‘ভূরকৌ ইপিল’ : সাঁওতালি শিক্ষার আসর বসল পান্ডুয়ায়
education-was-held-in-pandua

‘ভূরকৌ ইপিল’। ভোরের তারা — শুকতারা। ১৪ মে, পান্ডুয়ার তিন্না আদিবাসী পাড়ায় এই নামেই শুরু হল নতুন পাঠশালা — সাঁওতালি শিক্ষার আসর। আম, কাঁঠাল, যজ্ঞডুমুরের গাছের ছায়াঘন মুক্তাঙ্গনে পাঠশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্টজনেরা, বিশেষতঃ আদিবাসী সমাজের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রেমী মানুষ। অনুষ্ঠানের আনুপূর্বিক কাহিনী বলার আগে, প্রাসঙ্গিক কয়েকটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।

প্রাক স্বাধীনতা যুগে ব্রিটিশ প্রভুদের একান্ত অনুগত জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকদের অসংখ্য ছোট বড় বিদ্রোহ কৃষকদের সংগ্রামী চেতনা ও ঐক্যকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। যারফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাংলার কৃষকরা বিশেষত ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকরা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। আর কমিউনিস্ট পার্টির সান্নিধ্যে আসার পর বাংলার গরিব ভাগচাষি ও দরিদ্র কৃষকদের আন্দোলন নয়া ইতিহাস রচনা করে। ঐতিহাসিক সেই তেভাগা আন্দোলন আজও আমাদের ধ্রুবতারার মতো পথ চিনিয়ে দেয়। স্বাধীনতা উত্তরকালেও ভূমিহীন, গরিব ও ক্ষুদ্র কৃষকদের নেতৃত্বে খাস ও বেনামি জমি উদ্ধারের ছোট বড় সংগ্রামগুলি বৃদ্ধি পেয়ে এক সময় তীব্র বিষ্ফোরণ ঘটায়, সৃষ্টি হয় নকশালবাড়ির বিপ্লবী কৃষক অভ্যুত্থান। এ ইতিহাস মোটামুটি আমাদের সকলেরই জানা। এ’কথাও আমরা জানি, রাষ্ট্রবিরোধী একের পর এক ব্যাপক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তিই হল কৃষকদের সংগ্রামী জাগরণ বা অগণিত সংগ্রামী কৃষক।

কিন্তু বৃহৎ কৃষক সমাজের গঠন তো একমাত্রিক নয়। কৃষকদের মধ্যে রয়েছে নানা স্তর ও বিভিন্ন বর্গ। এক কথায়, পশ্চিমবাংলার কৃষক সমাজ অত্যন্ত বর্ণময়। আক্ষরিক অর্থেই, কৃষকদের এক বড় অংশের মধ্যেই রয়েছে বর্ণভেদ। উচ্চবর্ণের কৃষকরা অধিকাংশই ধনী ও সচ্ছল। নিম্নবর্ণের ক্ষুদ্র কৃষকরাই হাল চাষ করে আমাদের খাদ্য জোগান। আর তাঁদেরও নিচের ধাপে রয়েছেন দলিতরা — যাদের অধিকাংশই ভূমিহীন কৃষিমজুর, ঠিকা প্রথায় যারা মরশুম ভিত্তিতে ফসল চাষও করে থাকেন। সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের অধিকাংশই কৃষিজীবী। তাঁদের নিচের স্তরের অংশগুলি আর দলিত সম্প্রদায়ের ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক ও খেতমজুররাই সমস্ত কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিতে থেকেছেন। আর এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামের সামনের সারিতে থেকেছেন লক্ষ লক্ষ আদিবাসী কৃষক ও কৃষিমজুর। আমাদের পার্টির গণভিত্তি মূলত দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এই গ্রামীণ গরিবদের দ্বারাই পুষ্ট হয়েছে। আমাদের অগ্রণী, সংগঠক কমরেডরা দশকের পর দশক ধরে এদের মধ্যে পড়ে থেকেই কাজ করেন। তাঁদের জীবনচর্যা, লোক উৎসব, পালা পার্বণের সঙ্গে কমরেডরা নিজেদের অনেকাংশেই জড়িয়ে নিয়েছেন। তবু এই একাত্ম হওয়ার পথে আজও অনেক ফাঁক থেকে গেছে। যেমন আমরা বাংলায় কথা বলি। কিন্তু আদিবাসীদের ভাষা, সাঁওতালি ভাষা আমরা খুব কম জনেই জানি। একসাথে মিছিলে হাঁটি, মিটিংয়ে যাচ্ছি। তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষায় কথা বলছেন। আমরা প্রায় কিছুই বুঝছি না। মনে হয়, “এত কাছে, তবু বহু দূরে”। এই বেড়া ভাঙ্গবার জন্যই আমরা সাঁওতালি শিক্ষার পাঠশালা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই। এরফলে তাঁদের সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ যেমন বাড়বে তেমনই বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে সাঁওতালি সাহিত্য-সংস্কৃতিরও আত্মীয়তা গড়ে উঠবে আরও সাবলীলভাবে।

