২০ মে ২০২৩
নিজের হাতের মুঠোয় দিল্লীর আইনসভা ও প্রশাসনিক কার্যকলাপকে কব্জা করে রাখতে মোদী সরকার রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এমন এক অধ্যাদেশ জারি করল, যা কার্যত খারিজ করে দিল সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়কে। সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দিল্লী সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার ক্ষমতা ও দায়দায়িত্বের মধ্যে এক বিভাজন রেখা টেনেছিল, সাংবিধানিক ভাবে দিল্লী যে বিশেষ স্ট্যাটাস ভোগ করে তাকে মাথায় রেখে। যদিও গতকাল রাত্রে জারি করা এক বিশেষ অধ্যাদেশ বলে দিল্লীর আমলাকুলকে বদলি বা নিয়োগ করার ক্ষেত্রে লেফটেনেন্ট গভর্নরকেই চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়ে খারিজ করা হল নির্বাচিত দিল্লী সরকারের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্বগুলোকে, যা সংবিধান ও সাংবিধানিক বেঞ্চ অর্পন করেছিল।
দ্য গর্ভমেন্ট অফ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটারি অফ দিল্লী অ্যাক্ট, ১৯৯১-কে সংশোধন করা হল একটা অধ্যাদেশ এনে, আর তৈরি করা হল ন্যাশনাল ক্যাপিটাল সিভিল সার্ভিসেস অথরিটি, যার মাথায় থাকবে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী, দিল্লীর মুখ্যসচিব এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য স্বরাষ্ট্রসচিব। এই সংস্থা জাতীয় রাজধানীতে আমলাদের নিয়োগ ও বদলি করার ক্ষমতার অধিকারী, তবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটের ভিত্তিতে। এই সংস্থাই লেফটেনেন্ট গভর্নরের সিদ্ধান্তগুলোকে সুপারিশ করবে, আবার তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন যে ওই সংস্থার সুপারিশগুলো গ্রহণ বা বর্জন করা হবে কিনা। মতপার্থক্য রয়ে গেলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার লেফটেনেন্ট গভর্নরের উপরই থাকবে।
সুপ্রিম কোর্ট জোর দিয়েই বলেছিল, রাজ্যের শাসনতন্ত্রকে কেন্দ্রীয় সরকার কখনই কব্জা করতে পারে না। সে আরও আদেশ দেয়, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ ও জমি বাদে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাটি ন্যস্ত থাকবে জাতীয় রাজধানীর ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে জাতীয় রাজধানীর সরকারের উপরই।
ঘটনাচক্রে, সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্গত হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের নীতিমালাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সময় এই পর্যবেক্ষণ রাখে যে, দু’টি ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যগুলোর সরকার “আমরা, জনগণ” দ্বারা নির্বাচিত হয়। আর উভয় ক্ষেত্রেই তা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকেই প্রতিফলিত করে। এই পর্যবেক্ষণের পর সুপ্রিম কোর্ট জোর দিয়েই বলে, “যে ২৩৯এএ ধারা জাতীয় রাজধানীর ভূখন্ডে দিল্লীকে এক বিশেষ স্যট্যাটাস দিয়েছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের নির্যাসকে সামনে রেখে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ধরনকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে এই লক্ষ্য নিয়ে যাতে রাজধানীর নাগরিকরা কীভাবে শাসিত হতে চায় সে প্রশ্নে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে পারে। এনসিটিডি সরকারের উপর এই দায়িত্ব বর্তায় যারা তাঁদের নির্বাচিত করেছেন, তাদের আকাঙ্ক্ষাকে এবার মর্যাদা দিতে হবে। তাই একমাত্র যে যুক্তিসঙ্গত উপসংহারে উপনীত হওয়া যায়, তা হল, জিএনসিটিডি’র হাতে থাকবে পরিষেবার নিয়ন্ত্রণ, কিন্তু সেগুলো তার এক্তিয়ারে আসবে না যেগুলো তার আইনি পরিধির বাইরে।”
কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা অধ্যাদেশ সরাসরি শীর্ষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। ক্ষমতার বিভাজন ও বিচারব্যবস্থার কর্তব্যের প্রতি অবজ্ঞার এটা হল নগ্ন এক প্রকাশমাত্র।
আমরা বারেবারে দেখেছি, কিভাবে মোদী কর্তৃক নিয়োজিত লেফটেনেন্ট গভর্নর ও রাজ্যপালেরা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করেছে, বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলোতে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোকে অমান্য করেছে। দিল্লীর এই অচলাবস্থার জন্য দায়ী এলজি’র অতি সক্রিয়তা। নানান সময়ে দিল্লী সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোকে যিনি রূপায়িত করতে দেননি। এটা আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেখানেই বিজেপি হারছে, সেখানেই তারা এলজি ও রাজ্যপালকে ব্যবহার করছে শাসন প্রণালী ও গণতন্ত্রকে বানচাল করতে।
এমন একটা সময়ে এই অধ্যাদেশ আনা হল যখন সুপ্রিম কোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের নীতিমালাকে জোরের সাথে সামনে নিয়ে এল। এটাই দেখিয়ে দেয় আমাদের দেশের সাংবিধানিক নীতিমালা ও বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থার প্রতি বিজেপির চূড়ান্ত অবজ্ঞা। ক্ষমতা ধরে রাখতে মোদী সরকারের কদর্য খেলা দিল্লী জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে দলন করল। সিপিআই(এমএল) এর তীব্র বিরোধীতা করছে। জনগণের স্বার্থকে মাথায় রেখে, তাঁদের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান দিতে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারের এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত।
- রবি রাই, সম্পাদক, দিল্লী রাজ্য কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন