সম্প্রতি দলিত হিউম্যান রাইটস্ ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক (ডিএইচআরডিনেট) ও ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ উইমেন লিডারস্ (এনসিডবলিউএল) যৌথভাবে সাতটি রাজ্যে তৃণমূল স্তরে অনুসন্ধান ও সমীক্ষা করে অত্যন্ত উদ্বেগজনক তথ্য সামনে তুলে ধরেছেন। ওই সাতটি রাজ্য হল — হরিয়ানা, বিহার, গুজরাট, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র এবং উত্তরপ্রদেশ। ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত নানা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান চালিয়ে এমনটাই সামনে উঠে আসছে। দেখা যাচ্ছে, দলিতরাই সবচেয়ে বেশি শিকার ‘সম্মানার্থে হত্যার’ নির্মম, মর্মান্তিক ঘটনায়।
যে ২৪টি ঘটনা তারা অনুসন্ধান করেছেন, তারমধ্যে ২০টি ক্ষেত্রেই ছেলেটিকে হয় খুন করা হয়েছে, নতুবা পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছে। আর, এই সমস্ত ক্ষেত্রে অপরাধীরা হল যার সাথে সম্পর্ক ছিল, তাঁদের পরিবারের লোকজন। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নিহত বা গুরুতর আহত ব্যক্তিরা সকলেই তপশিলি জাতি ভুক্ত। উঁচু জাত থেকে আগত মহিলাদের সম্পর্ক বা বিয়ে ভাঙা, শিক্ষার জগত থেকে সরিয়ে নেওয়া, অপহরণ করে অজানা স্থানে নিয়ে চলে যাওয়া, হত্যা বা নির্মমভাবে পেটানোর ঘটনা ঘটেছে। যে দু’জন মহিলা খুন হয়েছেন, তাঁরা ছিলেন ওবিসি থেকে আগত, আর আরেকজন ছিলেন ডি নোটিফাইড ট্রাইবস্ কমিউনিটি থেকে।
এই সমস্ত ঘটনাই দেখিয়ে দিয়েছে, উঁচু জাতের যে সমস্ত মহিলা জাতপাতের বেড়া ভেঙে নিজেদের পছন্দসই জীবন সঙ্গী বেছেছেন তাঁদের রাখা হয়েছে কঠোর নজরদারির মধ্যে, তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ওই সমস্ত মহিলাদের গতিবিধির উপরও নানান নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সুখী গৃহকোণের আশায় তাঁরা পছন্দের জীবনসঙ্গীকে ঠিক করার ‘অপরাধে’ নিজের পরিবারের বা বৃহত্তর সম্প্রদায়ের নারী-বিদ্বেষী পুরুষদের কাছ থেকে নির্মম দমনের সম্মুখীন হয়েছেন।
হরিয়ানায় সংগঠিত চারটি ঘটনা ওই রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে যা সংগঠিত হয় ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০২০ সালে। প্রতিটি ঘটনার এক সাধারণ যোগসূত্র রয়েছে — ভিন্ন জাতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নিদারুণ ঘৃণা উগড়ে দেওয়া হয়েছে।
একটা ক্ষেত্রে দেখা যায়, উঁচু জাতের মহিলার পরিবারের ব্যক্তিরা নিজের ঘরের মহিলাকে খুন করার জন্য গুন্ডাদের ভাড়া করে। খুন হওয়ার পর তপশিলি জাতিভুক্ত ছেলেটি গা ঢাকা দেয় এই কারণে যে মেয়েটির পরিবার তাঁর বিরুদ্ধে মেয়েটিকে অপহরণ করে খুন করার অভিযোগ পুলিশের কাছে দায়ের করে। আরেকটি ক্ষেত্রে দেখা গেল, জাঠ পরিবারের মেয়েটিকে বিষ পান করতে বাধ্য করা হয়। তারপর গোপনে তার মৃতদেহের সৎকার করে দেয়।
সোনিপাতের খাড়াখোদায় গোটা দলিত পরিবারকে নিকেষ করা হয়। এই দলিত পরিবারের একটি ছেলের সাথে জাঠ পরিবারের মেয়েটির বিয়ে হয়। এদের চার বছর আগে বিয়ে হয়, তাঁদের তিন বছরের এক সন্তানও ছিল। ভাড়া করা গুন্ডাদের দিয়ে ছেলেটির পরিবারকে আক্রমণ করা হয়। তাতেই খুন হন ছেলেটি নিজে, তাঁর পিতা মাতা সহ তাঁর ভাই ও ভ্রাতৃবধু।
২০১২ থেকে ২০১৯’র মধ্যে গুজরাটে সংগঠিত তিনটি ‘সম্মান হত্যা’র ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলগুলো হল — মেহসানা, গান্ধিধাম এবং ঊনা।
একটা ক্ষেত্রে এক দলিত ছেলের সাথে কোলি সম্প্রদায়ের মেয়ের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি তাঁর পরিবার থেকে পালিয়ে এই দলিত ছেলেটির বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করে। এই কারণে, মেয়েটির পরিবারের লোকজন ছেলেটির বাড়িতে চড়াও হয়ে মেয়েটিকে জবরদস্থি বার করে ছেলেটিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে।
আমেদাবাদে, এক ২৫ বছরের দলিত যুবককে খুন করা হয়। খুন করে তাঁর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ উঁচু জাতের মেয়েটির পরিবারের লোকজন। পুলিশ জানায়, মেয়েটির পরিবারের লোকজনের সামনে এই খুনের ঘটনা ঘটে।
মজফ্ফরপুর, ঢাকা, ও রোহতাসে তিনটি ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে একটি ক্ষেত্রে এক দলিত ছেলের সাথে ওবিসি থেকে আগত একটি মেয়ের সম্পর্ক হয়। ১৮ মাস সম্পর্ক থাকার পর তাঁরা গোপনে গুজরাটের এক মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে। তারপর বাড়ি ফিরে আসার পর মেয়েটির পরিবার এক গল্প ফাঁদে, পুলিশে নালিশ করে, ছেলেটি ভয়ে পালিয়ে যায়, মেয়েটি তীব্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়। এরপর পরিবারের লোকজন তাদের পছন্দসই এক ছেলের সাথে মেয়েটির বিয়ে দেয়।
এই ধরনের আরও ঘটনা ঘটেছে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে। ঘটনাক্রম প্রায় একই ধরনের। শুধু স্থান কাল পাত্রপাত্রী ভেদের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা। উল্লিখিত সংস্থাটি জানিয়েছে, এই ধরনের ঘটনা অনেক বেশি তলে তলে ঘটছে। কিন্তু তা প্রচারের আলোতে কমই আসছে। পুলিশ প্রশাসনও তা সংবাদমাধ্যমের সামনে আনতে চায়না নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য।
স্বাধীনতার অমৃতকালে এই মধ্যযুগীয় বর্বরতা রমরমিয়ে চলছে। বিজেপি-আরএসএসের নারী বিদ্বেষী মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ এই সমস্ত ঘটনার পালে হাওয়া লাগাতে অনেক বেশি সাহায্য করেছে।
(তথ্যসূত্রঃ নিউজ ক্লিক, ৩ এপ্রিল ২০২৩)