উত্তরপ্রদেশ : রাস্তায় নমাজ পড়াকেই করা হল এফআইআর’এর ভিত্তি
pray-on-the-street

যোগী আদিত্যনাথের মুসলিম বিদ্বেষ এতই সুবিদিত যে নতুন করে তার উল্লেখ না করলেও চলবে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার অঙ্গীকারের সাথে সাথে মুসলিম-বিরোধী বিষোদগারও তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবেই করে এসেছেন। আর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে তিনি করে তুলেছেন তাঁর বৈষম্য ও উৎপীড়নের নিশানা। সম্প্রতি অতি সাধারণ একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ কানপুরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নামাল গণহামলা, এফআইআর দায়ের হলো প্রায় ১৮০০ অজ্ঞাতপরিচয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে। উপলক্ষটা ছিল ঈদের দিন কিছু মুসলিম মানুষের রাস্তায় নমাজ পড়া। আর সেটাই যোগী প্রশাসনের কাছে হয়ে দাঁড়াল গুরুতর অপরাধ। জাজমৌ থানা এলাকায় ৩০০, বাবুপুরওয়া থানা এলাকায় ৫০ এবং বাজারিয়া থানা এলাকায় প্রায় ১৫০০ অজ্ঞাতপরিচয় মানুষের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে। ভারতীয় দন্ডবিধির যে সমস্ত ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো হল ১৮৬ (সরকারি কাজে বাধাদান), ১৮৮ (১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জমায়েত), ২৮৩ (জমায়েতের মাধ্যমে রাস্তা অবরোধ) এবং ৩৪১ (অন্যায়ভাবে বাধাদান)। এই এফআইআর সাধারণ মুসলিম জনগণের মধ্যে যথেষ্ট আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, এফআইআর যেহেতু হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, পুলিশ তাই কোনো মানুষের পরিচিতি যাচাই না করেই তাদের তুলে নিয়ে যাবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অভিপ্রায় সেরকম হলে গ্রেপ্তারও করতে পারে। ঈদ অনুষ্ঠিত হয় ২২ এপ্রিল, আর পুলিশ এফআইআর দায়ের করে ২৬ এপ্রিল, অজ্ঞাতপরিচয় জনগণের সঙ্গে ঈদগাহ কমিটির বিরুদ্ধেও। প্রকাশিত সংবাদ থেকে আরও জানা গেছে, কানপুরের সঙ্গে আলিগড় এবং বাগপতেও একই ধরনের এফআইআর হয়েছে।

