কেন্দ্রীয় কমিটি বৈঠকের সার্কুলার
central-committee-meeting

সদ্য সমাপ্ত একাদশতম পার্টি কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ২৬ ও ২৭ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। কমরেড স্বদেশ ভট্টাচার্য, ধীরেন্দ্র ঝা, চন্দ্রমোহন, গীতা মণ্ডল এবং সুচেতা দে-র সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের সভাপতিমন্ডলী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সভা শুরুতেই সেই কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে যাঁদের আমরা একাদশতম পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে গত এক মাসে হারিয়েছি। আরারিয়ার রাধা দেবী এবং পূর্ণিয়ার রসিকলাল মুর্মু সহ যারা ১৫ ফেব্রুয়ারি পাটনার সমাবেশে যোগদানের পরে ফেরার সময় দুর্ঘটনায় মারা যান, কর্ণাটকের দুই স্যানিটেশন কর্মী সারিয়াপ্পা এবং মাইলাপ্পা যারা নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করে মারা যান, প্রখ্যাত হিন্দি কবি, অনুবাদক এবং সম্পাদক সুরেশ সলিল, প্রখ্যাত সাংবাদিক হরিশ চন্দোলা, আইসি কুমার, বিহারের প্রাক্তন আমলা এবং প্রাক্তন মুখ্য সচিব আইসি কুমার, পশ্চিম চম্পারণে জোখান মিয়াঁ এবং হকিক মিয়া, কুর্থার কৃষ্ণ মাঝি এবং বেয়াল বিন্দ উপেন্দ্র মির্ধা, যিনি বিহারে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, দীপচাঁদ সাহ, মুজাফফরপুর, দারভাঙ্গার তেতারি দেবী (অনিতা দেবী), যিনি ১০ ফেব্রুয়ারি হেফাজতে পুলিশের মারধরে নিহত হন, ডাঃ ওমপ্রকাশ গুপ্ত, গোপালগঞ্জ, ঘনশ্যাম মাঝি এবং ফুলওয়ারি শরীফের কাল্লু মাঞ্জি, মুন্না সিং, পুনপুনের মুখল পাসওয়ান, লালন পাসওয়ান এবং রামপ্রারুয়ার সুদামা পাসওয়ান, বিক্রম, মাহাউদ্দিন আনসারি, শ্রীরাম রাম, শিব কুমারী দেবী, বিজয় সিং, ধর্মেন্দ্র রাম এবং ভোজপুর জেলার আমির চাঁদ, পার্বতী জঙ্গী, বিন্দুখট্ট, উত্তরাখণ্ড এবং বিজেপি শাসিত আসামে সাম্প্রতিক ভুয়ো এনকাউন্টারের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা।

কেন্দ্রীয় কমিটির আলোচনা এবং সিদ্ধান্তগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে দেওয়া হল — রাহুল গান্ধীর অপসারণ: রাহুল গান্ধীকে তার লোকসভার সদস্যপদ এবং আট বছরের জন্য কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে অযোগ্য ঘোষণা বিরোধী শক্তি এবং ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর ওপর একটি মরিয়া সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। আদানি কেলেঙ্কারি এবং আদানি-মোদি সম্পর্ক – যা আদানিকে এত বড় কর্পোরেট জালিয়াতি করতে এবং ভারতের পরিকাঠামোগুলোর উপর প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে সক্ষম করেছিল — তা নিয়ে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্তের জন্য বিরোধীদের জোরালো দাবির কারণেই এই আক্রমণ। এই পরিঘটনাটি বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে গণ-ক্ষোভ তীব্র করা এবং বিরোধী দলগুলির মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য ও সমন্বয় তৈরি করার ক্ষেত্রে একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। এই দিকে ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।

