কর্নাটকে চূর্ণ মোদীর অপরাজেয়তার অতিকথা
modi's-invincibility

কর্নাটক নির্বাচনের ফলাফলে যে বার্তাটা ভারতের পরিবর্তনকামী জনগণের কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে পৌঁছালো তা হলো — নরেন্দ্র মোদী অপরাজেয় নন। যেকোনো নির্বাচনে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে গুরুত্বহীন করে তুলে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের সবচেয়ে বড় প্রচারক করে তোলা এবং নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যের কৃতিত্বকে মোদী-শাহদের অর্পণ করাটাই ২০১৪’র পর থেকে বিজেপির রীতি হয়ে উঠেছে। এবারের কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারের কার্যকলাপকে আলোচনায় না এনে এবং রাজ্য নেতৃত্বকে উপেক্ষণীয় করে তুলে নরেন্দ্র মোদীই হয়ে উঠলেন বিজেপির প্রচারের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। এবং প্রচারে নেমে মোদী বিজেপির জন্য ভোটও চাইলেন নিজের নামেই। ছ’মাস আগে হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনেও আমরা নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে মোদীকে প্রত্যাখ্যাত হতে দেখেছিলাম, তবে, এবারের কর্নাটকে প্রত্যাখ্যানটা এল আরও বড় আকারে এবং নির্ধারক নিহিতার্থের মধ্যে দিয়ে।

