গত ২৫ এপ্রিল বিক্ষোভকারী জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল কালিয়াগঞ্জ থানা প্রায় তিন ঘণ্টার জন্য।
তার মধ্যে যা যা ঘটেছে – আগুন, ভাঙচুর, ইট-পাটকেল-পাথর বৃষ্টি, স্থানীয় দোকানপাট ও ঘরবাড়ি লুঠ, পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো, জল কামান – এসব সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিতভাবেই এসেছে। এই ঘটনার দায় এখন কেউ নিতে চাইছে না - না মিছিলের উদ্যোক্তা সংগঠনটি, না পিছনে থাকা ইন্ধনদাতা বিজেপি-আরএসএস। তারা ‘গণরোষের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ’ বলে দায় এড়াচ্ছে।
এইসব তাণ্ডব আমরা সাম্প্রতিক কালে ধারাবাহিকভাবে দেখছি ‘রামনবমী’ বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলায় যারা ‘প্রধান বিরোধীদল’ বলে বুক বাজিয়ে বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের উদ্যোগে ও প্রত্যক্ষ মদতে ঘটছে এসব। কালকের ঘটনা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেল, কারণ শান্তি-শৃঙ্খলার রক্ষক পুলিশ নিজেই আক্রান্ত। এই ঘটনা ভাবাচ্ছে দ্বিবিধ কারণে। প্রথমত প্রশাসনের এই হাল হলে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা কে দেবে? দ্বিতীয়ত রাজ্যবাসীর ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ আছে, বর্তমান শাসকদলের দুর্নীতি, দৌরাত্ম্য দুরাচার নিয়ে। সরকারের অপদার্থতা নিয়ে। ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য মানুষ রাস্তায় নামছে, এমনকি বছর পার করে রাস্তায় বসে আছেন বহু মানুষ। কিন্তু বিক্ষোভের নামে এই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, অরাজকতা সৃষ্টি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মানুষের জন্য আন্দোলন, দলের জন্য নয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিসরে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে সেটা সব সময়ের জন্য মাথায় রাখতে হবে, নিজেদের সাংগঠনিক শিক্ষা ও কর্মসূচিতে তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। শুধু তাই নয়, অরাজকতা সৃষ্টির যে কোন চেষ্টাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমালোচনা ও প্রতিরোধ করতে হবে। তাৎক্ষণিক ‘লাভের’ জন্য মানুষকে হিংসা ও বিদ্বেষের পথে চালিত করে, বিভ্রান্ত করে বিধ্বংসী উন্মাদনায় যারা ক্ষেপিয়ে তোলে, তারা গণতন্ত্রের শত্রু। বিশ্বাসঘাতক। আর সেই অন্তর্ঘাতের কাজটা বেশ সুচারুভাবে শুরু হয়েছে এ রাজ্যে বিজেপি-আরএসএ-এর উদ্যেগে। চলুন, এবার মূল ঘটনায় ফেরা যাক।
কালিয়াগঞ্জের সেই নাবালিকা। বাবা পরিযায়ী শ্রমিক। দারিদ্র্যের সংসারে নানা চাপ, নানা সমস্যা। বয়ঃসন্ধিক্ষণের নানা অচেনা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। প্রতিবেশি এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। ছেলেটি ভিন ধর্মের। সেটা নিয়ে বহু টানাপোড়েন। সালিশীসভার নামে আরও হেনস্থা, আরো মানসিক চাপ। কৈশোরের এই একান্ত অনুভূতিকে নিয়ে সমাজ সংসারের এই কুৎসিত লোফালুফি এবং সালিশি সভায় তার (সেই ভালোবাসার) মৃত্যু পরোয়ানা- কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি দশম শ্রেণির ছাত্রী কিশোরীটি। মানসিক নির্যাতনে (সেদিন বাড়িতে অল্প মাত্রায় শারীরিক নিগ্রহও চলে) বিপর্যস্ত মেয়েটি গভীর অবসাদে, রাতে পুকুর পাড়ে এসে কীটনাশকের বোতল থেকে (প্রায় ২৫০ মিলি লিটার – যেটা কেউ কাউকে জোর করে খাওয়াতে পারে না – ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকা তিন চিকিৎসকের বোর্ড জানিয়েছে) তরল বিষ গলায় ঢেলে এলিয়ে পড়ে। মৃত্যুর আগে সে তার প্রেমিককেই শেষ ফোনটা করেছিল। বিপন্ন প্রেমিক গ্রামপ্রধানের পরামর্শ মেনে থানায় আত্মসমর্পন করে। সিপিআই(এমএল)-এর জেলা নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই বিবরণ দিতে পারছি আমরা। প্রাথমিক তথ্যে ভিত্তিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে যে এটি আসলে এক খাপ পঞ্চায়েতি অনার কিলিং বা আত্মহত্যায় বাধ্য করা। আরও অনুপুঙ্খ তদন্ত নিশ্চয় চলবে। কিন্তু এই মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পরবর্তীতে যা ঘটল বা বলা ভালো, ঘটানো হল – তা গভীর উদ্বেগের। দুশ্চিন্তার। এবং লজ্জার।
পরদিন সকালে অর্থাৎ ২১ এপ্রিল শুক্রবার তার নিথর দেহ উদ্ধার হয় বাড়ির কাছের পুকুরের ধার থেকে। তারপর থেকেই বিক্ষোভের নামে মৃতদেহ নিয়ে শুরু হয়ে যায় তাণ্ডব। অভিযোগ, মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। যদিও মেডিক্যাল বোর্ড পুলিশকে জানিয়েছে, ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী বিষক্রিয়াতেই মৃত্যু হয়েছে। শরীরে কোনো বড় আঘাতের চিহ্ন নেই। যৌন নির্যাতনের কোনো প্রমাণও মেলেনি। এটাও আরও তদন্ত সাপেক্ষ। কারণ ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট এখনও আসেনি।
