সাঁওতাল সমাজে সাধু রামচাঁদ মুরমুর পরিচিতি “কবিগুরু” বা “মহাকবি” হিসেবে। অনাড়ম্বর নিরহঙ্কার ত্যাগির মতো জীবন যাপনের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে ‘সাধু’ হিসেবে পরিচিত হন রামচাঁদ। জন্ম অধুনা ঝাড়গ্রাম জেলার শিলদার নিকটবর্তী কামারবাঁদি গ্রামে বাংলা ১৩০৪ সালের বৈশাখ মাসের ১৬ তারিখ (ইংরেজি তারিখে ১ মে ১৮৯৭)। পিতা মোহন মুরমু ও মাতা কুনি মুরমু। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রামচাঁদ গ্রামের স্কুল ও মধ্য ইংরাজী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। অভাবের তাড়নায় উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগ না পেলেও তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেন। সুর তাল ছন্দের নিখুঁত বুননে তিনি ফুটিয়ে তুলতে থাকেন সাঁওতাল সমাজের লায় লাকচার এবং সমাজের যত ভাল আর মন্দ। সাধু রামচাঁদ মুরমু কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েই দেখলেন যে সাঁওতালরা বৃহত্তর সমাজে আদিবাসী হিসেবে ঘৃণিত ও অবহেলিত। আর এই অবহেলা অবজ্ঞার ফলে সাঁওতালরা নিজেরাই নিজের ভাষাকে যথেষ্ঠ অবহেলা করে। এমনকি পথে ঘাটে দুই জন সাঁওতাল নিজ ভাষায় কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। রামচাঁদ চাইলেন সাঁওতালদের মধ্যে স্বাভিমান ও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করতে। আবার সমস্ত আদিবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি অখন্ড পরিমন্ডল তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন।
সাঁওতালি ভাষায় বই ছাপানো তখনকার দিনে একটি অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। তাই তিনি গান রচনা করে সেই গানে নিজে সুর দিলেন। তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় গান “দেবোন তিগোন আদিবাসী বীর” - আজ ছোটনাগপুরী ও ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। কবি সারদা প্রসাদ কিস্কু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সাধু রামচাঁদের গানের ঢেউ পুরুলিয়ার পাহাড়ি বনে আছড়ে পড়লে কৈশোরে তিনিও তার দোলায় তরঙ্গায়িত হন। “রামচাঁদ মুরমু আঃ দেবোন তেঁগোন আদিবাসী বীর, অনা তেড়ং হড়কো দুসৗউবোনা সেরেঞ দ নডেন হড়াঃ লুতুররে তারকোগৎ আকানা। সাঁও সাঁওতে উনিয়াঃ সারি ধরম সেরেঞ্ পুঁথিহঁ সেটের এনা।” (সাহিত্য আন্দোড়রে পুরুলিয়ৗ জিলৗ রেন হড় হপন)। রামচাঁদ সারি ধরম পুঁথি রচনা করে ও গ্রামে গ্রামে প্রচার করে আদিবাসী সাঁওতালদের নিজেদের প্রকৃত ধর্মের বিষয়ে সচেতন। তাঁর সাধারণ জীবন যাপন ও সারি ধরম নিয়ে প্রচারের কারণে সাধু নামে অভিহিত হন। তাঁর বহু শিষ্যও জুটে যায়। ১৯২৫-৩০’এর মধ্যে সাঁওতালি ভাষার উপযোগী “মঁজ দাঁদের আঁক” নামে এক বর্ণমালাও তৈরি করলেন। পরবর্তী কালে সেই বর্নমালতেই তাঁর সাহিত্য সম্ভার রচনা করেন। কিন্তু অর্থাভাবে তাঁর এই লিপির ব্লক তৈরী করে প্রচার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। সাহিত্যের প্রায় সমস্ত শাখাতেই তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। তাঁর রচিত ‘সংসার ফেঁদ’ খুব উঁচু মানের নাটক। ‘লিটা গডেত’, ‘সারি ধরম সেরেঞ্ পুঁথি’ ‘ইসরড়’ প্রভৃতি রচনা বাঙলা লিপিতেই ছাপা। এখনও তাঁর রচনার বিশাল অংশ অপ্রকাশিত। উনিশ শতকের প্রথম প্রহরে যখন সাঁওতালি ভাষায় লিখিত সাহিত্য ছিল না বললেই হয় তখন সাধু রামচাঁদ নতুন নতুন কবিতা ও গান লিখে ক্ষয়িষ্ণু সাঁওতাল সমাজকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। নিজেকে কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্য সাধু রামচাঁদের