প্রযুক্তির দাপটে বিপন্ন কাজ, জীবন-জীবিকা
threatened-by-technology

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা শব্দবন্ধটা বেশ অদ্ভুতুড়ে। মনে হয় বুদ্ধি তো বুদ্ধিই সেটার আবার আসল নকল কী! কিন্তু মানুষ তো সাধারণ জীব নয়, অপার তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা। দীর্ঘদিনের বিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত তার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, উৎকর্ষতা, গভীরতা অভুতপূর্ব ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটা পর্যায়ে এসে সেই বুদ্ধি সে যন্ত্রে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে। এই যন্ত্র যখন মানুষের মতো বুদ্ধি প্রদর্শন করতে শুরু করে কিংবা মানুষের বুদ্ধি থেকে তার পৃথকীকরণ করা যায় না, তখন সেটাকে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বলে। এই বুদ্ধি মানুষের বুদ্ধির চেয়ে বহুগুণ দ্রুত, পরিমাণগত ভাবে অনেক বেশি কাজ করতে পারে, যদিও উৎকর্ষতা আরও বেশি কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। একজন রেডিওলজিস্ট যেখানে ১০,০০০ প্লেট এক্সরে পরীক্ষা করতে পারে, সেখানে যন্ত্র করতে পারে সেটার অন্তত দশগুণ। যন্ত্র ক্লান্তিহীন এবং এর স্মৃতিশক্তি বিস্ময়কর, বিপুল পরিমাণে তথ্য সঠিক ও নির্ভুলভাবে মনে রাখতে পারে এবং চটজলদি তা পুনরুদ্ধার করতে পারে। এখন যন্ত্র কথা বুঝতে পারে, মুখ চিনতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অনুবাদ করতে পারে (যদিও তা এখনো ত্রুটিমুক্ত তা বলা যায় না), মানুষের সহায়তা ছাড়া অনেক কাজ করতে পারে। মানুষের বুদ্ধির সাথে মেশিনের বুদ্ধি যুক্ত হওয়ার কারণে আমাদের চারিপাশ অতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, জীবন ও জীবিকার এক আমূল এবং অপরিবর্তনীয় রূপান্তর ঘটছে।

কম্পিউটারের সাথে আমাদের পরিচয় হয় নব্বই দশকে। মাত্র দশ বছরের মধ্যে আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারে সড়গড় হয়ে উঠি। সেখান থেকে মাত্র পনেরো বছরে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার জগতে আমাদের প্রবেশ। মাত্র তিরিশ বছরে প্রযুক্তির এই উল্লম্ফন বিস্ময়কর! অথচ সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম সাড়ে পাঁচ হাজার বছর যন্ত্রের সাথে মানুষের পরিচয় ছিল নগণ্য, তখন যাবতীয় কর্মকান্ড হতো দৈহিক শ্রমের মাধ্যমে। আঠেরোশো শতাব্দীতে এলো বাষ্পশক্তি, একশো বছর বাদে বিদ্যুৎ। এই দুইয়ের আবিষ্কারকে যথাক্রমে বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু এবং তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ শুরু। প্রযুক্তি এখন উল্কার গতিতে এগিয়ে চলেছে। এখন তা রৈখিক গতির পরিবর্তে দৃষ্টান্তমূলক (exponential) গতিতে ধাবমান যারফলে প্রযুক্তির এক বিস্ফোরণ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে কাজ করছে? ধরা যাক মোবাইলে গুগলে গিয়ে নিজের নাম লিখছি। পঞ্চম অক্ষরে মোবাইল আমাকে চিনে ফেললো, পুরো নাম স্ক্রিনে চলে এলো, একটা স্পেস দিলে পদবিও চলে এলো। একই সাথে পাশে আমার ইমেল ঠিকানাও এসে গেল। অর্থাৎ মেশিন আমার নাম, পদবি, ঠিকানা মনে রেখেছে, প্রাথমিক কিছু ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র তা জানিয়ে দিচ্ছে। ধরা যাক অ্যামাজন থেকে আমি ফেলুদার বই কিনেছি। পরের দিন থেকে ফেসবুক খুললেই দেখা গেল ফেলুদার বিভিন্ন বইয়ের বিজ্ঞাপন আমার দিকে ধেয়ে আসছে — ফেলুদা সমগ্র, ফেলুদা একাদশ, কলকাতায় ফেলুদা ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ মেশিন আমার পছন্দ জেনে গেছে এবং আরও বইয়ের জানান দিয়ে আমাকে প্রলুব্ধ করছে। কিংবা গড়িয়াহাটের কোনো দোকান থেকে আমি জকির টি-শার্ট কিনে ডেবিট কার্ডে পয়সা দিয়েছি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নানা ব্র্যান্ডের টি-শার্ট দেখিয়ে মেশিন আমাকে নাজেহাল করে দেবে। পাশাপাশি দেখাচ্ছে গুগল-পে (অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থা যা দিয়ে টাকাপয়সা লেনদেন করা যায়, বিভিন্ন বিল মেটানো যায়) দিয়ে যদি আমি দাম দিতাম তাহলে আমি ১০ শতাংশ ছাড় পেতাম। এই ছাড়ের লোভে আমি গুগল-পে ব্যবহার শুরু করব। এইভাবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা নানা পণ্যে প্রলুব্ধ করে আমাকে ভোগবাদে নিমজ্জিত করবে, অনলাইন পেমেন্টে আমাকে জড়িয়ে দিয়ে আমার অর্থনৈতিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটার ওপর নজরদারি করবে।

