গত ৩১ মার্চ, মাদ্রাজ আইআইটি-র রিসার্চ স্কলার শচীন কুমার আত্মহত্যা করেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়ে মাদ্রাজ আইআইটি-তে শচীন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করছিল। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার আগে শচীন হোয়াটসঅ্যাপ স্টোরিতে লিখেছিল – “নট গুড এনাফ, আই অ্যাম সরি”।
সম্প্রতি রাজ্য সভায় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে আইআইটি-তে ৩৩ জন পড়ুয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ভারতের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্রদের আত্মহত্যার হার অবিরত বেড়ে চলেছে। রেকর্ড অনুযায়ী, আইআইটি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (এনআইটি) এবং দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম)-এ ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৬১ জন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের রিপোর্টে সরকারকে জানানো হয়, ২০১৪-২০২১ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১২২ জন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। যাদের মধ্যে ২৪ জন তফশিলি জাতি (এসসি)’র, ৩ জন তপশিলি উপজাতি (এসটি)’র এবং ৪১ জন অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (ওবিসি)’র অন্তর্গত।
গত ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ, বম্বে আইআইটি’র আটতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে, প্রথম বর্ষের দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্র দর্শন সোলাঙ্কি৷ দর্শনের বাবা পেশায় মুচি এবং মা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। অভাবের সংসার থেকে আসা এই আঠারো বছর বয়সী ছেলেটিই তার বংশে প্রথম উচ্চশিক্ষার দিকে এগোতে পেরেছিল। দুঃখজনক বিষয়, এত বড় নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই তাকে জাতিবৈষম্যের শিকার হতে হয়। তাকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হত যে, সে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে এসে উঁচুজাতের পাতে ভাগ বসিয়েছে। তিন মাস ধরে সহপাঠী, শিক্ষক ও অন্যান্যরা তাকে নানা জায়গায়, নানা উপায় বিচ্ছিন্ন করেছে।
সাধারণত নিয়মানুযায়ী ভারতবর্ষের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০% আসন তফশিলি জাতি(এসসি)’র জন্য সংরক্ষিত থাকে। স্বাধীনতা- পরবর্তী সময় থেকে এ’দেশে সংরক্ষণের নীতি প্রণয়ন হয়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানা হয় না। প্রাচীন সময় থেকে অনগ্রসর শ্রেণি শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই প্রগতিশীল সমাজে তাদের আরও বেশি করে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসার জন্যই সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। অপরদিকে, সাধারণ শ্রেণির বেশিরভাগ জনগণ মনে করে, সংরক্ষণ ব্যবস্থার ফলে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তবে এই ক্ষোভ ভিত্তিহীন এবং কিছুক্ষেত্রে এই বিভাজনের মনোভাব শাসকশ্রেণির কাছে টোপের মতো। যুগ যুগ ধরে উঁচু শ্রেণির ব্রাহ্মণদের কাছে একমাত্র শিক্ষার সুযোগ ছিল। সমতা ফেরাতে সংরক্ষণ আবশ্যক বৈকি!
২০১৫-২০১৯ সালের মধ্যে ১১টি আইআইটি’র ২৬টি বিভাগ থেকে একজনও তপশিলি উপজাতির ছাত্র গবেষণার সুযোগ পায়নি। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা- দলিত পড়ুয়াদের সাথে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমবেশি বৈষম্যমূলক বিভিন্ন আচরণ করা হয়ে থাকে। সংরক্ষণের জন্য অনগ্রসরদের রোজদিন বিদ্রুপ করা হয়। এদের কখনও ইচ্ছাকৃত পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া হয়, ভয় দেখানো হয়, একাকীত্ব আর হীনমন্যতায় ভুগতে বাধ্য করা হয়।
২০১৪ সালে আইআইটি বোম্বের গবেষণারত ছাত্র অনিকেত অম্ভোরে আত্মহত্যা করে। পরিবারের তরফে অভিযোগ জানানো হয়, ক্যাম্পাসের ভেতর অনিকেতকে তীব্র অপমান ও লাঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে। ২০১৬ সালে হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটির আরেকজন দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলা মৃত্যুর আগে নিজের সুইসাইড নোটে লিখে রেখে যায়, “আমার জন্ম কেবল একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা।” রোহিতের মৃত্যুর পর জাতীয় স্তরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে৷ দিকে দিকে প্রতিবাদ সংগঠিত হতে থাকে। ২০১৯ সালে মাদ্রাজ আইআইটি-তে ইন্টিগ্রেটেড মাস্টার্স কোর্স করতে এসে আত্মহত্যা করে ফাতিমা লতিফ। ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে ইন্টারনাল পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া হয়। ২০১৯ সালেই, ডাক্তারি পড়ুয়া পায়েল তাদভির জাতিবৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আত্মহত্যা করে। সহপাঠীরা তার সঙ্গে অত্যন্ত অবমাননাকর আচরণ করত। কর্তৃপক্ষকে জানানো সত্ত্বেও কোনও পদক্ষেপ তারা নেয়নি। এমনকি, আজও রোহিত, অনিকেত, ফাতিমা, পায়েলের হত্যার কোনও সঠিক তদন্ত হয়নি। সুবিচার পায়নি এদের পরিবার। পায়েল, রোহিত এরা সকলেই ছিল দর্শনের মতো বংশের প্রথম উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থী। সীমিত অর্থ ব্যয় করে অভাবের ঘরে বেড়ে ওঠা ছাত্ররা এত বৈষম্য, কটুকথা, দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে! এদের প্রত্যেকের জীবনের সমস্ত স্বপ্ন কেড়ে নিল তার শ্রেণি। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে বলুন! দলিত কবি নামদেও ধাসাল লিখেছিলেন – “রাত্রির দু’হাতের ভেতর আমার জন্মের মুহূর্ত!” এই কবিতা পড়ে মনে হয় কবি এখানে যেন প্রতিটা দলিত ছাত্রের কথা বলেন, তাঁদের জন্মের প্রতি যে ক্ষোভ, যে আক্ষেপ এই সমাজে দৈনন্দিনের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে তৈরী হয়, তার কথা বলেন!
