সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল বেশ আগে থেকেই। তলে তলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছিল, রামনবমীকে কেন্দ্র করেই ফের আগুন জ্বালানো হবে, ছড়ানো হবে সাম্প্রদায়িক হিংসা। দেখা গেল, দু-একটা রাজ্যে নয়, মুহূর্তের মধ্যে আট থেকে দশটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল সাম্প্রদায়িক হানাহানি। আর, বেশ পরিকল্পিতভাবেই। সর্বত্র একই ছবি। মিছিলে অস্ত্রের ঝনঝনানি, হাতে গৈরিক পতাকা ও গেরুয়া বর্ণের পোষাকে সজ্জিত অংশগ্রহণকারীরা, ডিজে-র কানঝালাপালা করা তারস্বরে গান ও উন্মত্ততা, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অশালীন, হুমকি মেশানো কদর্য উক্তির মিশেলে হিন্দুরাষ্ট্রের জয়গান। ধর্মীয় মিছিলের মুখোস ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ল দাঙ্গাবাজদের হিংস্র নখ দাঁত। কোথাও কোথাও মসজিদ পুড়ল, কোনো কোনো মসজিদের উপরে উঠে বেঁধে দেওয়া হল গৈরিক পতাকা। এ রাজ্যে বিজেপি-আরএসএস নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তৃণমূলী নেতাদেরও বেশ উৎসাহজনক উপস্থিতি নাগরিকদের গোচরে এল। দেশের প্রধানমন্ত্রী নীরব থেকেই গোটা ঘটনাকে বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন। এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে প্রশমিত করার বদলে বিহারে “দাঙ্গাবাজদের উলটো ঝুলিয়ে শাস্তি দেওয়ার হুমকি” দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিজেপি শাসিত রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রতি চোখ বন্ধ রেখে কেবলমাত্র দুষলেন অবিজেপি রাজ্যগুলোকে।
বেশ কয়েকবছর ধরেই চলছে এই ঘৃণ্য খেলা। এ রাজ্যে হিংসার মানচিত্র ক্রমে হাওড়া ছাড়িয়ে হুগলিতে ঢুকে পড়ল। হুগলির রিষড়ায় বিজেপির এক ডাকাবুকো নেতার উপস্থিতি ও ইন্ধনে শুরু হল এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, যা এখনো প্রশমিত হয়নি। সেই নেতার বিরুদ্ধে মমতার প্রশাসন এখনও পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করল না। তৃণমূলী নেতাদের উপস্থিতির কারণে “অনুমতি না নেওয়া” এই সমস্ত শোভাযাত্রা পুলিশ প্রশাসনের কাছে এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যায়। ঠিক যেমন, দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে, সংঘ বাহিনীর গুন্ডারা পুলিশকে সরাসরি প্রশ্ন করেছে, “হিন্দুর দেশে হিন্দুরা মিছিল করবে, তার জন্য অনুমতি নিতে হবে কেন”? সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টে দেখা গেল গুজরাটে মাথায় “জয় শ্রীরাম” গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা কয়েকজন তরুণ পুলিশকে দাঁড় করিয়ে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলছে, “আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আবার ২০০২ হয়ে যাবে”। খবরে প্রকাশ, আতঙ্কিত মুসলিম সম্প্রদায় ক্রমেই নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। সমাজের উচ্চবিত্ত স্তরে আসীন নাগরিকও ক্রমেই এই সাম্প্রদায়িক বৃত্তের মধ্যে চলে এসে পরোক্ষে মদত দিচ্ছে এই সাম্প্রদায়িক হিংসার। দেখা গেল, দিল্লির নয়ডা অঞ্চলে বহুতল আবাসনে দীর্ঘদিন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করলেও, এবার সেখানে শোনা গেল উল্টো সুর। হিন্দু আবাসিকরা পুলিশ প্রশাসনের কাছে নালিশ করে জানিয়েছে, তাঁদের আবাসন চত্বরের অদুরে রমজানের প্রার্থনা যেন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়।
এই হল ফ্যাসিবাদ। সে শুধু দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ভেতর থেকেই কুক্ষিগত করে না, সে তার চিন্তা মতাদর্শে গোটা সমাজকে গ্রাস করে, বশ করানোর চেষ্টা করে, তার যুক্তির পক্ষে টেনে নেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের। বিপদ এখানেই। দেশের অভ্যন্তরে যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ হিসাবে দাগিয়ে দেয় এক “অপর”-কে, আর সেই “অপর” ধুয়ে মুছে সাফ করলেই আকাঙ্ক্ষিত অমৃতকালের নাকি অভ্যুদ্বয় ঘটবে সব গ্লানির অবসান ঘটিয়ে!
এ রাজ্যে, ২০১৪’র আগে, সংঘ বাহিনীর এমন দাপট লক্ষ্য করা যায়নি। রামনবমীর মিছিলের এই লাম্পট্য, হিংস্রতা, অশান্তি বাঁধাবার পরিকল্পিত ছক বাংলার নাগরিক সমাজ দেখেনি। বামপন্থী রাজনীতি ক্রমে ক্রমে দুর্বল হওয়া, হিন্দুত্ববাদীদের সাথে টক্কর দেওয়ার নামে তাদেরই মাঠে নরম হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে তৃণমূলীদের সংঘ পরিবারের বেঁধে দেওয়া নিয়মে খেলতে যাওয়া, “আরএসএস ভালো, বিজেপি খারাপ” মমতার এই মতাদর্শগত প্রশ্রয়, গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করা, সরকার ও প্রশসনের সর্বাঙ্গে দুর্নীতির দগদগে ঘা — সংঘ পরিবারের বৃদ্ধি বিকাশের উর্বর জমি প্রস্তুত করেছে। রাজ্যে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন। ২০২৪-এ দেশের সাধারণ নির্বাচন। তারই প্রাক্কালে মেরুকরণের রাজনীতি ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে। বিদ্বেষ, হিংসা ঘৃণা ভাষণের পালে বাতাস বইয়ে জনগণের অত্যন্ত আশু ও জীবন্ত দাবিগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যকে প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে এনেই পার হতে হবে বিষের এই বিষাদ সিন্ধু। জনগণের দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণা, প্রতিদিন অর্জিত অধিকারগুলো যেভাবে খোয়াতে শুরু করেছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েই এই প্রতিক্রিয়াকে মোকাবিলা করতে হবে।