ছিল না, বরং সাঁওতালি ভাষাকে প্রতিষ্ঠাপূর্বক সাঁওতাল জাতিকে সংঘবদ্ধ করার সংকল্পই ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। সাধু রামচাঁদের এই ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজকের দিনের সাঁওতাল কবি ও সাহিত্যিকরা উপলব্ধি করেন। সাধু রামচাঁদকে নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন আধুনিক সাহিত্যিকরা। তবে বস্তুবাদী সাহিত্যিক ও পোন্ডগোডা পত্রিকার সম্পাদক শ্রীযুক্ত গোমস্তা প্রসাদ সরেনের (গত ৭ এপ্রিল ২০২৩ গোমস্তা প্রসাদ সরেন প্রয়াত হয়েছেন, ২০ এপ্রিল সংখ্যার দেশব্রতীতে তাঁর স্মরণে পাপিয়া মাণ্ডির লেখা ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে) লেখা সাধু রামচাঁদ বিষয়ক কবিতাটিতে যর্থাথ মূল্যায়ন দেখা যায়। প্রথম কারাম পূজার প্রবর্তক ধার্মুর সঙ্গে তিনি সাধু রামচাঁদের তুলনা করেছেন। সাধু রামচাঁদ মুরমুও ধার্মুর মতো সকলের বিদ্রুপ সহ্য করেছিলেন।
সাধু রামচাঁদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে ১৯৩৫-৩৬ এর কাছাকাছি। এক কথায় ১৯৩০-৩৯ সাল ছিল সাঁওতাল সমাজের ত্রিবেণী সঙ্গমের যুগ। ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন ও স্বজাতি প্রীতির প্রবল আকর্ষণ, আদর্শবোধ, আদিবাসী মহাসভার দ্বারা আদিবাসীদের প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ আবার সাধু রামচাঁদ, পাউল জুঝৗর সরেন, পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু, মঙ্গল সরেন প্রভৃতির সাহিত্যসৃষ্টির ভূমিকা একত্রিত হয়ে এক ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করে। সাধু রামচাঁদ বুঝতে পেরেছিলেন, ভাষা ও সাহিত্য ছাড়া কোনো জাতির বিকাশ অসম্ভব। সাহিত্যের বিকাশে জাতির বিকাশ। তাই বাড়িঘর আত্মীয় পরিজন ছেড়ে আমরণ সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। সাঁওতালি সাহিত্যের ধারাবাহিকতাকে বুঝতে সাধু রামচাঁদের রচনার মূল্যায়ন প্রয়োজন। ধর্ম ভাবনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ‘সারি ধরম’-এর প্রবক্তা। জীবিতকালে তিনি তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে আর্থিক অনটনের জন্য মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি। তাই দীর্ঘদিন তাঁর পাণ্ডুলিপি অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই নামাঙ্কিত সাধুরামচাঁদ উইহার বাথান (সাধুরামচাঁদ মুরমু স্মৃতি কমিটি) ও মারাংবুরু প্রেসের কর্ণধার ড. সুহৃদকুমার ভৌমিকের যৌথ প্রচেষ্টায় তাঁর পাণ্ডুলিপিগুলি সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়। গ্রন্থগুলি হল - (১) সারি ধরম সেরেঞ পুঁথি (২) অল দহ অনড়হে (৩) লিটা গোডেৎ (৪) সংসার ফেঁদ (৫) ঈশরড়।
কামার বান্দি সাধুরাম চাঁদ মুরমু উইহার বাথান থেকে তাঁর অনেক গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। সেগুলোই পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গ সরকাররের পক্ষ থেকে ‘সাধুরাম চাঁদ মুরমু অনল মালা’ নামে সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর অগণিত পান্ডুলিপি অনেকে প্রকাশের জন্য কবির কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। তারপর সেগুলোর আর হুদিস পাওয়া যায় নি। সাধু রামচাঁদ মুরমু শুধু কবি ছিলেন না। সাধুও না। তিনি ছিলেন দার্শনিক। তিনি ছিলেন গবেষক। তাঁর অনেক সৃষ্টি বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। কবি, সাধু, দার্শনিক, শিল্পী, প্রকৃতি প্রেমিক, সমাজ সেবক, সংস্কারক ও গবেষক সাধু রামচাঁদ মুরমু বাংলা ১৩৬০ বঙ্গাব্দের ১৯ অগ্রহায়ন (ইংরাজি ১৯৫৪) দেহত্যাগ করেন।