আজকের দেশব্রতী : ১১ মে ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
11 may 2023 deshabratijai-jawan-jai-kishanai-jawan

• সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য কুস্তিগীরদের পাশে দাঁড়িয়ে এই আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের রূপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

• এখন আমাদের গোটা দেশকে যন্তরমন্তরের মতো করে গড়ে তুলতে হবে এবং মহিলা কুস্তিগীরদের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে।

গত ৮ মে সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য দিল্লির যন্তরমন্তরে কুস্তিগীরদের বিক্ষোভে যোগ দেন। যারা বিজেপি সাংসদ ব্রীজভূষণ শরণ সিং-এর বিরুদ্ধে সাহসের সাথে বলিষ্ঠ কন্ঠে আওয়াজ তুলেছেন এবং ন্যায়বিচারের জন্য রাজপথে নেমেছেম, সেইসকল কুস্তিগীরের সঙ্গে তিনি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আরও বলেছেন, বিজেপি সরকার একাধিক যৌন নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্রীজভূষণকে কীভাবে আড়াল করছে এবং সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে! কুস্তিগীরদের আন্দোলনকে তিনি সংহতি জানিয়েছেন। কমরেড দীপঙ্কর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “দেশের প্রধানমন্ত্রী কর্ণাটকের নির্বাচনের প্রচার নিয়ে ব্যস্ত। একদিকে ভারতের কুস্তিগীররা সুবিচারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করছে, অন্যদিকে মণিপুরের জনগণের জীবন জেরবার। অথচ, কেন্দ্রের মসনদে বসে থাকা বিজেপি সরকারের নিজের দেশের জনগণের জন্য কোনও সময় নেই।”

যন্তরমন্তরে দ্বিতীয় পর্বের ধর্ণার দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। কোর্টের হস্তক্ষেপে বিজেপি সাংসদ ব্রীজভূষণ শরণ সিং-এর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হওয়ার পর দশদিন পেরিয়ে গেছে। স্বর্ণপদক জয়ী খেলোয়াড়দের যৌন নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তদের কোনওরকম জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আজ পর্যন্ত ব্রীজভূষণকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

সাতজন অভিযুক্তদের মধ্যে একজন নাবালক। তাই দুটি এফআইআর-এর মধ্যে একটি যৌন হেনস্তা থেকে শিশুদের রক্ষা (পকসো) আইনের অধীনে দায়ের করা হয়েছে। ব্রীজভূষণ সিং যদিও জেলের বাইরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে কুস্তিগীরদের হুমকি দিচ্ছেন এবং বলছেন যে তাকে বিজেপি সরকারের উচ্চপদস্থ নেতারা সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন যে, যদি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অথবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ অথবা বিজেপি’র সভাপতি নাড্ডা তাকে পদত্যাগ করতে বলেন, তবে তিনি অবশ্যই পদত্যাগ করবেন। কিন্তু নেতা-মন্ত্রীরা এখনও সর্বত্র নীরব।

jai-palwan

আইসা, এআইসিসিটিইউ, আরওয়াইএ ও আইলাজ-এর সাথে পার্টির সদস্যদের একটি দল যন্তরমন্তরে বিক্ষোভের স্থান পরিদর্শনে গিয়েছিল। সাক্ষী মালিক ও ভিনেশ ফোগাট সহ অন্যান্য বিক্ষোভকারীদের সাথে পার্টির সাধারণ সম্পাদক যোগাযোগ স্থাপন করেন।

ভারতের খ্যাতিমান কুস্তিগীরদের উপর যৌন নির্যাতনের ন্যায়বিচারের দাবিতে এই আন্দোলন গত এক দশকের জনপ্রিয় আন্দোলনগুলির চেতনাকে পুনরায় প্রজ্জ্বলিত করেছে এবং অন্যায় ও ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদের ঢেউ গোটা দেশ জুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছে। কুস্তিগীরদের আন্দোলনকে সামনে রেখে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের সাথে শ্রমিক, ছাত্র, আইনজীবী ও দিল্লির অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মী-সমাজকর্মীদের যন্তরমন্তরে একত্রে জমায়েত করার এই আন্দোলনের শক্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। “জয় জওয়ান, জয় কিষাণ, জয় পালওয়ান” — স্লোগানটি বৃহৎ পরিধিতে প্রতিবাদীদের মধ্যে ঐক্য ও সংকল্পবদ্ধ চেতনার উন্মেষকে তরান্বিত করেছে।

সিপিআই(এমএল) দেশের আপামর জনগণকে কুস্তিগীরদের সমর্থনে দাঁড়ানোর কথা বলেন, ব্রীজভূষণ শরণ সিং-কে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানায় এবং লিঙ্গ ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার এই আন্দোলনে সকলকে আহ্বান জানায়।

- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি

kalrob-kalighatgovernment-employees

৬ মে ২০২৩ তারিখে পশ্চিম বাংলার ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল। তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি তথা হরিশ মুখার্জি রোডে কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের মিছিল করার অনুমতি মেলেনি। সরকারি কর্মচারীদের প্রায় ৬০’র কাছাকাছি সংগঠনের মিলিত ঐক্য সংগ্রামী যৌথমঞ্চ শহীদ মিনারে তাদের অবস্থানের শতাব্দীতে হাজরা মোড় থেকে হরিশ মুখার্জী রোডে মিছিল করতে চাইলে অনুমতি দেয়নি পুলিশ। ফলে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের তরফ থেকে কলকাতা হাইকোর্টে মিছিলের অনুমতি চেয়ে মামলা করা হয়। অবশেষে বিচারক রাজশেখর মান্থ’র এজলাস মিছিলের অনুমতি দেয়। আর সেই অনুমতি সাপেক্ষে সংগ্রামী যৌথমঞ্চের নেতৃত্বে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারী বেলা ১২টার মধ্যে হাজরা মোড়ে জমায়েত হয়। সেখান থেকে দুপুর ১টার সময় শুরু হয় মিছিল। মিছিল হরিশ মুখার্জি রোড ধরে, দু’জন প্রভাবশালী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ও সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জীর বাসভবনের পাশ দিয়ে পুনরায় হাজরা মোড়ে এসে সম্পন্ন হয়।

সংগ্রামী যৌথমঞ্চের অন্তর্ভুক্ত বেশ কয়েকটি সংগঠন হরিশ মুখার্জী রোডে মিছিলের বিরোধিতা করে। প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে সেই বিরোধিতার স্বর তারা প্রকাশ করে। ফলে একটা বিতর্কের পরিবেশ তৈরি হয় যৌথমঞ্চের মধ্যে। এই বিপরীত পক্ষের মতে যৌথ মিটিং’এ হরিশ মুখার্জিতে মিছিলের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও কয়েক জন নেতৃত্ব অগণতান্ত্রিকভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা চেয়েছিলেন শতাব্দীতে শহীদ মিনারে সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে একটা ঐতিহাসিক জনসমাগম তৈরি করতে।

এই দ্বিমুখী বিতর্কের মাঝখানে দাঁড়িয়েও হরিশ মুখার্জী রোডে মিছিল মহাকাব্যিক আড়ম্বরের সঙ্গেই সম্পন্ন হয়েছে। মিছিল শেষে হাজরা মোড়ে একটি সভা করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সেই সভামঞ্চে এসে তাদের মতামত রাখে। ডিওয়াইএফআই/এসএফআই থেকে সৃজন, কলতান’রাও বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য রাখতে এসেছিলেন কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। পরে মঞ্চে বক্তব্য দিতে আসেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা তথা বর্তমান বিজেপির বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং অন্য এক প্রাক্তন তৃণমূল ও বর্তমান বিজেপির শঙ্কুদেব পান্ডা। এটাও একটা বিতর্কিত বিষয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এসে এই মঞ্চে বক্তব্য রাখবেন তা অধিকাংশ সংগঠনের অজানা ছিল। প্রোগ্রেসিভ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ‘PTAB’ সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের একজন শরিক সংগঠন হিসাবে উক্ত মঞ্চে বক্তব্য রাখার জন্য বিপ্লবী যুব এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে রণজয় সেনগুপ্তের নাম প্রস্তাব করে। সেই প্রস্তাব মাফিক মঞ্চে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখেন আরওয়াইএ’র রাজ্য সম্পাদক রণজয় সেনগুপ্ত।

সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ তিনটি মূল দাবিকে সামনে রেখে শহীদ মিনারে একশো দিন যাবৎ ধর্ণা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনটি দাবি হল,                   
১) সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘ্য ভাতা প্রদান।                   
২) শূন্য পদে স্বচ্ছ নিয়োগ।                    
৩) যোগ্য অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ীকারণ।

এই তিনটি দাবিকে সামনে রেখেই মিছিল হয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যকে ঘিরে। তারা বক্তব্য পরিবেশ কালে সংগ্রামী যৌথমঞ্চের উক্ত দাবিসমূহকে গৌণ করে নিজেদের নির্বাচনী জনসভার মতো বক্তব্য দিতে শুরু করেন। শুভেন্দু তো তিনটি দাবির গলায় পা রেখে ‘NO VOTE TO TMC’ শ্লোগানও তুলে দেয়। ফলে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের সংগঠনগুলির মধ্যে একটা তীব্র বিতর্কের সূচনা করে। ‘প্রোগ্রেসিভ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল’ শরিক সংগঠন হিসাবে এটার কঠোর সমালোচনা করে এবং আগামীতে সংগ্রামী যৌথমঞ্চের প্লাটফর্মকে কেউ যাতে নিজস্ব রাজনৈতিক মঞ্চ না ভাবে সে বিষয়ে সজাগ থাকার নিদান দিয়েছে।

সংগ্রামী যৌথমঞ্চের মধ্যে থাকা সংগঠনগুলির মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। এই ঐক্য তাই মতাদর্শগত ঐক্য নয়, দাবির মিলগত ঐক্য। মতাদর্শ যেমন একটা সংগঠনের বুনিয়াদকে দৃঢ় করে রাখে। এখানে সেই মতাদর্শগত দৃঢ়তা নেই, ফলে এই আন্দোলনের সাফল্যে একটা জিজ্ঞাসা মাঝে মাঝেই উঁকি দেয়। তবুও বিভেদের মাঝে মিলন ঐক্য তৈরি করে রেখেছে মহার্ঘ্য ভাতার অধিকার।

- মহঃ মেহেবুব মন্ডল

AI-monster-be-bottledAI-monster

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এবার তার সৃষ্টিকর্তা সহ গোটা মানবজাতিকেই গোগ্রাসে গিলতে উদ্যত হল। তার সর্বগ্রাসী ক্ষিধে, বীভৎস বিভীষিকাময় অবয়বে আতঙ্কিত খোদ কৃত্রিম মেধা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) আবিষ্কর্তা জিওফ্রে হিন্টন। তিনি তাঁর জীবনের প্রায় শেষ লগ্নে এসে নিজের কর্মক্ষেত্র গুগুল থেকে পদত্যাগ করলেন এই দানব সম্পর্কে গোটা মানবজাতিকে সতর্ক করতে। এতদিন পর তাঁর ঘুমিয়ে থাকা বিবেক হঠাৎ জাগ্রত হওয়ায় নিন্দুকেরা বাঁকা হাসি হাসছেন।

মাইক্রোসফট মদতপুষ্ঠ স্টার্ট আপ ওপেন এআই বিরাট শক্তিধর চ্যাটজিপিটি বাজারে আনার পর এক আলোড়ন পড়ে গেছে। আত্মপ্রকাশের মাত্র দু’মাসের মাথায় এই এআই’এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যায়, যা একটা রেকর্ড। বড় বড় টেক কোম্পানিগুলো ব্যাপক সংখ্যায় কর্মী কমিয়ে সেই কাজগুলো এআই মারফত করানোর জন্য বিপুল আর্থিক বিনিয়োগ করছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামও জানিয়েছে ২০২৭’র মধ্যে ৮৩ মিলিয়ন কাজ উবে যাবে। মানুষের মেধা, দক্ষতাকে বহুগুণ ছাপিয়ে যাওয়া এই এআই আজ পৃথিবীর বুকে সাক্ষাৎ এক মানুষখেকো দৈত্য। অল্প সময়ে অত্যাধিক মুনাফা আদায়ের লক্ষ্যে অন্ধ বেপরোয়া কর্পোরেট দুনিয়া কল্পনাতীত সর্বনাশকে সযত্নে ডেকে আনল।

২০১৪’র ডিসেম্বরেই বিশ্বশ্রুত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিন্স বলেছিলেন, “উন্নত ধরনের এআই গোটা মানব জাতির পতন ডেকে আনবে”। এলন মাস্ক বলেছেন, “এটা মানবজাতির অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ, যা পারমানবিক বোমার থেকেও ভয়ংকর”। টুইটারকে নিজের মুঠোয় আনার পর যে এলন মাস্ক মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যায় কর্মীদের ছাঁটাই করলেন, তিনিই আজ এই কৃত্রিম মেধার মধ্যে কাজ খোয়ানোর মারাত্মক বিপদ খুঁজে পেলেন। এমনই পরিহাস। ওপেন এআই’এর চ্যাটজিপিটি এবং অন্যান্য সংস্থাকে টেক্কা দিতে মাস্ক বাজারে আনছেন ‘ট্রুথ জিপিটি’র মতো এআই। তাঁর দাবি, এই নতুন প্রযুক্তির মূল লক্ষ্য হবে ‘পাথ টু সেফটি’, যার অর্থ এটা গোটা মানবজাতির মঙ্গলার্থে নাকি ব্যবহৃত হবে। ইতিমধ্যে মাস্ক, অ্যাপেলের অন্যতম কর্ণধার স্টিভ ওজনিয়াক, দুনিয়াব্যাপী স্বনামধন্য এআই’এর বিজ্ঞানী সহ প্রায় ১০০০ জন এক গণস্বাক্ষর করে আবেদন জানিয়েছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অন্তত ৬ মাসের জন্য এআই’এর সমস্ত কাজকর্মের উপর স্থগিতাদেশ জারি করা হোক। এমন এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হোক যারা শুধু এআই কার্যকলাপের উপরই নজর রাখবে না, বরং তার সঙ্গে সঠিক পদ্ধতি ও তার সীমারেখা নির্ধারণ করবে যেখানে এআই’এর প্রবেশ হবে নিষিদ্ধ। অবস্থা এতই গুরুতর যে এই প্রথম বাইডেন প্রশাসন ওয়াইট হাউসে গুগুল-অ্যাল্ফাবেট-মাইক্রোসফট, গুগুল সাহায্যপুষ্ঠ এনথ্রোপিক, চ্যাটজিপিটির প্রস্তুতকারক ওপেন আই’এর সিইওদের নিয়ে উচ্চপ্রর্যায়ের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক ডাকে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিস, আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সর্বময় কর্তাব্যক্তি, এমনকি তিনটি সেনাবাহিনীকে নিয়ে গঠিত অখন্ড সংস্থার প্রধান কর্ণধার ও হোমচোমড়া আমলাকুল! অল্পক্ষণের জন্য বাইডেন সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন। বৈঠকের পর হ্যারিস বলেন, “আমরা ওই সমস্ত বেসরকারি সংস্থাগুলোকে বলেছি যেন তারা যথাযথ নীতিসম্মত আচরণ বিধি, নৈতিকতা ও আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে সুরক্ষাজাল ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে”। বাইডেন বলেছেন, “আপনারা যা করছেন তার মধ্যে যেমন রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা, তেমনি নিহিত রয়েছে মারাত্মক বিপদ”।

‘রোবো স্যাপিয়ান্স’ বনাম ‘হোমো স্যাপিয়ান্স’এর এই অস্তিত্ববিনাশী যুদ্ধে কে জিতবে কে হারবে তা এখনো নির্ধারিত হয়ে যায়নি। এই দানবকে বশ মানাতে কি পারবে মানবসভ্যতা, তার অগ্নিপরীক্ষা আজ সামনে।

trial-became-a-farcewhen-the-trial

গণতন্ত্রকে সক্রিয় ও সচল হতে গেলে বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা অপরিহার্য – এই আপ্তবাক্যের অভ্রান্ততা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ কোনোকালে ছিল না, আজও নেই। তবে, আদালতের রায়ের মান্যতা আবশ্যক হলেও কিছু-কিছু রায়ই কিন্তু কাঠগড়ায় উঠছে। সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে ন্যায়বিচার লাভ একেবারে দুর্লভ না হলেও কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের অবস্থান এবং বহু ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতগুলোর রায় ন্যায্য প্রতিপন্ন হওয়ার চেয়ে স্বৈরাচারী শাসক স্বার্থের অভিমুখীই হচ্ছে। এখানে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে আসা উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাত আদালতের দুটি রায় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব যেগুলো ন্যায়বিচার প্রদানের বিপরীতে প্রহসন হয়েই দেখা দিয়েছে।

একটা রায় এ বছরের ৩১ মার্চ এল উত্তরপ্রদেশের মিরাটের এক আদালত থেকে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার ৩৩ বছর পর, এবং ঐ রায়ে বিচারক লখবিন্দার সিং সুদ ৩৯ জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস দিয়ে দেন। রায়টা ছিল উত্তরপ্রদেশের প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনী (পিএসি) এবং দাঙ্গাবাজ হিন্দু জনতার হাতে নারী-শিশু-সহ ৭২ জন মুসলিম জনগণের নিহত হওয়া প্রসঙ্গে। তৎকালীন কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়ায় দেশের বিভিন্ন অংশেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, এবং সেই উত্তেজনা ধিকিধিকি চলতেই থাকে। ১৯৮৭র মে মাসে উত্তরপ্রদেশের মিরাটে দাঙ্গা পরিস্থিতি সংকটজনক হয়ে ওঠে, ১৭ মে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে প্রাণঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী বীরবাহাদুর সিং কারফিউ জারি করেন, এবং জেলায় শান্তি বজায় রাখার জন্য রাজ্য সরকার ১১ কোম্পানি পিএসি পাঠায়। পিএসি গিয়েই মুসলিম জনগণের ওপর আক্রমণ শুরু করে। যেদিন গণহত্যা সংঘটিত হয়, সেই ২৩ মে পিএসি-র সঙ্গে হিন্দু দাঙ্গাবাজ জনতা হাত মিলিয়ে মালিয়ানায় হত্যার তাণ্ডবে মেতে ওঠে। মালিয়ানায় ঢোকা এবং বেরোনোর পাঁচটা পথকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়, পিএসি ও মারমুখী হিন্দু জনতা বন্দুক ও তরোয়াল-বর্ষার মতো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এবং স্থানীয় জনগণের মতে ৭২ জন মুসলিম জনগণকে হত্যা করা হয়।  সরকার ঘটনার পরপরই এফআইআর করার কথা ভাবতে পারেনি, প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি ৩০ মে মালিয়ানা পরিদর্শনের পরই কেবল এফআইআর করা হয়।

বিচারক তাঁর রায়ে বললেন, “সাক্ষীরা অভিযোগ করেছে, এক সাধারণ উদ্দেশ্যের চরিতার্থতায় অভিযুক্তরা বেআইনী সমাবেশ ঘটিয়েছিল। এই মামলায় সম্পত্তি লুট হওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির কাছ থেকেই তা উদ্ধার করা যায়নি। ঘটনার সময় ব্যবহৃত কোনো অস্ত্রই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা যায়নি। লিপিবদ্ধ নথিতে এমন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই যা স্পষ্ট করে জানায় যে কোন্ অভিযুক্তর নির্দিষ্ট অপরাধ সংঘটনে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল এবং বাদী পক্ষকে আক্রমণের জন্য কোন অভিযুক্ত কোন অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। সমস্ত অভিযুক্তর বিরুদ্ধেই অভিযোগগুলো একই ধাঁচে করা হয়েছে।”

এই রায়ের পর এখন মিরাটে, মালিয়ানার পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরছে এই প্রশ্নগুলো – ৭২ জন মানুষ যদি নিহত হয়ে থাকে তবে কাদের হাতে তাদের হত্যা হয়েছিল? লুট হওয়া সম্পত্তি যদি উদ্ধার না হয়ে থাকে, যে অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল তা যদি খুঁজে না পাওয়া গিয়ে থাকে, দায়ের করা এফআইআর-এ অভিযুক্তদের অপরাধ যদি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত না হয়ে থাকে তবে দায়টা কার? এটা কি প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই ইঙ্গিত করে না? প্রশাসন কি অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে আদৌ আগ্ৰহী ছিল? মালিয়ানার পাশাপাশি ১৯৮৭র ২২ মে হাসিমপুরাতেও সংঘটিত হয়েছিল গণহত্যা যাতে পিএসির সদস্যরা ৪২ থেকে ৪৫ জন মুসলিমকে ট্রাকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ক্যানেলের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেই গণহত্যায় অভিযুক্ত পিএসি সদস্যদের শাস্তি প্রদানে যিনি প্রশংসনীয় ও দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেন, সেই আইপিএস অফিসার বিভূতি নারায়ণ রাই মালিয়ানার রায় সম্পর্কে জানিয়েছেন – “এই রায় একেবারে শুরু থেকেই পুলিশের মামলাটাকে দুর্বল করে তোলার পরিণাম। এফআইআর-এ বেশকিছু ফাঁক-ফোকর ছিল। এফআইআর-এ অভিযুক্ত পিএসি সদস্যদের নামের উল্লেখ ছিল না। ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলোকে পাল্টে দেওয়া হয়। হিংসায় বেঁচে যাওয়া মানুষদের বিবৃতিগুলোকে ভুলভাবে নথিবদ্ধ করা হয়। হাসিমপুরার মতোই সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।” এখানে উল্লেখ্য, পুলিশ নির্দিষ্ট অভিযুক্তদের খুঁজে বার করার পরিবর্তে ভোটার তালিকা থেকে ইচ্ছে মতো ৯৩ জনের নাম তুলে নিয়ে অভিযুক্তদের তালিকা বানিয়েছিল, যাদের মধ্যে বেশকিছু ব্যক্তি গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অনেক আগেই মারা গিয়েছিল এবং এটাও মামলা দুর্বল হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল।

আর, বিচারকও কি ন্যায়বিচার প্রদানে অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন? অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পেশ হওয়া অভিযোগগুলো প্রমাণের লক্ষ্যেই কি তিনি সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্ৰহণ করেছিলেন? রায় বেরোনোর পর এক সাক্ষী মহম্মদ ইসমাইল জানিয়েছেন (যিনি দাঙ্গায় তাঁর প্রায় পুরো পরিবারকেই হারান) – “আমার বক্তব্য নথিবদ্ধ করাটাকে বিচারক প্রয়োজনীয় মনে করেননি। আমাকে জানুয়ারির গোড়ায় আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম বিচারক ছুটিতে গেছেন। আর এখন আমি খবরের কাগজ থেকে এই রায়টা জানতে পারলাম।”

সাম্প্রতিক কালের অন্য আর একটা যে রায়ে ন্যায়বিচার মুখ থুবড়ে পড়ে তা হল ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি নারোড়া গাম গণহত্যায় আমেদাবাদের বিশেষ আদালতের বিচারক শুভদা বক্সীর ২০ এপ্রিলের রায় যাতে ৬৭ জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। নারোড়া গাম ছিল নরেন্দ্র মোদীর শাসনাধীনে গুজরাতে ২০০২-এর মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গার অন্যতম অকুস্থল। সেদিন একই মুসলিম পরিবারের নারী-শিশু-সহ ১১ জনকে ঘরে আটকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। ঐ মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন ৬৭ জন এবং অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন সেই সময়ের মোদী সরকারের মন্ত্রী মায়া কোডনানী এবং বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গি। বহু প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আদালতে তাঁদের সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার দিন তাঁরা মায়া কোডনানীকে নারোড়া গামে সশরীরে হাজির থাকতে এবং দাঙ্গায় প্ররোচনা দিতে দেখেছিলেন। আর, অমিত শাহ ২০১৭র ফেব্রুয়ারি মাসে মায়া কোডনানীর হয়ে সাক্ষী হিসাবে হাজিরা দিয়ে আদালতে বলেন, ১১ জনকে পুড়িয়ে মারার দিন তিনি সকাল সাড়ে আটটায় মায়া কোডনানীকে বিধানসভায় দেখেছিলেন এবং বেলা সওয়া এগারটা নাগাদ সোলা সিভিল হাসপাতালেও তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেখেছিলেন। কাজেই, দাঙ্গার সময় নারোড়া গামে কোডনানীর উপস্থিতি অবিশ্বাস্য। অমিত শাহর সদর্প সাক্ষ্যের চাপে নারকীয়তা চাক্ষুষ করা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য তলিয়ে গেল এবং শাসক দলের প্রতাপান্বিত নেতার সাক্ষ্য বিচারকের কাছে শিরোধার্য হল। এই গণহত্যার তদন্ত যাতে দ্রুত সমাধা হয় তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গড়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ‘দ্রুততার’ বাস্তবায়ন ঘটল গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার ২১ বছর পর সমস্ত অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেওয়ার মধ্যে দিয়ে, এবং রায় ঘোষণার পর আদালত চত্বর বিস্ফোরিত হল ‘জয় শ্রীরাম’, ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনির অট্টনাদে। বিচারকের কানেও সেই আওয়াজ নিশ্চয় পৌঁছেছিল! তবে, গণহত্যার এই ঘটনার বিচারের পর যে প্রশ্নগুলো রয়ে গেল এবং চর্চায় ফিরে এল তা হলো: পুলিশের উপস্থিতিতেই যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, তাতে কাদের হাত ছিল? তাদের সনাক্ত করাটা কি খুবই দুঃসাধ্য ছিল? গুজরাত সরকার কাদের পাশে দাঁড়াতে আগ্ৰহী ছিল – নিহতদের পরিবারের নাকি অভিযুক্তদের?

অতএব, প্রশ্ন আজ উঠছে ন্যায়বিচারের অভিভাবকের দৃঢ়তার অভাব নিয়ে, বহু মামলাতেই ন্যায়বিচার প্রদানে বিচারবিভাগের ব্যর্থতা নিয়ে। এরই পাশাপাশি বিচারের প্রহসনে পর্যবসিত হওয়াও এক চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছে, এবং “গণতন্ত্রের জননী” রূপী এই দেশে বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকছে না। জনগণের বুনিয়াদি অধিকারের রক্ষায় আদালতের ব্যর্থতাও প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। সরকারের স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপকে সমালোচনায় ফেলে নাগরিকের নিপীড়ন প্রতিরোধ ও অধিকার সুরক্ষার পরামর্শ আদালতের কাছ থেকে কদাচই আসে। এছাড়া, আদালতকে ও বিচারপতিদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার মোদী সরকারের প্রচেষ্টাতেও কোনো খামতি নেই। আদালতকে সরকারের বশংবদ পরিণত করা চলবে না, বিচারের প্রহসন নয়, চাই ন্যায়বিচার – এই দাবি অত্যন্ত সংগতভাবেই আজ হয়ে উঠেছে নাগরিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।

- জয়দীপ মিত্র

west-bengal-its-dynamics-and-crisisdynamics-and-crisis

পশ্চিম বাংলা কৃষি সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রবণতা আজকের নয়, ১৯৯০ থেকেই আমাদের এই রাজ্যে কৃষির স্থবিরতা ফুটে ওঠে। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসন বা মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারের তিন তিনবার নিরবচ্ছিন্ন শাসনকাল যে কৃষি অর্থনীতি বা রাজ্যের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নে সহায়ক হয়ে উঠল না, তা বলাই বাহুল্য। অন্যভাবে বলা যায়, রাজ্যের মসনদে স্থায়ী শাসন আমাদের রাজ্যে কৃষি বা শিল্প বা সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ। ২০০৮ সালে রাজ্য বিধানসভায় ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২৩৪টি আসন বামফ্রন্টের পক্ষে থাকলেও তখন থেকেই কৃষি বা শিল্পে পতনের লক্ষণগুলো প্রকট হতে শুরু করে।

বর্তমানে ফিরে আসার আগে একবার পেছনের দিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। বাম জমানায় মানব উন্নয়নের সূচকের মাপকাঠিতে ১৭টি প্রধান প্রধান রাজ্যের সাপেক্ষে বাংলা ছিল ১০ নম্বরে। তখন গ্রাম বাংলায় মাত্র ৩২ শতাংশ পরিবার বিদ্যুতের সংযোগ পেয়েছিলেন, যা এই রাজ্যকে দেশের মধ্যে সেই সময়ে নামিয়েছিল ১৩ নম্বরে। স্বাক্ষরতার মাপকাঠিতে কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকলেও পড়ুয়ারা স্কুলে গড়ে ৪.৪ বছর টিকে থাকত। সবার নিচে বিহারের অবস্থান থেকে যা ছিল মাত্র একধাপ উপরে। সেই সময় থেকেই অন্য রাজ্যের তুলনায় এই রাজ্যে প্রাইমারি স্তরে স্কুলছুটের গড় হার খুব বেশি ছিল। এতদসত্ত্বেও বামফ্রন্ট সংসদীয় রাজনীতিতে কিভাবে তার আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়, তার আলোচনার পরিসর এটা নয়। (তথ্যসূত্রঃ দ্য ইকনমি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, রতন খাসনবিস, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি, ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮)।

সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’র ২২ এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যায়। লেখকদ্বয় : সোহম ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনীল দাসগুপ্ত। সেখানে তাঁরা রাজ্যের কৃষি সম্পর্কে যে সমস্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা সংক্ষিপ্তভাবে এখানে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

১) ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫’র সর্বশেষ সমীক্ষায় (২০১৯-২০) দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারের (৬৫.২ শতাংশ) হাতে এক ছটাকও কৃষি জমি নেই। গ্রাম বাংলার প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল — কৃষিজীবী পরিবারগুলো অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তাদের জমি খোয়াচ্ছে। উল্লিখিত সংস্থাটি যখন ১৯৯৮-৯৯ সালে এনিয়ে সমীক্ষা চালায় তখন দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে কৃষি জমি খোয়ানো পরিবারের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক, ৫০.৮ শতাংশ। যত দিন গড়াচ্ছে, ততই জমি খোয়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। অর্থাৎ, বাম জমানায় যে প্রবণতার শুরু, তৃণমূলের ১২ বছরের শাসনে তা আরও গতি পেয়েছে।

২) গ্রাম বাংলায় এখন কৃষিকে প্রধান জীবিকা করে টিকে থাকা পরিবারের সংখ্যা আরও কম। আর, এর মধ্যেও রয়েছে বিরাট তারতম্য। ২০২০’র পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (যা কোভিডের আগে করা হয়েছিল) থেকে উঠে আসছে সমগ্র গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে ২৪.১ শতাংশ কৃষিতে স্বনিযুক্ত, অর্থাৎ, যাদের আয়ের প্রধান উৎসই হল কৃষিতে স্বনিযুক্ত শ্রম। এই বর্গকে ব্যাপক অর্থে কৃষিজীবী পরিবার হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে।

৩) যে সমস্ত পরিবারগুলোর কাছে আয়ের প্রধান উৎস এখনও কৃষি রয়েছে, অত্যন্ত ক্ষুদ্র জোতের কারণে কৃষি থেকে আয়ের প্রধান রাস্তাও দ্রুতই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সমীক্ষা দেখিয়েছে, রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ৮০ শতাংশ কৃষি জোতের আকার হল ০.৫ হেক্টারের কম। আর, গড়ে, যা ০.২ হেক্টার। এত ক্ষুদ্র জোতে চাষবাস করে বেঁচে বর্তে দিন গুজরান করার মতো আয় ওই জমি থেকে সম্ভব নয়। ফলে, ওই সমস্ত পরিবারগুলো বিরাট পরিমাণে অ-কৃষি ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল। ফলে বলা যায়, ৮০ শতাংশেরও বেশি কৃষিজীবী পরিবারগুলো, যাদের নিম্নতম স্তরটি হচ্ছে প্রান্তিক কৃষক, তাঁদের সর্বহারাকরণ ঘটছে। ২০০২-০৩ সালে বাম জমানায় এই হার ছিল ৭০ শতাংশ।

৪) কৃষিকাজে স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদের বয়সের হারও বিগত দশকে বদলেছে। বর্তমানে কৃষিতে স্বনিযুক্ত কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির গড় বয়স ৪৫’র বেশি। এক দশক আগে যা ছিল ৩৭.৫ শতাংশ।

৫) বাংলার কৃষকদেরও বয়স বেড়ে গেছে। তাঁরা এখন অ-কৃষি কাজের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। কৃষিজীবী পরিবারগুলোর মধ্যে ছোট্ট একটা অংশের হাতে রয়েছে ০.৫ হেক্টারের বেশি জমি, যেখান থেকে তাঁরা প্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত আহরণ করে দিন কাটান। কিন্তু অবশিষ্ঠ গরিষ্ঠাংশ সব কিছু খুইয়ে সর্বহারা হয়েছে। লেখকদ্বয়ের অভিমত, এই কারণে উত্তর-পশ্চিম ভারতের চাষিদের মতো এরাজ্যের বৃহদাংশ কৃষক কৃষি উপকরণের, চাষবাসের ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আলোড়িত হন না, কারণ বিপুল সংখ্যক কৃষকদের কাছে অ-কৃষি কাজই উপার্জনের প্রধান উৎস।

৬) ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত কৃষিতে অনিয়মিত বা ক্যাজুয়াল মজুর, যাদের কাছে কৃষিই উপার্জনের প্রধান অবলম্বন — এই সংখ্যাটা ছিল সমগ্র কৃষিজীবী পরিবারের ১৯ শতাংশ। ২০১১-১২ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৩৪ শতাংশ। কৃষিতে অনিয়মিত মজুর হিসাবে গ্রামীণ মজুরদের যুক্ত থাকার হার বর্তমানে প্রায় ২১ শতাংশ। এই তথ্য থেকে লেখকেরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন তা হল, বাংলার কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতা ক্রমেই কমছে, আর তার অন্যতম কারণ হল বেশ কিছু ক্ষেত্রে শ্রম সাশ্রয়কারী যন্ত্র কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। নানা তথ্য দিয়ে তাঁরা দেখিয়েছেন, ২০১১-১২-তে হেক্টর পিছু ধান চাষের জন্য গড়ে দৈনিক আট ঘন্টা হিসাবে ১৪৮.২ শ্রম দিবস ব্যবহৃত হয়েছিল, যা ২০১৯-২০-তে ১২৪.২ শ্রম দিবস অর্থাৎ ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সময়কালে এরাজ্যে বরো চাষের জমির পরিমাণও বেশ খানিকটা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। সেচের খরচ ক্রমে বাড়ার কারণও এর অন্যতম।

৭) কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি স্থান না পেয়ে যে গ্রামীণ উৎপাদন ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। বরং আমাদের রাজ্যে ঘটছে ঠিক তার বিপরীত। গ্রামীণ উৎপাদন শিল্পে গ্রামীণ শ্রমশক্তি জায়গা করে নেওয়া বিগত দশকে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে ৪.৫ শতাংশ বিন্দুতে। ২০১১-১২-তে ১৬ শতাংশ থেকে নীচে গড়িয়ে ২০১৯-২০ সালে ১১ শতাংশের সামান্য উপরে দাঁড়িয়েছে।

উৎপাদন শিল্পে গ্রামীণ শ্রমশক্তি স্থানান্তরিত হওয়ার বদলে তা বড় মাত্রায় যেখানে জায়গা খুঁজে নিয়েছে তা হল নির্মাণ ক্ষেত্র। এখন নির্মাণ শিল্পের গোটাটাই অনিয়মিত মজুর। গ্রামীণ বাংলায় মহিলা শ্রমিকদের অংশগ্রহণ গত এক দশকে মোটেই বাড়েনি।

বাংলার গ্রামে এই বদল, শ্রেণিশক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্যের এই পরিবর্তন, কৃষি অর্থনীতিতে ঘনিয়ে আসা গভীর সংকট আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে কঈ প্রভাব ফেলে তা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, গ্রাম বাংলায় দারিদ্রতা, সর্বহারাকরণ বিরাট গতিতে বাড়ছে, বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ শ্রমশক্তি পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে উন্নত মজুরির সন্ধানে। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু পুরুষই নয়, গোটা পরিবার নিয়েই ভিনরাজ্যে চলে যাওয়ার এই প্রবণতা শুরু হয়েছে।          
গভীর সংকটে নিমজ্জিত বাংলার গ্রাম্যজীবন।

- অতনু চক্রবর্তী

aiarla-aikm-joint-meetingaikm-joint-meeting
কাজ খাদ্য জমির অধিকারের দাবিতে প্রচার ও গণসংযোগ অভিযানে লক্ষাধিক স্বাক্ষর সংগ্রহের কর্মসূচি

কলঙ্কিত রাজ্য শাসকেরা যখন নিজেদের সংকট থেকে মানুষের নজরকে ঘুরিয়ে দিতে তথাকথিত গণজোয়ার যাত্রা করছে। সীমাহীন দুর্নীতি দলবাজি ও প্রশাসনের সার্বিক ব্যর্থতার ফলে গড়ে ওঠা গণক্ষোভের মুখে বেগতিক বুঝে ওরা পঞ্চায়েত নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে গ্রামাঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গণসংযোগ অভিযান চালিয়ে লক্ষাধিক স্বাক্ষর সংগ্রহের কর্মসূচি গ্রহণ করল আয়ারলা ও এআইকেএম। আজ যখন বিজেপি আরএসএস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার এ রাজ্যের গরিব মানুষদের বঞ্চনা করে চলেছে, সুযোগ পেলেই বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা লাগিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তখন এই অভিযানে তার বিরুদ্ধেও জনমতকে সংগঠিত করা হবে। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি গড়ে তুলতে যে আওয়াজকে তুলে ধরা হবে তা হল —

পঞ্চায়েতকে দলতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের শাসন থেকে মুক্ত করো, গ্রামীণ জনতার অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করো। সন্ত্রাসমুক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচন ও কাজ, মজুরী, আবাস, ফসলের ন্যায্য দামের অধিকারের দাবীতে জোট বাঁধো তৈরি হও।

এই অভিযানে ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ ও বকেয়া মজুরির দাবিতে রাজ্যপালের উদ্দেশ্যে এক মাসব্যাপী জবকার্ড নং সহ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ চালানো হবে। গত ৭ মে বর্ধমানে আয়োজিত এক যৌথ কর্মী সভা থেকে এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১০ মে থেকে ১০ জুন স্বাক্ষর সংগ্রহ চালিয়ে রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হবে। এছাড়া উত্তরবঙ্গে তিস্তা প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা তাঁদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে রাজ্য সরকারের কাছে দাবিসনদ পেশ করবে এবং এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে।

এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করে পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বলেন, সারা দেশের পাশাপাশি এ রাজ্যেও সংকটগ্রস্ত কৃষি-অর্থনীতি তলানিতে এসে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ এ রাজ্যে ৬৫ শতাংশ গ্রামীণ মানুষের এক ছটাকও জমি নেই। ৭০ শতাংশ মানুষ জমি হারিয়েছে। মাত্র ২৪ শতাংশ পরিবার স্বনিযুক্ত কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। চুক্তি-চাষ বিরাট পরিমানে বেড়ে গেছে। তাই কৃষিক্ষেত্রকে রক্ষা করার বিষয়টিকে কেন্দ্রে রেখে আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনী প্রচারে এই প্রশ্নটাকেই আমাদের জোরের সাথে তুলে ধরতে হবে। গ্রাম সংসদ তথা গণতদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

