“হিন্দুরাজ কায়েম হলে তা নিঃসন্দেহেই দেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হবে। স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতির পক্ষে তা বিপজ্জনক। গণতন্ত্রের সাথে বেমানান। যে কোনও মূল্যে হিন্দুরাজকে প্রতিহত করতে হবে।”
১৯৪৬ সালে ‘পাকিস্তান অর পার্টিসন অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে এই জরুরি সতর্কবার্তাটি ঘোষণা করেছিলেন বাবাসাহেব ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর। তাঁর জন্ম ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল, প্রয়াত হয়েছেন ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচয়িতা হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। মহারাষ্ট্রের ‘অচ্ছুৎ’ পরিবারে জন্ম নিয়ে আমৃত্যু ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করেছেন। বুদ্ধ-কবীর-ফুলে ত্রয়ীকে নিজের শিক্ষক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি ছিলেন সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, আইন ও রাজনীতির শ্রেষ্ঠ ও অগ্রণী তাত্ত্বিক ও গণ আন্দোলনের নেতা, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত নির্মাণের আলোকবর্তিকা। যত দিন পেরিয়েছে ততই আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে তাঁর জীবন ও শিক্ষা। আমরা তাঁকে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই।
বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়ে সংবিধানসভায় গেছিলেন। সংবিধানসভায় তিনি যাতে কোনওভাবেই যেতে না পারেন তার জন্য ক্ষমতাশীলরা অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেই সময়, বাংলার হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের নমশুদ্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের উদ্যোগে তিনি বাংলা থেকে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনিই সংবিধান রচনায় নেতৃত্ব দেন। সংবিধান রচনায় সমাজের প্রান্ত থেকে উঠে আসা আরেক সোচ্চার প্রতিনিধি জয়পাল সিং মুণ্ডার নাম এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি আমরা।
বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর অনেকটা মিশরের গ্রেট পিরামিডের মতো। ভারতের সমাজ ও রাজনীতির সুগভীর বাস্তব সত্যগুলি বুকে ধারণ করে সকলের চোখের সামনে সবার ঊর্ধ্বে সমুজ্জ্বল খাড়া হয়ে আছেন অথচ তাঁকে যেন কেউ দেখতেই পাচ্ছিল না। যাদের বিরুদ্ধে, যে সমাজের বিরুদ্ধে, লড়তে লড়তে অনির্বান দীপশিখা হয়ে উঠেছেন তিনি, সেই হিন্দুত্ববাদীরা তাঁকে দুমড়ে মুচড়ে বিকৃত করে আত্মসাৎ করতে চেয়েছে। আরএসএস-বিজেপি তাঁকে এমনকি “আধুনিক মনু” বলে তুলে ধরেছে। বাস্তবে, মাহাড় সত্যাগ্রহ চালানোর সময় ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মনুস্মৃতি পোড়ানোর কর্মসূচি সংগঠিত করেছিলেন আম্বেদকর। এখনও এই মনুস্মৃতি দহন দিবস পালিত হয়। তিনি বলেছিলেন,
“মনুস্মৃতি দহন সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করা হয়েছিল। আমরা তা করেছিলাম কারণ আমরা ওটাকে অন্যায় অবিচারের প্রতীক বলে মনে করি যার অধীনে আমরা শত শত বছর ধরে নিপীড়িত হয়ে আসছি।”
তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “কাস্ট ইজ অ্যান্টিন্যাশনাল” কারণ তা এক জাতের সাথে অন্য জাতের হিংসা, দ্বেষ ও বৈরিতা তৈরি করে সমাজকে ভেতর থেকে টুকরো করে দেয়। তাঁর মতে, “হিন্দুনেশন” তাই এক অবাস্তব ধারণা।
