উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ। রাজ্য রাজনীতির শিরোনাম হয়ে ওঠা এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর কেন্দ্র ছিল সাহেবঘাটা অঞ্চল ও বাজার। সেখান থেকে আধ কিলোমিটার দুরে এক নাবালিকার দুঃখজনক মৃত্যু নিয়ে রাজ্য রাজনীতি হয়ে উঠেছে তোলপাড়। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেলো বাজারে বেছে বেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর করা হয়েছিল, দুটিতে লাগানো হয়েছিল আগুন। সেগুলিকে মেরামত করে পুনরায় বাজার সচল হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে লোকজন খুবই কম। মানুষ নানা আশংকার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু আজ ব্যাপক মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, আক্রান্ত দোকানদারদের অপরাধ কী ছিল? কেবল ধর্মীয় পরিচয়? পরস্পরের প্রতি ঘৃণাবিদ্বেষই কি আমাদের বাঁচার পথ? এই বাজারে প্রধানত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের দোকান। আর বাজারের ভেতরে পথের ধারে রকমারী জিনিসের দোকান নিয়ে যারা বসেছেন তাঁরা মূলত হিন্দু উদ্বাস্তু ও স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। গোটা এলাকাতেই রয়েছে এই ধরনের জনবিন্যাস। নাবালিকার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রাতারাতি মিথ্যা প্রচার করে গুজব রটিয়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করে এদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ বিভাজন সৃষ্টির মরিয়া চেষ্টা করা হয়েছিল। তবুও এক সপ্তাহ পর এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো তাঁরা একে অপরের সাথে মিলে মিশে পাশাপাশি রয়েছেন। যেমন, পথে বসে ফল বিক্রেতা কালীদাস সরকার ঘটনাস্থলের কাছেই মনসুর সেখের বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে জানালেন, ঘটনার দিন আমি সারা রাত রাস্তায় পাহাড়া দিয়েছি। কদিন আগেই তো মনসুরের বাবা মারা গেছে। সে ছিল আমার বন্ধু লোক। তাই আমিই ওদের পরিবারটাকে আগলে রেখেছি। এভাবেই জ্বলজ্বল করে উঠলো আমাদের পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন। না, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় সীমিত সংখ্যক কিছু উগ্র জনগোষ্ঠীর কথা বাদ দিলে এটাই হয়ে উঠেছে এলাকার এক সাধারণ ছবি।
ঘটনা সম্পর্কে জানা গেল, কিশোরির মৃত্যুর ঠিক পরই বিজেপির নেতা সুকান্ত মজুমদার, দেবশ্রী চৌধুরীরা চটজলদি এলাকায় পৌঁছে যায়। এর সাথে জেলা ও স্থানীয় মাতব্বররা মিথ্যা প্রচার ও গুজব ছড়িয়ে লোকজন জড়ো করে সকলকে উত্তেজিত করতে শুরু করে। ওরা মৃতদেহ আটক করে রাখে। অনেকেই জানালেন পুলিশ যখন মরদেহ হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন জয় শ্রীরাম বাহিনী রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে মরদেহটিকে অশালীন অবস্থায় নিয়ে গেছে। সে সময় পুলিশের ভূমিকাও ছিলো নক্কারজনক। মরদেহকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া এক চরম অপরাধ যা কঠোর শাস্তির দাবি করে। এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি আরএসএস বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে দাঙ্গার পরিস্থিতি চরমে নিয়ে যায়। গোটা এলাকায় উভয় পক্ষই প্রস্তুত হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় প্রায় লাগে লাগে এমনই অবস্থা! যাই হোক বিষয়টা সে দিকে যায় না৷ তার দুদিন পরেই সংগঠিত হয় বিক্ষোভের নামে থানা আক্রমণের ঘটনা৷ বিজেপির পরিকল্পনা ছিল, রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে থানা আক্রমণ করছে – এই জাতীয় একটা জিগির ও ন্যারেটিভ তুলে ধরা। কিন্তু বাস্তব ঘটনাবলীর বিকাশ বিপরীত অভিমুখে এগিয়ে গেছে। থানা আক্রমণের ঘটনা সাধারণ মানুষ মোটেই মেনে নেয়নি। সেটা সর্বস্তরে নিন্দিত হয়েছে। বরং বিজেপির পরিকল্পনাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ওরা অনেকটাই রক্ষণাত্মক জায়গায় চলে গেছে। “গাবর সংঘ” (রাজবংশী ভাষায় গাবর অর্থ যুবক) নামক একটা সংগঠন বেশ কয়েক বছর ধরে তৈরি করে বিজেপি তার নামে কাজ চালাচ্ছে। থানায় হামলার প্রোগ্রাম ওরা এই ব্যানারে সংগঠিত করেছে।
নাবালিকার মৃত্যু নিয়ে একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে বিশ্বাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ধর্ষণ হয়েছে। টার্গেট করা হয়েছে সংখ্যালঘুদের। সেই অনেকটা “ধর্মীয় স্থলে অমুকের মাংস” পাওয়া গেছে গোছের গুজব। যা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুচারুভাবে প্রচার করা হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভিন্ন ধর্মে প্রেম বা বৈবাহিক সম্পর্ক রাখা যাবে না এই ফতোয়া জারি করে গ্রাম্য সালিশীর মাধ্যমে তৃণমূলের মাতব্বররা একটি মেয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। তাঁকে অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিয়েছে। এটা অত্যন্ত বেআইনি অপরাধমূলক কাজ। যা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বাস্তব ঘটনা রূপে দেখা যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উঠে এসেছে সমগ্র ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ তদন্তর দাবি। অন্য সম্প্রদায়ের স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, আদৌ কোনো ধর্ষণ হয়নি। ঘটনা পরম্পরা তার সত্যতার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে মৃতদেহ নিয়ে পুলিশী বর্বরতা ও থানায় হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতে গ্রেপ্তারি ও গুলি চালিয়ে হত্যা প্রবল তৃণমূল বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৩০ এপ্রিল কালিয়াগঞ্জে পার্টি কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান পরিস্থিতির আলোচনায় উঠে এলো, সমগ্র এলাকায় এক সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। থানায় হামলার ঘটনায় এক সম্প্রদায়ের মানুষ পুলিশী ধরপাকড়ের আতংকে রয়েছে। নতুন করে কখন কোথায় হামলা আসবে সেই আশঙ্কায় রয়েছে অপর এক সম্প্রদায়। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ক্রমশই বুঝতে পারছে যে এই পরিস্থিতির জন্য বিজেপি ও তৃণমূল উভয়েই দায়ী। সব মিলিয়ে তৃতীয় শক্তির একটা পরিসর গড়ে উঠছে। এই দিশায় আমাদের নিজেদের শক্তিকে সংহত করা এবং আগামী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঘটনার তদন্ত, অপরাধী পুলিশের শাস্তি সহ জরুরি দাবিগুলি নিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের বিরুদ্ধে জেলা সদরে প্রচার ও প্রশাসনে ডেপুটেশন দেওয়া হবে, ১৪৪ ধারা উঠে গেলে সম্প্রীতি মিছিল করা হবে।
- জয়তু দেশমুখ