আগামী আশু কাজ হিসাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে বর্ধিত সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, গ্রামে গ্রামে গণস্বাক্ষর সংগ্রহে প্রতিটি গ্রামসভায় কমপক্ষে ১০০ বাড়ি যাওয়া, গ্রাম সংসদ ভিত্তিক কর্মীবৈঠক ও গ্রামসভা করা, সম্ভাব্য সমস্ত শক্তিকে সমাবেশিত করে স্থানীয়ভাবে জমায়েত ও মিছিলের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া,

২৫ মে নকশালবাড়ি দিবসে প্রচার কর্মসূচি নেওয়া, অঞ্চল পঞ্চায়েতে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা, স্থানীয়ভাবে আন্দোলনমুখী উদ্যোগ নেওয়া, মহিলা, ছাত্র-যুব, শ্রমিক সংগঠনের সাথে যুক্তভাবে প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করা। এছাড়া গণপ্রচারে ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার, গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হোয়াটসঅ্যাপ সংযোগ গড়ে তোলা। পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে সংযোগ গড়ে তোলা। গ্রামসংসদ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য ও আইন নিয়ে প্রচার করা।

aiarla-meeting

প্রচারে যে দাবিগুলো তুলে ধরা হবে তা হল —

  • ১০০ দিন কাজের আইন অনুযায়ী সকল জবকার্ডধারী গরিবদের কাজ, বকেয়া মজুরি এবং কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত ৪২৯ টাকা ন্যুনতম মজুরি দিতে হবে। নয়া ডিজিটাল হাজিরার বিধি বন্ধ করতে হবে।

  • আবাস যোজনায় দুর্নীতি দলবাজি বন্ধ করে সকল গরিবদেরকে ঘর দিতে হবে, সহায়তা বৃদ্ধি করে ৫ লক্ষ টাকা করতে হবে। বাসগৃহের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

  • দীর্ঘদিন বসবাসের জমিতে গরিব মানুষকে বাস্তুপাট্টা দিতে হবে। নতুন করে বাসগৃহ আইন প্রণয়ন করতে হবে।

  • ন্যূনতম মজুরির হারবৃদ্ধি করতে হবে এবং তাকে কার্যকরী করতে নির্দিষ্ট পরিকাঠামো সুনিশ্চিত করতে হবে।

  • খাদ্য নিশ্চয়তা আইনকে শক্তিশালী করতে হবে। চাল, আটা, ডাল, তেল, সব্জি, চিনি, দুধ ইত্যাদি রেশনের মাধ্যমে দিতে হবে।

  • ফসলের লাভজনক দাম গ্যারান্টি আইন করতে হবে। গ্রামে ক্যাম্প করে ২০৪০ টাকা সরকারি দরে ধান কিনতে হবে।

  • গরিব চুক্তিচাষিদের সরকারি নথিভূক্ত করতে হবে, তাদের কৃষক বন্ধু সহ সমস্ত সরকারি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

  • বনাঞ্চল সহ আদিবাসীদের সমস্ত জমির পাট্টা ও পরচা দিতে হবে।

  • বর্গা উচ্ছেদ বন্ধ করো, বর্গা আইন কঠোরভাবে লাগু করতে হবে

  • সকল দলিত ও দরিদ্র শ্রমজীবীর সরকারী ও মহাজনী ঋণ মকুব করতে হবে। বিনা সুদে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রদান করতে হবে। মাইক্রোফাইন্যান্স কোম্পানিগুলির সুদের হার কমাতে হবে। জোর করে ঋণ আদায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করতে হবে।

  • সমস্ত দলিত ও দরিদ্র সহ বিপিএল পরিবারের করোনা সময়কালের বিদ্যুৎ বিল মকুব করতে হবে। এদের বিনামূল্যে মাসিক ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ দিতে হবে।

  • মানুষ মারা মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য শস্য, ঔষধ সহ চিকিৎসা ব্যয়ের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর। দরিদ্র শ্রমিকদের জন্য মহার্ঘ্য ভাতা চালু করতে হবে।

  • ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও হামলার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে দ্রুত মামলা দায়ের করতে হবে।

demonstration-of-the-landless-at-siligurisiliguri-sub-district-council-office

শিলিগুড়িতে কাওয়াখালি-পোড়াঝাড় ভূমিরক্ষা কমিটি ও তিস্তা-মহানন্দা প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কমিটির পক্ষ থেকে প্রথমে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ অফিসে জেলাশাসকের উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। তার আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম থেকে মিছিল করে মহকুমা পরিষদ দপ্তরের সামনে এলে পুলিশ মিছিলের গতিরোধ করে। মিছিল থেকে ৭ জনের প্রতিনিধি দল স্মারকলিপি পেশ করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন এআইসিসিটিইউ থেকে বাসুদেব বসু, সিটুর পক্ষ থেকে গৌতম ঘোষ, ইউটিইউসি থেকে তাপস গোস্বামী, এআইকেএমএস থেকে অমল রায়, কাওয়াখালি পোড়াঝাড় ভূমি রক্ষা কমিটির পক্ষে মিঠু মল্লিক, স্বপ্না বাইন ও তিস্তা মহানন্দা ভুমি রক্ষা কমিটির পক্ষে সুরেন দাস। স্মারক লিপিতে দাবি করা হয়,

১) অবিলম্বে কাওয়াখালি পোড়াঝাড় অঞ্চলে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দিতে হবে।               
২) বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কৃষকদের পুনর্বাসন না দেওয়া হলে উৎসধারা আবাসন প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হবে।               
৩) কর্তৃপক্ষকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে যুক্ত বৈঠকের ব্যবস্থা করতে হবে, ইত্যাদি।

পরিশেষে বাসুদেব বসু বিস্তারিতভাবে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার সারমর্ম তুলে ধরেন। পরবর্তীতে উত্তরায়ণে এসজেডিএ দপ্তরে যাওয়া হয়। একই প্রতিনিধি দল এসজেডিএ সিইও’র সাথে সাক্ষাত করে। সেই সাক্ষাতে সিইও জানান ২৫২ জনের নামে জমি বণ্টন ও আবাসন গড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। এইসব নিয়ে দ্রুত বৈঠক ডাকা হবে। সমস্ত কর্মসূচিতে দার্জিলিং জেলার এআইকেএম সম্পাদক পবিত্র সিংহ নেতৃত্ব দেন। উপস্থিত থাকেন শরৎ সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, মুক্তি সরকার প্রমুখ।

police-attack-on-protesting-wrestlersprotesting-wrestlers

মধ্যরাতে আন্দোলনরত কুস্তিগীরদের উপর পুলিশি আক্রমণকে ধিক্কার জানিয়ে এবং বিজেপি সাংসদ ব্রীজভূষণ সিং’কে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার দাবিতে ৫ মে ২০২৩ কলেজ স্ট্রীটে আইসা’র উদ্যোগে বিক্ষোভ সভা করা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন কমরেড সায়ন্তন ও অনন্যারা। সভা সঞ্চালনা করেন কমরেড ত্রিয়াশা।

aiarla-program

সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এর যৌথ উদ্যোগে ত্রিপুরায় সর্বভারতীয় ব্লক ডেপুটেশন কর্মসূচি গোমত জেলা সদর উদয়পুর মহকুমাশাসক (এসডিএম)-এর নিকট মাননীয় রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্য ১০ দফা দাবিতে অনুষ্ঠিত হয়।

এই ডেপুটেশনে ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকারের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল মহকুমাশাসকের অনুপস্থিতিতে অতিরিক্ত মহকুমাশাসককে ডেপুটেশন দেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন গোমতী জেলা কমিটির সম্পাদক গোপাল রায়, রাধাকিশোরপুর লোকাল কমিটি সম্পাদক দেবাশীষ রায় ওরফে রবি, খেতমজুর সভার পক্ষে মোজাম্মেল আহম্মেদ সরকার, বাবুল দত্ত, তাজের ইসলাম খাদিম, নজীর মিয়া সরকার, সন্তোষ দাস প্রমুখ। এখানে উল্লেখ্য, ব্লক কর্মসূচি হলেও মাতাবাড়ি ব্লক নিরাপত্তার অজুহাতে ডেপুটেশন গ্রহণ করতে রাজি হননি, যার ফলে মহকুমাশাসকের নিকট ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ৩ মার্চ ২০১৮ বিজেপি জোট ক্ষমতায় আসার পর বিরোধীদের মিছিল, মিটিং, পার্টি অফিস আক্রান্ত। ২০২৩ সালে পুনরায় ৩৯ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে ৩৩টি আসন নিয়ে কোনোক্রমে ক্ষমতায় এসেছে, বিরোধীদের উপর দমনপীড়ন তথা নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাস এখনো অব্যাহত। এরপরও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও কৃষিমজুর সভার এই উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

may-day-report-of-south-24-parganasmay-day-report

দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা জুড়ে উদযাপন হল ভারতে ঐতিহাসিক মে দিবসের শতবর্ষ। সকাল সকাল জেলা অফিসে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন এআইসিসিটিইউ/বিসিএমএফ জেলা নেতা লক্ষীকান্ত অধিকারী। শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন মহঃ মহসীন ও অন্যান্য কমরেডরা। মে দিবস উদযাপন ও আজকের কর্তব্য তুলে ধরেন পশ্চমবঙ্গ গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদক কিশোর সরকার। সবশেষে কমরেডদের সঙ্গে নিয়ে এআইসিসিটিইউ’র মে দিবসের আহ্বান পাঠচক্র চলে অফিসের ভিতর।

নিশ্চিন্তপুর গ্রামের হালদার পাড়া ও বৈষ্ণব পাড়ায় কর্মসূচি পালিত হয়। রক্তপতাকা উত্তোলন করেন নিশ্চিন্তপুর লোকাল কমিটির সম্পাদিকা দেবযানী গোস্বামী। সভা পরিচালনা করেন লোকাল কমিটির সদস্য আশুতোষ মালিক। উপস্থিত সমস্ত সদস্যরা মাল্যদান করেন।

বারুইপুরে হরিহরপুর-লাঙ্গলবেড়িয়া রিক্সাচালক ইউনিয়নের উদ্যোগে মে দিবস পালন হয়। রক্তপতাকা উত্তোলন করেন এআইসিসিটিইউ নেতা স্বপন ব্যানার্জী। উপস্থিত ছিলেন বর্ষীয়ান কমরেড জেলা কমিটির সদ‍স‍্য শিশির চ‍্যাটার্জী। এছাড়াও ছিলেন হরিহরপুর-লাঙ্গলবেড়িয়া রিক্সাচালক ইউনিয়নের সভাপতি মনসুর সেখ সহ আরো অনেক লড়াকু সাথীরা। বাখরাহাট মোড়ে বিষ্ণুপুর সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির নেতৃত্বে মে দিবস উদযাপন হয়। শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও রক্তপতাকা উত্তোলন করেন নবকুমার বিশ্বাস। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন যুবনেতা শুভদীপ পাল ও লোকাল কমিটি সম্পাদক নিখিলেশ পাল, স্মৃতিময় মাইতি সহ আরো অনেকে।

arrogance-of-powerarrogance-of-power_0

‘চায় পে চর্চা’ তাহলে বঙ্গ রাজনীতিতে মান্যতা পেয়ে গেল! এখন আর তা প্রধান বিরোধীদলের সর্বভারতীয় সহ সভাপতির একচেটিয়া ব্যাপার নয়। রাজ্যের শাসকদলের সর্বভারতীয় সম্পাদকও উত্তরবঙ্গে ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে এসে চা-পান পর্বে জনসংযোগ সারছেন। কর্মী সমর্থকদের সাথে তো বটেই, জনতার ছেঁড়া ছেঁড়া ভীড়ের মানুষজনের সঙ্গেও টুকরো আলাপ চলছে।

দিন কয়েক আগে তপনের চক সাথীহারা গ্রামে চলছিল সেই চা-পর্ব। সেখানেই ঘটল সেই ঘটনা। তিনি সেই তিন লাঞ্ছিতা আদিবাসী নারীকে নিজের হাতে চা এগিয়ে দিলেন, তাদের সঙ্গে চা খেলেন আর আলাদা করে তাদের সঙ্গে কথাও বললেন! অবশ্য ‘দলিত’ পরিবারে মধ্যাহ্নভোজনও করেছিলেন ক’দিন আগে তৃণমূলের যুবরাজ। আহা, ভোট বড় বালাই! (তিনি ধন্য হয়েছিলেন, না ধন্য করেছিলেন সেটা পাঠক বুঝে নিন।)

হ্যাঁ, সমস্ত রাজনৈতিক দল যেদিন ডাঃ বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের জন্মজয়ন্তী পালন করছিল তার মাত্র দিন সাতেক আগের ঘটনা। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের তপন থানার বাসিন্দা তিন আদিবাসী মহিলাকে বিজেপি থেকে আবার তৃণমূলে ফিরে আসার আগে এক ভয়ঙ্কর ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে হয়েছিল। তাদের বালুরঘাট কোর্ট মোড় থেকে নাকে খত দিয়ে দণ্ডী কাটতে কাটতে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে ঢুকতে হয়েছিল। সেই ‘প্রায়শ্চিত্তের’ নিদান দিয়েছিলেন মহিলা তৃণমূলের জেলা সভানেত্রী — এমনটাই ছিল অভিযোগ। আদিবাসী সমাজ তার গ্রেপ্তারির দাবিতে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে — এটাও তাদের দাবি ছিল। রাজ্যের অভিজাত বুধমণ্ডলী অবশ্য এই বর্বরতার অভিঘাতে কতটুকু বিচলিত হয়েছিলেন তা জানা নেই। তবে বঙ্গ বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে যা যা করার, করে ফেলেছিলেন। যেখানে যেখানে নালিশ করার করেছেন। এরাজ্যে ‘দলিত’, ‘আদিবাসী’, ‘দরিদ্র’ মানুষের, বিশেষত মহিলাদের ‘সুরক্ষা’ নিয়ে তারা বড্ড ‘ভাবিত’ কিনা! অন্য রাজ্যে তাদের জন্যে বিজেপি’র ‘বুলডোজার’ তৈরি থাকে — তাতে কী!

যাই হোক, পুলিশ ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ করে গত ১৩ এপ্রিল ২০২৩ জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে এক রিপোর্ট পেশ করে জানিয়েছিল — এখানে কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটেনি এবং মহিলারা নাকি ‘স্বেচ্ছায়’ দণ্ডী কেটেছেন। কিন্তু তাও ‘ভীষণ কর্তব্যনিষ্ঠ’ পুলিশ দুই যুবককে গ্রেফতার করে। তারা আবার অচিরে জামিনও পেয়ে যায়। আর তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব আদিবাসী ক্ষোভের আঁচ পেয়ে ঐ জেলা সভানেত্রীকে পদ থেকে সরিয়ে সেখানে এক আদিবাসী মহিলাকে বসিয়েছে। তাকে (প্রদীপ্তা চক্রবর্তী) বালুরঘাট পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকেও সরানো হয়েছে। (এই মহিলা অবশ্য আগেও প্রকাশ্য ভাষণে কুকথা বলে সংবাদমাধ্যমের সমালোচনায় এসেছিলেন।)

কিন্তু প্রশ্ন হল, ‘স্বেচ্ছায়’ দণ্ডী কাটার পরেও পুলিশ কেন দু’জনকে গ্রেফতার করল? আর ঐ নেত্রী যদি নাই দোষী হন তাহলে তাকে পদ থেকে সরানো হল কেন? আর যদি দোষী হন তাহলে তাকে পার্টির তরফে কঠোর সাজা দেওয়া হলনা কেন? এই ব্যাপারে পুলিশ যথাযথ তদন্ত করল না? এমন একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধের প্রকৃত দোষীর উপযুক্ত সাজা আদৌ হবে কি?

আসলে এই জঘন্য ঘটনা সমাজ বা রাজনীতি’র কাছে ততটা ন্যক্কারজনক হয়ে উঠতে পারেনি যেহেতু লাঞ্ছিতারা একে ‘দরিদ্র’, তায় ‘আদিবাসী’, তায় আবার ‘মহিলা’। সমাজের গভীরে ঘৃণ্য ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র, নারীবিদ্বেষ, জাত পাত বর্ণের (এমনকি গাত্রবর্ণও!) বিভাজন যে ভয়ঙ্কর শিকড় চারিয়ে দিয়েছে তাকে উন্মূল করা এক কঠিনতম কাজ। একমাত্র সমাজ বদলের লক্ষ্যে কঠোর শ্রেণিসংগ্রামের হাত ধরেই এগোতে পারে সেই কাজ! আর সেইজন্যই এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া সাপেক্ষ কিন্তু প্রতি মুহূর্তের লড়াই। ‘চায়ের কাপে’ সেই লাঞ্ছনার অপমান অভিমান মুছে যাওয়ার নয় — এটা তৃণমূলের যুবরাজকে বুঝতে হবে! সবটাই ভোটের রাজনীতির নিখুঁত পাটিগণিত নয়। আজ ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের কুড়মি সমাজও তাদের ১২ দফা দাবি নিয়ে রাস্তায় জোরালো আন্দোলনে নেমেছে। সেই আন্দোলনকে ‘খালিস্থানপন্থী’দের মতো সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের তকমা দিয়ে একেবারে মুখোমুখি সংঘাতে নেমে গেলেন ক্ষমতার শাঁস জলে পুষ্ট তৃণমূলের দুই অর্বাচীন নেতা। ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা তাদের কুশপুতুল দাহ করছে। ক্ষমতার দম্ভ এইভাবেই শাসককে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। পায়ের নিচে মাটি সরে যায়, চোরা বালি ক্রমশ গ্রাস করে নেয়। কালিয়াগঞ্জের ঘটনা থেকে শাসকদল ও তার প্রশাসন আদৌ কি কিছু শিক্ষা নেবে?

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

saving-the-country-democracydemocracy-constitution-was-heard

আয়োজক দুই সংগঠন উই দ্য পিপল অফ ইণ্ডিয়া এবং আইনজীবীদের সংগঠন আইলাজ গত কয়েক মাসে রাস্তায় নেমে গণতন্ত্র, দেশ এবং সংবিধানের সঙ্কটে উদ্বিগ্ন হয়ে পরপর ৬টি পথসভা করার পর এবার ৭ মে জর্জ ভবনে সভা করলেন। সমাজের সমস্ত স্তরে সচেতনতা ও সম্প্রীতির বাতাবরণ গড়ে তোলা ছিল উদ্দেশ্য। আর তার প্রেক্ষিত সবারই জানা। এই শাসনেই কর্পোরেট পুঁজিপতি আদানি বিশ্বের ৬০৯ নম্বর সম্পদশালী থেকে তিন নম্বরে এক অস্বাভাবিক হারে পৌঁছেছে। মূল্যবৃদ্ধি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। উচ্ছেদ হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ দলিত, গরীব, আদিবাসী। বেকারির হার ব্যাপক। বেসরকারিকরণের মাধ্যমে সার্বভৌম ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে হিমঘরে পাঠানো হচ্ছে। মিডিয়া এখন প্রায় সম্পূর্ণ গোদি মিডিয়া এবং রাষ্ট্র শাসকের নিয়ন্ত্রণে।

একটা দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল যেমন আগে ইহুদিদের ক্ষেত্রে হত। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া চালু হল। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা মানুষদের জন্য সিএএ চালু হতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে শাহীনবাগের মতো বিশাল আন্দোলন সংগঠিত হল। সেই ঐক্যের ভিত্তি ছিল সংবিধানের প্রস্তাবনা। কৃষি ব্যবস্থায় তিনটি কালা আইন প্রত্যাহার করার আন্দোলনেরও ভিত্তি ছিল সেই সংবিধানের প্রস্তাবনা। বিরোধী কন্ঠস্বর ও গণআন্দোলনের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে। দানবীয় আইনে প্রতিবাদীদের জেলে পচানো হচ্ছে। ভারতীয় সমাজের বর্ণময় বহুত্ববাদ অস্বীকার করে এক হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের মরিয়া চেষ্টা চলছে যা রামনবমীর সশস্ত্র ও সহিংস মিছিলে দেখা গেল। সাম্প্রদায়িক অস্থিরতায় এবং মানুষের ক্ষয় ক্ষতির সংবাদে পাওয়া গেল। বিনা বিচারে আটক, বুলডোজার এবং এনকাউন্টার হত্যা এখন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কথায়, সংবিধান এবং গণতন্ত্র বিপন্ন। দেশকে এদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। হিটলার যুগের হাইপার ন্যাশনালিস্ট মতাদর্শ, সংহতি কৌশল এবং গণহত্যার নীল নকশা থেকে শেখা পাঠে সজ্জিত ধর্মকে কাজে লাগানোর এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। এবং গণতন্ত্র সচেতন ঐক্যবদ্ধ মানুষই পারে তার মোকাবিলা করতে। সভা শুরু হয় নীতিশ রায়ের অনবদ্য গান দিয়ে।

সভা সঞ্চালনা করেন আইনজীবী সেলের দিবাকর ভট্টাচার্য। বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন আইপিএস নজরুল ইসলাম, কলকাতা হাই কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী সুজয় ভট্টাচার্য, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনিল নৌরিয়া, সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, সমাজ সংগঠক তায়েদুল ইসলাম, পরিবেশ কর্মী বিবর্তন ভট্টাচার্য, যাদবপুরের প্রাক্তন অধ্যাপক মৃদুল বোস, অধ্যাপক সৌম্য শাহিন প্রমুখ। বিশিষ্ট উপস্থিতি, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, ইমতিয়াজ আহমেদ মোল্লা, প্রদ্যোত নাথ, ডঃ বর্ণালী রায়, অধ্যাপক রবিউল ইস্লাম, কবি প্রদীপ নন্দী, অম্লান ভট্টাচার্য, আইনজীবী অভিজিৎ দত্ত, শৈবাল মুখার্জী, অমিতাভ সেনগুপ্ত প্রমুখ।

প্রথম বক্তা নজরুল ইসলাম উদাহরণ দিয়ে বলেন জরুরি অবস্থায় ও সিএএ বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। শেষোক্ত আইনের ১৪নং ধারায় সাম্যের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সমস্ত ধর্মের মধ্যে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের লোকেরা হবে অনুপ্রবেশকারী। বিচার ব্যবস্থার সর্ব স্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্য। আড়াই শতাংশ একই ধরনের পরিবার থেকে আগত। স্পষ্টত, রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ গণজাগরণের প্রয়োজন অনেকেই বললেন। বোলান গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, আক্রান্তকারী এবং আক্রান্ত প্রায়শই হত দরিদ্র। তিনি মন্তব্য করেন যে এধরনের সভার মুল্য তখনই হবে যখন সভা রাস্তায় প্রকাশ্যে হবে। সঞ্চালক তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন এর আগে ৬টা পথসভা হয়েছে। বক্তারা বর্তমান কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের সরকার একই গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন। গণতন্ত্রে সিপিএম বা কংগ্রেস কারো ভূমিকা খুব স্বচ্ছ ছিল না। এক সুবিধাবাদী বামপন্থা শেষের দিকে রাজত্ব করেছে। হাইকোর্টের আইনজীবী সুজয় ভট্টাচার্য বলেন, মানুষ রুখে না দাঁড়ালে শুধু বিচার ব্যবস্থার উপর ভরসা করে লাভ নেই। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনিল নৌরিয়া অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার মিডিয়াকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে ফলে মিডিয়ার উপর আর কোনো ভরসা নেই, বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। সৌম্য শাহিন হিন্দু মুসলিম বাইনারি অস্বীকার করে গণ আন্দোলন এবং অর্থনৈতিক শোষণ বেশি করে উন্মোচনের পক্ষপাতী। আলোচনা শেষে শপথ নেওয়া হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রচারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভুপেন হাজারিকার বিস্তীর্ণ দুপারে গেয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি করেন মীরা চতুর্বেদী।

- অসিত বরণ রায়

human-rights-violations-in-narendrapurnarendrapur-police-station

কুখ্যাত নরেন্দ্রপুর থানায় এবার দলিত যুবকের হেফাজৎ মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগ সৃষ্টি করল। ১৩ এপ্রিল বিনা ওয়ারেন্টে কয়েকজন যুবককে মন্দিরের পাশে নেশা করার অভিযোগের অছিলায় তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়ির লোকজনকে টাকা চাওয়া হয়। তার মধ্যে একজন ছিলেন সুরজিত সর্দার, যার বাড়ির লোক ২০ হাজার টাকা দেওয়ার পর আরও পাঁচ হাজার টাকা দিতে বাকি থাকায় তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করে মেরে ফেলা হয় ২১ এপ্রিল। জীবন্ত অবস্থায় বাড়ির লোকেদের তাঁর সঙ্গে দেখাই করতে দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর পর বডি দেওয়া হয়। অসংখ্য গুরুতর আঘাতের দাগ ছিল সারা শরীরে। থানা এখন উল্টে পরিবারটিকে টাকা নিয়ে কেস মিটিয়ে নিতে বলছে।

গত ২৫ এপ্রিল সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষে তিনজনের এক প্রতিনিধি দল নিহত যুবকের গড়িয়ার বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা, দাদা ও অন্যান্যদের সাথে কথা বলে ঘটনার অনুসন্ধান করে। সুরজিত স্থানীয় কে কে দাস কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রাবস্থায় পড়া ছেড়ে দিয়ে হোম ডেলিভারির কাজ করতেন। ভালো স্পোর্টসম্যান ছিলেন। দাদা ছোটখাট ব্যবসা করেন। বাবা কংগ্রেস দলের পরিচিত কর্মী ছিলেন। এখনও পর্যন্ত তাঁদেরকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখানো হয়নি। গ্রেপ্তারের খবরও তাঁরা অনেক পরে পেয়েছিলেন। কোন আক্রোশে পিটিয়ে মারা হল, তাঁরা এখনও বুঝতে পারছেন না। কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচী তাঁদের হয়ে মামলা লড়ছেন। কংগ্রেস, সিপিএম এপিডিআর-এর পক্ষ থেকে নানা প্রতিবাদী কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। তাঁরা দায়ী পুলিশ অফিসারদের শাস্তি চান। আইসি অরিন্দম বিশ্বাস এবং আইও দলমত নির্বিশেষে সকলকেই পক্ষে পেতে চান। তৃণমূল মিটিয়ে নিতে পরামর্শ দিচ্ছে। বিরোধী দল বিজেপি একেবারেই উদাসীন।