কিন্তু মানুষের জীবিকা, কাজের, ব্যবসার কী ক্ষতি করছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা? আমি আগে পাড়ার দোকান থেকে বই কিনতাম। কোনো বই না পেলে দোকানি আমাকে কলেজ স্ট্রিট থেকে সেই বই এনে দিতেন। এখন কে আর এই গরমে ঠেঙিয়ে বাইরে বেরোবে? তার চেয়ে ঠাণ্ডা ঘরে বসে মোবাইলে টেপাটেপি করে অ্যামাজনে অর্ডার দিয়ে দিলাম। দু’দিনে বই পৌঁছে গেল, একেবারে হাতেগরম! এই করে পাড়ার বইয়ের দোকান উঠে গেল। পাড়ার মুদির দোকানগুলো ধুঁকছে। বহু বাড়ির মাসের বাজার হয় এখন বিগ বাস্কেট বা ব্লিঙ্কেট (অনলাইন মুদিখানা) থেকে। বাড়িতে হঠাৎ দশ-বারো জন লোক খাবে, কে আবার বাজার করতে যাবে? লিসিয়াসকে ফোন করে মাছ মাংস বলে দাও, ব্লিঙ্কেটকে বলে মশলা আনাজপাতি আনিয়ে নাও। কী সুবিধা! আমরা খলবল করে উঠি। খেয়াল করি না এই ‘সুবিধার’ কারণে কতো ব্যবসা, রুটিরুজি তলিয়ে গেল। নাকের ডগায় এটিএম থাকার কারণে এবং অ্যাপের মাধ্যমে কেনাকাটা অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কারণে বাড়িতে এখন ক্যাশ পয়সা কমই থাকে। এক যুবক বাড়িতে টিভির কেবলের পয়সা নিতে আসে কিন্তু ক্যাশ না থাকার ফলে তাকে বারবার ফিরে যেতে হয়। তাকে একদিন বললাম গুগল-পে দিয়ে টাকা ট্র্যান্সফার করে দেব। তার মুখটা শুকিয়ে গেল। বলল, আরও কয়েকজন এরকম বলছে, তাহলে তো দাদা আমার কাজটা আর থাকবে না!

তা এই হল অবস্থা! প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের জীবিকার ক্ষেত্রে চরম আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। প্রতিটি শিল্প বিপ্লবের ফলে দৈহিক শ্রমের ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। যন্ত্র বহু মানুষের কাজ কেড়ে নিয়েছে, মানুষ ক্ষিপ্ত হয়েছে, মেশিন ভাঙচুর করেছে। লুডাইতদের সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকেই অবহিত, যাঁরা কাজ চলে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে কাপড়ের কল ভেঙে ফেলেছিল। এখন কী ধ্বংস করবে? গুগল-পে ধ্বংস করবে? সেটা তো অননুভবনীয়, ধরা ছোঁয়ার বাইরে, ইন্ট্যাঞ্জিবল! অ্যামাজন কোথা থেকে বই পাঠাচ্ছে? সেখানে গিয়ে হামলা করবে? কলকাতায় কি অফিস আছে তাদের? সেখানেই কি বই আছে, নাকি বহু শহরের গুদামে ছড়ানো?

লেখাটা লিখছি হঠাৎ মোবাইলে একটা খবর ভেসে উঠলো, অ্যামাজন ভারতে ৫০০ জন কর্মচারি ছাঁটাই (লে-অফ) করেছে। বিশ্বে ৯,০০০ ছাঁটাইয়ের এটা একটা অংশ মাত্র। একই সাথে কোম্পানি জানাচ্ছে যে এদের মধ্যে কিছু লোককে ‘রিলিজ’ করা হবে, বাকিদের ‘রিএসাইন’, অর্থাৎ অন্য কাজে যুক্ত করা হবে। একই বিবৃতিতে দু’রকম কথা! গত নভেম্বরে কোম্পানি ১৮,০০০ কর্মচারিকে ‘রিলিজ’ করার কথা ঘোষণা করেছিলো, যারমধ্যে ১,০০০ ভারতে। দৈত্যকায় কর্পোরেট কোম্পানিগুলোতে ছাঁটাইয়ের সুনামি শুরু হয়েছে। এলন মাস্ক ট্যুইটার কেনার পর ৭,৫০০ কর্মী বাহিনীর প্রায় ৫০ শতাংশ ছাঁটাই করে দিয়েছেন, সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করেছেন, দৈনিক বারো ঘণ্টা কাজ চালু করেছেন। মেটা ১১,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। এয়ারবিএনবি ২৫ শতাংশ, স্ন্যাপচ্যাট ২০ শতাংশ, উবের ১৪ শতাংশ কর্মী বিদায় করেছে। শুধুমাত্র টেক কোম্পানিগুলোতে ইতিমধ্যেই ৭৮০টির অধিক সংস্থায় ১,২০,০০০ কর্মীর চাকরি গেছে। কোম্পানিগুলি কারণ দেখাচ্ছে যে করোনাকালে টেক সংস্থাগুলির ব্যবসা বিপুল বিস্তার লাভ করায় প্রচুর কর্মী নিয়োগ করা হয়। মহামারী স্তিমিত হওয়ার পর ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ার কারণে এখন আর অতো কর্মীর প্রয়োজন নেই। সুতরাং ছাঁটাই। এটা অংশত সত্যি। আসল কারণ হচ্ছে প্রযুক্তির উল্লম্ফন। টেক কোম্পানিগুলিতে কাজের ব্যাপক রোবটিকরণের কারণে বহু কর্মী অতিরিক্ত হয়ে পড়েছে। পাঁচজন কর্মীর কাজ এখন একটা রোবট করে দিচ্ছে। কোম্পানি রোবটের জন্য একবার খরচ করছে, পাঁচ শ্রমিককে বাতিল করে দিচ্ছে। মজুরি, বোনাস, মেডিক্যাল ইত্যাদি দেওয়ার কোনো গল্প নেই, পিএফ-পেনশনের ঝামেলা নেই, মুনাফা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সমাজে অভুতপূর্ব অসাম্য তৈরি হচ্ছে। কিছু লোক বিশ্বের সর্বোত্তম ধনীদের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছে, বিপুল বিশাল সংখ্যক মানুষ হয় কাজ হারাচ্ছে, নয় নুন্যতম মজুরি পেয়ে কোনরকমে দিন গুজরান করছে। বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতে ৩০ কোটি কাজ শ্রেফ হারিয়ে যাবে নয় সেগুলির মূল্য, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে।

‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ তাদের ফিউচার অফ জবস, ২০২৩ রিপোর্টে নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে যে ভীতি তৈরি হয়েছে সেটাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছে। তাও তাদের সমীক্ষায় যে কোম্পানিগুলি অংশগ্রহণ করেছে তাদের অর্ধেক মনে করে নতুন প্রযুক্তি কাজের বাজারে সদর্থক প্রভাব ফেলবে, বাকিরা মনে করে সেটা ক্ষতি করবে। জানা যাচ্ছে ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের ৩৪ শতাংশ এখন মেশিন দ্বারা হয়, যা ২০২৭এ ৪২ শতাংশ হবে। কাজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে যারফলে ১.৪ কোটি মানুষের চাকরি যাবে। অফিসকাছারির কর্মচারী, ক্যাশিয়ার, ডেটা অপারেটার, আধিকারিক, সেক্রেটারি ধরনের কাজ, আইনি পেশার নিম্নস্তরের কাজ সবচেয়ে বেশি বাতিল হবে। ২০২৭এ এঁদের কাজের সংখ্যা বিপুলভাবে হ্রাস পাবে — ২.৬ কোটি! ঐ বছরের মধ্যে ১০ জন শ্রমিকের মধ্যে ৬ জনকে ‘রিস্কিল’ অর্থাৎ নতুন করে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। হায় রে! আমাদের দেশে কাজ চলে যাওয়া শ্রমিকের তো নতুন করে দক্ষতা অর্জনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকরণ এবং প্রযুক্তির সব নবতর রূপের কারণে আমরা আজ একটা দুর্গম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। উৎপাদন শিল্প প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিকের কাজ চলে গেছে। পরিষেবা শিল্পে বহু কাজ নিঃশব্দে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে ব্যাংকে এখন হাতে গোনা কয়েকজনকে দিয়ে কাজ চালানো হয়। এতে কোনো প্রতিবাদ হয় না। কারণ মানুষের ঘরের কাছে এটিএম আছে, বিভিন্ন পেমেন্ট অ্যাপ আছে। এটা পরিস্কার, নতুন প্রযুক্তির কারণে স্থায়ী চাকরির দিন শেষ। এখন কাজ অস্থায়ী, এমনকি ক্ষণস্থায়ী। কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক, ইন্সিওরেন্স, এমনকি সরকারি অফিস খালি। রাস্তায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার কর্মীদের ভিড় বাড়ছে। জীবন বাজি ধরে, কাঁধে পেল্লাই ব্যাগ নিয়ে মধ্যরাতে রাজপথ দিয়ে বাইকে ছুটে যায় ডেলিভারি ওয়ার্কার। খাবারটা পৌঁছাতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে আগামীকাল তার আর কাজ থাকবে না। এটাই আজকের বাস্তব! এই নতুন যুগের জন্য চাই নতুন চিন্তা, মুক্ত চিন্তা, সাবেকি ধারণা বিবর্জিত সংগঠন ও নেতৃত্ব।

- সোমনাথ গুহ

খণ্ড-30
সংখ্যা-15