আবার বাজি বিস্ফোরণে মর্মান্তিক মৃত্যু। এবার পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় খাদিকুল গ্রামে। মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কয়েকজন মহিলা সহ আটটা দেহ, নিভে গেল তাজা প্রাণ। তাঁরা সকলেই হতদরিদ্র গ্রামের মানুষ। এত তীব্র ছিল বিস্ফোরণের অভিঘাত যে উড়ে গেল বাড়ি, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিও যে বীভৎস ছবি দেখে আঁতকে উঠেন।
বেআইনি এই বাজি কারখানার মালিক, নেপথ্যের খলনায়ক, প্রতাপশালী বাহুবলী কৃষ্ণপদ ওরফে ভানু বাগ দগ্ধ অবস্থায় ওড়িশার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন প্রয়াত হলেন। মারা গেলেন কলকাতায় এসএসকেএম’এ বিস্ফোরণে আহত আরও দু’জন। বদলি করা হল এগরা থানার আইসি’কে। কিন্তু, অজস্র যে সমস্ত প্রশ্ন উঠে গেল, তার জবাব পাওয়া গেল না।
ভানুর এই বেআইনি বাজির কারখানায় প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৯৫ সালে। তখন মৃত্যু হয় পাঁচ জনের। ফের ২০০১ সালে বিস্ফোরণ ঘটে ওখানেই, আর তখন নিজের ভাই সহ তিন জনের মৃত্যু হয়। বার বার প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় দিব্যি রমরমিয়ে চলে আসছিল এই বেআইনি বাজি কারখানা। এমনকি, বর্তমান বিরোধী দলের নেতা, যিনি অনেক লম্বা চওড়া বিবৃতি দিচ্ছেন, তাঁরও রয়েছে এর পেছনে প্রশ্রয়ের আশীর্বাদ।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ওই এলাকার চরম আর্থিক দুর্দশার কাহিনী। একশ দিনের কাজ নেই, নেই অন্য কাজকর্মের সুযোগ সুবিধা। চরম কর্মহীনতা মমতার বাংলায় গ্রাস করে যে নিদারুণ অবস্থা তৈরি করেছে, এই অঞ্চলে তার ছাপ রয়েছে পরতে পরতে। ডুবন্ত মানুষের শেষ অবলম্বন ১০০ দিনের কাজ করা সত্ত্বেও ২০২১-২২ আর্থিক বছরে কর্মীদের মজুরি বাবদ বকেয়া ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা কেন্দ্র আটকে রেখেছে। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে বকেয়ার পরিমাণ ২ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে শাসক দলের পরিচালিত সাহাড়া পঞ্চায়েতটি নির্দলকে নিয়ে কব্জা করেছে বিজেপি। তারা আসার পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি একরত্তি। এগড়া-১’র বিডিও স্বীকার করেছেন, গত দেড়বছর গোটা ব্লকে বন্ধ রয়েছে ১০০ দিনের কাজ। নিঃস্ব রিক্ত অভাব অনটনে দীর্ণ ওই এলাকার কর্মহীন রোজগারহীন গ্রামবাসী ছিল ভানুর অবৈধ কারখানার স্থায়ী মজুত বাহিনী। অভাবগ্রস্তদের নানা সময়ে সাহায্যের ছল চাতুরিতে ঋণের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, হুমকি দেখিয়ে নিজের কারখানায় কাজ করাতে বাধ্য করেছিল। স্থানীয় প্রশাসন বা বিরোধী দলের আগুনখোর নেতা যে এইসব জানতেন না, তা কিন্তু নয়। নামমাত্র মজুরিতে গ্রামের মানুষেরাই কাজ করতে বাধ্য হতেন। দিনমজুর মা ছেলের পড়ার খরচ জোগাড় করতেই ওই মৃত্যুপুরীতে কাজ করতেন, জানিয়েছে তাঁর ছেলে। যারা যারা মারা গেছেন তাঁদের প্রায় কারুর জবকার্ড ছিল না। মজুরি না পাওয়ায় গ্রামের মানুষেরা ১০০ দিনের কাজে আগ্রহ হারাচ্ছে।
