গত ১৬ মার্চের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নতুন উদ্যমে শুরু প্রতিবিধান পত্রিকা’ শীর্ষক লেখাটি পড়ে তারই সংযোজনায় নিজের কিছু স্মৃতি তুলে ধরার আগ্রহ হল।
সিপিআই(এমএল) পার্টির পরিচালনায় তিল তিল করে গড়ে ওঠা ‘প্রতিবিধান’ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকেই আমার তার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ হয়েছিল। তখন যাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পত্রিকার কাজ শুরু করেছিলাম তাদের অনেকেই আজ আর নেই। কেউ কেউ নানা কারণে আমাদের সংগঠন ছেড়ে চলে গেছেন। এটা আমার কাছে মর্মান্তিক দুঃখের। তাদের সবাইকে লাল সেলাম জানাই।
১৯৮০’র শুরুতে ‘প্রতিবিধান’-এর আত্মপ্রকাশ -মহিলাদের সংগঠিত করা আর বৃহত্তর নারী আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির লক্ষ্যে। পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা প্রথম অঙ্কুরিত হয় কমরেড বিনোদ মিশ্রের চিন্তায়। প্রথম উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ধূর্জটী প্রসাদ বক্সী, অনিমেষ চক্রবর্তী, সুদর্শন বসু, পরেশ ব্যানার্জি, বুলা ভরদ্বাজ (শিখা) প্রমুখ কমরেডরা। শর্মিষ্ঠা, স্বপ্নার বাড়িতে রাতের পর রাত প্রতিবিধান, মহিলা সংগঠন নিয়ে বৈঠক হত। নেতারাও থাকতেন।
পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন কমরেড বিনোদ মিশ্র। প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন দেবযানী চট্টোপাধ্যায়। প্রকাশক ছিলাম আমি। পরবর্তীকালে পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন হয় ‘সমকালীন প্রতিবিধান’ নামে। উপদেষ্টামণ্ডলীতে ছিলেন বহু বিশিষ্ট মানুষ, তাঁরা শুধু অর্থ, লেখা বা পরামর্শদিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, তাঁদের অনেকেই নারী নির্যাতন, বধূহত্যা ও পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে (পত্রিকার উদ্যোগে) সামিল হতেন। পায়ে পা মিলিয়ে যেমন মিছিলে হাঁটতেন, তেমনই পথসভায় মাইক ধরে বক্তব্য রাখতেন। পরবর্তীতে প্রতিবিধান ‘নারীনির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের’ সঙ্গে মিলিত ভাবে প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলেছে।
‘৭৯ সালে মথুরা রেপ কেস, অর্চনা-লতিকা গুহ-র ওপর রুণু গুহ নিয়োগীর বর্বর অত্যাচার, ৮০র দশকে পর পর ঘটে যাওয়া বধূহত্যার ঘটনার বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদ ঝলসে ওঠে প্রতিবিধানের পাতায়। কলকাতায় চলা বিভিন্ন মামলায় আমরা প্রতিবিধান-এর তরফ থেকে আদালতেও উপস্থিত থাকতাম। এ ছাড়া জীবন-সংগ্রাম নিয়ে লেখায় উঠে আসতো খনি, বিড়ি, জুতো, গেঞ্জি, অ্যাম্পুল কারখানার শ্রমিক বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকদের, নার্সদের দৈনন্দিন লড়াইয়ের কথা। এর জন্য প্রতিবিধানের প্রতিনিধিরা ছুটে যেতেন আসানসোল, দুর্গাপুর, কৃষ্ণনগর, নদিয়া, হালিশহর, নৈহাটি, বনগাঁ, বরানগর... বরানগরে ছাইগাদায় কয়লা বাছতে গিয়ে একবার ধ্বস চাপা পড়ে মৃত্যু হয় কয়েক জন মহিলা ও শিশুর। সেই মর্মান্তিক প্রতিবেদন আমরা পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেছিলাম।
এই সব সাক্ষাৎকার ও আন্দোলনের খবর সংগ্রহের কাজে গিয়ে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হোত। তার থেকে দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এরকমই এক কাজে একবার আমি আর দেবযানী দুর্গাপুর যাচ্ছি। ট্রেনে প্রচণ্ড ভীড়। দাঁড়িয়েই যাচ্ছি। বাইরে দাবদাহ চলছে। দুর্গাপুর স্টেশনে নেমে নির্দিষ্ট ঠিকানার উদ্দেশে হাঁটছি। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য। লু বইছে। গন্তব্যে পৌঁছে দেখি দরজায় তালা। অগত্যা সেখান থেকে গেলাম কৃষ্ণার কোয়ার্টার। সেখানেও তালা। চোখ মুখ জ্বালা করছে। ক্লান্ত পায়ে ফেরার ট্রেন ধরতে স্টেশনে গিয়ে শুনি, একটু আগেই কলকাতার ট্রেন চলে গেছে। এবার? নিরুপায় হয়ে চললাম দুর্গাপুরের পরের স্টেশন কালিপাহাড়, দেবযানীর বন্ধুর আস্তানায়। সেখানে গিয়ে শুনি সে সেখানে নেই। আবার স্টেশন। জানা গেল পরবর্তী কলকাতার ট্রেন ওখানে দাঁড়ায় না। চললাম আসানসোল – ওখান থেকেই হাওড়ার ট্রেন ধরতে হবে। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত ফেরার ট্রেনে উঠলাম যখন, রাতের অন্ধকার নেমেছে। জানলার ধারে জায়গাও পেলাম যা হোক। আসলে প্রচণ্ড গরমে ওখানকার লোক কলকাতায় চলে আসে-জানা ছিল না। তার চেয়ে বড় কথা – তখন মোবাইল ফোন ছিল না। এই জন্যে এত নাজেহাল হতে হল। আজ প্রযুক্তি আমাদের কত সহায়ক হয়েছে। যাই হোক, মধ্যরাতে হাওড়ায় পৌঁছে স্টেশনে রাত কটিয়ে যখন ভোরের বাস ধরছি তখন আমাদের দু’জনের আর কথা বলার অবস্থা ছিল না।
আরেকদিন। প্রতিবিধান নিয়ে কথা বলতে গেছি উলুবেড়িয়া কলেজের অধ্যাপিকার বাড়ি। ঘরে পা রাখতেই ভেতরের ঘর থেকে প্রবল সারমেয় – চিৎকার কানে এল। অধ্যাপিকা মৃদু হেসে বললেন – একটু বসুন। আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ওদের নিয়ে আসি। আমরা হতভম্ব। মহিলা প্রায় বাঘের সাইজের পোষ্য দুটিকে নিয়ে এলেন। তারা এসেই আধ হাত লম্বা জিভ দিয়ে আমাদের আপাদমস্তক লেহন করে চুপচাপ চলে গেল। আমরা তখন বাক্যহারা। দেবযানীর রুমাল সারমেয়ের লালায় জব জব করছে। প্রতিবিধান আমাদের যে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে কত রকম অভিজ্ঞতায়।
তরুণ প্রজন্মের নতুন উদ্দীপনায় প্রতিবিধান আরও শাণিত হয়ে উঠুক, এগিয়ে চলুক দুর্বার গতিতে।
সংগ্রামী অভিনন্দন সহ
স্নিগ্ধা বসু