পালাইবাড়ি গ্রামটিতে হিন্দু-মুসলমানের পাশাপাশি বাস। সেখানে বিজেপি'র সংগঠনও আছে। তারা বিদ্যুৎ বেগে নাবালিকা-মৃত্যুর করুণ ঘটনাটি নিয়ে আসরে নেমে পড়ে। বিশেষত, অভিযুক্ত যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সাধারণ মানুষের বেদনা ও ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে, তাদের ক্ষেপিয়ে তুলে, মৃতদেহ আটকে রেখে টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে, বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের দোকানপাট লুঠ করে, ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে ব্যাপক তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়। পুলিশ মৃতদেহ নিতে এলে ইটবৃষ্টি হতে থাকে। পুলিশ শূন্যে গুলি ছুঁড়ে, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়ে কোনক্রমে দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায়।
এর মধ্যে চটজলদি রায়গঞ্জের বিজেপি সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরী, উত্তর মালদহের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু, বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদাররা সদলবলে চলে আসেন সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে ইন্ধন যোগাতে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কালিয়াগঞ্জ ও তার আশেপাশে সাত দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
শনিবার ছিল ঈদ। চারিদিকে সন্ত্রাসের আবহে স্থানীয় সংখ্যালঘু মানুষজন দীর্ঘ একমাস রমজান পালনের পর কাঙ্খিত উৎসবের দিনটিও ঠিকমত পালন করতে পারেননি। সম্পূর্ণ অকারণে গোটা সম্প্রদায়কে নিশানা করে ফেলা হল। পরবর্তীতে রায়গঞ্জেও বিক্ষিপ্তভাবে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর তথ্যানুসন্ধানকারী দল মৃতার গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছেন। উত্তর দিনাজপুর জেলা কমিটি প্রথম বিশৃঙ্খলা রুখতে প্রশাসনের ব্যর্থতা ও নাবালিকার মৃতদেহের প্রতি পুলিশের চরম অমানবিকতার প্রতিবাদ জানিয়ে এবং গতকালের অরাজকতা সৃষ্টির জন্য বিজেপি-আরএসএস-কে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করে জনগণকে তাদের চক্রান্ত থেকে দূরে থাকার আবেদন জানিয়েছেন এবং জেলা সম্পাদক ব্রজেন সরকার ও জেলার রাজ্য কমিটি সদস্য তসলিম আলি উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে দুটি বিবৃতি জারি করেছেন।
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতির উদ্ভব হল? একটি মৃত্যু মানুষকে ব্যথিত করে, শোকবিহ্বল করে, ক্রুদ্ধ বা ক্ষুব্ধও করতে পারে। কিন্তু এমন ব্যাপক আকারে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টি কেন? সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি কেন? জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন ‘নিরপেক্ষ’ তদন্তের নামে যা করছেন তাকে ‘দলীয়’ নির্দেশপালন এবং রাজ্যের সুস্থ পরিবেশ বিপন্ন করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। এ রাজ্যে মহিলা ও শিশু সুরক্ষিত - এমন অন্যায্য দাবি কেউ মানছেন না। গত সোমবার রাতেই মালদহের কালিয়াচকে আরেকটি দশম শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষিতা ও খুন হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় মালদহের একটি যানবহুল রাস্তায় স্বামীর বাইকে চড়ে যাওয়ার সময় দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন আইনুল বিবি। এ রকম ধর্ষণ খুন শ্লীলতাহানি ও সম্মানহানির ঘটনা গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু দেবশ্রী সুকান্ত শুভেন্দু সত্যিই যদি নারী সুরক্ষা নিয়ে এত চিন্তিত থাকেন তবে সেসব ক্ষেত্রে কেন মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন? যন্তর মন্তরে বিক্ষোভরত মহিলা কুস্তিগিরদের বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে অমিত শাহের পুলিশ কেন এফআইআর নেয় না? মধ্যপ্রদেশে ‘কন্যাদানের’ নামে যখন আদিবাসী মেয়েদের কুমারীত্ব ও গর্ভাবস্থা পরীক্ষার নামে চরম অসম্মান করা হল, তারা চুপ থাকলেন। অথচ এক্ষেত্রে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন! আসলে নির্লজ্জ বিজেপি-আরএসএস এক নাবালিকার মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে নিজেদের সংগঠনের পালে হাওয়া লাগাতে চাইছে। রাজ্যে একগুচ্ছ গোদি মিডিয়া চ্যানেল ক্রমাগত ইন্ধন দিয়ে গেছে। ভিনধর্মের ছেলে মেয়ের প্রেম ও তা নিয়ে বসা একাধিক সালিশী সভার কথা মিডিয়া প্রায় সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে জনরোষ তৈরিতে আরএসএস-বিজেপিকে সুযোগ করে দিয়েছে। এই মুসলিম বিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী বিজেপি-আরএসএস বিলকিস বানোর খুনী-ধর্ষকদের সসম্মানে মুক্তি দেয়!
বাংলার মানুষ সতর্ক থাকুন এই আরএসএস-বিজেপি'র ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে!