বর্তমানে যা বাংলাদেশের অংশ, সেই ঢাকায় প্রায় ৭৮ বছর আগে, ১৯৪৫ সালের ২৩ জুলাই, জন্ম নেয় এক শিশু, যার সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৯৮ সালে যখন তিনি কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বিজ্ঞানী, অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিক। তাঁর যখন বয়েস দু-বছর, সে সময়ে দেশ স্বাধীন হল ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে। ১৯৪৭ সালের আগস্টের মধ্যরাতে সেই স্বাধীনতার আনন্দ উৎসব একই সাথে প্রকটিত করে ধর্মীয় দাঙ্গা এবং দেশ ভাগের দুঃস্বপ্নেরও, যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের “সভ্য” শাসনের অধীনে ইতিমধ্যে লুণ্ঠিত ও নিষ্পেষিত ভারতবর্ষকে দেওয়া বিদায়ী “উপহার”।
সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি তার পরিবারের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত তাদের প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে, চলে আসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা নদীয়ায়। সেখানেই বেড়ে ওঠে সে। চারপাশে ছিল তাদের মতোই আরো অসংখ্য উদ্বাস্তু পরিবার। আজ যখন দামী গৃহশিক্ষক থেকে শুরু করে নানা সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রদের একাংশকে তৈরি হতে দেখি, তখন অবাক হয়ে ভাবি যে কেমন করে অভাব অনটনে জর্জরিত দরিদ্র গ্রামীণ বাংলা সেদিন এদের মতো মানুষদের তৈরি করেছিল, যেমন করেছিল এই ছেলেটিকে কেবল একজন চমৎকার বহুমুখী বিজ্ঞানী করেই নয়, একজন দরদী বুদ্ধিজীবী, একজন গভীর মানবতাবাদী এবং চারপাশের দুর্গন্ধযুক্ত সমস্ত কিছুর আপোষহীন সমালোচক হিসেবে, তা সে নিজের কর্মক্ষেত্রেই হোক বা তার বাইরের জগতে বৃহত্তর সমাজের মধ্যেই হোক।
স্যারকে দাদা বলতে শিখেছিলাম সাহা ইন্সটিটিউটে গবেষণা করতে এসে। কমলেশদাকে পেলাম সেখানে — আমার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, বন্ধু, জ্যাকারি (স্বশাসিত গবেষণাগারগুলির যৌথ সংগ্রাম মঞ্চ) আন্দোলনের সাথী কমরেড যার সঙ্গে গত ২৫ বছর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা বলছি, এবং গভীরভাবে উপকৃত হয়েছি। প্রথম ১০ বছর আমাদের সম্পর্কটা মূলতঃ ছাত্র-শিক্ষকের হলেও, তখনো রাজনীতির প্রসঙ্গ বারে বারেই উঠে এসেছে তার মধ্যে। তিনি আজীবন সিপিআই(এম) দলের সদস্য, আর তার ছাত্র তৎকালীন বাম সরকারের টালিনালা উচ্ছেদের, বাগবাজার খালপাড়ের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রাস্তায়, গরীব মানুষের উপর বাম সরকারের দমন-পীড়ন নিয়ে স্যারের সামনে উত্তেজিত। তিনি কিন্তু চিরদিন এই উত্তেজনাকে ধৈর্যের সঙ্গে ধারণ করেছেন, চট করে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন না। এই সেদিনও তো, ৭-৮ মাস আগের কথা হবে, ফোনে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে একটু কটু ভাষাতেই বললাম যে পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় বামপন্থীরা দেখছি এ দেশের সবচেয়ে বড় বিপদ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চোর ধরতে পুলিশের চাকরি নিয়েছে; পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও দুর্নীতির আন্তঃসম্পর্কের অ-আ-ক-খ কি তারা ভুলে গেলেন? তিনি শুনলেন, তারপর যথারীতি যে প্রসঙ্গে আগে কথা চলছিল, তা নিয়েই কয়েকটি