জাতের বিনাশ তাঁর কাছে ভারতের ব্যাপক দলিত সাধারণ ও নারী সমাজের মুক্তির প্রাথমিক অপরিহার্য শর্ত। তাঁর অজস্র লেখায় হিন্দুত্ব/হিন্দুইজমকে তিনি আক্রমণ করেছেন মূলত নারীবাদী অবস্থান থেকে। একদিকে তিনি দেখাচ্ছেন, জাতব্যবস্থা নিছক শ্রমবিভাজন নয়, তা শ্রমিকেরও বিভাজন। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজের নির্দিষ্ট বাস্তবতায় শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্য অর্জন করতে হলে জাতব্যবস্থার মাধ্যমে চলা নিপীড়ণ ও বৈষম্যকে সবার আগে উপলব্ধি করতে হবে। এই অনুভবের মাধ্যমেই শ্রমিক শ্রেণী গতিময় সামাজিক সমাবেশ ঘটিয়ে জাতের বেড়াজাল ছিঁড়ে ফেলতে পারে। অন্যদিকে তিনি দেখছেন, নারীকে পরাধীন না রেখে, নারীর যৌন স্বায়ত্ততাকে হিংস্রভাবে দমন না করে এবং সেই দমনের মতাদর্শ সমাজে চালু না রেখে জাতব্যবস্থা গড়ে তোলা ও টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই জাতের বিনাশের আরেক শর্ত হল নারীর নির্ভয় স্বাধীনতা।
বিবাহ ব্যবস্থাকে নারীর জন্য এক বন্ধনস্বরূপ হিসেবে বুঝতে ও বলতে তাঁর বাধেনি। সেই সময় দাঁড়িয়ে গর্ভনিরোধক চালু করার কথা বলেছেন, মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটিকে মান্যতা দিতে তীব্র ধৈর্যশীল তর্ক চালিয়েছেন, ভালোবাসার সম্মতির বয়সের প্রশ্নে মেয়েদের অধিকারের স্বপক্ষে লড়েছেন। হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার আইনসিদ্ধ করার জন্য তিনি ‘হিন্দুকোড বিল’ প্রণয়ন করতে চাইলে সংসদের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন। এবং শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। আম্বেদকর বড় বড় সমাবেশ করেছেন শুধু মহিলাদের নিয়ে যা ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে অনন্য। এরকম এক সমাবেশে আম্বেদকর বলেছিলেন,
“আপনাদের সামনে বলার সুযোগ পাওয়ায় আমি খুশি। দলিত বর্গের অগ্রগতিতে আগ্রহী ব্যক্তির কাছে মহিলাদের এমন একটি সমাবেশ প্রত্যক্ষ করার থেকে সুখকর আর কিছু হতে পারেনা। আপনারা যে এমন বৃহৎ সংখ্যায় সমবেত হয়েছেন — প্রায় বিশ পঁচিশ হাজার — তা দশ বছর আগে ভাবা অসম্ভব ছিল। আমি নারী সংগঠনে গভীর আস্থাশীল। তাঁরা চাইলে সমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে যে কত কিছু করতে পারেন তা আমি জানি... যখন থেকে আমি দলিত বর্গের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছি তখন থেকেই পুরুষের সাথে নারীদেরকে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। সেই কারণেই আমাদের সম্মেলনগুলিকে সর্বদাই মিশ্র সম্মেলন হিসেবে দেখতে পাবেন।... কোন সমাজে মেয়েদের কতটা অগ্রগতি ঘটেছে তা দিয়ে আমি সেই সমাজের অগ্রগতি পরিমাপ করি।... আপনার সন্তানদের পড়াশুনা করান।... তাদের মনে এই বিশ্বাস জাগান যে জীবনে মহৎ কার্যকরাই তাদের ভবিতব্য। তাদের মন থেকে সমস্ত হীনমন্যতা উপড়ে ফেলুন। বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না, বিয়ে একটি দায়।... সর্বোপরি প্রত্যেকটি বিবাহিত মেয়েকে তাঁর স্বামীর সামনে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে স্বামীর বন্ধু ও সমকক্ষ হিসেবে দাবি করতে এবং দাসী হতে অস্বীকার করতে সহযোগিতা করুন।”
স্ত্রী, ভ্রাতা, ভ্রাতৃবধুসহ পারিবারিক গ্রুপ ফটো। ‘পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল’ -নিছক ভাষণে নয়, যাপনেও। এমনকি বাড়ির পোষা কুকুরের বসার জায়গা থেকেও পরিবারে সম্পর্কের কাঠামোতে তাঁর অবস্থান বোঝা যায়।
“সমাজতন্ত্রীরা যদি সমাজতন্ত্রকে একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবে পরিণত করতে চান, তবে তাঁদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে সমাজ সংস্কারের সমস্যাটি মৌলিক এবং একে এড়িয়ে গিয়ে পরিত্রাণ পাবেন না”