কর্নাটক নির্বাচনে মোদী যেমন মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন, অন্য কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায়নি। এবং তা বোধহয় রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে প্রবল বিজেপি-বিরোধী হাওয়া আঁচ করেই। নির্বাচন কমিশন কর্নাটকের নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে ২৯ মার্চ আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১০ মে। গত কয়েক মাসে তিনি নয় নয় করে ১২ বার কর্নাটক সফর করেছেন এবং যেটা অন্য কোথাও হয়নি কর্নাটকের ক্ষেত্রে সেটাও ঘটেছে, তিনি সেখানে রাত্রি যাপনও করেছেন। আর, নির্বাচন যত এগিয়েছে প্রচারের মাত্রাকেও তিনি বাড়িয়ে তুলেছেন, এবং প্রচারের শেষ পর্বে ২৯ এপ্রিল থেকে ৮ মে তিনি তিনটে থেকে চারটে করে জনসভা এবং রোড-শো করেছেন। একেবারে ২১টি জনসভা এবং তার সঙ্গে ছ’টি রোড-শো নিয়ে ছিল তাঁর প্রচারের ব্যাপ্তি, এবং একটি রোড-শো একেবারে ২৬ কিমি লম্বা ছিল বলে কথিত। উন্নয়ন নামক প্রকল্পের ঘোষণা ও উদ্বোধন এবং তার সাথে হিন্দুত্ববাদী ও সংখ্যালঘু-বিরোধী রাজনীতির মিশ্রণে মেরুকরণ ঘটানোর যে কৌশল মোদী নিয়ে থাকেন, কর্নাটকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কর্নাটকে গিয়ে তিনি হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’এর হেলিকপ্টার ফ্যাক্টরি দেশের কাছে উৎসর্গ করেছেন, শিবামোগা বিমানবন্দরের উদ্বোধন করেছেন, মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট, এক্সপ্রেসওয়ে, ব্যাঘ্র প্রকল্পকে চালু করেছেন। কোথাও আবার কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ঘোষণাও করেছেন, যেমন, ইয়াদগিরি জেলার হুনসাগর তালুকে ৪২২৩ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। তবে, মোদী ও বিজেপির প্রচারে জোর সবচেয়ে বেশি ছিল তাদের মার্কামারা সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলোর ওপর। এবার আমরা নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে মেরুকরণ ঘটানোর লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদী থেকে অন্যান্য বিজেপি নেতৃবৃন্দ যে সংখ্যাগুরুবাদী ও সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলোকে প্রচারের জোরালো ইস্যু করে তুললেন, সেগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে ঘৃণা ও হিংসার কারবারি বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করায় মোদী তার মধ্যে মেরুকরণের এক অস্ত্রকে খুঁজে পেলেন। তিনি বজরং দলের সঙ্গে বজরংবলীকে (হনুমান দেবতা) একাকার করে তুললেন এবং বললেন, “বুথে গিয়ে যখন বোতাম টিপবেন ‘জয় বজরংবলী’ বলে (কংগ্রেসকে) শাস্তি দেবেন।” ‘কাশ্মীর ফাইলস’ গোত্রের আর একটা ছবি সুদীপ্ত সেন পরিচালিত ‘কেরালা স্টোরি’ মুক্তি পায় কর্নাটক নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে, ৫ মে। ছবিটি মুসলিম যুবকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর বিজেপির দুরভিসন্ধিমূলক ইস্যু লাভ-জিহাদ’এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, এবং বিজেপি ও আরএসএস অতি তৎপরতার সঙ্গে ছবিটির প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। মোদী তাঁর প্রচারে কেরালা স্টোরির উল্লেখ করলেন, ছবিতে বর্ণিত পার্শ্ববর্তী রাজ্য কেরলের নারীদের ধর্মান্তরিত করে আইএসআইএস’এর কাছে পাঠিয়ে তাদের কাজে লাগানোর প্রসঙ্গ টেনে হিন্দু ভোটের মেরুকরণে প্রয়াসী হলেন। মেরুকরণ ঘটানোর লক্ষ্যেই কর্নাটকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম নারীদের হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল যা নির্বাচনী প্রচারের একটা ইস্যু হয়ে ওঠে। হালাল ব্র্যান্ডের মাংসও মুসলিম-বিরোধী প্রচারের অঙ্গ হয়। মুসলিম ওবিসি’দের জন্য নির্দিষ্ট ৪ শতাংশ কোটাকে বাতিল করাটাও (যার বৈধতা এখন আদালতের বিবেচ্য) হিন্দুত্ববাদী আবেগকে উস্কিয়ে তোলার একটা উপায় হয়ে উঠল। টিপু সুলতানও পরিণত হলেন হিন্দু ভোট সংহত করার এক মাধ্যমে। প্রকৃত ইতিহাস আমাদের জানায়, টিপু সুলতান ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করার সময়ই ব্রিটিশদের হাতে নিহত হন। কিন্তু কর্নাটকে টিপুর মতো মুসলিম সম্রাটকেও ঘৃণায় ভাসানো হল এবং ভোক্কালিগা জাতের ভোট বিজেপির পক্ষে টানার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে প্রচার করা হল যে, ব্রিটিশদের হাতে নয়, টিপু সুলতান নিহত হয়েছিলেন ভোক্কালিগা জাতের দুই ব্যক্তির হাতে! কর্নাটকে প্রচারে নেমে মোদীর চেষ্টাই ছিল বিজেপি শাসনের পরিণামে রাজ্যের নিকৃষ্ট বাস্তব পরিস্থিতি থেকে জনগণের নজরকে ঘোরানো; রান্নার গ্যাস-পেট্রল-ডিজেল-অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি, বেকারির মতো ইস্যুগুলো থেকে ভাবনাকে সরিয়ে কর্নাটকের জনগণ যেন সংখ্যাগুরুবাদী চিন্তাতেই আবিষ্ট থাকেন। এছাড়া, দুর্নীতিও কর্নাটকের নির্বাচনে একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল, বাসবরাজ বোম্বাইয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ৪০ শতাংশ কমিশনের সরকার বলেই জনগণের মনে গেঁথে গিয়েছিল। কোনো ঠিকাদারের বিল পাশ করাতে গেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে ৪০ শতাংশ কমিশন প্রদান ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। এক ঠিকাদার ৪০ শতাংশ কমিশন দিতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন এবং সেই ঘটনায় বিজেপির এক বিধায়ক গ্রেপ্তারও হন। দুর্নীতির এই ব্যাপকতা সত্ত্বেও মোদী তা নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি; ফলে, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই ও ইডিকে লেলিয়ে দিয়ে নিজেকে দুর্নীতি দমনের প্রাণপুরুষ রূপে জাহির করার জন্য যে কসরতের ওপর তিনি ভর করে চলেছেন, কর্নাটকে তা আরও একবার কপট ও অসার বলেই প্রতিপাদিত হলো।

