পরিকল্পনা করা হয়েছিল প্রবীণরা সরে দাঁড়িয়ে এগিয়ে দেবেন নবীনদের। আর হলও তাই।
গত ২৯শে এপ্রিল ক্রান্তি প্রেসের ‘লোকায়ত’ সভাঘরে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ এক ফ্যাসি-বিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সভার শুরুতে পরিষদের রাজ্য সম্পাদক সরিৎ চক্রবর্তী বলেন যে এই অনুষ্ঠান মূলত পরিষদের নিজস্ব এক মিলনসভা, যেখানে প্রবীণরা থাকলেও নবীনরাই পাবেন অগ্রাধিকার। আর এই সভা থেকে প্রাপ্ত ফসল নিয়ে পরিষদ রাজ্যজুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অভিযান পরিচালনা করবে। সভার শুরুতে বালির ‘ইঙ্গিত’ তীব্র প্রতিবাদী স্বরে গেয়ে উঠলেন, “একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, রাজার দোহাই দিয়ে, এযুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি, মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি...”। সভার সুর ও মেজাজ তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর পরিষদের শিক্ষকসম ফ্যাসীবাদ বিরোধী ও এককালের গণনাট্য সংঘের শিল্পীসেনা শ্রী কঙ্কন ভট্টাচার্য মঞ্চে আসেন। তিনি এই মুহূর্তে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ফ্যাসিবাদের ঘনঘটা সম্পর্কে সচেতন করার পর বেশ কিছু গান পরিবেশন করেন তার চিরন্তন সাবলীল গায়কিতে। এরপর শোভনা নাথের পরিচালনায় পরিষদের মধ্যমগ্রাম শাখা বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাগুচ্ছ নিয়ে সমবেত আবৃত্তিতে “কালো রাত কাটে না, কাটে না এত ডাকি, রোদ্দুর এই পথে হাঁটে না...”র পর ভোরের পদধ্বনির আভাস রেখে উচ্চারিত হয়, “তুমি মাটির দিকে তাকাও... তুমি মানুষের হাত ধর...”। এরকম আরও অনেক। আমাদের নতুন তরুণ বন্ধু সায়ন রায় (ঋভু) পরিষদের মঞ্চে এই প্রথম গান শোনালেন। বিশ্বরূপ সাহা নজরুল দিয়ে শুরু করলেন, “এই শিকল পরার ছল মোদের... ওরা ভয় দেখিয়ে করছে শাসন, জয় দেখিয়ে নয়, সেই ভয়ের টুঁটি ধরব চেপে, করব তারে লয়...”। আর শেষ করলেন নীতীশ রায়ের ‘লালন’ দিয়ে। পরিষদের কার্যকরী সমিতির তরুণ সদস্য ও সঙ্গীত পরিচালক সায়ন বিশ্বাস অপূর্ব সাবলীলতায় মিলিয়েছেন “ওরে হল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল” ও আজকের যুদ্ধবাজদের সাবধান করে কবীরের “হোশিয়ার রহনা হ্যায়...”। গেয়েছেন এনআরসির বিরুদ্ধেও। তরুন তুর্কীর মত সপ্তক “ওরা”, “ফুট পাথের ছেলে” ইত্যাদি র্যাপ/ হিপহপ মিউজিকের ঝড়ে দরিদ্র মানুষের জীবনযন্ত্রণার ছবি আঁকলেন। তালে তাল দিল গোটা সভাঘর। কলেজ ছাত্রী নিরভিমানা দাসের “আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি মন বান্ধিবি কেমনে” গানটি ফ্যাসিবাদের মুখে যেন জোরালো এক চপেটাঘাত। মীরা চতুর্বেদী গাইলেন নীতীশ রায়ের গান, “জানি একদিন একদিন আসবে সুদিন, শুধতে হবে শত শহীদের ঋণ”। সাবির রাজা গানে গানে বললেন, “একই চাঁদ ওঠে রাসপূর্ণিমায়, একই চাঁদ ওঠে ঈদে/ একই সে বেদনা মাথা কুটে মরে, মন্দিরে মসজিদে...”। পরিষদেরই সংগঠক অভিজিৎ মণ্ডলের রচিত একটি গানও রাজা গাইলেন, “সব প্রহসন ব্যর্থ ওদের, ওরা দিশেহারা, তাই বিবেক ভুলে, ধর্ম নিয়ে দিচ্ছে মাথা চাড়া”।
অয়ন্তিকার গানে সব ধর্মের প্রতি মিলেমিশে থাকার আকুতি, “আমি মুসলমানের মেয়ে... আমি হিন্দুর সাথে মিশি, তারা আমারই তো মাসি-পিসি...” এমনকি শত্রুর বিপদে তাকেও সাহায্য করার হাত বাড়িয়ে দেয় এ গান। বালির ‘সংযোগ’ গাইল, “মানবো না এই বন্ধনে...”। বৃন্দগানে ‘কান্ডীর’এর “জালিম যাও যাও”এ “বেলা চাও চাও”এর সুর-মূর্ছনা মুহূর্তে মাতিয়ে দিল সভা। শেষে “বাইরে যখন হাজার হাজার লাল পতাকা” গানটি ধরে রাখল সভার বিপ্লবী মেজাজ। দু’টি স্বরচিত কবিতা পাঠ করলেন কবি প্রণব রায় ও কবি গোপাল শেঠিয়ার। সবশেষে অনুপ (বাবুনি) মজুমদারের সেই অনবদ্য কণ্ঠ। পরিষদের রাজ্য সম্পাদক সরিৎ চক্রবর্তীর সুরে তিনি গাইলেন, “গুনগুন চারিদিকে গুঞ্জন চলছে/ চারদিকে জাতপাত ভেদাভেদ আমাদের রক্তে হিংসার জাল আজ বুনছে... এসো শত্রুর জাল কেটে টুকরো করি/ মোরা সবাই মিলে আজ ঝাঁপিয়ে পড়ি/ মিথ্যার প্রলোভন উস্কানি ভুলে আজ/ প্রাণের ছন্দকে আজ স্বাধীন করি”। এভাবে চার ঘণ্টা জুড়ে নতুন, পুরনো ও আন্তর্জাতিক গানে সভাঘর ছিল পরিপূর্ণ। এককভাবে ও পরিষদের শাখা সংগঠনগুলিতেও নবীন মুখের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ছাত্রছাত্রীরাই উদ্যোগ নিয়ে সভাকক্ষ সাজিয়ে তুলেছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে সংহতরূপে সঞ্চালনা করেন নীতীশ রায়। এই উপলক্ষে একটি ফোল্ডার প্রকাশ করা হয়। পরিষদের পক্ষ থেকে উপস্থিত সকলের জন্য ছিল চা জলখাবারের আয়োজন। তারুণ্যের উদ্দীপনা প্রাণিত করেছে গোটা সভাকে, যা আগামীদিনে আরও নতুন গান কবিতা নাটক আলেখ্য ইত্যাদি নিয়ে নতুন ও নবীন মুখের সমাবেশে বৃহত্তর কর্মসূচি নিতে সহায়ক হবে।
- বর্ণালী রায়