কুখ্যাত নরেন্দ্রপুর থানায় ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচারের ঘা শুকাবার আগেই নাগরিক স্বাধীনতার ওপর আবার নতুন ঘা দিল বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করে লক আপে পিটিয়ে দলিতহত্যা করে। এর প্রতিবাদে এলাকায় স্থানীয় মানুষকে সামিল করে মিছিলের উদ্যোগ চলছে। প্রতিবাদে ২ মে বারুইপুর এসপির কাছে পার্টির প্রতিনিধি ডেপুটেশনের জন্য জানানো হয়েছে। শাসকদল এই ঘটনায় কিছুটা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে রয়েছে বোঝা যাচ্ছে। দোষী পুলিশ আফিসারের শাস্তির দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া হবে।

FIR-is-to-pray-on-the-streetpray-on-the-street

যোগী আদিত্যনাথের মুসলিম বিদ্বেষ এতই সুবিদিত যে নতুন করে তার উল্লেখ না করলেও চলবে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার অঙ্গীকারের সাথে সাথে মুসলিম-বিরোধী বিষোদগারও তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবেই করে এসেছেন। আর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে তিনি করে তুলেছেন তাঁর বৈষম্য ও উৎপীড়নের নিশানা। সম্প্রতি অতি সাধারণ একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ কানপুরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নামাল গণহামলা, এফআইআর দায়ের হলো প্রায় ১৮০০ অজ্ঞাতপরিচয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে। উপলক্ষটা ছিল ঈদের দিন কিছু মুসলিম মানুষের রাস্তায় নমাজ পড়া। আর সেটাই যোগী প্রশাসনের কাছে হয়ে দাঁড়াল গুরুতর অপরাধ। জাজমৌ থানা এলাকায় ৩০০, বাবুপুরওয়া থানা এলাকায় ৫০ এবং বাজারিয়া থানা এলাকায় প্রায় ১৫০০ অজ্ঞাতপরিচয় মানুষের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে। ভারতীয় দন্ডবিধির যে সমস্ত ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো হল ১৮৬ (সরকারি কাজে বাধাদান), ১৮৮ (১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জমায়েত), ২৮৩ (জমায়েতের মাধ্যমে রাস্তা অবরোধ) এবং ৩৪১ (অন্যায়ভাবে বাধাদান)। এই এফআইআর সাধারণ মুসলিম জনগণের মধ্যে যথেষ্ট আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, এফআইআর যেহেতু হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, পুলিশ তাই কোনো মানুষের পরিচিতি যাচাই না করেই তাদের তুলে নিয়ে যাবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অভিপ্রায় সেরকম হলে গ্রেপ্তারও করতে পারে। ঈদ অনুষ্ঠিত হয় ২২ এপ্রিল, আর পুলিশ এফআইআর দায়ের করে ২৬ এপ্রিল, অজ্ঞাতপরিচয় জনগণের সঙ্গে ঈদগাহ কমিটির বিরুদ্ধেও। প্রকাশিত সংবাদ থেকে আরও জানা গেছে, কানপুরের সঙ্গে আলিগড় এবং বাগপতেও একই ধরনের এফআইআর হয়েছে।

এফআইআর’এর সমর্থনে পুলিশ বলেছে, ঈদের আগে বৈঠক করে ঈদগাহ (ঈদের নমাজ পড়ার জন্য খোলা প্রশস্ত স্থান) এবং মসজিদের ভিতরই নমাজ পড়ার কথা বলা হয়েছিল, রাস্তায় নমাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জাজমৌ ঈদগাহ, বাবুপুরওয়া ঈদগাহ ও বাদি ঈদগাহ সংলগ্ন রাস্তায় নমাজ পড়া হয়েছিল, আর তাই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের জন্য পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার আনন্দ প্রকাশ তিওয়ারি জানিয়েছেন, “সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সাহায্যে আমরা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। তাদের চিহ্নিত করা হয়ে গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এখানে প্রশ্ন হল, নমাজ যদি রাস্তায় পড়া হয়ে থাকে তবে সবাই কি সেখানে নমাজ পড়েছিলেন, নাকি অল্পকিছু মানুষই সেখানে নমাজ পড়েছিলেন? তাঁরা কতক্ষণ রাস্তায় ছিলেন এবং তারজন্য কতটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে এবং কতজন মানুষের কতটা ক্ষতি হয়েছে? রাস্তায় নমাজ পড়ার মধ্যে রাস্তা বন্ধ করার অভিপ্রায় কি তাঁদের ছিল? মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা ও ভাষ্যকাররা জানিয়েছেন, অধিকাংশ মুসলিমই ঈদগা হতে ও মসজিদের ভেতরেই নমাজ পড়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ একটা মুহূর্তে অনেক মানুষ একসঙ্গে জড়ো হয়ে যান, এবং ঈদগাহ ও মসজিদের ভেতরে জায়গা না হওয়ায় তাঁরা রাস্তায় নমাজ পড়তে বাধ্য হন। এরজন্য রাস্তা বন্ধ হয়ে থাকতে পারে বড় জোর পাঁচ থেকে দশ মিনিট। চিত্রনাট্য রচয়িতা দারা ফারুকীর কথায়, “ঈদের মতো আনন্দের বিশেষ এক দিনে কেউই রাস্তায় নমাজ পড়তে চায় না। মুসলিমরা রাস্তায় নমাজ পড়তে চায় বলেই সেখানে নমাজ পড়ে না, রাস্তায় নমাজ পড়ে বাধ্য হয়ে।” আর নিরুপায় এই পরিস্থিতিতে রাস্তায় নমাজ পড়াটাকে পুলিশ মহা-অপরাধ ধরে নিয়ে দন্ডবিধির গোটাকয়েক কঠিন ধারা লাগিয়ে এফআইআর করল। উদ্দেশ্য, সজ্ঞানে স্বেচ্ছাকৃতভাবে রাস্তা অবরোধের অভিযোগে মুসলিম সম্প্রদায়ের হেনস্তা ঘটানো। পুলিশের এফআইআর দায়েরের এই পদক্ষেপ মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অপমান বোধের জন্ম দিয়েছে। মুসলিম ধর্মীয় নেতারা এফআইআর’এর বিরোধিতা করে সেগুলো তুলে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন এবং বলেছেন, “উৎসবের সময় এই ধরনের ঘটনা কখনো ঘটেনি, যে উৎসব শান্তি ও সম্প্রীতির লক্ষ্যেই পালিত হয়। এই এফআইআরগুলোর লক্ষ্য হলো সামাজিক বুনটকে ছিন্নভিন্ন করা। হয় এফআইআরগুলোকে তুলে নিতে হবে, অন্যথায় আমরা হাজার হাজার যে সমস্ত মানুষ সেদিন প্রার্থনা করেছিলাম তারা সবাই গ্রেপ্তার বরণ করব।”

যোগী জমানায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবেই মুসলিমদের জীবন ও জীবিকার ওপর আক্রমণ হানা হয়েছে — গোহত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, অন্য মাংস বিক্রি করলেও বিক্রেতাকে মারধর করা হয়েছে এবং এমনকি মুসলিমদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কটের আহ্বানও ঐ রাজ্যে বিরল নয়। সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদের সময় মুসলিম যুবকদের হত্যা এবং মুসলিম পাড়ায় গিয়ে পুলিশের মুসলিম বাড়িতে ঢুকে জিনিসপত্র ধ্বংস করাটাও ঐ রাজ্যে প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন হয়ে রয়েছে। আর লাভ-জিহাদকে করে তোলা হয়েছে মুসলিম যুবকদের উপর আক্রমণের এক হাতিয়ার, পুলিশের চালানো এনকাউন্টার ও বুলডোজার অভিযানের শিকারও বহু ক্ষেত্রেই হয়েছে মুসলিমরা। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ভিত্তিক অপরাধ বেড়ে চলেছে এবং উত্তরপ্রদেশে মুসলিম সম্প্রদায়কে অপরাধ সংঘটকের গ্যাং’এর সঙ্গে একাকার করে তোলার প্রচেষ্টাও জোরালোভাবেই জারি রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে তাঁর শুভেচ্ছা বার্তায় নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে অভিনন্দন। আমাদের সমাজে সম্প্রীতি ও সহানুভূতির স্পিরিটের বৃদ্ধি হোক। আমি সবার সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ কামনা করছি। ঈদ মুবারক।” মুখে যা বলা বাস্তবে তার বিপরীতটা করাই বিজেপির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। আর তাই মোদী যখন ঈদ উপলক্ষে সামাজিক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহানুভূতির কথা বলবেন, তখন তাঁর দলের অপর এক শক্তিশালী নেতা যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন যে ঈদের নমাজ পড়াকে কেন্দ্র করেই মুসলিমদের হয়রানি ঘটাতে, তাদের অপদস্থ করতে ফন্দি আঁটবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কি থাকতে পারে!

where-is-the-country-going

     
the-country ২০০২ সালে গুজরাতে নারোদা গামে হিন্দুত্ববাদী আক্রমণে সংঘটিত গণহত্যায় অভিযুক্ত সকলকেই যথারীতি তথ্যপ্রমাণের অভাবের দোহাই দিয়ে বেকসুর বলে খালাস করে দেওয়া হল গত ২০ এপ্রিল ২০২৩ এক সিট কোর্ট থেকে। ঐ ঘটনায় ১১ জনকে হত্যা সহ অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, যথেচ্ছ হাঙ্গামা ও লুঠতরাজ চালানো হয়েছিল। মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ছিল ৬৭ জন, যারমধ্যে ছিলেন গুজরাতের বিজেপি সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী মায়া কোডনানী, বজরং দলের পান্ডা বাবু বজরঙ্গী ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক মাথা গোছের জয়দীপ পটেল প্রমুখ। ঐ পর্বে গুজরাতে সবচেয়ে পাঁচটি যে ধ্বংসকাণ্ড সংগঠিত হয় তারমধ্যে একটি হল নারোদা গাম গণহত্যা, অপরটি হল নারোদা পাটিয়া গণহত্যাকান্ড। এই মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা ছিল শতাধিক। মায়া কোডনানীর পক্ষে প্রধানতম সাক্ষ্য দেন অমিত শাহ। বিজেপির এই দু’নম্বর নেতা সাক্ষ্যদানে বুঝিয়ে দেন মায়া কোডনানী ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে ছিলেন না। সিট কোর্টে খালাস ঘোষণার রায়দানের দিন গেরুয়া বাহিনীর লোকেরা মুহুর্মুহু শ্লোগান দিতে থাকে ‘জয় শ্রীরাম’, ‘ভারতমাতা কী জয়’! বিপরীতে, নারোদা গামের বিচারপ্রার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই এই চরম অবিবেচনাপ্রসূত রায় মেনে না নেওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সিট কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানাতে গুজরাত হাইকোর্টে যাবেন বলে জানিয়েছেন।

(দি টাইমস্ অব ইন্ডিয়া, ২১ এপ্রিল ২০২৩)

suspend for urdu song
the-country-going স্কুলে নমাজ পড়ানো হচ্ছে ধূয়ো তুলে অভিভাবকদের একাংশকে নিয়ে প্রতিবাদী বিক্ষোভ শুরু করেছিল কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। তার জেরে সাসপেন্ড করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের হাথরসের একটি বেসরকারী স্কুলের অধ্যক্ষ ও দুই শিক্ষককে। স্কুলের উপাধ্যক্ষ জানান, গত ১৮ এপ্রিল বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস এবং ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে মহম্মদ ইকবাল রচিত “লব পে আতি হ্যায় দুয়া বনকে” গানটি গাওয়া হয়। তিনি বলেন, “মোটেও নমাজ পড়া হয়নি। আর গান গাইতে জোরও করা হয়নি কাউকে।” তবে বিক্ষোভের জেরে স্কুল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে অধ্যক্ষ সোনিয়া ম্যাকফার্সন এবং দুই শিক্ষক ইরফান ইলাহি ও কানওয়ার রিজওয়ানকে সাসপেন্ড করেন। জেলা প্রশাসনও তদম্তের জন্য দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেছে।

(আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ এপ্রিল ২০২৩)

defence
country-going ভারত বর্তমান বিশ্বে সামরিক ব্যয়ে চতুর্থ বৃহত্তম স্থানে পৌঁছে গেছে। ২০২২-এ প্রাপ্ত হিসাব বলছে, গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রেই সামরিক খাতে ব্যয় বেড়েছে, বৃদ্ধি ঘটেছে ৩.৭ শতাংশের মতো, মার্কিন ডলারের হিসাবে ২,২৪০ বিলিয়ন। এই ব্যয়বৃদ্ধির প্রশ্নে বিশ্বে প্রথম ১০টি রাষ্ট্রের মধ্যে ভারতের স্থান এখন মার্কিন, চীন, রাশিয়ার ঠিক পরেই, চতুর্থ স্থানে। চীনের ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দের বৃদ্ধি ঘটেছে যখন চারগুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন বৃদ্ধি ঘটিয়েছে দশগুন। আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার ব্যয়ের অঙ্ক যথাক্রমে ৮৭৭, ২৯২ ও ৮৬.৪ বিলিয়ন ডলার। ভারতের সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ৮১.৪ বিলিয়ন ডলার। সূত্রের খবরে প্রকাশ, ভারতের ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে সামরিক বাজেটে বরাদ্দ ধরা হয়েছে জিডিপি’র ১.৯৭ শতাংশ, যদিও সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, বৃদ্ধি করা প্রয়োজন জিডিপি’র অন্তত ২.৫ শতাংশ।