বিস্ফোরণের অভিঘাত থেকেই মালুম হয়, কী ভয়ংকর বিস্ফোরক সেখানে মজুত ছিল। বোঝাই যায়, যত পঞ্চায়েত নির্বাচন এগিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ও প্রধান বিরোধী দলের অস্ত্র বোমা-বিস্ফোরকের উপর নির্ভরতা ততই বেড়ে চলেছে। ফলে, তার চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর আগেও রাজ্যের একাধিক জায়গায় এই সমস্ত অবৈধ বাজি (পড়ুন বোমা) তৈরির কারখানায় দুর্ঘটনার খবর সামনে আসে। কিন্তু পরিস্থিতির কোন বদল হল না।
আমাদের দেশে ২০১৭-২০২০ অব্দি গড়ে প্রতিদিন তিনজন শ্রমিক প্রাণ হারায় শিল্প দুর্ঘটনার জন্য। আর, কোনো বেআইনি কারখানায় নয়, সবগুলোই ঘটেছে সরকারি নথিভুক্ত কারখানায়! কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থানের ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফ্যাক্টরি অ্যাডভাইস সার্ভিস অ্যান্ড লেবার ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে ইন্ডিয়া স্পেন্ড নভেম্বর ২০২২-এ তথ্য জানার অধিকার আইনে উক্ত তথ্য জানতে পেরেছে। এই সমস্ত দুর্ঘটনায় সরকারিভাবে ৩,৩৩১টি মৃত্যু নথিভুক্ত হয়েছে, কিন্তু ফ্যাকট্রি আইন, ১৯৪৮ মোতাবেক মাত্র ১৪ জনের কারাদন্ড হয়েছে ওই সময়ের মধ্যে। মনে রাখা দরকার এই তথ্য কেবলমাত্র সরকারি নথিভুক্ত কারখানার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু, আমাদের দেশে ৯০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন ইনফর্মাল ক্ষেত্রে, যা সরকারি দপ্তরে নথিভুক্ত নয়।
মানেসর ভিত্তিক এক সংগঠন ‘সেফ ইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’ (এসআইআই) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘ক্রাশড ২০২২’, যা হল ছ’টা রাজ্যের অটো সেক্টারে শ্রমিকদের কাজের পরিবশ ও কর্মস্থলে দুর্ঘটনা ও আঘাতজনিত বহু ঘটনার অনুসন্ধান ভিত্তিক এক সমীক্ষা। রিপোর্ট দেখিয়েছে, প্রতিবছর কয়েক হাজার শ্রমিক তাঁদের হাত, হাত-পায়ের আঙুল হারিয়েছে কর্মস্থলে দুর্ঘটনার জন্য। এই সমস্ত অটো হাবে বহু শ্রমিক রয়েছেন যারা পরিযায়ী। তাঁদের নেই কোন ধরনের আইনি সুরক্ষা কবচ, অত্যন্ত নিম্নহারে মজুরি পান, যেখানে কার্যকর নয় দেশের শ্রম কানুনের কোনো ধারা।
২০২০-তে দেশে ৩,৬৩,৪৪২টি নথিভুক্ত কারখানা ছিল, যারমধ্যে ৮৪ শতাংশ চালু আর তাতে ২ কোটি ৩ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত ডিজিএফএএসএলআই’র সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী। সেই রিপোর্ট জানাচ্ছে, গড়ে প্রতি বছর ওই কারখানাগুলোতে ১,১০৯ জনের মৃত্যু ও ৪,০০০’র উপর দুর্ঘটনায় আহত হন।
আইএলও তার রিপোর্টে বলেছে, যুদ্ধের থেকেও বেশি মানুষ নিরাপত্তাহীন কর্মস্থলের দরুণ প্রাণ হারাচ্ছে, যার সংখ্যা দৈনিক প্রায় ৬,০০০। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ২৭ কোটি শিল্প দুর্ঘটনা হয়, আর তাতে মারা যাচ্ছে ২২ লক্ষেরও বেশি মানুষ। আইএলও আরও জানিয়েছে যে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি। অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক কাজের পরিবেশও কেড়ে নিচ্ছে বহু প্রাণ। শুধুমাত্র অ্যাসবেসটসের দূষণে প্রতিবছর ১,০০,০০০ শ্রমিক প্রাণ হারান। অস্বাস্থ্যকর, দূষিত কর্মস্থল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্রমেই অনেক বেশি মৃত্যু ডেকে