ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিগড় থেকে মুক্ত ভারতে শাসকশ্রেণী স্বাধীনতাপ্রাপ্তীর দুই দশক পরে শ্রমজীবী নাগরিকের কাছে সমঅধিকার, সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিভঙ্গের এক কলঙ্কজনক নজির তুলে ধরেছিল। বিগত শতাব্দর ৪’এর দশকে বাংলার বুকে সাম্রাজ্যবাদী সরকার ও সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকেরা ফসলের তেভাগার দাবি নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। তার অব্যবহিত পরে দক্ষিণের তেলেঙ্গানায় সামন্তী নিজামশাহীর বিরুদ্ধে আবারও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষকেরা নারী, পুরুষ নির্বিশেষে গেরিলা যুদ্ধে নেমেছিল। নেহেরু সরকারের দেশের সম্পদ সৃষ্টিকারী কৃষক জনতার উপর নির্মম দমনপীড়নের স্বরূপ সেদিন উন্মোচিত হয়েছিল সংগ্রামের সুবাদে। পাঁচের দশকজুড়ে বাংলার বুকে উদ্বাস্তু আন্দোলন, ট্রামশ্রমিকদের লড়াই, শিক্ষকদের উন্নত মজুরি ও মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন, সর্বোপরি জমিদারী বিলোপ আইনের সূত্রে জোতদার-জমিদারদের সিলিং বহির্ভূত বেনামী জমি দখলের আহ্বান কংগ্রেসী সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনতার বৃহদাংশের, বিশেষ করে গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের প্রত্যক্ষ বিদ্রোহে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল।
ব্রিটিশ ভারতে ১৮৫৫’র সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭এ উর্দিপরা কৃষকদের মহাবিদ্রোহ, ১৮৬০’র নীল বিদ্রোহ, ১৮৯৯-১৯০০ সালের মুন্ডা বিদ্রোহের উত্তরাধিকারে সম্পৃক্ত সংগ্রামী কৃষকেরা গান্ধীর প্রবচন না মেনে চৌরিচৌরায় বিদ্রোহী চেতনাকে ব্যক্ত করেছিল বিপুল তেজে।
ভারতের ইতিহাস কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস। ৬’এর দশকে নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, ফাঁসিদেওয়ায় ৬০ হাজার কৃষক জোতদারদের সামন্তী শোষণের অবসান ঘটাতে ও পুঁজিপতি-পরস্ত ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে জমির নিরঙ্কুশ অধিকার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের স্পর্ধা নিয়ে উত্তরের মাঠে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। অগণ্য শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে ১৯৬৭-৭৭’র এই বিপ্লবী দশকের অভিঘাতে এই বাংলায় ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের স্বার্থে ভূমিসংস্কারের কর্মসূচিকে আংশিকভাবে রূপায়িত করতে বাধ্য হয়েছিল পরবর্তী বামফ্রন্ট সরকার।
নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম ভারতের কৃষি অর্থনীতিকে যেমন জনমুখি করে তুলেছিল, তেমনি ইতিহাস চর্চায় নিম্নবর্গের শ্রমজীবী জনতার ভূমিকাকে মান্যতায় প্রতিষ্ঠা করেছিল।
আজ নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রামের পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে গ্রামবাংলার কৃষিজীবী পরিবারগুলি সার, বীজ, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ফসলের অভাবী বিক্রি, ভাগচাষিদের অধিকারচ্যূতি, লীজ চাষিদের সরকারী ঋণ, কিষাণ ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি না পাওয়া, সেচের সুবিধা না পাওয়া, কৃষি সমবায়গুলির দুর্নীতি ও অকার্যকারিতার মুখে গ্রামীণ সর্বহারায় পরিণত হয়ে চলেছে। সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা জানাচ্ছে বাংলার গ্রামাঞ্চলে কৃষিতে স্বনিযুক্ত পরিবারগুলি সমগ্র গ্রামীণ সমাজের মাত্র ২৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাম শাসনকালের শেষপর্বে জমি থেকে অধিকারচ্যূত পরিবারের সংখ্যা ৪০-৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ জবকার্ডধারী শ্রমজীবি জনতা, যাদের বছরে ১০০ দিনের কাজ মোদী সরকারের সৌজন্যে দেশজুড়ে ১৭ দিনে পর্যবসিত হয়েছে, বরাদ্দ ছাঁটাই হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আর বাংলার জবকার্ডধারী শ্রমিকেরা বিগত ১৫ মাস ধরে তাঁদের কষ্টার্জিত ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে।
মোদী সরকারের উদ্যোগে কৃষিজমির অধিকার, কৃষিজাত ফসলের উৎপাদন, বণ্টন ও বিপণনকে পুরোপুরি আদানি- আম্বানি পরিচালিত কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়ার কৃষিনীতি কৃষকদের মাটি কামড়ানো প্রতিরোধের মুখে প্রতিহত হয়েছে। তবু দেশজুড়ে কৃষিজাত ফসলের ন্যূনতম সরকারী সহায়কমূল্য বা কৃষিউপকরণের মূল্যহ্রাসের কোন নীতি প্রণয়নে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোন আগ্রহ নেই। বরং তৃণমূল সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শাসকদলের গ্রামীণ প্রতিনিধিদের দ্বারা মজুরি লুট, জবকার্ডের অপব্যবহার, আবাস প্রকল্পে বরাদ্দ তহবিল তছরূপ, দলীয় ও পুলিশী সন্ত্রাস ইত্যাদি গ্রামীণ সমাজকে অপশাসনের অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে। ভারতীয় সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে মমতা শাসনে সম্পূর্ণত দলীয় ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে কুক্ষিগত করে রাখা হচ্ছে।
পাঁচদশক পূর্বের কৃষক সংগ্রামের উজ্জ্বল পরম্পরায় বিপ্লবী কৃষক চেতনাকে আবার নতুন করে বাংলার গ্রামে গ্রামে জীবন, জীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হবে। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে পাখির চোখ করে পার্টি ও গণসংগঠনের সমগ্র কর্মীবাহিনীকে আগামী দিনগুলিতে গ্রামবাংলার প্রতিটি জেলায় নিবিড় গ্রামভিত্তিক কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
কমরেডগণ, আসুন ১০ মে থেকে ১০ জুন অবধি এআইকেএম ও আইয়ারলা’র রাজ্য কমিটি দ্বারা সূচিত কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে গ্রামের ঘরে ঘরে সমীক্ষা ও প্রচার, কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিপুল সংখ্যায় জনসমাবেশ ঘটিয়ে পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিসে ধর্ণা-ঘেরাও, কৃষিমন্ত্রক ও রাজ্যপালের কাছে জনমুখি বিকল্প কৃষিনীতি প্রণয়ন ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে শোষণ, শাসনমুক্ত জনমুখিকরণের লক্ষ্যে দাবিসনদ পেশ — ইত্যাদি আলোড়নধর্মী কর্মসূচিগুলিকে সফল করে তুলি।
২৫ মে ‘নকশালবাড়ি দিবস’ উদযাপন এবারে হয়ে উঠুক পার্টির পলিটব্যুরো নির্দেশিত ২৮ জুলাই অবধি পার্টি ব্রাঞ্চ ও লোকাল কমিটিগুলির সশক্তিকরণের মাধ্যমে নিরন্তর গণসংযোগ ও কৃষিজীবী জনতার বিপ্লবী দিশায় অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার গণসংগ্রামের শপথী সূত্রপাত।
- অভিজিৎ মজুমদার