‘জাতের বিনাশ’ নিবন্ধে ওপরের কথাগুলি বলেছিলেন আম্বেদকর। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একশ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার পর বর্তমান ফ্যাসিবাদী বাস্তবতায় এই কথাগুলির মূল্য আমরা আরও বেশি অনুভব করতে পারছি। মতাদর্শগত স্তরে আম্বেদকর তাঁর সমগ্র লেখাপত্রে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার সাথে নিরন্তর কথোপকথনে ছিলেন। কার্ল মার্ক্স তাঁর ১৮৫৩ সালের ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধে জাতবর্ণ ব্যবস্থাকে “ভারতের অগ্রগতি ও ক্ষমতায়নের সবচেয়ে নির্ধারক প্রতিবন্ধক” হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। অন্যদিকে, আম্বেদকর কখনই এই ধারণাকে খারিজ করেননি যে ‘জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’। শ্রেণীকে সামাজিক ধর্মীয় দিকগুলি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘অর্থনৈতিক’ ক্যাটেগরি হিসাবে দেখার সংকীর্ণ ধারণাকে খারিজ করেছিলেন তিনি। জাতকে তিনি শ্রেণী হিসেবে বিবেচনা করে “জাত হল এক আবদ্ধ শ্রেণী” বলে বর্ণনা করেছেন।
১৯৩৬ সালে আম্বেদকরের প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিপেণ্ডেন্ট লেবার পার্টি’(আইএলপি)-র ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী ও পুঁজিবাদী সামাজিক কাঠামোকে আমূল বদলে দেওয়া’। বিপুল ভোটে জিতে ১৪ জন বিধায়কসহ বম্বে প্রদেশের বিধানসভায় ঢুকে আম্বেদকর প্রথমেই কোঙ্কন অঞ্চলে জমিদারী প্রথা বিলোপ করার আইন প্রস্তাব করেন। কোঙ্কন অঞ্চল থেকে বিশাল সংখ্যক কৃষককে সমাবেশিত করা হয় বম্বেতে। ২০,০০০-এর ওপর কৃষকের বম্বে শহর অভিমুখে এই যাত্রাকে অনেকেই স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় কৃষক সমাবেশ বলে বর্ণনা করেছেন। শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নিতে বিধানসভায় ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপ্যুট বিল’ আনা হলে তার বিরুদ্ধে কম্যুনিস্টদের সাথে মিলে বম্বের বস্ত্রশিল্পে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত করে আইএলপি।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে উন্মোচিত করে গেছেন তিনি স্বাধীনতাকালের উচ্ছ্বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে, যা আজকের বাস্তবতায় সহজ সত্য বলে প্রতিভাত হয়। সংবিধানসভার উপদেষ্টা কমিটির কাছে মৌলিক অধিকার প্রশ্নে এক স্মারকলিপিতে আম্বেদকর বলেন,
“দুর্ভাগ্যজনক যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এমন একটা নতুন মতবাদের জন্ম দিয়েছে যাকে বলা চলে, সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী সংখ্যালঘুর ওপর শাসন চালানোর ‘সংখ্যাগুরুর স্বর্গীয় অধীকার’। সংখ্যালঘুরা একটু ক্ষমতার ভাগ চাইলেই তা হয়ে যায় সাম্প্রদায়িকতা, আর সংখ্যাগুরুর হাতে সমস্তরকম ক্ষমতা একচেটিয়া করাকে বলা হয় জাতীয়তাবাদ।”
আম্বেদকরের কাছে গণতন্ত্রের অর্থ, “জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন”। গণতন্ত্র বলতে নিছক রাজনৈতিক গণতন্ত্র নয়, সামাজিক গণতন্ত্রের কথা বলেন তিনি, যার ভিত্তি হবে স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতি — এই তিনটি দিক পরস্পর অবিচ্ছেদ্য এবং একটির ব্যত্যয় হলে অন্যগুলিও ভেঙ্গে পড়ে।
“সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র কখনই সফল হতে পারে না। ... সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে সমতার চাহিদাকে আর কতদিন অস্বীকার করে চলব আমরা? এই সমতাকে অস্বীকার করে চলা মানে শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া।”
আম্বেদকর আমাদের যে বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন আজ তা ভয়ঙ্কর চেহারায় দেশের সামনে প্রকট। গণতন্ত্র ও সংবিধান বিপন্ন। দলিত, মহিলা, আদিবাসী, পিছড়ে বর্গ ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য যা যা অর্জনের স্বপ্ন আম্বেদকর-গুরুচাঁদ-জয়পাল-ভগৎ সিংহরা দিয়ে গেছিলেন তা আজ প্রতিদিন ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে মোদি-শাহর শাসন। দেশজুড়ে তাই আওয়াজ উঠেছে, ‘সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে এই লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাব। আম্বেদকর জয়ন্তীতে এই আমাদের অঙ্গীকার।
(হালিসহর সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রকাশিত প্রচারপত্র থেকে নেওয়া)