এফআইআর’এর সমর্থনে পুলিশ বলেছে, ঈদের আগে বৈঠক করে ঈদগাহ (ঈদের নমাজ পড়ার জন্য খোলা প্রশস্ত স্থান) এবং মসজিদের ভিতরই নমাজ পড়ার কথা বলা হয়েছিল, রাস্তায় নমাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জাজমৌ ঈদগাহ, বাবুপুরওয়া ঈদগাহ ও বাদি ঈদগাহ সংলগ্ন রাস্তায় নমাজ পড়া হয়েছিল, আর তাই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের জন্য পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার আনন্দ প্রকাশ তিওয়ারি জানিয়েছেন, “সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সাহায্যে আমরা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। তাদের চিহ্নিত করা হয়ে গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এখানে প্রশ্ন হল, নমাজ যদি রাস্তায় পড়া হয়ে থাকে তবে সবাই কি সেখানে নমাজ পড়েছিলেন, নাকি অল্পকিছু মানুষই সেখানে নমাজ পড়েছিলেন? তাঁরা কতক্ষণ রাস্তায় ছিলেন এবং তারজন্য কতটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে এবং কতজন মানুষের কতটা ক্ষতি হয়েছে? রাস্তায় নমাজ পড়ার মধ্যে রাস্তা বন্ধ করার অভিপ্রায় কি তাঁদের ছিল? মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা ও ভাষ্যকাররা জানিয়েছেন, অধিকাংশ মুসলিমই ঈদগা হতে ও মসজিদের ভেতরেই নমাজ পড়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ একটা মুহূর্তে অনেক মানুষ একসঙ্গে জড়ো হয়ে যান, এবং ঈদগাহ ও মসজিদের ভেতরে জায়গা না হওয়ায় তাঁরা রাস্তায় নমাজ পড়তে বাধ্য হন। এরজন্য রাস্তা বন্ধ হয়ে থাকতে পারে বড় জোর পাঁচ থেকে দশ মিনিট। চিত্রনাট্য রচয়িতা দারা ফারুকীর কথায়, “ঈদের মতো আনন্দের বিশেষ এক দিনে কেউই রাস্তায় নমাজ পড়তে চায় না। মুসলিমরা রাস্তায় নমাজ পড়তে চায় বলেই সেখানে নমাজ পড়ে না, রাস্তায় নমাজ পড়ে বাধ্য হয়ে।” আর নিরুপায় এই পরিস্থিতিতে রাস্তায় নমাজ পড়াটাকে পুলিশ মহা-অপরাধ ধরে নিয়ে দন্ডবিধির গোটাকয়েক কঠিন ধারা লাগিয়ে এফআইআর করল। উদ্দেশ্য, সজ্ঞানে স্বেচ্ছাকৃতভাবে রাস্তা অবরোধের অভিযোগে মুসলিম সম্প্রদায়ের হেনস্তা ঘটানো। পুলিশের এফআইআর দায়েরের এই পদক্ষেপ মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অপমান বোধের জন্ম দিয়েছে। মুসলিম ধর্মীয় নেতারা এফআইআর’এর বিরোধিতা করে সেগুলো তুলে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন এবং বলেছেন, “উৎসবের সময় এই ধরনের ঘটনা কখনো ঘটেনি, যে উৎসব শান্তি ও সম্প্রীতির লক্ষ্যেই পালিত হয়। এই এফআইআরগুলোর লক্ষ্য হলো সামাজিক বুনটকে ছিন্নভিন্ন করা। হয় এফআইআরগুলোকে তুলে নিতে হবে, অন্যথায় আমরা হাজার হাজার যে সমস্ত মানুষ সেদিন প্রার্থনা করেছিলাম তারা সবাই গ্রেপ্তার বরণ করব।”

যোগী জমানায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবেই মুসলিমদের জীবন ও জীবিকার ওপর আক্রমণ হানা হয়েছে — গোহত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, অন্য মাংস বিক্রি করলেও বিক্রেতাকে মারধর করা হয়েছে এবং এমনকি মুসলিমদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কটের আহ্বানও ঐ রাজ্যে বিরল নয়। সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদের সময় মুসলিম যুবকদের হত্যা এবং মুসলিম পাড়ায় গিয়ে পুলিশের মুসলিম বাড়িতে ঢুকে জিনিসপত্র ধ্বংস করাটাও ঐ রাজ্যে প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন হয়ে রয়েছে। আর লাভ-জিহাদকে করে তোলা হয়েছে মুসলিম যুবকদের উপর আক্রমণের এক হাতিয়ার, পুলিশের চালানো এনকাউন্টার ও বুলডোজার অভিযানের শিকারও বহু ক্ষেত্রেই হয়েছে মুসলিমরা। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ভিত্তিক অপরাধ বেড়ে চলেছে এবং উত্তরপ্রদেশে মুসলিম সম্প্রদায়কে অপরাধ সংঘটকের গ্যাং’এর সঙ্গে একাকার করে তোলার প্রচেষ্টাও জোরালোভাবেই জারি রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে তাঁর শুভেচ্ছা বার্তায় নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে অভিনন্দন। আমাদের সমাজে সম্প্রীতি ও সহানুভূতির স্পিরিটের বৃদ্ধি হোক। আমি সবার সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ কামনা করছি। ঈদ মুবারক।” মুখে যা বলা বাস্তবে তার বিপরীতটা করাই বিজেপির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। আর তাই মোদী যখন ঈদ উপলক্ষে সামাজিক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহানুভূতির কথা বলবেন, তখন তাঁর দলের অপর এক শক্তিশালী নেতা যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন যে ঈদের নমাজ পড়াকে কেন্দ্র করেই মুসলিমদের হয়রানি ঘটাতে, তাদের অপদস্থ করতে ফন্দি আঁটবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কি থাকতে পারে!

খণ্ড-30
সংখ্যা-14