রাজ্যজুড়ে প্রায় সর্বত্রই পালিত হল মহান মে দিবস। সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলা, কলে কারখানার গেটে, রিক্সা অটো টোটো স্ট্যান্ডে, জনবহুল রাস্তার মোড়ে, চা বাগিচায়, ইউনিয়ন অফিসগুলোতে এআইসিসিটিইউ, সিপিআই(এমএল) পালন করল এই মহান দিনটি। রাজ্য পার্টির সদর দপ্তরেও ট্রেড ইউনিয়ন ও পার্টির নেতৃবৃন্দ পতাকা উত্তোলন করেন।
কলকাতায় প্রতিবছরের মতো (ব্যতিক্রম শুধু ছিল কোভিড কালের দু’টো বছর) এবারও বামপন্থী কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যুক্ত জনসভা সংগঠিত হল শহিদ মিনার পাদদেশে। ব্যানার ফেস্টুনে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত শহিদ মিনারের সভার শুরুতে সিটুর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু যুক্ত আহ্বান পত্রটি পাঠ করেন।
প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়, এ’বছর ভারতে মে দিবসের শততম বর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। প্রথম এদেশে, ১৯২৩ সালে, এম সিঙ্গারাভেলু চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচে লাল পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। বিশ্বজুড়ে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের চাকরি, মজুরি, কাজের শর্তাবলী, অর্জিত অধিকার এবং কষ্টার্জিত মৌলিক অধিকারের ওপর শাসক শ্রেণির আক্রমণের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালাচ্ছেন, তার প্রতি সংগ্রামী সংহতি জানানো হয়। জনগণের জীবন-জীবিকার উপর নেমে আসা ক্রমবর্ধমান দুর্দশা, তীব্র বেকারত্ব, সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থহীন করে ফেলা, আদানির সাথে সরকার ও রাষ্ট্রের গভীর আঁতাত, নানা এজেন্সি দিয়ে বিরোধীদের হয়রানি প্রভৃতির পাশাপাশি শ্রমিকদের সমস্ত অর্জিত অধিকারগুলো হরণ করা আর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরানোর আরএসএস-বিজেপির চক্রান্তকে উন্মোচিত করা হয়। মোদী সরকারকে পরাস্ত করে দেশ ও গণতন্ত্রকে বাঁচানোর আবেদন রাখা হয় এই সম্মিলিত মঞ্চের পক্ষ থেকে।
প্রস্তাবনার পক্ষে বক্তব্য রাখেন সিটু’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, ইউটিইউসি’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অশোক ঘোষ, এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
৩০ জানুয়ারি ২০২৩-এ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যুক্ত কনভেনশনে গৃহীত কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে এবং আগামী ৯ আগস্ট কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকে কলকাতায় রাণী রাসমনি রোডে যে মহাধর্ণা হবে তাকে সর্বাত্মকভাবে সফল করার আহ্বান এই সভা থেকে রাখা হয়।
ভারতে মে দিবস পালনের শতবর্ষে হুগলি জেলার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিকদের উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়। উৎসবমুখর শ্রমিকদের নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মধ্যে মে দিবসের তাৎপর্য অনুধাবন করা, আজকের কঠিন সময় পেড়িয়ে যেতে লড়াই ও মে দিবসের শহিদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলার শপথ গ্রহণ ছিল প্রধান দিক। এঙ্গাস জুট শিল্পের শ্রমিকেরা বিসিএমএফের ব্যানারে মিল গেটে কর্মসূচি পালন করেন। জমজমাট মিল গেটে লাল পতাকা উত্তোলন, শহিদ স্মরণ সহ সমগ্র কর্মসূচি উপস্থিত মেহনতি মানুষদের নজর কাড়ে! জয়শ্রী টেক্সটাইলের কর্মসূচিও ছিল রঙিন ও প্রাণবন্ত। কারখানার গেট সংলগ্ন তারের বেড়াজাল ভরে উঠেছিল লাল পতাকায়। গোটা কর্মসূচিতে ইউনিয়নের সাধারণ সদস্য ও তরুণ প্রজন্মের সংগঠকদের উৎসাহ অনুভূত হয়। হিন্দমোটর ইটখোলা মোড়ে নির্মাণ শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দিনটি