এবার বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের আখ্যা পেল ভারতবর্ষ। রাষ্ট্রসংঘের পেশ করা বিশ্ব জনসংখ্যা রিপোর্ট জানাল, চলতি বছরের মাঝামাঝি চিনের ১৪২.৫ কোটি জনসংখ্যাকে ৩০ লক্ষের বেশি ছাপিয়ে ভারত হয়ে উঠবে বিশ্বেরে সবচেয়ে জনবহুল দেশ। সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে জনসংখ্যার বয়সের গড় হার ২৮.২; এদিকে চিনে বয়সের গড় ৩৯ বছর। অর্থাৎ, গড় ভারতীয়রা চিনা জনসংখ্যার বয়সের তুলনায় ১০ বছর কম। ৬৫ শতাংশ ভারতীয়র বয়স এখন গড়ে ৩৫ বছরের কম।
ইতিমধ্যে গোটা জাপান বৃদ্ধতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়েছে। ইতালিতে থমকে যাওয়া জনসংখ্যা আর্থিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট বিপদ ডেকে আনায় সেখানকার সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। পশ্চিমী দেশ বা ইউরোপের শ্রমশক্তি যখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ তখন জনসংখ্যাগত দিক থেকে ভারতে যৌবনের এই নবতরঙ্গ তাদের ঈর্ষান্বিত করছে বৈকি। কিন্তু জনসংখ্যায় তারুণ্যের এই আধিপত্য আশীর্বাদ নাকি বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা নিয়ে নানান মহলে মাথা চাড়া দিয়েছে নতুন এক বিতর্ক।
ভারতে জনসংখ্যা যখন বাড়ছে, তখন দেখা গেল ৬১ বছরের মধ্যে এই প্রথম চিনের জনসংখ্যা কমল ৮৫০,০০০। ভারতেও বিগত কয়েক দশকে জন্মহার কমেছে। ১৯৫০ সালে যেখানে একজন ভারতীয় রমনী গড়ে ৫.৭ সন্তানের জন্ম দিতেন, বর্তমানে তারা জন্ম দিচ্ছেন গড়ে দুটি সন্তানের। শুধু চিন নয়, এশিয়ার অনেক দেশই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভারতের থেকে বেশি সাফল্য পেয়েছে।
কিন্তু বিপুল এই তরুণ শ্রমশক্তি আজ বেকারত্বের শুকনো বারুদের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেশের অর্থনীতির বিকাশের পথে যা সবচেয়ে বড় অন্তরায়। সিএমআইই’র রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মার্চে ভারতের বেকারত্বের হার ছুঁয়েছে ৭.৮ শতাংশে যা এমনকি শহুরে ভারতের বেকারত্বকেও (৮.৫ শতাংশ) ছাপিয়ে গেছে। প্রতিবছর প্রায় ৫০ লক্ষ তরুণ প্রবেশ করে দেশের শ্রমশক্তির বাজারে। ভারতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিও দিনের পর দিন কমছে। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০১০ এর মধ্যে দেশে বার্ষিক বিনিয়োগের গড় হার ছিল ১০.৫ শতাংশ, যা ২০১১ থেকে ২০২১ এ নেমেছে ৫.৭ শতাংশ হারে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ, ভিয়েতনামে জনসংখ্যার গড় হার ভারতের তুলনায় বেশি হলেও বিনিয়োগ টানা ও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে ভারত থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে, জানাচ্ছে সিএমআইই। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, দেশের আর্থিক বৃদ্ধি নির্ভর করে মানবসম্পদের দক্ষতার উপর, আর সে ক্ষেত্রে চিন এগিয়ে রয়েছে অনেকটাই। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এটা একই ভাবে প্রযোজ্য। মূলত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপর নির্ভর করে চিন কৃষিপ্রধান দেশ থেকে রূপান্তরিত হয়েছে উৎপাদন ও পরিষেবা নির্ভর উন্নত অর্থনীতিতে।
ভারতের ক্ষেত্রে গতিপথটা একেবারেই উলটো। এখানে কৃষির উপর নির্ভরতা বাড়ছে। দেশের কর্মরত মানুষের প্রায় ৪৫ শতাংশ কৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্ত। আমাদের দেশে ১৫-২৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা বিপুল — প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লক্ষ। শোভন কাজ, ভদ্রস্থ মজুরি, শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকার যদি দৃষ্টি ফেরায়, তবেই এই নবীন প্রজন্ম সম্পদ হয়ে উঠবে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর “ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ্ ফ্রিডম” বইয়ে লিখেছেন — তরুণ জনসংখ্যার সাফল্য নির্ভর করছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উপর। তবেই, এই তরুণ ভারত আধুনিক অর্থনীতির বিকাশের জন্য অংশ নিতে পারবে।