শেয়ার গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর অনীতিনিষ্ঠ কার্যকলাপ নিয়ে এবছরের ২৪ জানুয়ারি রিপোর্ট প্রকাশ করার পর ঐ কোম্পানিগুলোর কার্যকলাপ নিয়ে তদন্তের দাবি ওঠে। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল — আদানিরা শেয়ার আইন লঙ্ঘন করেছে, কোম্পানির ২৫ শতাংশ শেয়ার নিজেদের ও পরিবারের গণ্ডির বাইরে রাখার বিধিকে ভেঙে ঐ ২৫ শতাংশ শেয়ারের অধিকাংশই নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছে এবং সন্দেহজনক উৎস থেকে বিনিয়োগ ঘটিয়ে কারচুপির মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের বহুগুণ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী সরকার ঐ তদন্তের দাবিতে বাধা দিলে এবং যৌথ সংসদীয় কমিটির অধীনে তদন্তের দাবিকে আটকালেও সুপ্রিম কোর্ট সর্বোচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এম সাপ্রের নেতৃত্বে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে তদন্ত করতে বলে। উল্লিখিত অভিযোগগুলোর অনুধাবনে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির কোনো ব্যর্থতা ছিল কিনা সেটাই ঐ কমিটির বিচার্য বিষয় হয়। ঐ কমিটি সম্প্রতি তাদের রিপোর্ট জমা করেছে এবং রিপোর্টের বিষয়বস্তুও প্রকাশ পেয়েছে।
কমিটি তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে — আদানিরা আইন ও তার প্রয়োগ বিধি ভেঙেছে, এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ সেবি পায়নি। এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ সেবির হস্তগত হয়নি যার ভিত্তিতে বলা যাবে যে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধিতে আদানিরা কারচুপির আশ্রয় নিয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সেবির দেওয়া ব্যাখ্যাকে ধর্তব্যের মধ্যে নিলে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় যে, শেয়ারের দামে কারচুপির অভিযোগ বুঝতে নিয়ন্ত্রকের দিক থেকে ব্যর্থতা ছিল।” আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই সমস্ত বিনিয়োগ আসলে আদানিদেরই টাকা। টাকা ভারত থেকে বিদেশে গিয়ে মরিশাসের মতো করের স্বর্গরাজ্যে নথিবদ্ধ কোম্পানির বিদেশি বিনিয়োগ হিসাবে ফিরে এসে আদানিদের কোম্পানিতেই খাটছে। এবং এই ধরনের বিনিয়োগের পরিমাণ বিপুল হলে কোম্পানির শেয়ারের দামও অতি দ্রুত লাফিয়ে বেড়ে চলে। এই সমস্ত বিদেশি কোম্পানির প্রকৃত পরিচিতি সম্পর্কে রিপোর্টের অভিমত হল, “যে সন্দেহের ভিত্তিতে সেবি আদানিদের নথিভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের (এফপিও) অংশিদারি নিয়ে তদন্তে উদ্যোগী হয় তা হলো এই যে, তাদের মালিকানার কাঠামো ‘অস্বচ্ছ’, কেননা, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের ভাগিদার ১৩টা বিদেশি সংস্থার মালিকানা শৃঙ্খলের শেষটা স্পষ্ট নয়।” অর্থাৎ, ঐ ১৩টা সংস্থা নামে বিদেশি হলেও সেগুলো গৌতম আদানিরই খাড়া করা কোম্পানি কিনা, সেগুলোর বিনিয়োগের টাকা আদানিদেরই টাকা কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ সেবির থাকলেও তার কিনারা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই ঘটনা সুবিদিত যে, এই ১৩টা বিদেশি কোম্পানি বা তাদের অর্থের দৌলতেই আদানি একেবারে শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, কিছু সময়ের জন্য বিশ্বের তৃতীয় ধনি ব্যক্তির মর্যাদা লাভও করেছিলেন। এই ১৩টা সংস্থায় আবার অর্থ জুগিয়েছে ৪২টা অজ্ঞাত পরিচয়ের জোগানদার যাদের পরিচিতির উন্মোচন ঘটানো সেবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই কোম্পানিগুলোকে খাড়া করার পিছনে যদি আদানিদের হাত থেকে থাকে এবং কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে তাদের হস্তগত শেয়ারের পরিণতিতে যদি মূল কোম্পানি ও তাদের পরিবারের বাইরে ২৫ শতাংশ শেয়ার রাখার বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন ঘটে থাকে, তবে ৪২টা জোগানদারের পরিচিতির উন্মোচন ছাড়া সেটা ধরতে পারা সম্ভব হবে না। এদের পরিচিতির উদঘাটন না হলে আদানিদের টাকাই বিদেশ ঘুরে ভারতে বিনিয়োগ হচ্ছে কিনা তা অবিদিতই থেকে যাবে। বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে সেবির এই প্রচেষ্টা অভিহিত হয়েছে ‘গন্তব্যহীন যাত্রা’ হিসাবে। অর্থাৎ, ৪২টা অর্থ জোগানদারের পরিচিতির উন্মোচনে সেবি প্রয়াসী হলেও তা তাদের সাধ্যের বাইরে থেকে যাবে। এবং এই অর্থের প্রকৃত উৎস আদানিরা হলেও তার অনুদঘাটন তাদের শঙ্কাহীন এবং কারচুপি ও জালিয়াতিতে আরও বেপরোয়া করে তুলবে।
গৌতম আদানির কোম্পানিগুলোতে সন্দেহজনক বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে চর্চা হালফিলের কোনো বিষয় নয়। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার অনেক আগে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র ২০২১’র জুলাই মাসেই আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাঁর প্রশ্ন ছিল — আদানিদের বিরুদ্ধে সেবি, আয়কর বিভাগ, ইডি, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক, ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্স কোনও তদন্ত করছে কিনা। তার উত্তরে কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধরি ২০২১’র ১৯ জুলাই সংসদে বলেন, “হ্যা, মহাশয়া, সেবির নিয়ন্ত্রণ মেনে চলা বিষয় নিয়ে সেবি আদানি গোষ্ঠীর কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।” আর সেবি এবছরের ১৫ মে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামায় জানাল — আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ২০১৬ সাল থেকে তাদের তদন্ত চালানোটা ‘তথ্যগতভাবে ভিত্তিহীন’। তাহলে, কে সত্যিটা বলছে — মোদী মন্ত্রীসভার মন্ত্রী না সেবি? মন্ত্রী ও সেবির অবস্থানের এই বৈপরীত্য মহুয়া মৈত্রর কাছে চরম বিস্ময়কর হয়েই ঠেকেছে — “এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ভারতের প্রধান বাজার নিয়ন্ত্রকের আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে এতটাই যোগসাজশ রয়েছে যে সংসদে লিখিত বিবৃতি দিয়ে ওরা মিথ্যা বলছে যে ওরা তদন্ত করছে। অর্থ মন্ত্রকে ওদের ওপরওয়ালারা সংসদে মিথ্যা বলছে যে সেবি তদন্ত করছে।… আর তারপর সেবি সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলছে যে তারা তদন্ত করেনি। এটা সত্য বলার হলফ করেও মিথ্যাকথন।”
মহুয়া মৈত্রর সূত্র ধরেই অনামিকা জয়সওয়াল সুপ্রিম কোর্টে তাঁর জনস্বার্থ মামলায় জানিয়েছেন, মরিশাসে নথিবদ্ধ তিনটে কোম্পানি আলবুলা ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, ক্রেস্টা ফান্ড এবং এপিএমএস ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড আদানিদের চারটে কোম্পানিতে (আদানি এন্টারপ্রাইজেস, আদানি গ্রীন এনার্জি, আদানি ট্রান্সমিশন এবং আদানি টোটাল গ্যাস) ৪৩,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এই তিনটে সংস্থার আসল মালিক কারা, আদানিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী, এই বিনিয়োগগুলো কী আদানিদের কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের বৃদ্ধিতে কোনো অবদান রাখেনি? জয়সওয়ালের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্রতিনিধিত্ব করছেন অ্যাডভোকেট প্রশান্ত ভূষণ এবং সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের সামনে তাঁর উপস্থাপনা ছিল এরকম — “এটা একেবারেই পরিষ্কার যে আদানির কোম্পানিগুলোকে আড়াল করার একটা প্রচেষ্টা চলছে। লিখিত আকারে ওদের বলতে হবে ২০১৬ সাল থেকে চালানো তদন্তের ফল কী হয়েছে। আদানিদের শেয়ার মূল্যে যদি ১০,০০০ বা ৫,০০০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে তবে বিপদসূচক ঘন্টা অবশ্যই বাজাতে হতো।… সেবি যদি এই ব্যাপারগুলোয় তদন্ত চালিয়ে থাকে তবে বিস্তারিত এই ব্যাপারগুলো ওদের নজর এড়িয়ে গেল কী ভাবে,” অতএব, সুপ্রিম কোর্ট গঠিত প্যানেল তাদের রিপোর্টে সেবির কোনো ত্রুটি খুঁজে না পেলেও আদানির কোম্পানিগুলোতে সন্দেহজনক উৎস থেকে বিনিয়োগ সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নই উত্তরের অপেক্ষায়।
সুপ্রিম কোর্ট হিন্ডেনবার্গের অভিযোগুলো, বিশেষভাবে বিদেশি লগ্নিকারীদের স্বচ্ছতা নিয়ে ২ মার্চ সেবিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দু’মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করতে বলেছিল। সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেছে ২ মে ২০২৩, এবং সেবি তদন্ত সম্পন্ন করতে সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে আরো ছ’মাস সময় চাইলে সুপ্রিম কোর্ট তাদের তিন মাস সময় দিয়ে ১৪ আগস্টের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে। এবং নির্দেশ দিয়েছে, সেবি যেন তদন্তকে নানা দিকে না ছড়িয়ে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে উল্লিখিত অভিযোগ অনুসারে কোম্পানির শেয়ার দরে কারচুপি, অর্থাৎ, সন্দেহজনক উৎস থেকে বিনিয়োগ এনে শেয়ার দরের বৃদ্ধি ঘটানো এবং হিসাব-নিকাশের জালিয়াতির ওপরই তাদের তদন্তকে নিবদ্ধ রাখে। সেবি প্রশাসনিক চাপকে অগ্রাহ্য করে কতটা নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারে এবং তাদের তদন্তের মধ্যে হিন্ডেনবার্গ, মহুয়া মৈত্র এবং অনামিকা জয়সওয়ালের তোলা অভিযোগের ওপর কতটা আলোকপাত হয়, তার দিকে আমরা সাগ্ৰহে তাকিয়ে থাকব। তবে, সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটি যেভাবে আদানি ও সেবিকে ক্লিনচিট দিয়েছে, তাতে সেবির তদন্তের অভিমুখ তার থেকে কতটা ভিন্ন হতে এবং তাদের তদন্ত কতটা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হতে পারবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
সবশেষে একটা বিষয়ের উল্লেখ আবশ্যক হয়েই দেখা দিচ্ছে। অর্থের যে ৪২টা জোগানদার ১৩ বিদেশি সংস্থায় অর্থ জুগিয়েছে, তাদের প্রকৃত পরিচিতির উন্মোচন কি একেবারেই দুঃসাধ্য? এরা ছড়িয়ে রয়েছে সাতটা দেশে — কেম্যান আইল্যান্ড, মালটা, কিউরাকো, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, বারমুডা, আয়ারল্যান্ড ও গ্রেটব্রিটেনে। সেখানে গিয়ে তদন্ত করে এদের সন্ধান পাওয়াটা অসম্ভব নয় বলেই মনে হয়। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত এ এম সাপ্রের নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, এদের লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত জে পি মরগান চেজ, গোল্ডম্যান স্যাকস, সিটি গ্রুপ, ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা ও মরগান স্ট্যানলির মতো ব্যাঙ্কগুলোকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হলেও তারা আসেনি। রিপোর্ট জানিয়েছে, “কোনো আন্তর্জাতিক সিকিউরিটি ফার্ম ও ব্যাঙ্ক এই ব্যাপারে অংশ নিতে আগ্ৰহ দেখায়নি।” ভারতের তদন্তের প্রয়োজনে কেন এদের হাজির হতে বাধ্য করা যাবে না? এটা ঐ কমিটির অক্ষমতাকেই প্রতীয়মান করে। নরেন্দ্র মোদীর ইচ্ছায় আয়কর দপ্তর বিবিসির দিল্লী ও মুম্বই অফিসে হানা দিতে পারলে এবং বিবিসি ভারতের আইনের প্রতি মান্যতা দেখাতে পারলে এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপ্রকাশিত জরুরি তথ্যের উদঘাটনে অবশ্যই বাধ্য করা যায়। কেউ-কেউ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, যৌথ সংসদীয় কমিটির সেই ক্ষমতা আছে এবং তার সমনকে অগ্রাহ্য করা এদের পক্ষে সম্ভব হবে না। অতএব, সাপ্রের নেতৃত্বাধীন কমিটি ও সেবির অনির্ভরযোগ্য ও ফাঁপা তদন্তের পরিবর্তে প্রশাসনিক চাপকে অগ্রাহ্য করা সনিষ্ঠ তদন্ত ও যৌথ সংসদীয় কমিটির নেতৃত্বাধীন তদন্তের দাবিকে আমাদের দৃঢ়তার সাথে ওঠাতে হবে।
- জয়দীপ মিত্র