উদযাপিত হয়। এখানে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন মহিলা নির্মাণ শ্রমিক কমরেড মঞ্জু ওঁরাও। কোন্নগর চলচ্চিত্রম মোড়ে যথাযথ মর্যাদায় দিনটি পালন করা হয়। অসংগঠিত শ্রমিক ও স্থানীয় পার্টি কর্মীরা এখানে উপস্থিত ছিলেন। চুঁচুড়ায় কাজ হারানো পরিবহন শ্রমিকেরা রক্ত পতাকার সামনে আগামী লড়াইয়ের শপথ নেন। প্রত্যেক বছরের মতো এবছরেও অসংগঠিত শ্রমিক অধ্যূষিত জিটি রোড সংলগ্ন ব্যান্ডেল নেতাজি পার্কে মে দিবসের কর্মসূচি পালিত হয়, এখানে পতাকা উত্তোলন করেন নির্মাণ শ্রমিক গোপাল পাল। হুগলির গ্রামাঞ্চলে পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচি ও ইলছোবায় গ্রামীণ মেহনতি মানুষদের উপস্থিতিতে পার্টির পক্ষ থেকে মে দিবস উদযাপিত হয়।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর বিষ্ণুপুর পৌরসভার সামনে মে দিবসে শহীদ স্মরণ ও রক্ত পতাকা উত্তোলন হ’ল।
বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ও এআইসিসিটিইউ’র উদ্যোগে পৌরসভার সামনে প্রায় দুই শতাধিক সাফাইকর্মীরা উপস্থিত থেকে মহান মে দিবসে শহীদ স্মরণ ও রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলন করেছেন বর্ষীয়ান (৬০ ঊর্ধ্ব), এখনও কর্মরত সাফাই মজদুর কমরেড নেপাল বাউরী।
১ মে সমস্ত দপ্তরে ছুটি, কিন্তু পৌর সাফাইকর্মীদের ছুটি নেই। তারা বেরিয়ে পরেছে শহরকে আবর্জনামুক্ত করতে। এই সাফাইকর্মীরাই যখন নিজেদের দাবি আদায়ের লড়াইয়ে একদিনের ধর্মঘটে কাজ বন্ধ করেছিল, তার পরের মাসে প্রত্যেকের বেতনের থেকে একদিনের টাকা কেটে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তায় সরকার ঘোষিত দৈনিক ৩৭৬ টাকা মজুরি চালুর দাবিতে, পিএফ-পেনশন চালুর দাবিতে এবং শ্রমিক হিসাবে ন্যয্য মর্যাদার দাবিতে সর্বোপরি পুঁজিবাদের শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের লড়াই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে শ্রমিক ঐক্য দৃঢ় করার অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। আগামীতে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের লড়াই আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সম্পাদক দিলবার খান।
কলকাতায় যাদবপুর-ঢাকুরিয়া আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে ৩ জায়গায় (গাঙ্গুলি পুকুর, গড়ফা, সুপার মার্কেট) এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটি কন্ট্রাক্ট কর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মে দিবস উদযাপন করা হয়।
বাঘাযতিন-গড়িয়া-বাশঁদ্রোণী আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে ২ জায়গায় (সূর্য সেন মেট্রো, গড়িয়া) মে দিবস উদযাপন করা হয়।
কালীঘাটে ১ জায়গায় মে দিবস উদযাপন করা হয়।
পূর্ব-মধ্য কলকাতা আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে ২ জায়গায় (বিরসূল হাটে মাইক সহযোগে সভা হয় এবং মৌলালী সদর দপ্তরের সামনে) মে দিবস উদযাপন করা হয়।
বেহালা আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে ৩ জায়গায় রবীন্দ্র নগর, সরশুনা, কালীতলায় মে দিবস উদযাপন করা হয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মে দিবস
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদবপুর ও সল্টলেক দুই ক্যাম্পাসেই ‘যাদবপুর ইউনিভার্সিটি কনট্রাক্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’ পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মে দিবস উদযাপন করে। চুক্তিবদ্ধ কর্মচারীরা শপথ নেন কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম-কোড এবং অমানবিক চুক্তিপ্রথা বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার। যাদবপুর ৮বি এলাকায় কর্মচারিদের মিছিল শ্রমিকের দাবিগুলি তুলে ধরে।
বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম কামারহাটি আগরপাড়া জুট মিল ইউনিয়ন কার্যালয়, কাঁকিনাড়া জুট মিল, গৌরীপুর কার্যালয়, নৈহাটি জুট মিল কার্যালয় ইত্যাদি জায়গায় সুসংগঠিতভাবে মে দিবস পালন করে। লাল পতাকা উড়িয়ে, শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে, শ্রমিকেরা মিছিল করেন আগরপাড়া ও নৈহাটিতে। আগরপাড়ায় পার্টির শ্রমিক ফ্রন্টের বর্ষীয়ান নেতা তথা পাটকল ইউনিয়নের সভাপতি নবেন্দু দাশগুপ্ত পতাকা তোলেন, বক্তব্য রাখেন ইউনিয়ন সম্পাদক মাজাহার খান। নৈহাটিতে ইউনিয়ন সম্পাদক মহম্মদ জহিম পতাকা উত্তোলন করেন, পার্টির জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। মিছিলগুলিতে ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান। বসিরহাটে নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, শিবদাসপু্রে ইটভাটা শ্রমিক ইউনিয়ন, হালিশহর, আইআরইএফ কাঁচরাপাড়া ইউনিয়ন বিভিন্ন স্থানে মে দিবসের কর্মসূচি সংগঠিত করে। পার্টির পক্ষ থেকে অশোকনগর, রাজারহাট ও বেলঘরিয়ায় কর্মসূচি হয়।
দার্জিলিং জেলার রাঙ্গাপানি রেল ইয়ার্ডে ‘দার্জিলিং জেলা সংগ্রামী মুটিয়া মজদুর ইউনিয়ন’ ও ‘এনআরএল ইউনিয়ন’-এর পক্ষ থেকে মে দিবসে পতাকা উত্তোলন, পুষ্প অর্পণ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মে দিবসের এই কর্মসূচিতে সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক অভিজিত মজুমদার ও দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ সহ শরৎ সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, পঞ্চা বর্মন, ইউনিয়ন নেতা বুলু সিংহ, সুরেন দাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মে দিবসের কর্মসূচিতে ভালো সংখ্যক শ্রমজীবী মহিলার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। রাজ্য সম্পাদক তাঁর বক্তব্যে মে দিবসের বর্তমান তাৎপর্য তুলে ধরে আরএসএস-বিজেপির ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র করার আহ্বান জানান।
ভারতবর্ষের মে দিবস পালনের ১০০ বছরে দাঁড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে গ্রামীণ মজুরদের জোর দিতে হচ্ছে ১০০ দিনের কাজের দাবিতে আন্দোলন। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ও গ্রামীণ মজুরদের কাজের অধিকারের প্রশ্নে কোনো আইন নেই। তাঁত, রেশম, কাঁসা-পিতল সহ বিভিন্ন ধরনের কুটীর শিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কৃষি অলাভজনক থাকাতে কৃষিতেও কাজের সংকট। লক্ষ লক্ষ বেকার গ্রামীণ মজুর কাজের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্য ও বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। ৮ ঘণ্টার দাবি ও মজুরির দাবিতে লড়াইয়ের চেয়েও বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ পাওয়ার লড়াইটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। অনেক আন্দোলনের ফলেই এমজিএনআরইজিএ আইন তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ মজুরদের বছরে ১০০ দিন কাজ পাওয়ার একমাত্র আইনি অধিকার। আর এই আইনটাও তুলে দিতে চাইছে কেন্দ্রের শাসকরা। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দুই বছর কাজ দেওয়াই হচ্ছে না। তাই শ্রমিক ঐক্য ও সংহতি, কাজ এবং মজুরির দাবির সাথে সাথে ১০০ দিনের কাজের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে ঐতিহাসিক মে দিবসের শত বার্ষিকী। জেলায় কালনা ২নং ব্লকের আগ্রদহ বাজার ও বৈদ্যপুর বাসস্ট্যন্ডে, মেমারী ১নং ব্লকের নিমো অফিসে, মন্তেশ্বরের কুসুমগ্রাম বাজারে, জামালপুর ব্লকের আজাপুর বাজারে, পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া অফিসে ও গলসীতে মে দিবস পালন করা হয়।