(দি টাইমস্ অব ইন্ডিয়া, ২৫ এপ্রিল ২০২৩)

adivasi-machet-mahaadivasi-machet-maha

অলচিকি লিপি বা সান্তালি বর্ণপরিচয়ের স্রষ্টা, গুরু গমকে রঘুনাথ মুর্ম্মুর জন্মদিবসকে আদিবাসী শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হল, সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের পক্ষ থেকে।

এইদিন খাতড়া পাম্প মোড়ে, পন্ডিত রঘুনাথ মুর্ম্মুকে স্মরণ করে তাঁর ছবিতে মাল্যদান করা হয় এবং বিশিষ্ট সাঁওতালী কবি সাহিত্যিক মনোরঞ্জন বেসরার উপস্থিতিতে তিনজন আদিবাসী শিক্ষক মহাশয়কে সম্বোধিত করে এই দিনটিকে আগামীতে ‘আদিবাসী শিক্ষক দিবস’ হিসাবে পালন করার ঘোষণা করা হয়।

সমগ্র কর্মসূচিকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি ও শিক্ষক মাননীয় সুনীল মান্ডি মহাশয়। তিনি বলেন, “আদিবাসী বিভিন্ন সংগঠনগুলিকে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের পরিবর্তে একতা নিয়ে চলতে হবে, এ’প্রশ্নে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি”।

ঝাড়খন্ড জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এই জন্মদিবস পালনে উপস্থিত হয়ে সর্বভারতীয় সভাপতি ও শিক্ষক গৌর হেমব্রম, সহ-সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ মান্ডি শিক্ষক মহাশয় হ্যামলেট বাস্কেরা অলচিকি হরফে শিক্ষা প্রদানের দাবি তোলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজ সংস্কারক হিসাবে রঘুনাথ মুর্ম্মুর অবদান বর্ণনা করেন। পাশাপাশি নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় আদিবাসী হস্টেল উঠিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ উঠিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে পিছিয়ে পড়া নিপীড়িত জাতিগুলির মিলিত প্রতিরোধকে জোরদার করার শপথ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন ছাত্র সংগঠন আইসা’র নেতা সুশান্ত ধীবর। প্রধান উদ্যোক্তা ও আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের নেতা সুধীর মুর্মু জানান, “আজ থেকে পুরুলিয়ায় অযোধ্যা পাহাড়ে সেঁন্দরা (ল-বীর বাইসি) শুরু, এটা আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ, বর্তমান কেন্দ্র সরকার আমাদের ধর্ম কেড়ে নিতে চায়, তায় আদিবাসীদের প্রকৃতি ধ্বংসকারী ও বন্যপ্রাণী নিধনকারী হিসাবে প্রচার করছে কিন্তু আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের দেখানো পথ ভুলিনি। বীর বান্টা সিধু কানু ফুলো ঝানোর পথও আমরা ভুলিনি।” অবশেষে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন পন্ডিত রঘুনাথ মুর্ম্মুর কবিতা,

“বর্ণমালা আছে তোমার,     
আছে তোমার ভাষা ধর্মাচরন     
আছে তোমার জীবনেরই আশা।     
হারিয়ে গেলে ভাষা তোমার, হারিয়ে যাবে বর্ণ,     
নিজেই তুমি হারিয়ে যাবে, হারিয়ে গেলে ধর্ম।”

will-cross-this-poisonous-sindhuhand-in-hand

দেশজুড়ে কর্পোরেট মদতপুষ্ট সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপি আরএসএস ও তাদের শাখা সংগঠনগুলির লাগাতার সাম্প্রদায়িক হামলার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মিলনের যে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আছে তাকে শক্তিশালী করতে ৬ মে ২০২৩ গণসংস্কৃতি পরিষদের মধ্যমগ্রাম শাখা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আলোচনা, সংগীত, কবিতা পাঠ, নৃত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমকে সংগঠিত করে এই মিলনের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়। নৈবেদ্য ডান্স অ্যাকাডেমির শিশু শিল্পীদের নৃত্য, আলোক বর্তিকা ও উত্তরণের কবিতা পাঠ এবং আবৃত্তি পরিবেশন করেন স্বাগতা সুর ও কৃষ্ণা গাঙ্গুলী। সংগীত পরিবেশন করেন স্বীকৃতি সাহা ও গণসঙ্গীত শিল্পী রুমা সুর, সোমা সুর এবং অনুপ মজুমদার। কবিতা আলেখ্য ও সলিল চৌধুরীর রচনা উলুখড়ের রুপকথা শ্রুতিনাটক পরিবেশন করেন গণসংস্কৃতি পরিষদের মধ্যমগ্রাম শাখা। আজকের অস্থির সময়ে আমাদের দেশের ইতিহাস কিভাবে বদলে দেওয়া হচ্ছে, কিভাবে দেশের সমস্ত সরকারী সম্পদের উপর কোম্পানির দখল বেড়ে যাচ্ছে, আমাদের ঐক্যের সংস্কৃতিকে বিষিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে বিভাজনের চেষ্টা চলছে এবং এই বিষয়ে আমাদের কর্তব্য নিয়ে আলোকপাত করেন ডাক্তার দেবাশীষ মুখার্জী। সমগ্র অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গণসংস্কৃতি পরিষদের কার্যকরী কমিটির সদস্য শোভনা নাথ। স্থানীয় বহু মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এলাকার বিশিষ্ট বাচীক শিল্পী মুকুল দেব ঠাকুর।

craftsman-of-building-a-new-worldnew-world
খুদে সৈনিকদের মাটিতে পা, নির্মল বাতাস, জল আর সূর্যকণার পরশ মাখিয়ে নয়া পৃথিবী গড়ার কারিগর হতে সাহায্য করো

আমাদের চারপাশে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মনে কুপ্রভাব পড়ার মতো ঘটনা সবসময় ঘটেই চলেছে। হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বৈষম্য, বিকৃত তথ্য। আমরা যারা বয়সে বড়, আমাদের দায়িত্ব নয় কি এক সুন্দর, সুস্থ পৃথিবী আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া ? চেষ্টা করতে দোষ কী? আর এই চেষ্টাকে সঙ্গী করে, আমরা ‘স্টিল অ্যাণ্ড মুভি প্ল্যাটফর্ম’-এর পক্ষ থেকে সিনেমার ঝুলি নিয়ে স্কুলে-স্কুলে যাব ঠিক করেছি। স্কুলে সিনেমা। মূল কাজ হল, কিশোর-কিশোরীদের, শিশুদের তাদের চেনা সিনেমার বাইরে এক অন্যরকম সিনেমার গল্প বলা। আর সেই গল্পের সাথে সাথে তাদের নিজেদের জীবনের গল্প শোনা। যে সমাজে, যে পরিবেশে তারা বড় হচ্ছে, তা বোঝাতে ও বুঝতে চাওয়া, কথা শোনা, তার নিজের মতো করে বলা কথা, প্রতিক্রিয়া। গত ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ সোদপুর স্টেশনের কাছে দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যাপীঠ-এ ছিল এই প্রকল্পের প্রথম দিন। ছাত্রীদের মধ্যাহ্ন ভোজনের পর সিত্যিজিত রায়ের ‘টু’, চাও হাম্বার্গের ‘দ্যা বয়, দ্যা স্লাম অ্যাণ্ড দ্যা প্যানস লিডস’, নর্মান ম্যাকলারেনের ‘নেইবরস’ এবং আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘লিটল টেররিস্ট’ — এই পাঁচটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হওয়। আর কথাবার্তা হওয় ছাত্রীদের সাথে প্রচুর। একাদশ শ্রেণীর এক মেয়ে বলে, তার জীবনে ডান্সার হবার শখ। কিন্তু বাড়ির অর্থনৈতিক চাপে সে কোনদিন নাচ শিখতেই পারলোনা। ‘টু’ দেখে খুব সহজেই বুঝে গেলো দুটি শিশুর বেড়ে ওঠার বৈষম্যের গল্প। ওদের মন খারাপ লাগছিলো তখন, যখন বড়লোকের ছেলে বন্দুক দিয়ে খোলা আকাশে ওড়া গরিব ছেলের ঘুড়িটা ছিঁড়ে দিল। এভাবেই শিশুদের কল্পনা ডানা মেলে। চেনা চোখে জানতে চেষ্টা করে অজানা পৃথিবীকে।

টেরোরিস্ট কাদের বলা হয়? ওরাই বললো, আতঙ্কবাদীদের। কাদের আতঙ্কবাদী বা শত্রু ভাবি? সবাই মিলে বলে ওঠে পাকিস্তান। পাকিস্তান আমাদের শত্রু, এটা শিশু মনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু 'নেইবরস' আর 'লিটিল টেররিস্ট' সিনেমা দুটি দেখে ওদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। আমরা বললাম ক্লাসরুমের মাঝখানে একটি গন্ডী কেটে যদি তোমাদের বন্ধুদের আলাদা করে দেওয়া হয়, যদি এমন হয়, কেউ কাউকে দেখতে পাবেনা, কথা বলতে পারবে না, তাহলে কেমন লাগবে? এক ছাত্রী নিজের ভাষায় বললো, ঘৃণা-বিদ্বেষ নয়, কাউকে কারোর ধর্ম, জাত, গরিব, বড়লোক দিয়ে আলাদা করা উচিৎ হবে না। ক্লাস ফাইভের একটি মেয়ে ‘নেইবরস’ সিনেমা নিয়ে বললো, একটা ফুলের জন্য মারপিট করে সব ধ্বংস করে দিল! বড় মেয়েরা বলল, এখন কাশ্মীরে যা হচ্ছে। অনেকের ধারণা, শিশুরা রাজনীতি বোঝে না। ওদেরকে এইসব থেকে দূরে রাখা উচিত। কিন্তু যে হামলার মুখে এই প্রজন্ম বড় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত শিশুর মন-শরীর আক্রান্ত হচ্ছে, সেই শিশুদের সুপ্ত প্রতিরোধী মনকে গড়ার কাজে আমাদের হাত লাগাতে হবে না! না অন্য কাজের ভীড়ে, এই কাজটাকে সরিয়ে রাখা হবে? ভিন্নধারার গান, নাচ, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, গল্প, নাটক, সিনেমা প্রভৃতি শিশু-কিশোর-কিশোরীর মন গড়ার কাজের একটা ধাপ। আগামী দিনে নয়া পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার কারিগর এই প্রজন্মের শিশুরাই হবে, যদি আমরা দায়বদ্ধতায় আমাদের কাজটা ঠিক মতো করি। দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যাপীঠ-এর বড়দি (মাননীয়া প্রধান শিক্ষিকা মহাশয়া) ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এই ‘লিটিল টেররিস্ট’ সিনেমা নিয়ে তোমাদের সবার সামার প্রজেক্ট থাকবে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই বিষয়ের উপর। তখন আমাদের মনে হয়, আজকের কর্মসূচি অল্প হলেও সার্থক। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সমস্ত ছাত্রীদের জন্য শিশু মনোপযোগী ‘সিনেমা ইন স্কুলস’ শিরোনামে একটি ফোল্ডার প্রকাশিত হয়। সোদপুরের দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যাপীঠ-এর সমস্ত ছাত্রী, সহশিক্ষিকা, অশিক্ষক কর্মচারী কর্মসূচিতে উচ্ছাস প্রকাশ করেন। সহশিক্ষিকারা ও প্রধান শিক্ষিকা মহাশয়া জানিয়েছেন আবার এধরনের উদ্যোগ নেওয়ার ইচ্ছা আছে। সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনাদের পরিচিত বিদ্যালয়ে যদি এরকম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন, তাহলে আমাদের এই শিশু মনোপযোগী প্রকল্পটি সার্থক হয়। গণসংস্কৃতি পরিষদের এই প্ল্যাটফর্মকে ডাকলেই পাবেন, যোগাযোগ দূরভাষ : সাগর ৯৪৩৩৮৯৭২২১, মিতালি - ৯৪৩৩৭৬০৭৫২, ধন্যবাদ।

scientist-professor-kamlesh-bhowmikprofessor-kamlesh-bhowmik

বর্তমানে যা বাংলাদেশের অংশ, সেই ঢাকায় প্রায় ৭৮ বছর আগে, ১৯৪৫ সালের ২৩ জুলাই, জন্ম নেয় এক শিশু, যার সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৯৮ সালে যখন তিনি কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বিজ্ঞানী, অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিক। তাঁর যখন বয়েস দু-বছর, সে সময়ে দেশ স্বাধীন হল ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে। ১৯৪৭ সালের আগস্টের মধ্যরাতে সেই স্বাধীনতার আনন্দ উৎসব একই সাথে প্রকটিত করে ধর্মীয় দাঙ্গা এবং দেশ ভাগের দুঃস্বপ্নেরও, যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের “সভ্য” শাসনের অধীনে ইতিমধ্যে লুণ্ঠিত ও নিষ্পেষিত ভারতবর্ষকে দেওয়া বিদায়ী “উপহার”।

সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি তার পরিবারের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত তাদের প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে, চলে আসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা নদীয়ায়। সেখানেই বেড়ে ওঠে সে। চারপাশে ছিল তাদের মতোই আরো অসংখ্য উদ্বাস্তু পরিবার। আজ যখন দামী গৃহশিক্ষক থেকে শুরু করে নানা সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রদের একাংশকে তৈরি হতে দেখি, তখন অবাক হয়ে ভাবি যে কেমন করে অভাব অনটনে জর্জরিত দরিদ্র গ্রামীণ বাংলা সেদিন এদের মতো মানুষদের তৈরি করেছিল, যেমন করেছিল এই ছেলেটিকে কেবল একজন চমৎকার বহুমুখী বিজ্ঞানী করেই নয়, একজন দরদী বুদ্ধিজীবী, একজন গভীর মানবতাবাদী এবং চারপাশের দুর্গন্ধযুক্ত সমস্ত কিছুর আপোষহীন সমালোচক হিসেবে, তা সে নিজের কর্মক্ষেত্রেই হোক বা তার বাইরের জগতে বৃহত্তর সমাজের মধ্যেই হোক।

স্যারকে দাদা বলতে শিখেছিলাম সাহা ইন্সটিটিউটে গবেষণা করতে এসে। কমলেশদাকে পেলাম সেখানে — আমার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, বন্ধু, জ্যাকারি (স্বশাসিত গবেষণাগারগুলির যৌথ সংগ্রাম মঞ্চ) আন্দোলনের সাথী কমরেড যার সঙ্গে গত ২৫ বছর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা বলছি, এবং গভীরভাবে উপকৃত হয়েছি। প্রথম ১০ বছর আমাদের সম্পর্কটা মূলতঃ ছাত্র-শিক্ষকের হলেও, তখনো রাজনীতির প্রসঙ্গ বারে বারেই উঠে এসেছে তার মধ্যে। তিনি আজীবন সিপিআই(এম) দলের সদস্য, আর তার ছাত্র তৎকালীন বাম সরকারের টালিনালা উচ্ছেদের, বাগবাজার খালপাড়ের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রাস্তায়, গরীব মানুষের উপর বাম সরকারের দমন-পীড়ন নিয়ে স্যারের সামনে উত্তেজিত। তিনি কিন্তু চিরদিন এই উত্তেজনাকে ধৈর্যের সঙ্গে ধারণ করেছেন, চট করে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন না। এই সেদিনও তো, ৭-৮ মাস আগের কথা হবে, ফোনে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে একটু কটু ভাষাতেই বললাম যে পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় বামপন্থীরা দেখছি এ দেশের সবচেয়ে বড় বিপদ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চোর ধরতে পুলিশের চাকরি নিয়েছে; পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও দুর্নীতির আন্তঃসম্পর্কের অ-আ-ক-খ কি তারা ভুলে গেলেন? তিনি শুনলেন, তারপর যথারীতি যে প্রসঙ্গে আগে কথা চলছিল, তা নিয়েই কয়েকটি কথা বললেন। আসলে সামাজিক-রাজনৈতিক বহু উত্থান-পতনের দেখে তিনি ধৈর্য ও মুক্তমন, দুই-ই অর্জন করে নিয়েছিলেন, যা খুব বেশি মানুষের মধ্যে আমি দেখিনি। ষাটের দশকে, তিনি যখন ছাত্র ছিলেন, সম্ভবত তাঁর কলেজের সময়কালে, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসেছিলেন, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য মেহনতি মানুষের চলমান লড়াইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কমলেশদা প্রায়ই নদীয়ায় তার এলাকার একজন কমিউনিস্ট নেতা, সম্ভবত গৌর কুন্ডু, নামটি উল্লেখ করতেন, যিনি তাঁকে আর্থ-সামাজিক দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

একজন পদার্থবিদ হিসেবে, আমি তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভা খুব কমই দেখেছি। তিনি উচ্চ শক্তির পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে তাঁর গবেষণা জীবন শুরু করেন এবং পিএইচ ডি করেন সাহা ইন্সটিটিউটে অধ্যাপক বিনায়ক দত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে। তারপর তিনি একটি সম্পূর্ণ নতুন বিষয় বাছাই করলেন, বায়োফিজিক্স। তিনি এটা এত ভালোভাবে শিখে ফেললেন যে তিনি ভারতের সর্বাধিক নামজাদা মেডিকেল ইনস্টিটিউটগুলিতে — যেমন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস (AIIMS), পরে ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস (NIMHANS)-এ যথাক্রমে লেকচারার ও এসিস্টেন্ট প্রফেসর পদে নিযুক্ত হন। তিনি এই ইনস্টিটিউটগুলিতে ডাক্তারি ছাত্রদের কয়েকটি এমডি থিসিসের তত্ত্বাবধানও করেন। এরপর যখন তিনি ভারতের একটি অন্যতম প্রধান পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠান সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (SINP)-এর থিওরি ডিভিশনে যোগ দেন, তখন সেখানে তিনি নিউরোবায়োফিজিক্সে গাণিতিক মডেলিংয়ে পিএইচডি ছাত্রছাত্রীদের তত্ত্বাবধান করেন। এরপর তিনি সেখানকার ইলেকট্রনিক্স বিজ্ঞান বিভাগে চলে যান। এখানে তিনি আবার সম্পূর্ণ নতুন একটি গবেষণার বিষয়ে নিজেকে নিযুক্ত করেন যা কম্প্যুটার সায়েন্সের কাছাকাছি বিষয়। এখানে তিনি সিলিকন নিউরন এবং সিলিকন ভিশনের মতো খুব সমসাময়িক ধারণাগুলি নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং নিউরোমর্ফিক ইমেজ প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে পিএইচডি ছাত্রের তত্ত্বাবধান করেন। এভাবেই কণাপদার্থবিদ্যা থেকে, জীবপদার্থবিদ্যা হয়ে তিনি চলে আসেন সিগন্যাল প্রসেসিং, ইনফর্মেশন প্রসেসিং–এর জগতে। SINP থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তিনি গবেষণা চালিয়ে যান এবং তার তত্ত্বাবধানে লিখিত পিএইচডি থিসিসগুলি মনোজগতের পদার্থবিদ্যা বা সাইকোফিজিক্স-এর গন্ডীতে প্রবেশ করে। আমার মতো অতি সাধারণ মানের গবেষকের কাছে কমলেশদাই সেই হেল্মহোল্টজ, ম্যাক্সওয়েল যার হাত ধরে আমি শিখেছি কি করে ওই মহান বিজ্ঞানীদের অনুসরণ করে ফিজিক্স থেকে ফিজিওলজি বা সাইকোলজির জগতে অনধিকার প্রবেশের চাবি চুরি করা যায়। উত্তরাধিকারসূত্রে আমার কাছে থেকে যাবে তাঁর সংগ্রহে বই — কুফ্‌লার-নিকলসের From Neuron to Brain, যে বইয়ের উপর সুরসিক কমলেশদা নিজহস্তাক্ষরে লিখেছেন — Stolen from N Pradhan, NIMHANS (ইনি পরে NIMHANS-এর অধিকর্তা হয়েছিলেন) Now belongs to K Bhaumik.

কমলেশদা নিজে ছিলেন SINP-এর বিনায়ক দত্ত রায় (BDR)-এর অত্যন্ত কৃতী ছাত্র, যিনি নিজে ১৯৫০-এর দশকে কণা পদার্থবিদ্যা নিয়ে বাঘা বাঘা নোবেলজয়ীদের মাঝে বিচরণ করে প্রিন্সটনে পিএইচডি করেছিলেন, পরবর্তীকালে JACARI-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। BDR-এর মতোই কমলেশদা সেই বিরল প্রজাতির মানুষ যারা অনায়াসে নিজের প্রতিভা লুকিয়ে রেখে অন্যান্য সহকর্মী এবং ছাত্রদের দক্ষতার প্রশংসা করতে পারেন। অথচ আপনি বিনায়ক দা বা কমলেশদা-কে যে কোনো বিষয় দিন, তারা খুব দ্রুত সেখান থেকে মূল বিষয়গুলো বের করে খুব স্পষ্ট ভাষায় আপনার সামনে উপস্থাপন করবেন। যাকে মানুষ বলে, জন্মগত শিক্ষক, এঁরা ছিলেন তাই। আর কমলেশদা তো একদম নীরবে স্টেজের পিছনে কাজ করতে জানতেন।

BDR চলে যাওয়ার পর গত কয়েক বছরে, তার কাজের বহুমুখীনতা প্রকাশ পেয়েছে আরো নানা দিকে। মনে পড়ছে, তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুর পরে, তাঁর গবেষণার কাজ ব্যাখ্যা করে একটি চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং পরে এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনের উপর একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছিলেন। সেস্টাস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতীয় বর্ণ ব্যবস্থার ঊনবিংশ শতকের মহান সংস্কারক জ্যোতিরাও ফুলের জীবন নিয়ে নেহাই-এ লেখা, শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা থেকে শুরু করে নতুন শিক্ষানীতির বিশদ সমালোচনা পর্যন্ত নানা বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, কোনো ছুৎমার্গিতা ছাড়া অত্যন্ত সুচারু ও গভীর বিশ্লেষণাত্বক বক্তব্য রেখেছেন বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মঞ্চে, দলের বিচার না করে যুক্ত হয়েছেন গণ আন্দোলনে।

শেষের হঠাৎ ধরা পড়া কষ্টের পর্যায়টুকু বাদ দিলে, JACARI থেকে ছুটি নিয়ে কমলেশদা তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি (প্রায় ৬ মাস) আনন্দে কাটিয়েছিলেন তাঁর পরিবারের প্রিয়জনদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই সময়পর্বেও SINP থেকে অবসরের পরে বৌদির সঙ্গে তাঁর ভিয়েতনাম ভ্রমণ ও সেই দেশটি সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস-ভূগোল-রাজনৈতিক উপলব্ধিতে ভরা তাঁর একটি বই — চল যাই ভিয়েতনাম, নেহাই প্রকাশ করেছিল।

একজন শিক্ষক, একজন বন্ধু এবং একজন কমরেডের কেমন হওয়া উচিত, একজন সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী হওয়ার অর্থ কী, কমলেশদা তাঁর এক অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। তিনি চলে গেলেন ঠিক এমন এক সময়ে যখন তাঁর অতিপ্রিয় একটি বিষয় ভারতের বর্তমান ফ্যাসিস্ট কেন্দ্রীয় সরকার লেখাপড়ার সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে দিল। বিবর্তনের অসামান্য ব্যাখ্যাকার ছিলেন কমলেশদা। পদার্থবিদ হয়েও এ বিষয়টা অনেক বায়োলজিস্টের থেকে বোধহয় ভালো বুঝতেন।

তিনি আমাদের মাঝে রেখে গেলেন বৌদিকে, আর আমেরিকায় বিজ্ঞানী হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত তাঁর একমাত্র মেয়ে সংযুক্তা ও জামাই সৈকতদের সঙ্গে দুই আদরের নাতি মনন ও সৃজনকে। তার চিরকলীন দ্রুতগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে গেলেন মাত্র কয়েকদিনের নোটিসে মারণ কর্কট রোগে, আমার মত অর্বাচীনদের ঘাড়ে বড্ড বেশী দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে।

কুন্তল ঘোষ  
[অধ্যাপক কুন্তল ঘোষ বর্তমানে আই এস আই, কলকাতায়, মেশিন ইনটেলিজেন্স ইউনিটে কর্মরত, এবং JACARI-এর বর্তমান সম্পাদক। সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ তিনি যখন PhD করেন, তখন তাঁর গাইড ছিলেন অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিক।]

farewell-sameresh-majumdersameresh-majumder

উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের জঙ্গল প্রায় শেষ, রুগ্ন চা বাগান গুলি ধুঁকছে, চা বাগানের সাথে যুক্ত শ্রমিক কর্মচারী পরিবারগুলো জীবনযুদ্ধে ধস্ত। উত্তরবঙ্গের কালোসবুজ অরণ্যঘেরা তিরিতিরি আংরাভাষা নদী পাড়ের ঝিরিঝিরি স্বর্গছেড়া চা বাগানের সাতকাহনের অনবদ্য কথা শিল্পী সমরেশ মজুমদারও (১৯৪৪ - ২০২৩) কোনো উত্তরাধিকার না রেখে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির দৌড় শেষ করলেন। হিমালয় পর্বত পেরিয়ে আসা বুনো হাঁসের চোখে এক ফোঁটা জল। চোখে জল গয়েরকাটা টাউনের গর্ভধারিনীর। নথুয়ার বৃদ্ধা মদেসিয়া মা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন বড় পাপ হে। আর কালবেলায় হরিণবাড়ি পেরিয়ে সিংহবাহিনী পুরোনো জমিদার বাড়ি ছাড়িয়ে মহানগরীর ঘিঞ্জি বস্তিতে কালপুরুষের জন্ম হবে মুষলকালকে স্বাগত জানাতে। মাধবীলতাদের জলসিঞ্চনে অনিমেষ থেকে অর্করা মহীরুহ হবেন, গভীর প্রত্যয় নিয়ে উঠে দাঁড়াবে দীপাবলিরা।

বিদায় সমরেশ মজুমদার।

(সামাজিক মাধ্যম থেকে সংগৃহীত)

aisa national conference
খণ্ড-30
সংখ্যা-14