২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ক্রমেই সরগরম হয়ে উঠছে। নির্বাচনী আবহে এখন থেকেই শুরু হয়েছে কোন দল কত আসন জয়লাভ করবে, তা নিয়ে জল্পনা ও নানান হিসাব নিকেষ। তূণমূল কংগ্রেস জনগণের কাছে আবেদন করছে ৪০টি আসনে জয়ী না করলে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে থেকে দাবি-দাওয়া আদায় করা যাবে না, কেন্দ্রীয় সরকারে বিরুদ্ধে চাপও দেওয়া যাবে না। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনে জমি তৈরির লক্ষ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে হাতিয়ার করতে বিজেপি এবং তূণমূল কংগ্রেস উভয় শাসক পার্টি সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্র সহ তৃণমূল সরকারের আপাদমস্তক দুর্নীতি আজ রাজ্য রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। আর সেই সুযোগ নিয়ে বিজেপি সিবিআই, ইডি’কে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের শাসকদল ও তার নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমেছে। বাংলায় বিজেপি তার সমস্ত ধরনের সংগঠনকে যেমন, আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, এবং ধর্মীয় উৎসব প্রভৃতিকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের লক্ষ্যে খুব সক্রিয় হয়ে নেমে গেছে ময়দানে। বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে থাকার সুবাদে আরএসএস’এর শাখা এরাজ্যে বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি ধর্মীয় উৎসবকে কাজে লাগিয়ে হাওড়া ও হুগলি জেলায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি ও সামাজিক বিভাজন তৈরি করার ঘৃণ্য খেলায় নামে। উত্তর দিনাজপুর জেলায় কালিগঞ্জে একটি দুঃখজনক প্রেম ঘটিত বিষয়কে মূলধন করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ব্যাপক নৈরাজ্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করে বিজেপি। ঘটনাস্থলে শাসক পার্টির পঞ্চায়েত প্রধানের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। স্থানীয় দুই সাংসদ ও বিজেপির অন্যান্য নেতারাও সরাসরি ইন্ধন যুগিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদকে অবজ্ঞা করে নিজের মুঠোয় সমস্ত ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার নোংরা খেলায় নেমেছে মোদী সরকার। আর, এই কাজে তার সহযোগী হয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে এই ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা হচ্ছে। ২০২১ সালে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতার আসার দিবাস্বপ্ন দেখায়। কিন্তু, বাংলার জনগণ তাকে বেশ ধাক্কা দিয়েছিল। কর্নাটকের নির্বাচন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে, মোদী-বিজেপি বিরোধী গণরায় সারা দেশের জনগণ ও বিরোধী শক্তিকে ২০২৪’র জন্য শক্তি বৃদ্ধি করতে সুযোগ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে এই পরিবেশকে আমাদের পার্টি ও সমস্ত গণসংগঠনকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হতে হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনকে বিচার করতে হবে।
২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচন বাংলার জনগণের কাছে অনেক নেতিবাচক শিক্ষা নিয়ে হাজির হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় শাসক দলের দখলে আসন সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পরিবেশ এবং পুলিশের গুলিতে কোচবিহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছিল। সংবিধানের নিয়মকানুন না মেনে খোলা মঞ্চে হুমকি, খুনের বার্তা, কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নির্বাচন করা প্রভৃতি প্রচার করেও বিজেপি ফলাফলে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি। কাজেই ২০২৩’র পঞ্চায়েত নির্বাচন বিরোধী শক্তির কাছে দু’দিক থেকেই এক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসাবে সামনে আসছে।