কথা বললেন। আসলে সামাজিক-রাজনৈতিক বহু উত্থান-পতনের দেখে তিনি ধৈর্য ও মুক্তমন, দুই-ই অর্জন করে নিয়েছিলেন, যা খুব বেশি মানুষের মধ্যে আমি দেখিনি। ষাটের দশকে, তিনি যখন ছাত্র ছিলেন, সম্ভবত তাঁর কলেজের সময়কালে, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসেছিলেন, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য মেহনতি মানুষের চলমান লড়াইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কমলেশদা প্রায়ই নদীয়ায় তার এলাকার একজন কমিউনিস্ট নেতা, সম্ভবত গৌর কুন্ডু, নামটি উল্লেখ করতেন, যিনি তাঁকে আর্থ-সামাজিক দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
একজন পদার্থবিদ হিসেবে, আমি তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভা খুব কমই দেখেছি। তিনি উচ্চ শক্তির পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে তাঁর গবেষণা জীবন শুরু করেন এবং পিএইচ ডি করেন সাহা ইন্সটিটিউটে অধ্যাপক বিনায়ক দত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে। তারপর তিনি একটি সম্পূর্ণ নতুন বিষয় বাছাই করলেন, বায়োফিজিক্স। তিনি এটা এত ভালোভাবে শিখে ফেললেন যে তিনি ভারতের সর্বাধিক নামজাদা মেডিকেল ইনস্টিটিউটগুলিতে — যেমন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস (AIIMS), পরে ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস (NIMHANS)-এ যথাক্রমে লেকচারার ও এসিস্টেন্ট প্রফেসর পদে নিযুক্ত হন। তিনি এই ইনস্টিটিউটগুলিতে ডাক্তারি ছাত্রদের কয়েকটি এমডি থিসিসের তত্ত্বাবধানও করেন। এরপর যখন তিনি ভারতের একটি অন্যতম প্রধান পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠান সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (SINP)-এর থিওরি ডিভিশনে যোগ দেন, তখন সেখানে তিনি নিউরোবায়োফিজিক্সে গাণিতিক মডেলিংয়ে পিএইচডি ছাত্রছাত্রীদের তত্ত্বাবধান করেন। এরপর তিনি সেখানকার ইলেকট্রনিক্স বিজ্ঞান বিভাগে চলে যান। এখানে তিনি আবার সম্পূর্ণ নতুন একটি গবেষণার বিষয়ে নিজেকে নিযুক্ত করেন যা কম্প্যুটার সায়েন্সের কাছাকাছি বিষয়। এখানে তিনি সিলিকন নিউরন এবং সিলিকন ভিশনের মতো খুব সমসাময়িক ধারণাগুলি নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং নিউরোমর্ফিক ইমেজ প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে পিএইচডি ছাত্রের তত্ত্বাবধান করেন। এভাবেই কণাপদার্থবিদ্যা থেকে, জীবপদার্থবিদ্যা হয়ে তিনি চলে আসেন সিগন্যাল প্রসেসিং, ইনফর্মেশন প্রসেসিং–এর জগতে। SINP থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তিনি গবেষণা চালিয়ে যান এবং তার তত্ত্বাবধানে লিখিত পিএইচডি থিসিসগুলি মনোজগতের পদার্থবিদ্যা বা সাইকোফিজিক্স-এর গন্ডীতে প্রবেশ করে। আমার মতো অতি সাধারণ মানের গবেষকের কাছে কমলেশদাই সেই হেল্মহোল্টজ, ম্যাক্সওয়েল যার হাত ধরে আমি শিখেছি কি করে ওই মহান বিজ্ঞানীদের অনুসরণ করে ফিজিক্স থেকে ফিজিওলজি বা সাইকোলজির জগতে অনধিকার প্রবেশের চাবি চুরি করা যায়। উত্তরাধিকারসূত্রে আমার কাছে থেকে যাবে তাঁর সংগ্রহে বই — কুফ্লার-নিকলসের From Neuron to Brain, যে বইয়ের উপর সুরসিক কমলেশদা নিজহস্তাক্ষরে লিখেছেন — Stolen from N Pradhan, NIMHANS (ইনি পরে NIMHANS-এর অধিকর্তা হয়েছিলেন) Now belongs to K Bhaumik.
