স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতির লড়াইয়ের ময়দানে শ্রমিকশ্রেণীর প্রাণশক্তি ও ক্ষমতার উত্থান
Liberty, Equality and Solidarity

মে দিবস ২০২৩ : 

১ মে ২০২৩-এ ভারতবর্ষে মে দিবস উদযাপনের শতবর্ষ পূরণ হতে চলেছে। দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময়সীমা নির্ধারণের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৮৮৬ সালে মে দিবস পালন শুরু হয়েছিল। ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোতে হে-মার্কেট হত্যাকাণ্ডের পর আন্দোলনের গতি আরও বৃদ্ধি পায়৷ ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বদের একটা বড় অংশকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলে আন্তর্জাতিক স্তরে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম আরও তীব্রতর হয়। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে, জার শাসনাধীন রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণী বিশ্বে সর্বপ্রথম বিপ্লব সংঘটিত করে। এরপরই শ্রমিকশ্রেণীর জাগরণের তরঙ্গ ঔপনিবেশিক ভারতে এসে পৌঁছায়। ১৯২০ সালে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস গঠিত হয় এবং ১৯২৩ সালে এম সিঙ্গারাভেলারের নেতৃত্বে চেন্নাইতে প্রথম মে দিবস উদযাপিত হয়।

যেহেতু আমরা ভারতে মে দিবস উদযাপনের শতবর্ষ পালন করছি, আমাদের অবশ্যই ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। একইসাথে, শ্রমিকের সামাজিক মুক্তি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার অধিকারকেও সুনিশ্চিত করতে হবে। এ’কথা অনস্বীকার্য যে, কমিউনিস্ট আন্দোলন শ্রমিকশ্রেণীর দাবির ভিত্তিতে সুসংগঠিত ও প্রসারিত হয়েছিল। তবে শুধু কমিউনিস্টরাই নন, স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক বিশিষ্ট নেতা ছিলেন যাঁরা শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগতিতে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখেছিলেন। লালা লাজপত রায়, চিত্তরঞ্জন দাস, জওহরলাল নেহেরু এবং সুভাষচন্দ্র বসুর মতো প্রখ্যাত কংগ্রেসী নেতারা সকলেই বিভিন্ন সময়ে এআইটিইউসি’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে জ্যোতিরাও ফুলের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, নারায়ণ লোখান্ডে, জাতিগত নিপীড়ন এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী যুদ্ধের পাশাপাশি মহারাষ্ট্রে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিলেন।

আজ একদিকে যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যে অধিকারগুলি ছিনিয়ে নিয়েছিলাম — ভারতীয় সাধারণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, আইনের শাসনের সাংবিধানিক কাঠামো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উপর ভিত্তি করা সামাজিক কাঠামো এবং অন্যান্য নাগরিক অধিকার — সেই সবকিছু আজ ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে, শ্রমিকশ্রেণীর আদায়কৃত অধিকারগুলিও পরিকল্পিতভাবে খর্ব করা হচ্ছে। কর্পোরেট স্বার্থবাহী তিনটি কৃষি আইন কৃষকেরা বাতিল করতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু চারটি শ্রমকোড, যেগুলি পূর্ববর্তী শ্রম আইন এবং শ্রমিকের অধিকারগুলির বেশিরভাগকে প্রতিস্থাপিত করবে, তা এখনও ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর মাথার উপরে বিপদের খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। স্পষ্টতই, আগামীদিনে শ্রমিকশ্রেণীকে কৃষকদের মতো কঠোর লড়াই করতে হবে এবং ঔপনিবেশিক যুগের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মতো এই লড়াইগুলোকেও গণতন্ত্রের জন্য বৃহত্তর লড়াইয়ে রূপ দিতে হবে।

মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও মর্যাদার গৌরবময় ইতিহাস। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ শ্রমিক কিছু মৌলিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। চাকরির নিরাপত্তা, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, সম কাজে সম মজুরি সহ জীবিকা নির্বাহ এবং সামাজিক নিরাপত্তা — শ্রমিকশ্রেণীর মর্যাদা ও ঐক্যের প্রধান চারটি ভিত্তি। ভারতীয় শ্রমিকদের বেশিরভাগই আজ এই সমস্ত মৌলিক অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিপজ্জনক কাজ, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্র, সংকটাপন্ন জীবনযাপন এবং বাড়তি কাজের জন্য নামমাত্র বেতন — এইসব এখন ভারতের লক্ষ লক্ষ চুক্তি-কর্মী, ইনফর্মাল সেক্টরের কর্মী, সাফাই কর্মী, স্কিম কর্মী এবং ডেলিভারি কর্মী যারা দেশের পরিষেবা এবং ডিজিটাল অর্থনীতির বৃহৎ অংশ পরিচালনা করেন তাঁদের কাজ ও জীবনযাপনের শর্ত হয়ে উঠেছে।

ভারতের বৈচিত্র্যময় শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণী ঐক্যের বন্ধনকে শক্তিশালী করার জন্য শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে অবশ্যই নিরাপত্তাহীনতা, অসম্মান ও অসমতার এই মৌলিক ধারাগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের বিক্ষিপ্ত এবং বিভক্ত শ্রমিকদের একটি সর্বভারতীয় শ্রেণী হিসেবে গড়ে তুলতে আরও কিছু বিভাজনের দেয়ালকেও ভাঙতে হবে। ‘জাত’, যাকে আম্বেদকর ‘শ্রমিকদের বিভাজন’ ব্যবস্থা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই জাত ব্যবস্থা আজও শ্রমিকশ্রেণীকে খণ্ডিত করে চলেছে। এক সচেতন ও ধারাবাহিক জাত-বিরোধী দিশাই শ্রেণী ঐক্য গড়ে তুলতে এবং জাত-ভিত্তিক নিপীড়ন ও সামাজিক বর্জন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক কুসংস্কার এবং প্রতিকূল বৈষম্যের শিকার, সরাসরি সামাজিক বর্জন ও হয়রানির ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্র একই রকম ভূমিকা পালন করে। শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যকে অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা ও ভাষাগত বিভেদ এবং স্থানীয় শ্রমিক ও বহিরাগতদের মধ্যে বিরোধ কাটিয়ে উঠতে হবে।

ন’বছরের মোদী শাসনে ভারতের অর্থনীতি, সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মোদী সরকার এবং সঙ্ঘ বাহিনীর দ্বারা নিরন্তর যে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ নেমেছে, শ্রমিক আন্দোলন তার সাক্ষী। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আর মাত্র এক বছর বাকি আছে। ২০২৩ সালের মে দিবস বার্তা দিচ্ছে, ভারতীয় সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ভারত ও ভারতীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে ঐক‍্যবদ্ধ ফ‍্যাসিবিরোধী আন্দোলনে নামতে হবে।

- এমএল আপডেট, সম্পাদকীয়, ২-৮ মে ২০২৩

খণ্ড-30
সংখ্যা-13