বিরোধী পক্ষের ওপর মোদী সরকারের উন্মত্ত অভিযান সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল যুদ্ধের মাত্রা অর্জন করেছে। বিরোধীরা আদানি কেলেঙ্কারির তদন্তে এক যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি তুলতে শুরু করলে এবং রাহুল গান্ধী মোদী-আদানি গাঁটছড়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে বিরোধীদের নিশানা বানাতে প্রতিহিংসাপরায়ণ মোদী সরকার ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উঠল। রাহুল গান্ধির বক্তৃতা থেকে সমালোচনামূলক সমস্ত অংশ বাদ দেওয়া হলো, এবং রাহুল গান্ধি লন্ডনে গিয়ে যে মন্তব্য করেননি তার জন্য রাহুল গান্ধিকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি তুলে শাসক দল সংসদের পরবর্তী সমস্ত কার্যকলাপকে বন্ধ করে দিল। ইতিমধ্যে গুজরাট হাইকোর্ট রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে জারি হওয়া ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের মানহানির মামলায় যে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল, গত ২১ ফেব্রুয়ারি তা তুলে নিল এবং ২৩ মার্চ রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে দু-বছর কারাদণ্ডের সাজা দিল। পরদিনই লোকসভার সচিবালয় তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করে দিল।
যে দ্রুততার সঙ্গে গোটা নকশাটায় রূপ দেওয়া হল তাকে একমাত্র সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। যে ধারায় মামলাটা এগিয়েছে তার চক্রান্তমূলক প্রকৃতিও প্রশ্নাতীত। অপরাধমূলক সম্মানহানির মামলাটা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে, কেননা, অভিযোগকারী মোদী পদবিধারী সবারই সম্মানহানি হয়েছে বলে মামলাটা দায়ের করেছেন, যদিও সরাসরি সম্মানে আঘাত লেগেছে এমন ব্যক্তিরাই সাধারণত অপরাধসম মানহানির মামলা দায়ের করে থাকেন। এই মামলাটার প্রহেলিকাময় একটা আখ্যান হল এই যে, অভিযোগকারী নিজেই যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকার আর্জি জানিয়ে ২০২২-এর মার্চ মাসে গুজরাট হাইকোর্ট থেকে মামলায় স্থগিতাদেশ নেন। সেই একই অভিযোগকারী আবার রহস্যজনকভাবে ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে মামলাটা পুনরায় চালু করার আবেদন জানালেন এবং এক মাসের মধ্যেই শুনানি শেষ হয়ে সাজা ঘোষণা হয়ে গেল।
অপরাধসম মানহানির মামলায় সর্বোচ্চ সাজার পরিমাণ হল দু-বছরের কারাদণ্ড এবং সুরাটের আদালত সেই সর্বোচ্চ দু-বছরের সাজাই দিয়েছে। সাজা প্রাপ্তির পর নির্বাচিত প্রতিনিধির সদস্যপদ খারিজ করার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সাজা হল দু-বছরের কারাদণ্ড। রাহুল গান্ধীর সদস্যপদ খারিজের ব্যাপারটা একটা ‘অবিসংবাদী ব্যাপার’ হয়ে উঠলেও সাজা ঘোষণার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে লোকসভার সচিবালয় যে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তাঁর সদস্যপদ খারিজ করল তাতে প্রতিষ্ঠিত কোনো রীতিরই তোয়াক্কা করা হল না। লোকসভার প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক পিডিপি আচার্য জানিয়েছেন, সদস্যপদ খারিজের এই ধরনের সিদ্ধান্তের ঘোষণার বিশেষ অধিকার রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতির, লোকসভার স্পিকারের তা নেই। রাহুল গান্ধীর সাজাপ্রাপ্তির অন্য তাৎপর্যটা হল তিনি আট বছর আর কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। অবশ্য, উচ্চতর কোনো আদালত রাহুল গান্ধীর সাজাপ্রাপ্তিতে স্থগিতাদেশ দিলে বর্তমান লোকসভা থেকে রাহুল গান্ধীর সদস্যপদ খারিজ হওয়া বা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর অনধিকার বাতিল হয়ে যেতে পারে। আইনি প্রতিকার চেয়ে আবেদনের জন্য সুরাটের আদালত রাহুল গান্ধীকে ৩০ দিনের যে সময়সীমা মঞ্জুর করেছে সবার দৃষ্টি এখন সেই দিকেই নিবদ্ধ হবে; তবে, এক্ষেত্রে সংশয়হীনভাবেই যা ধরা পড়ছে তা হল বিজেপির এই আইনের নিজেদের পছন্দমতো ব্যবহার — তাদের নিজেদের নেতাদের সাজাপ্রাপ্তি হলে এই আইন ব্যবহার হচ্ছে সুরাক্ষাদায়ী ধারায়, আর বিরোধীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে প্রতিহিংসার চরিতার্থতায়।
উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট এবং কর্নাটকের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যে সাজাপ্রাপ্ত বিধায়ক ও মন্ত্রীরা সাজাপ্রাপ্তির পরবর্তী পর্যায়ের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে উচ্চতর আদালতের কাছ থেকে দণ্ডের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সরকারি পদ ধরে রেখেছেন। গুজরাটে মোদী মন্ত্রীসভার জলসম্পদ মন্ত্রী বাবু বোখিরিয়া অবৈধ খননকার্য চালানোর অভিযোগে ২০১৩ সালে তিন বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হলেও ঐ পদে অবস্থান করতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি সাজাপ্রাপ্তিতে স্থগিতাদেশ লাভ করেন এবং শেষমেষ অপরাধ থেকে বেকসুর খালাস পান। এর বিপরীতে লাক্ষাদ্বীপের সাংসদ মহম্মদ ফইজল খুনের চেষ্টার অভিযোগে ২০২৩-এর জানুয়ারিতে সাজাপ্রাপ্ত হলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তাঁর সদস্যপদ খারিজ করা হয়। কেরল হাইকোর্ট অবিলম্বে সাজার ঐ নির্দেশে স্থগিতাদেশ জারি করে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঐ কেন্দ্রের উপনির্বাচন অনুষ্ঠান স্থগিতে নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করলেও লোকসভা সচিবালয় তাঁর সদস্যপদ ফিরিয়ে দিতে প্রথমে অস্বীকার করে এবং অনেক পরে ২৯ মার্চ তাঁকে সাংসদ পদে পুনর্বহাল করে।
রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ হওয়াটাকে বিজেপি আইনের নিজের পথে চলাবলে চালাতে চাইলেও তা প্রশ্নাতীতভাবেই সত্যের অপলাপ। এই সাজাকে ওবিসি অস্মিতার প্রতিপাদন বলে জাহির করার বিজেপির আখ্যানও একই ধরনের ছলনাময়। পলাতক ব্যবসায়ী নীরব মোদী ও ললিত মোদীদের ওবিসির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। যে দলটা সংরক্ষণ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটাতে ও তার সংকোচনে সার্বিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের এবং জাতি ভিত্তিক গণনার বিরোধিতা করে এসসি/ এসটি/ওবিসিদের সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে চলেছে, এবং হরবকত বিরোধী পক্ষের ওবিসি নেতাদের অবমাননা ঘটাচ্ছে, তারাই এখন কংগ্রেস ও সমস্ত বিরোধী পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার নিগ্ৰহে ওবিসি-দরদের সংকেত দিতে চাইছে।
ফন্দি এঁটে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ করাটা আসলে হলো মোদী সরকারের পক্ষে বিপুলাকায় আদানি কেলেঙ্কারি থেকে ওঠা প্রশ্নগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার এবং ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে বিরোধী পক্ষ ও জনগণের কন্ঠকে স্তব্ধ করার এক মরিয়া প্রয়াস। এই অভিসন্ধি যাতে মোদী সরকারকেই পাল্টা ধাক্কা দিতে পারে সেটাই আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে। এটা ইতিমধ্যেই বাস্তব ক্ষেত্রে বিস্তৃত স্তরে বিরোধী ঐক্যের সক্রিয় হওয়া এবং জনগণের মধ্যে বৃহত্তর সচেতনতা জেগে ওঠার সংকেত দিয়েছে। আদানি কেলেঙ্কারিকে শুধু এক বিপুলাকায় কর্পোরেট জালিয়াতি হিসাবে দেখলেই হবে না, এটা সর্বাগ্রে হল মোদী-আদানি গাঁটছড়ার মধ্যে দিয়ে কর্পোরেট ক্ষেত্রের ভারতীয় গণতন্ত্র ও অর্থনীতিকে হাতিয়ে নেওয়ার একটা বাস্তব ঘটনা, যে গাঁটছড়া তৈরি হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও সম্পদের এক হাতে জমাট বাঁধার ঘনিষ্ঠ অংশীদারির মধ্যে দিয়ে। আদানি কেলেঙ্কারিকে আমাদের বেসরকারিকরণ ও কর্মসংস্থান নষ্ট হওয়ার আজকের দিনের জরুরি ইস্যুগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এবং করপোরেট লুট ও গণ বঞ্চনার বাস্তবতাকে তুলে ধরে বিজেপির জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়নের মেকি ভাষ্যের উন্মোচন ঘটাতে হবে। জনগণের গণতান্ত্রিক অভীপ্সার কাছে স্বৈরাচারীর হামলাবাজির ছকের নত হওয়াকে অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ মার্চ ২০২৩)