২০২১ সালে শিক্ষামন্ত্রীর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৬-২০২১ সাল পর্যন্ত, প্রথম সারির সাতটি আইআইটি’তে স্নাতক স্তরে ড্রপ আউট হয়েছে সংরক্ষণের আওতাভুক্ত ৬৩% পড়ুয়া। স্কলারশিপের টাকা অনিয়মিত হওয়ার দরুন আর্থিক অনটনের কারণে বহু দলিত, আদিবাসী, মুসলিম ছাত্র পড়াশোনায় ইতি টেনেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও কেন পড়ুয়ারা দেশের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে? কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এর কোনও সদুত্তর নেই। উপরন্তু তারা এহেন বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। ভারতের তেরঙ্গা পতাকার গায়ে মিথ্যে রাংতা জড়িয়ে, তার সাথে স্রেফ একটা ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর কনসেপ্ট জুড়ে দিতে পারলেই হল!
শচীন কুমার বা দর্শন সোলাঙ্কির ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাদের মৃত্যুর কারণ – গলায় দড়ি দেওয়া, ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়া, নাকি নিয়মিত মানসিক নির্যাতন, সামাজিক চাপ?- এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আশা করি আমাদের কারোর কোনও দ্বিধা থাকবে না। আমরা সবাই জানি, কোনদিকে পাল্লা ভারী! ছাত্ররা আত্মহত্যা করবে আর উদাসীন-অসংবেদনশীল কর্তৃপক্ষ কেবল তাদের জন্য শোকসভার আয়োজন করবে – এমনটা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর ছাত্র সংগঠন আইসা দীর্ঘদিন ধরে সমস্ত ক্যাম্পাসে রোহিত অ্যাক্ট ও এসসি-এসটি সেল চালু করার দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষকে একজোট হয়ে লড়তে হবে। রোহিতের জন্য, ফতিমার জন্য, পায়েলের জন্য, দর্শনের জন্য, শচীনের জন্য, প্রতিটা অন্যায়ের জন্য রাস্তায় নামতে হবে।
২০২০ সালে, লকডাউনের মরশুমে নয়া শিক্ষানীতির খসড়া পেশ করল কেন্দ্রীয় সরকার। গোটা দেশ জুড়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। শিক্ষক, অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ - সকলেই এই শিক্ষানীতিকে বিভাজনের নীতি ব’লে দাগিয়ে দিল। আজ যখন সেই শিক্ষানীতি লাগু হতে যাচ্ছে, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে, এই নয়া শিক্ষানীতিতে ‘সংরক্ষণ’ নিয়ে একটি বাক্যও লেখা নেই৷ অতএব, সংরক্ষণ আগামীদিনে কেবল সংবিধানের বিষয়বস্তু হয়ে থেকে যাবে। নিশ্চুপে নিভৃতে এই অনাচার এখনও মেনে নিলে মোদী-শাহর হিটলারি শাসনে সুদিন আনবে কারা? সাম্যের গান গাইবে কারা? আজ যখন একলব্যের শুধু আঙুল নয়, গোটা শরীরটাকেই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে ফেলা হচ্ছে, তখন একবার ভেবে দেখুন, আপনি নিজে গেরুয়াবাহিনীর ফ্যাসিস্ট শাসনে কতখানি নিরাপদ, আপনার ভবিষ্যৎ কতখানি সুনিশ্চিত?
- ত্রিয়াশা লাহিড়ী