আনছে। আইএলও তার রিপোর্টে এটাও দেখিয়েছে যে হাড়-ভাঙা খাটুনি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার জন্য স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় স্বাভাবিক অবসরের অনেক আগেই বহু শ্রমিক বাধ্যতামূলক ভাবে অবসর নিচ্ছেন। আইএলও অধিকর্তা আক্ষেপ করে বলেছেন, “কুড়ি বছর আগে ভোপালে ঘটেছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা যাতে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ২,৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে, অসুস্থ হয়ে পড়েন ২ লক্ষের উপর মানুষ। পরবর্তীতে আরও ২০,০০০ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কিন্তু, তারপরও পরিস্থিতি বদলালো না।”
২০২০-তে মোদী সরকার আগেকার কারখানা আইন, ১৯৪৮-কে বাতিল করে ওকুপেশনাল সেফটি হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন কোড নিয়ে আসে। আগের কারখানা আইন (ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট, ১৯৪৮) বর্তমান এই আইনের তুলনায় কয়েকটি ক্ষেত্রে বেশ কঠোর ছিল। যেমন, যেকোনো বিপজ্জনক কারখানা, তার আয়তন যাই হোক না কেন, তাতে সেফটি কমিটি গঠন করতে হতো, কিন্তু নতুন কোডে একমাত্র সরকারি বিজ্ঞপ্তি বা নির্দেশিকা থাকলেই তা গঠন করা যাবে।
যে বিপজ্জনক কারখানায় ন্যূনতম ২৫০ শ্রমিক কাজ করেন, সেখানে সুরক্ষা কমিটি গঠন করা যাবে। কারখানার সংজ্ঞাও পাল্টে গেছে। বিদ্যুতবিহীন সেই সংস্থাগুলোকেই কারখানা বলা যাবে যেখানে ন্যূনতম ৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন, আগে যে সংখ্যা ছিল ২০, আর, বিদ্যুতচালিত সেই সংস্থা যেখানে ন্যূনতম ২০ জন কাজ করে, সেগুলোই কারখানা সংজ্ঞার আওতায় আসবে।
ভারতে কয়েক লক্ষ কারখানা নতুন এই সংজ্ঞার পরিবর্তনে ‘কারখানা’র আওতার বাইরে চলে গেল। এমনকি কারখানা নিরীক্ষণ করার শর্তগুলো বদলে ফেলা হল। ফ্যাক্টরি আইন, ১৯৪৮ থাকা সত্ত্বেও বেআইনি কারখানার গজিয়ে ওঠা, বা সেখানে নিয়ম কানুন লাগু করা যায়নি। নতুন কোড আসার পর সবকিছুই উবে যাবে। শ্রমিকদের ঠেলে দেওয়া হবে চরম নিরাপত্তাহীন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশে।
ভারতে সবচেয়ে বেশি শিল্প দুর্ঘটনা হচ্ছে শিল্পপ্রধান রাজ্যগুলোতে। একই ভাবে, বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বেড়ে চলেছে শিল্প দুর্ঘটনা। আরও ঝুঁকিপূর্ণ, নিরাপদহীন হয়ে উঠছে কর্মস্থল। সরকারের রঙ যাই হোক না কেন, বিশ্বে দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও যাই হোক না কেন, নব্য উদারবাদী অর্থনীতি দ্রুত অত্যাধিক মুনাফা আদায়ে শ্রমিকদের সমস্ত সুরক্ষা কবচগুলো হরণ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। চিনেও কিছুদিন আগে ফক্সকনের শ্রমিকরা সুরক্ষিত কর্মস্থলের দাবিতে যে আন্দোলন করেন, তা প্রচারের আলোয় আসে।
এই রাষ্ট্রীয় অপরাধ, রাষ্ট্র কর্তৃক এই গণহত্যার আয়োজনের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলনকে অনেক মারমুখী আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নের অন্যতম দাবি এখন সুরক্ষিত কর্মস্থল, শোভন কাজ, সামাজিক সুরক্ষা। এই দাবিতেই সোচ্চার হতে হবে সর্বত্র।
- অতনু চক্রবর্তী