কমলেশদা নিজে ছিলেন SINP-এর বিনায়ক দত্ত রায় (BDR)-এর অত্যন্ত কৃতী ছাত্র, যিনি নিজে ১৯৫০-এর দশকে কণা পদার্থবিদ্যা নিয়ে বাঘা বাঘা নোবেলজয়ীদের মাঝে বিচরণ করে প্রিন্সটনে পিএইচডি করেছিলেন, পরবর্তীকালে JACARI-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। BDR-এর মতোই কমলেশদা সেই বিরল প্রজাতির মানুষ যারা অনায়াসে নিজের প্রতিভা লুকিয়ে রেখে অন্যান্য সহকর্মী এবং ছাত্রদের দক্ষতার প্রশংসা করতে পারেন। অথচ আপনি বিনায়ক দা বা কমলেশদা-কে যে কোনো বিষয় দিন, তারা খুব দ্রুত সেখান থেকে মূল বিষয়গুলো বের করে খুব স্পষ্ট ভাষায় আপনার সামনে উপস্থাপন করবেন। যাকে মানুষ বলে, জন্মগত শিক্ষক, এঁরা ছিলেন তাই। আর কমলেশদা তো একদম নীরবে স্টেজের পিছনে কাজ করতে জানতেন।
BDR চলে যাওয়ার পর গত কয়েক বছরে, তার কাজের বহুমুখীনতা প্রকাশ পেয়েছে আরো নানা দিকে। মনে পড়ছে, তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুর পরে, তাঁর গবেষণার কাজ ব্যাখ্যা করে একটি চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং পরে এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনের উপর একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছিলেন। সেস্টাস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতীয় বর্ণ ব্যবস্থার ঊনবিংশ শতকের মহান সংস্কারক জ্যোতিরাও ফুলের জীবন নিয়ে নেহাই-এ লেখা, শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা থেকে শুরু করে নতুন শিক্ষানীতির বিশদ সমালোচনা পর্যন্ত নানা বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, কোনো ছুৎমার্গিতা ছাড়া অত্যন্ত সুচারু ও গভীর বিশ্লেষণাত্বক বক্তব্য রেখেছেন বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মঞ্চে, দলের বিচার না করে যুক্ত হয়েছেন গণ আন্দোলনে।
শেষের হঠাৎ ধরা পড়া কষ্টের পর্যায়টুকু বাদ দিলে, JACARI থেকে ছুটি নিয়ে কমলেশদা তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি (প্রায় ৬ মাস) আনন্দে কাটিয়েছিলেন তাঁর পরিবারের প্রিয়জনদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই সময়পর্বেও SINP থেকে অবসরের পরে বৌদির সঙ্গে তাঁর ভিয়েতনাম ভ্রমণ ও সেই দেশটি সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস-ভূগোল-রাজনৈতিক উপলব্ধিতে ভরা তাঁর একটি বই — চল যাই ভিয়েতনাম, নেহাই প্রকাশ করেছিল।
একজন শিক্ষক, একজন বন্ধু এবং একজন কমরেডের কেমন হওয়া উচিত, একজন সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী হওয়ার অর্থ কী, কমলেশদা তাঁর এক অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। তিনি চলে গেলেন ঠিক এমন এক সময়ে যখন তাঁর অতিপ্রিয় একটি বিষয় ভারতের বর্তমান ফ্যাসিস্ট কেন্দ্রীয় সরকার লেখাপড়ার সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে দিল। বিবর্তনের অসামান্য ব্যাখ্যাকার ছিলেন কমলেশদা। পদার্থবিদ হয়েও এ বিষয়টা অনেক বায়োলজিস্টের থেকে বোধহয় ভালো বুঝতেন।
তিনি আমাদের মাঝে রেখে গেলেন বৌদিকে, আর আমেরিকায় বিজ্ঞানী হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত তাঁর একমাত্র মেয়ে সংযুক্তা ও জামাই সৈকতদের সঙ্গে দুই আদরের নাতি মনন ও সৃজনকে। তার চিরকলীন দ্রুতগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে গেলেন মাত্র কয়েকদিনের নোটিসে মারণ কর্কট রোগে, আমার মত অর্বাচীনদের ঘাড়ে বড্ড বেশী দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে।
কুন্তল ঘোষ
[অধ্যাপক কুন্তল ঘোষ বর্তমানে আই এস আই, কলকাতায়, মেশিন ইনটেলিজেন্স ইউনিটে কর্মরত, এবং JACARI-এর বর্তমান সম্পাদক। সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ তিনি যখন PhD করেন, তখন তাঁর গাইড ছিলেন অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিক।]