সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একাদশ পার্টি কংগ্রেস দেশের বুকে ফ্যাসিবাদী বিপর্যয়ের মুখে সার্বিক প্রতিরোধের এক আলোকবর্তিকা এবং বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিশা নির্দেশিকা হয়ে উঠেছে। গত ১৫-২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এই মহাধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে বিহারের রাজধানী পাটনায়। বিহারের বুকে নকশালবাড়ির ধারায় কৃষক আন্দোলন তার ভরকেন্দ্র খুঁজে পেয়েছে, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যার অস্তিত্ব ও অগ্রগতি অব্যাহত। যা কিছু প্রগতিশীল সমাজবাদী ধারা ও ঐতিহ্য তার সাথে একাত্মতা গড়ে তুলে সেখানে সামাজিক পরিবর্তনের লড়াই তীব্রতর হয়ে চলেছে। এই বুনিয়াদি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের জাগরণের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে বাইরে থেকে অভূতপূর্ব হস্তক্ষেপের বার্তা এই পার্টি কংগ্রেস তুলে ধরেছে। দক্ষিণে কেরলের পরই এখন বিহারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বিধানসভার ভেতরে এবং মাঠে ময়দানের লড়াইয়ে দেশের মধ্যে বৃহত্তর বাম শক্তি। অপরদিকে ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপি হিন্দি বলয়কেই তাদের গৈরিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র বানাতে চাইছে। সেই রণভূমিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিপিআই(এমএল) গড়ে তুলেছে জনতার প্রতিরোধ, বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য। এই প্রেক্ষাপটে আয়োজিত পার্টি কংগ্রেসের সমগ্র অনুষ্ঠানসূচি ছিল বহুমাত্রিক। শুরুতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, পাটনার গান্ধী ময়দানে সংগঠিত হয় লক্ষাধিক মানুষের মহাসমাবেশ। যা সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, এমন কী সংবাদমাধ্যমগুলি যাকে লিবারেশন তথা ‘মালে’র বর্ধিত শক্তি রূপে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, উদ্বোধনী অধিবেশনে দেশের মূল ধারার সমস্ত বামপন্থী দলগুলির শীর্ষনেতৃত্ব অংশগ্রহণ করেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বামদলগুলির বোঝাপড়াকে রাজনৈতিকভাবে আরও উন্নত করে তোলার লক্ষ্যে এই অধিবেশন খুবই কার্যকরী হয়ে ওঠে।
১৬ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক অধিবেশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলির পারস্পরিক সংহতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা তুলে ধরেছে। কংগ্রেসের দলিলে উল্লিখিত ‘ফ্যাসিবাদ যখন আরো একবার একটি আন্তর্জাতিক প্রবণতা হিসেবে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে’ ভারতীয় ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ‘আন্তর্জাতিক আবহ যথেষ্ট রণনৈতিক সমর্থন ও বৈধতা যোগাচ্ছে’ তখন এই অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৭ ফেব্রুয়ারি, অনুষ্ঠিত হয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ‘দেশ বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ সেমিনার। যা সিপিআই(এমএল)-এর ইতিহাসে নতুন একটি বিষয়। সম্প্রতি বিহার বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘মহাগাঠবন্ধন’ বা বিজেপি বিরোধী দলগুলির আসন বোঝাপড়ার একটা অনুশীলন চলেছে। পরবর্তীতে বিহারের মাটিতে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সেটি আরও বর্ধিত হয় এবং কার্যকরী ভূমিকা নেয়। এ প্রসঙ্গে পার্টি কংগ্রেসের দলিলে উল্লেখ করা হয় “ফ্যাসিবাদী বিপর্যয় ও ধ্বংসের আবর্তথেকে দেশকে বাঁচানো বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ... এই কর্তব্য অবশ্যই সকল ধারার গণতান্ত্রিক শক্তি ও আদর্শের মধ্যে যতটা সম্ভব ব্যাপকতম ঐক্য ও সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে... আসন্ন নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপিকে দুর্বল করতে এবং মোদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সর্বভারতীয় স্তরে