একদিকে বিজেপি সরকার অন্যদিকে তূণমূল কংগ্রেসের শাসনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করেই পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের রাজ্যের ১০০ দিনের কাজের অর্থ আটকে রেখেছে, বকেয়া মজুরিও পরিশোধ করেনি। কেন্দ্রীয় বাজেটে টাকাও কমিয়ে ১০০ দিনের প্রকল্পকে ১৭ দিনে নামিয়ে আনা হল। প্রতিহিংসা পরায়ণ বিজেপি সরকারের মনোভাব হচ্ছে ‘হাতে মারা ও ভাতেও মারা’র কৌশল। বিজেপির ফ্যাসিবাদি রাজনীতি যেমন পরাস্ত করতে হবে, তেমনি ১০০ দিনের কাজ ও মজুরি এরাজ্যে আটকে রাখার বিরুদ্ধে আমাদের জোরাল আওয়াজ তুলতে হবে। রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত পরিচালনার সাথে বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকারগুলির মধ্যে ফারাক টানা মুশকিল। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে বা সরিয়ে আমলা বা পার্টি নেতারাই আজ মুরুব্বি ও সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই পঞ্চায়েতে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না, গ্রাম সংসদের কাছে হিসাব পেশ করার কোনো নিয়মনীতি চালু নেই। বিধবা ভাতা, বয়স্কদের পেনশন, বা আবাস যোজনা পাওয়ার ক্ষেত্রে কাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে সে সব ক্ষেত্রে বিচার বিবেচনা বা মতামত সংগ্রহ করা হয় না। অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে পঞ্চায়েত পরিচালনা করার পদ্ধতিই নেই। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা হল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু এই ব্যবস্থাকে সব রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার নিজ নিজ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে অর্থবল, বাহুবল ও প্রশাসনকে কাজে লাগায়। পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই। স্বাভাবিক ভাবে গ্রামে গ্রামে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ গড়ে উঠে। বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে যাদের হাতে রাজনৈতিক দলের সরকার রয়েছে তাদের পক্ষেই ফলাফল যায়। পঞ্চায়েত জনগণের কাছে হিসাব নিকাশ জমা দেয়না। এই অভিযোগ বিস্তর। আমাদের অবশ্যই পঞ্চায়েতের হিসাব জনগণের কাছে তুলে ধরবার আওয়াজ তুলতে হবে। বাংলার শাসককে কাঠগড়ায় তুলে প্রচার সংগঠিত করতে হবে। আমাদের বামপন্থী শক্তির সাথে আসন সমঝোতা করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসাবে নিজেদের জায়গা করে উঠতে না পারে। বিজেপি ইতিমধ্যে নিজেকে মূল বিরোধী শক্তি হিসাবে তুলে ধরে সব ধরনের শক্তিকে জোটবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিয়েছে। এমনকি সংখ্যালঘু এলাকায় লোকসভা নির্বাচনের কথা ভেবে সেই কাজে জোর দিচ্ছে। গ্রামবাংলায় যাতে বামপন্থীরা কোন জায়গা না পায় সেটাও তাদের লক্ষ্য। তাতে আমাদের বন্ধুরা অনেকাংশে বিভ্রান্ত। আমাদের সেই অবস্থান থেকে তাদের সরাতে হবে। তূণমূল কংগ্রেস বিরোধী প্রধান শক্তি হিসাবে বিজেপি নিজেকে তুলে ধরে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের পার্টি ও সমস্ত গণসংগঠনকে বিজেপির এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। আদিবাসী ও সংখ্যালঘু এলাকায় এবং তার সাথে রাজবংশী জনগণের মধ্যে বিজেপি এবং তার সমস্ত শাখা সংগঠনকে রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণের জন্য উদ্যোগী করে তুলেছে। এই প্রশ্নে আমাদের বুথগুলিকে, পার্টি ব্রাঞ্চ, লোকাল কমিটিগুলিকে সচেতন করার চেষ্টা করতে হবে। ত্রিস্তর পর্যায়ে এই নজরদারী দরকার। আমাদের কাজের অবস্থা অনুযায়ী বেশিরভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে আমরা জোর দিই কিন্তু রাজনৈতিক বোঝাপড়া ব্লক ও জেলা পরিষদে হয়। এখন থেকে আমাদের সেই দিকটা নজর দিতে হবে। কাজেই এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজনৈতিক দিকটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন থেকেই সেই সমস্ত দিক মাথায় রেখে আমাদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
- কার্তিক পাল