত দরিদ্র। তিনি মন্তব্য করেন যে এধরনের সভার মুল্য তখনই হবে যখন সভা রাস্তায় প্রকাশ্যে হবে। সঞ্চালক তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন এর আগে ৬টা পথসভা হয়েছে। বক্তারা বর্তমান কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের সরকার একই গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন। গণতন্ত্রে সিপিএম বা কংগ্রেস কারো ভূমিকা খুব স্বচ্ছ ছিল না। এক সুবিধাবাদী বামপন্থা শেষের দিকে রাজত্ব করেছে। হাইকোর্টের আইনজীবী সুজয় ভট্টাচার্য বলেন, মানুষ রুখে না দাঁড়ালে শুধু বিচার ব্যবস্থার উপর ভরসা করে লাভ নেই। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনিল নৌরিয়া অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার মিডিয়াকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে ফলে মিডিয়ার উপর আর কোনো ভরসা নেই, বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। সৌম্য শাহিন হিন্দু মুসলিম বাইনারি অস্বীকার করে গণ আন্দোলন এবং অর্থনৈতিক শোষণ বেশি করে উন্মোচনের পক্ষপাতী। আলোচনা শেষে শপথ নেওয়া হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রচারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভুপেন হাজারিকার বিস্তীর্ণ দুপারে গেয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি করেন মীরা চতুর্বেদী।

- অসিত বরণ রায়

খণ্ড-30
সংখ্যা-14