এবং প্রধান প্রধান রাজ্যগুলিতে একটি গতিশীল ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বিরোধীপক্ষ গঠন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ” এই রাজনৈতিক দিশায় প্রধানত বিহারের মাটিতে ঐক্য প্রক্রিয়ায় সাথে সংশ্লিষ্ট বিরোধী দলগুলিকেই সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন বিরোধীদল কংগ্রেসের জাতীয় স্তরের নেতৃত্ব, আরজেডি, জেডিইউ নেতৃত্ব তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এবং উপমুখ্যমন্ত্রীগণ। বিজেপির বিরুদ্ধে আগামী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক সমঝোতা নিয়ে সকলে চর্চা করেন। সেখানে সিপিআই(এমএল)-এর প্রাসঙ্গিকতা ও বলিষ্ঠ ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকরী রূপে সকলের কাছে সমাদৃত হয়। একে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল বিরোধী ঐক্যের এক অনুঘটক রূপেও তুলে ধরেন।
এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা আভ্যন্তরীণ আলাপ আলোচনার শেষপর্বে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “এই সেমিনারে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিরোধী নেতৃবৃন্দ নির্বাচনী বোঝাপড়া নিয়ে নিজেদের কৌশল প্রসঙ্গে পারস্পরিক বার্তালাপ করেছে, ওরা নিজেদের কাজ করেছে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এই প্রক্রিয়া থেকে আমরা বড় ধরনের কোনো সহায়তা পাব না। একমাত্র নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে আমরা যতটা মজবুত সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছি কেবলমাত্র সেই অনুপাতে আমরা সাফল্য পেয়েছি এবং আগামীতেও পেতে পারি।” এ’বিষয়ে পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক দলিলে বলা হয় — “বিরোধী দলগুলির যতটা সম্ভব সার্বিক ঐক্যকে স্বাগত জানানো, সহযোগিতা করা এবং যোগদান করার সাথে সাথে কমিউনিস্টের অবশ্যই রাজনৈতিক মতাদর্শগত স্বাধীনতা সম্পূর্ণত বজায় রাখতে ও প্রয়োগ করতে হবে, যাতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ও কার্য্যকর প্রতিরোধ জারি রাখা যায়। একথা আমাদের হিসবে রাখতে হবে যে বর্তমানে ভারতে যে বিরোধী ঐক্য গড়ে উঠেছে তো এখনো কোনো সাধারণ ফ্যাসি-বিরোধী চেতনা বা প্রতিশ্রুতি দ্বারা নির্ধারিত নয়, অনেক বিরোধী দল আরএসএস-এর বিরোধিতা করতে এবং এর বিবিধ মিথ্যা ও সন্ত্রাসের ভয়ংকর অভিযানকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত নয়।... মোদী সরকারকে ভোটে হারিয়েই ফ্যাসিবাদকে নির্ধারকভাবে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। যা প্রয়োজন তা হল ফ্যাসিবাদের রাজনীতি ও মতাদর্শের এক জোরদার প্রত্যাখ্যান গড়ে তোলা যা তাকে ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজের প্রান্তে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে... একদম মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগতভাবে লড়তে হবে আমাদের।”
কমরেড দীপঙ্কর আরও বলেন, বিগত সময়কালে পার্টি বিভিন্ন ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এজন্য কোনো ব্যাক্তিগত চর্চা আমরা করিনি৷ যেকোনো সঙ্কট মোকাবিলায় সমগ্র পার্টি সংগঠনকে সচেতন ও সক্ষম করে তোলা, ব্যাপকতম জনগণের কাছে চলে যাওয়ার কর্মনীতি আমরা গ্রহণ করেছি। এভাবে লড়তে লড়তেই আমরা এগিয়ে চলেছি। পূঁজির ক্রমবর্ধমান শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে আমাদের প্রয়োজন সংখ্যার শক্তি। ব্যাপক শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের শক্তি। একে লাগাতার সংগঠিত করা, তাঁদের চেতনার বিকাশ ঘটানো, জীবন্ত গতিশীল গণকাজের ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে তোলা — এ পথেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব। বড় বড় আন্দোলন আমরা গড়ে তুলছি, কিন্তু সেই অনুপাতে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির প্রশ্নে দুর্বলতা ঘাটতি আমাদের কাটিয়ে তুলতে হবে।
- জয়তু দেশমুখ