পাঞ্জাবের পরিস্থিতি : সিসি পাঞ্জাবের চলমান পরিস্থিতি বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যেখানে অমৃতপাল সিংকে গ্রেপ্তার করার নামে, কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্র এবং রাজ্যের নাগরিকদের স্বাধীনতা খর্ব করছে। একজন জঙ্গি শিখ প্রচারক এবং খালিস্তান দাবির চ্যাম্পিয়ন হিসেবে অমৃতপাল সিংয়ের রহস্যময় উত্থান এবং রূপান্তরের গোটা পরিঘটনাটি পাঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলনকে অসম্মানিত ও বিপথগামী করা এবং রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশকে বিষিয়ে দেওয়ার একটি রাজনৈতিক নকশা বলেই মনে হয়। পাঞ্জাবের পরিস্থিতি অপারেশন ব্লুস্টার পরবর্তী দিনগুলির অস্থিরতা এবং সহিংসতার দীর্ঘ সময়ের দিকে ফিরে যেন না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। পাঞ্জাবের আর্থ-সামাজিক অবস্থা একটি দীর্ঘস্থায়ী কৃষি সংকট, বেকারত্ব এবং যুবকদের সুযোগ সুবিধার নানা অভাবের কারণে এমনিতেই বেশ খারাপ। কংগ্রেস এবং আকালিদের আধিপত্যের বিকল্প সন্ধানের জায়গা থেকেই আপ এর উত্থান হয়েছিল, তবে ভগবন্ত সিং মান সরকারের প্রতি মোহভঙ্গের নানা লক্ষণ ইতিমধ্যেই সামনে আসতে শুরু করেছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও সামাজিক বিভাজন বাড়ানো এবং রাজ্যে সংঘ-বিজেপি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য আরএসএস এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। এই বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। গ্রামীণ শ্রমিকদের আন্দোলন এবং কৃষকদের কর্পোরেট বিরোধী দাবির মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক এজেন্ডা বিকশিত হয়েছে তা আমাদের সাহসের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং পাঞ্জাবকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রতিরোধের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

ত্রিপুরা নির্বাচন এবং তার পরে : বিজেপি ত্রিপুরাতে তার ভোট শেয়ার এবং আসন সংখ্যার উল্লেখযোগ্য পতন সত্ত্বেও ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাম-কংগ্রেস জোট এবং টিপরা মোথার মধ্যে ভোটের বিভাজন বিজেপিকে ক্ষমতায় ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল। আমরা মাত্র একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি এবং আমাদের ভোটে উৎসাহজনক বৃদ্ধি হয়েছে। যদিও নির্বাচন অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তীকালে পরিস্থিতি বদলেছে এবং বিরোধীদের ওপর হিংসাত্মক আক্রমণ হয়েছে। তৃণমূল স্তরে সংগ্রামী বিরোধী শক্তি হিসেবে আমাদের ভূমিকা ও উদ্যোগ অব্যাহত রেখে পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করার দিকে আমাদের আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার।

কর্ণাটক নির্বাচন : আমাদের কাজের প্রধান ক্ষেত্রগুলিতে আমাদের কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত। অন্যান্য বাম শক্তির সাথে নির্বাচনী বোঝাপড়ার সম্ভাবনাগুলি খুঁজে দেখা দরকার। বিজেপিকে পরাজিত করার জন্য একটি জোরালো প্রচার অভিযান আমাদের চালাতে হবে।

পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস : এই ২২ এপ্রিল আমরা পার্টি প্রতিষ্ঠার ৫৪তম বার্ষিকী পালন করব। এই দিনে আমাদের প্রতিটি পার্টিশাখায় দলীয় পতাকা উত্তোলন করে শাখা বৈঠক করতে হবে। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্য, জেলা এবং এলাকা/ব্লক কমিটিগুলিকে নিতে হবে। প্রতিটি রাজ্য কমিটিকে শাখা বৈঠকের রিপোর্ট, বৈঠকে উপস্থিতির হিসাব সংগ্রহ করতে হবে এবং কেন্দ্রীয় কমিটিকে তার একটি সারসংক্ষেপ পাঠাতে হবে। জেলা/ব্লক কমিটির সদস্যদের শাখার বৈঠকগুলি সফল করার চেষ্টা চালাতে হবে এবং কয়েকটি শাখা বৈঠকে উপস্থিত হতে হবে। একাদশ কংগ্রেসের রিপোর্টটি সমস্ত ভাষায় একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রচার করা দরকার। একাদশতম পার্টি কংগ্রেস এবং তার পরে — একাদশতম কংগ্রেসের সফল সমাপ্তি পার্টি জুড়ে অনেক আশা এবং উদ্দীপনা তৈরি করেছে৷ আমাদের এখন একে পার্টি সংগঠন শক্তিশালী করা, কমিটি পদ্ধতির কার্যকারিতার মান বাড়ানো, পার্টি কাজের শৈলী উন্নত করা এবং সমগ্র পার্টির মতাদর্শগত-রাজনৈতিক স্তরকে বিকশিত করার দিকে চালিত করতে হবে। পার্টি কংগ্রেসের বার্তা ও উপলব্ধিকে প্রতিটি শাখায় নিয়ে যেতে হবে। পার্টি মুখপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং পর্যালোচনাগুলি ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করা দরকার। কংগ্রেসে গৃহীত পার্টির দলিলগুলি শীঘ্রই চূড়ান্ত করা হবে এবং তারপর পার্টিজুড়ে এগুলি অধ্যয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। পার্টি কংগ্রেসের সাফল্যের চাবিকাঠি হল বিহারে পার্টির সহজাত শক্তি এবং আজকের সংকটময় সময়ে আমাদের পার্টি লাইনের প্রাণশক্তি। পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে এবং পার্টির ভূমিকা বাড়াতে আমাদের অনুশীলনের বিভিন্ন দিকগুলির দ্বান্দ্বিক সমন্বয়ের বিষয়টি পুরো পার্টিকে উপলব্ধি করতে হবে। সেগুলি হল —

  • ১) পার্টির নিজস্ব ভূমিকার পাশাপাশি গণসংগ্রাম ও নির্বাচনী হস্তক্ষেপ — উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক সম্ভাব্য ঐক্যের চেষ্টা করা,
    ২) তৃণমূল স্তরে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করা, সাহসী রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া এবং বিপ্লবী সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি,
    ৩) শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের বুনিয়াদী বিষয়ে দৃঢ় থেকেই বিভিন্ন পরিচিতি সত্তা ও সামাজিক/ সাংস্কৃতিক বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন,
    ৪) মূল শক্তির জায়গাগুলোতে ব্যাপক ও গভীর গণকাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে ও নতুন নতুন অঞ্চলে পার্টি প্রসার ও প্রভাব বৃদ্ধির দিকে নজর রাখা,
    ৫) আন্দোলন, প্রচার, শিক্ষা এবং সংগঠনকে একটি সমন্বিত এবং আন্তঃসম্পর্কিত বিষয় হিসেবে দেখা,
    ৬) যৌথ পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান এবং ব্যক্তির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা,
    ৭) সংগঠনের বিস্তারের পাশাপাশি মতাদর্শগত-রাজনৈতিকভাবে একীকরণ।

পার্টি পলিটব্যুরো: কেন্দ্রীয় কমিটি একটি ১৭ সদস্যের পলিটব্যুরো নির্বাচন করেছে। এর সদস্যরা হলেন - কমরেড স্বদেশ ভট্টাচার্য, কুনাল, ধীরেন্দ্র ঝা, অমর, রাজারাম সিং, মীনা তেওয়ারি, শশী যাদব, মনোজ ভক্ত, জনার্দন, বিনোদ সিং, কার্তিক পাল, অভিজিৎ মজুমদার, ভি শঙ্কর, রামজি রাই, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সঞ্জয় শর্মা, রবি রাই।

পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত দলিল এপ্রিলের শেষে প্রকাশ করা হবে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-9