জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক এখন নরেন্দ্র মোদীর বিষ নজরে। তিনি ২০১৯’র সাধারণ নির্বাচনের আগে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে ৪০ জনেরও বেশি সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সিআরপিএফ জওয়ান হত্যাকাণ্ডের পর নরেন্দ্র মোদী প্রশাসনিক ত্রুটি নিয়ে কিছু না বলার নির্দেশ দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি এখন চুপ থাক’। নরেন্দ্র মোদীর সত্যপাল বিদ্বেষ আরও তীব্র হয়েছে দুর্নীতি সম্পর্কে মোদীর মনোভাব নিয়ে মালিকের মন্তব্যে। মালিক বলেছেন, দুর্নীতি বিষয়টাকে মোদী তেমন ঘৃণা করেন না। আর এই প্রসঙ্গে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের দুটো প্রকল্প বাতিলের কথা উত্থাপন করেছেন এবং সেই প্রকল্প দুটোতে দুর্নীতি জড়িয়ে থাকলেও (প্রকল্প দুটো পাশ করানোর জন্য ৩০০ কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব ছিল) আরএসএস-বিজেপি নেতা রাম মাধব প্রকল্প দুটো পাশ করানোর জন্য মালিকের কাছে যে দরবার করেছিলেন সে কথা তিনি ফাঁস করে দিয়েছেন। মালিক তাহলে মোদীর নিশানার বাইরে থাকবেন কি করে? মালিকের অভিযোগের ভিত্তিতে সিবিআই ২০২২’র এপ্রিলে ঐ দুটো প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তে দুটো এফআইআর করে এবং মালিককে দুবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সিবিআই আবারও গত ২৮ এপ্রিল ঐ প্রকল্প দুটোর একটা নিয়ে — যেটা ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারি কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প এবং যেটি পেতে মুখিয়ে ছিল মোদী ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতি অনিল আম্বানি — সত্যপাল মালিককে আবারও পাঁচ ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এখন আবার সিবিআই সত্যপালকে ছেড়ে ঝাঁপাল সত্যপালের ঘনিষ্ঠ ও অনুগত ব্যক্তিদের নাকাল করতে।
গত ১৭ মে ২০২৩ সিবিআই দিল্লীর দশটি ও রাজস্থানের দুটি স্থানে হানাদারি চালায়। সিবিআই’এর নিশানায় ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল থাকার সময় সত্যপাল মালিকের সংবাদ সচিব সৌনক বালি। নয়াদিল্লীর ডিফেন্স কলোনি ও ওয়েস্ট এন্ডে তাঁর বাড়িতে বুধবার সকাল থেকে সিবিআই তল্লাশি শুরু করে। সিবিআই আরও যাদের বাড়িতে হানা দেয় তাঁদের মধ্যে ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরে থাকার সময় মালিকের জনসংযোগ অফিসার বীরেন্দ্র সিং রানা এবং ব্যক্তিগত সহায়ক কুনওয়ার সিং রানা। সিবিআই’এর থাবা আরও যাঁর ওপর পরে তিনি হলেন রাজস্থানের বিজেপি নেত্রী ডঃ প্রিয়ঙ্কা চৌধরি। তিনি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান এবং সত্যপাল মালিকের প্রতি অনুগত। রাজস্থানের বারমের ও জয়পুরে তাঁর বাসস্থানে সিবিআই হানা দেয় ও তল্লাশি চালায়। এঁরা ছাড়া ছয় চাটার্ড অ্যাকান্টেন্টের বাড়িতেও সিবিআই তল্লাশি চালায়।
সিবিআই’এর হামলার পর এক সরকারি কর্তা জানিয়েছেন, “আজ যাদের বাড়িতে এবং অফিসে তল্লাশি চালানো হয়, মালিক রাজ্যপাল থাকার সময় তাদের কয়েকজনের জম্মু ও শ্রীনগরের রাজভবনে অবাধ গতিবিধি ছিল।” যে প্রশ্নটা এরসঙ্গেই উঠছে তা হলো — স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পে তদন্তের স্বার্থে সত্যপাল মালিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়িতে হানাদারি কি অপরিহার্য ছিল? সিবিআই কী যথার্থভাবেই বিশ্বাস করেছিল যে, এই তল্লাশিগুলোয় তদন্তের কিনারার সূত্র মিলবে? সিবিআই’এর অফিসাররা বলছেন, অভিযুক্তদের কাছ থেকে পাওয়া লিখিত ও ডিজিটাল বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণ করেই তাঁরা ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ জনগণের চোখে এই হানাদারির মধ্যে মোদী প্রশাসনের মার্কামারা বৈশিষ্ট্যের ছাপই সুস্পষ্ট। কোনো ধরনের বিরোধিতাকে সহ্য না করাটা নরেন্দ্র মোদীর মজ্জাগত অভ্যাস, আর সত্যপাল মালিককেও প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে বৈরীর যা প্রাপ্য তা মিটিয়ে দিতেই তিনি মনস্থ করেছেন বলে মনে হয়। মালিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে আসলে মালিককেই একটা বার্তা দেওয়া হল। মালিক নিজেও বলেছেন, তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়িতে তল্লাশির আসল উদ্দেশ্য তাঁর হেনস্তা ঘটানো। মালিককে শিক্ষা দিতে এইভাবে তদন্তকে ঢাল করা হলো। তদন্তের এই কপটতার মধ্যে দিয়ে একটা শব্দই সুস্পষ্টভাবে ফুটে বেরোলো — ‘প্রতিহিংসা’।