বেলা সাড়ে এগারোটা। পাঠশালা আরম্ভের ঘোষিত সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সাঁওতালি ভাষায় পঠন পাঠনের মুখ্য সঞ্চালক, বিভিন্ন ভাষায় সুপণ্ডিত অসিত বরণ রায় কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। কী দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত? ঠিক তখনই দেখা গেল, পার্শ্ববর্তী আদিবাসী ক্লাব থেকে বেঞ্চ বয়ে নিয়ে আসছেন এক যুবক। তিনি আর কেউ নন, স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক শ্রী উদয় মান্ডি স্বয়ং। চেয়ার, বেঞ্চ সাজাতে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল অয়ন্তিকা, আদিত্য, অনীতা, নন্দিতা, পৃথ্বিরাজের মতো আদিবাসী কিশোর কিশোরীরা। অসিতদার মুখে হাসি ফুটল। তাঁর সঙ্গে আসা ফরাসি কবি বের্নার সিন্তেজও চনমনে হয়ে উঠলেন। ক্রমে ক্রমে উপস্থিত হলেন আমাদের দুই মাননীয় অতিথি তথা শিক্ষক শ্রী লক্ষ্মণ হাঁসদা ও শ্রী দাশু মান্ডি। এসে পৌঁছলেন আয়ারলা’র দুই সুপরিচিত নেতা সজল অধিকারী ও নিরঞ্জন বাগ। এসে হাজির এআইকেএম নেতা বিনোদ আহির সহ আরও কয়েকজন। আজ অবশ্য তাঁরা কেবল কৃষিশ্রমিক নেতা বা কৃষক নেতা নন। তাঁরা আজ নতুন পাঠশালার শিক্ষার্থী। বেলা ঠিক বারোটায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠশালার সূচনা ঘটালেন আদিবাসী নেত্রী ময়না কিসকু। ইতিমধ্যে কুলিপুকুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অনেক আদিবাসী মহিলাও এই নতুন পাঠশালার উদ্বোধনপর্বে উৎসাহ দিতে এসে পড়েছেন। অসিতদা শুরু করলেন, “নোয়া দ চেত্ কানা? (এটা কী?) অয়ন্তিকা, অনীতা, নন্দিতা — তিন আদিবাসী কিশোরী উত্তর দিল, “নোয়া দ বাহা দারে কানা” (এটা ফুল গাছ)। প্রকৃতির পাঠশালায় গাছগাছালি, প্রাণীদের দেখিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে থাকল। ছাত্রছাত্রীরা সব খাতায় লিখে নিচ্ছেন। এক থেকে দশ অবধি সাঁওতালি ভাষায় সংখ্যা গোনাও শেখা হল। সবাই অত্যন্ত খুশী। অতিথি শিক্ষক লক্ষ্মণ হাঁসদা, দাশু মান্ডিরাও মাঝে মাঝে এই অনুশীলনে অংশ নিলেন। বেলা প্রায় দুটোয় প্রথম দিনের পাঠ শেষ হল। কেউ কেউ দাবি তুললেন, অলচিকিটাও শেখাতে হবে। আশ্বাস দেওয়া হল, ভবিষ্যতে সেটাও হবে। সকলে অঙ্গীকার করলেন, “সপ্তাহে একদিন করে এই ক্লাস চলতে থাকবে। তিন্না আদিবাসী পাড়ায় এই স্কুল যেমন চলতে থাকবে তেমনি অন্যত্রও ‘ভূরকৌ ইপিল’এর শাখা খোলা হবে।”

- মুকুল কুমার

খণ্ড-30
সংখ্যা-15