(প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জ্যাঁ দ্রেজ ১৩ এপ্রিলের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন "সংকটগ্রস্ত মজুরি" শিরোনামে। আমরা লেখাটির গুরুত্ব বুঝে তার ভাষান্তর এখানে প্রকাশ করলাম। - সম্পাদকমন্ডলী, দেশব্রতী)
প্রকৃত মজুরির বৃদ্ধিই হল ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচক। কিন্তু এই সূচকটাই আমাদের দেশে দারুণভাবে অবহেলিত। উদাহরণ স্বরূপ, সর্বশেষ প্রকাশিত ২০০ পাতার আর্থিক সমীক্ষার স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাপেন্ডিক্স -এ মজুরি নামক শব্দটাই উধাও। এমনকি, অর্থমন্ত্রীর শেষ বাজেট বক্তৃতায়, বা তার আগের বছরের বাজেট ভাষণেও মজুরি শব্দটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জনপরিসরে আর্থিক নীতি সংক্রান্ত বিতর্কগুলিতে প্রকৃত মজুরি কোন গুরুত্বই বহন করেনা। তার বদলে চলে “বেকারত্ব” সম্পর্কে অন্তহীন অবান্তর পরিসংখ্যান নিয়ে তুলনামূলক ভাবগম্ভীর আলোচনা।
বেকারত্বের শুকনো পরিসংখ্যান নিয়ে আমাদের দেশের গরিব মানুষদের কোন মাথাব্যথাই নেই। ভারতে হাতে গোনা গরিব মানুষেরা বেকার, কারণ বেকার হয়ে বসে থাকাটা তাদের সইবে না। কোনো শোভন কাজ না পেলে বেঁচে বর্তে থাকার জন্য হয় তাঁরা ডিম বেচবেন, নতুবা রিক্সা টানবেন। আর, পরিবার ভিত্তিক সার্ভের সময় এদের বেকার হিসাবে গণ্য করা হয়না। বেকারের বদলে এরা হলেন ছদ্ম বেকার বা প্রকৃত অর্থে কর্মরত নন। কিন্তু, এই ছদ্ম বেকারত্ব আমাদের দেশের সমীক্ষায় স্থান পায়না। বা, প্রকৃত অর্থে এটার পরিমাপ করা ভারি মুশকিল।
অন্যদিক থেকে দেখলে এটা বলতে হয় যে, প্রকৃত মজুরি কিন্তু অনেক তথ্য সরবরাহ করে থাকে। প্রকৃত মজুরি বাড়লে শ্রমিকরা বেশি আয় করবে, জীবনধারণের মানও কিছুটা উন্নত হবে। ধারাবাহিকভাবে প্রকৃত মজুরি বাড়াটা ভালো লক্ষণ, তাতে বোঝা যায় আর্থিক বৃদ্ধি উন্নত মানের কাজ তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু, অন্য দিকে, প্রকৃত মজুরি থমকে থাকলে দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্য ধাক্কা খাবে।
অন্তত বেশ কয়েকটি পেশার ক্ষেত্রে প্রকৃত মজুরির বাড়া-কমাটা নজরে পড়ে। কৃষি শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই ধরা যাক। ভারতের বেশিরভাগ গ্রামে যে কোন সময়ে ক্যাজুয়াল কৃষি শ্রমিকদের মজুরি কত তা বেশ ভালভাবেই জানা বোঝা যায়। এর জন্য ঘরে ঘরে গিয়ে সমীক্ষা করার কোন প্রয়োজন পড়ে না। গ্রাম স্তরে একটু খোঁজ খবর নিলেই তা জানা যায়। মাঝে মধ্যে, কিছুটা নিয়মিত ব্যবধানে বেশ কয়েকটি এলাকায় আমরা যদি এই সমীক্ষা চালাই, তবে মজুরির হার সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ছবি আমাদের সামনে ফুটে উঠবে। মূল্য সূচকের সাপেক্ষে প্রকৃত মজুরির হিসাব করাটা আদৌ কঠিন কাজ নয়।
শ্রম ব্যুরো বহু বছর ধরে এই কাজটাই করে আসছিল। পেশাভিত্তিক মজুরির পরিসংখ্যান প্রতি মাসে সারা ভারতের সমস্ত রাজ্য থেকে সংগ্রহ করার পর ব্যুরো সেই পরিসংখ্যানের সারাংশ প্রকাশ করে ইন্ডিয়ান লেবার জার্নালে। ওই সমস্ত তথ্যের গুণমান কিছুটা অনিশ্চিত হলেও প্রকৃত মজুরির প্রবণতাকে বোঝার ক্ষেত্রে তা ছিল যথেষ্ট।
এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এই কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছে। তার সর্বশেষ প্রকাশিত “হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিসটিক্স অন ইন্ডিয়ান স্টেটস্”-এ আরবিআই ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ এর বার্ষিক মজুরির এক ছবি দিয়েছে, যা লেবার ব্যুরোর পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তিশীল। মজার ব্যাপার হল, এই তথ্য পরিসংখ্যানে কেবল পুরুষ শ্রমিকদেরই ধরা হয়েছে। এর আওতায় এসেছে চারটি পেশাগত গ্রুপ : সাধারণ কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, অ-কৃষি কাজের সাথে যুক্ত মজুর, এবং বাগিচা শ্রমিক। এখানে শেষোক্ত গ্রুপটিকে ধরা হয়নি, কারণ, কেবলমাত্র কয়েকটা রাজ্য থেকেই বাগিচা শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত তথ্য এসেছে।
প্রকৃত মজুরির হিসাবটা সহজেই বার করা যায়। কৃষি মজুরদের ভোগ্য পণ্য সূচক (কনসিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স ফর এগ্রিকালচারাল লেবারারস) এর সাপেক্ষে তারা যে মজুরি পাচ্ছেন, তাকে রূপান্তরিত করলেই প্রকৃত মজুরির হিসাবটা পাওয়া যায়। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ এর মধ্যে সমস্ত ধরনের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম; কৃষি মজুর, নির্মাণ শ্রমিক এবং অকৃষি মজুরদের ক্ষেত্রে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে যথাক্রমে ০.৯ শতাংশ, ০.২ শতাংশ ও ০.৩ শতাংশ হারে। আমরা যদি ভোগ্যপণ্য সূচকের সাপেক্ষে এই বৃদ্ধি পরিমাপ করি, তবে দেখব বৃদ্ধির হার অনেক কম, আর নির্মাণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা ঋণাত্বক হয়ে দাঁড়িয়েছে!
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০২১-২২ এ এসে থেমে গেছে। কিন্তু, সাম্প্রতিকতম আর্থিক সমীক্ষার দিকে চোখ বোলালে দেখা যাবে, মজুরির এই থমকে থাকা হাল বজায় রয়েছে ২০২২ এর শেষ পর্যন্ত। এখান থেকে সহজেই এই উপসংহার টানা যায় : গত আট বছর ধরে সর্বভারতীয় স্তরে প্রকৃত মজুরির কোনও বৃদ্ধি হয়নি। এর আগে শম্ভু ঘটক এই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।
রাজ্যওয়াড়ি ক্ষেত্রে এই একই চিত্র পাওয়া যায়। কৃষি মজুরদের প্রকৃত মজুরির কথাই ধরা যাক। এই পেশাগত গ্রুপটির প্রকৃত মজুরির বার্ষিক বৃদ্ধির হার দুটো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ২ শতাংশের সামান্য উপরে — কর্ণাটকে ২.৪ শতাংশ, এবং অন্ধ্র প্রদেশে ২.৭ শতাংশ। কিন্তু আরও পাঁচটা রাজ্যে ( হরিয়ানা, কেরল, পাঞ্জাব, রাজস্থান, ও তামিল নাড়ুতে) ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২-এ প্রকৃত মজুরি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে।
এখান থেকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা উঠে আসে। প্রথমত, প্রকৃত মজুরির দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। মজুরি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে আরও প্রসারিত ও উন্নত করতে হবে। ভারতীয় অর্থনীতির দ্রুততালে বৃদ্ধির বিরোধাভাসে প্রকৃত মজুরির খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার এই নিদারুণ ও উদ্বেগজনক অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।
সবশেষে বলতে হয়, এই বৈপরিত্য দাবি জানাচ্ছে, আর্থিক নীতির আমূল বদল আর মজুরি বৃদ্ধির উপরই প্রধান জোর দিতে হবে। পরবর্তী বাজেট ভাষণে কর্মসংস্থান ও মজুরি সম্পর্কে যদি দু-চার কথা থাকে, তবে বলা যাবে নতুন এক ইতিবাচক পর্বের সূচনা হতে যাচ্ছে।
ভাষান্তর অতনু চক্রবর্তী