বিজেপি-বিরোধী হওয়া এতটাই প্রবল ছিল যে বাসবরাজ বোম্বাই সরকারের একেবারে ১২ জন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। পরাজিতদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশ যিনি ছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার মূল হোতা। আর এটাও এক প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা যে, কংগ্রেস-জেডিএস ভেঙ্গে বিজেপিতে গিয়ে সরকারের মন্ত্রী হওয়া বিধায়কদেরও কর্নাটকের জনগণ ভালো চোখে দেখেননি। তাঁদের অনেকেই পরাজিত হয়েছেন এবং সেই তালিকায় রয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে সুধাকর, পরিবহণমন্ত্রী বি শ্রীরামুলু, আইনমন্ত্রী জে সি মধুস্বামী, ক্ষুদ্রশিল্পমন্ত্রী এম টি বি নাগরাজ, কৃষিমন্ত্রী বি সি পাতিল। আসন প্রাপ্তির দিক থেকে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে ফারাক (১৩৫ বনাম ৬৬) এতটাই হয়েছে যে, ‘প্ল্যান বি’কে সক্রিয় করার কোনো অবকাশ বিজেপির কাছে থাকেনি। ‘প্ল্যান বি’ আসলে বিধায়ক কিনে বা ভাঙ্গিয়া এনে নিজেদের সরকার গড়া, যে খেলাটায় বিজেপি সিদ্ধহস্ত এবং যেটা তারা ২০১৯ সালে কর্নাটকে খেলেছিল, এবং বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হলে যে কৌশলের প্রয়োগে তারা প্রস্তুতও ছিল। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং ১৬ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে প্রচারে নামিয়েও এবং একবছর আগে মুখ্যমন্ত্রী বদল করে ও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেশকিছু নতুন মুখ এনেও কর্নাটকের জনগণের এই প্রবল বিজেপি-বিরোধী মনোভাবে কোনো বদল আনা যায়নি।

কর্নাটকে বিজেপি বিধ্বস্ত হওয়ায় দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে সংসদীয় আসন বৃদ্ধির তার অভিপ্রায় সুনিশ্চিতভাবেই ধাক্কা খেল। কিন্তু এই প্রশ্নটা এখন সবার মনেই উঁকি দিচ্ছে যে, দক্ষিণের রাজ্যের এই ফল উত্তরের রাজ্যগুলোতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে? এ’বছরের শেষে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা, মেঘালয়ে যে বিধানসভা নির্বাচন এবং তারপর ২০২৪ সালে যে সাধারণ নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনগুলোতেও কি বিজেপিকে রোখা যাবে? ২০১৯’র সাধারণ নির্বাচনের আগে কংগ্রেস রাজস্থান-ছত্তিশগড়-মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হলেও ঐ রাজ্যগুলো থেকে ব্যাপক সংখ্যাধিক আসনই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল। কেউ কেউ অতএব বলতেই পারেন যে, কর্নাটকের ফলাফলের তাৎপর্যকে বেশি বাড়িয়ে না দেখাটাই প্রাসঙ্গিক হবে। কিন্তু কর্নাটকের ফলাফল থেকে এটা বেরিয়ে এসেছে যে, বিজেপির বিদ্বেষ-বিভাজন সৃষ্টির ফাঁদে পা না দিয়ে বেকারি, মূল্যস্ফীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো বুনিয়াদি ইস্যুগুলোর প্রতি অবিচল থাকলে জনগণ তাতে অবশ্যই সাড়া দেন। এবং ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের অঙ্গীকারকে অনমনীয় করাটাও বিজেপি প্রতিরোধের অবশ্য শর্ত। তবে, কিছু-কিছু কংগ্রেসি নেতা নরম হিন্দুত্বর প্রতি যে আসক্তি এখনও দেখিয়ে চলেছেন, পরিণামে তা বিজেপির কাছে মওকা হয়েই উঠতে পারে। বিজেপির পরাজয়ের প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে এবং বিরোধী ঐক্যকে অভঙ্গুর করতে পারলে নরেন্দ্র মোদীর অপরাজেয়তাকে পর্যুদস্ত করার সম্ভাবনা একেবারেই অকল্পনীয় নয়।

খণ্ড-30
সংখ্যা-15