সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত প্রায় ৭ বছর ধরে নিয়োজিত ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বাতিল ঘোষণা হল। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, অনিয়ম প্রভৃতি নিয়ে গত কয়েকবছর ধরেই মামলা, তদন্ত, নগদ উদ্ধার, জেল জরিমানা সবই চলছে। রাজ্যের মন্ত্রী, আমলা, নেতা জেলবন্দি। শেষ পদক্ষেপ হল, গোটা নিয়োগটাই প্রায় বাতিল।
কিন্তু, মামলায় বঞ্চিত ও সরকারপক্ষ সকলের কথা শোনা হয়েছে। চাকরি প্রাপকদের কথা কি শোনা হল? একথা কেউই বলতে পারেননা যে, বাতিল সমস্ত শিক্ষকই অযোগ্য বা বেআইনি পথে চাকরি পেয়েছেন?
তাহলে, শাস্তি ঘোষণার আগে এমনকি ফাঁসির আসামির কথা যদি শোনা যায়, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা কেন শোনা হল না?
প্রথমত, সংরক্ষণ বিধি যদি না মানা হয় তবে বঞ্চিতদের থেকে বর্তমান শূন্যপদে সেই নিয়োগ হতেই পারত।
দ্বিতীয়ত, অপ্রশিক্ষিত নিয়োগকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা কমিশন (NCERT) স্বীকৃতি দিয়েই তো ২০১৬ সালে নির্দেশ জারি করে ২০১৯ পর্যন্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ চাকুরীরত শিক্ষকদের দেওয়া হয়। বর্তমানে কর্মরত কোনো শিক্ষকই অপ্রশিক্ষিত নেই।
তৃতীয়ত, যারা সব যোগ্যতার ঊর্ধে শুধু দুর্নীতির যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন, তাদের বিছিন্ন করে বরখাস্ত করা যেতই। এবং সেটা রাজ্য সরকারের ঘোষিত নিয়োগ মাপকাঠির বিচারেই করা যেত।
বিরাট সংখ্যক শিক্ষক যারা বৈধভাবে সরকারি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে চাকরি পেয়েছেন, তারা কেন হয়রানির শিকার হবেন?
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যা কিছু বেনিয়ম তার দায় শিক্ষা দফতরকে বহন করতে হবে। একথা বলার চেষ্টা হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষকদের নতুন করে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে, নয়তো ছাঁটাই। এটা নিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন। কর্মচারীর গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ। কোনো নতুন শর্তের দ্বারা পুরোনো শর্ত বাতিল করা যায় না। তাহলে, যেকোনো কর্মরত সরকারী কর্মচারীর নিয়োগ প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে বর্তমানে তাকে পুনরায় যোগ্যতা প্রমাণের পরীক্ষা দিতে হতে পারে। যেটা ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে বাধ্য।
প্রশ্নটা চাকুরিরত শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রতি দয়াদাক্ষিণ্য নয়, তাদের আইনি, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন। এই প্রশ্নেই আইনি ও রাস্তার লড়াই করে রাজ্যের শিক্ষক সমাজকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
রাজ্যের সামগ্রিক সরকারি শিক্ষা-কাঠামো এক সংকটের মধ্যে। ইতিমধ্যেই ৮৭০২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় তুলে দেবার কথা শোনা যাচ্ছে। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় দেখা গেল, ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। এই পরিণতির উৎস কোথায়? দীর্ঘদিন বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, পরিকাঠামোর অভাব ছাড়াও বাংলার শ্রমজীবীদের ভয়ঙ্কর আর্থিক সংকট অন্যতম। রাজ্য সরকারের সিলেবাস কমিটি যেখানে শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষকের সুপারিশ করে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের ৩০:১ অনুপাত কিভাবে রাজ্য মেনে নেয়? এই অনুপাত হতে পারে সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে। কিন্তু, বিদ্যালয়গুলোতে নূন্যতম শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষক ছাড়া চলতে পারে?
এই নীতিমালা পূরণ করতে হলেই রাজ্যের বর্তমান প্রশিক্ষিত বড় অংশ নিয়োগ হতে পারে।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা কেবল পদ্ধতিগত নয়, দৃষ্টিভঙ্গিগত। রাজ্যের সামগ্রিক বিদ্যালয় শিক্ষাকে জনমুখী করতে যে আন্তরিক উদ্যোগ প্রয়োজন তারই সংকট। কেবল ৬০০ টাকার জুতো, জামা দিয়ে স্কুলছুট যে ঠেকানো সম্ভব নয় তা আমরা দেখছি।
পরিশেষে, বর্তমান শিক্ষক ছাঁটাই এক সামগ্রিক সরকারি শিক্ষা সংকট হিসাবেই দেখতে হবে। শিক্ষার অধিকার, শিক্ষকের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে আসুন জোট বাঁধি।
- অজয় বসাক