সংবিধান বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও সভা থেকে উঠে এল বিজেপি বিরোধী মহাজোটের বার্তা

save-the-democracy-meeting
সিপিআই(এমএল)-এর একাদশ পার্টি কংগ্রেসের মূল বিষয়বস্তু ছিল ভারতের বর্তমান ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা। এরসঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সম্মেলনকক্ষে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়।

এই আলোচনাসভার আহ্বান ছিল গণতন্ত্র বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও। আলোচনাসভায় আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা সংযুক্ত জনতা দলের নেতা নীতীশ কুমার, বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা তেজস্বী যাদব, কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা সলমন খুরশিদ।

আলোচনাসভায় অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও নীতীশ কুমার, তেজস্বী যাদব ও সলমান খুরশিদ এসেছেন। সেজন্য ওনাদের ধন্যবাদ। আমাদের দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র সংকটে। এগুলো চলে গেলে দেশের আর কী থাকবে। এগুলো বাঁচানোর জন্য বড় জোট দরকার।

সত্তর দশকে গণতন্ত্রের জন্য যে সঙ্কট এসেছিল সেখানে বিহারে বড় আন্দোলন হয়েছিল। সেখান থেকেই নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ যাদবরা উঠে এসেছিলেন। একদিকে যখন জর্জ ফার্ন্ডান্ডেজের নেতৃত্বে লড়াই চলছিল, সেই সময়েই বিহারের গ্রামে সিপিআই(এমএল) লড়ছিল। আমাদের সাধারণ সম্পাদক জহর সেই লড়াইতে শহীদ হন।

আজকে সংসদে ও রাস্তায় বিজেপি ঘৃণা ও হিংসা ছড়াচ্ছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। কংগ্রেসের বড় র‍্যালি হয়েছে। আমাদের পার্টি কংগ্রেস হচ্ছে। মহাজোটের এক বড় জমায়েত আছে আগামী ২৫ তারিখ। বড় বড় লড়াই হয়েছে। শাহীনবাগে কৃষকেরা লড়েছেন।

আন্দোলনের জোট আর রাস্তার লড়াই মিলিয়ে ২০২৪-এ পরিবর্তন সম্ভব।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তাঁর বক্তব্যে বলেন যে আমাদের সঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর বহুদিনের সম্পর্ক। রাজনীতিতে নানা বদল হয়। যারা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন তারা দেশের স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থে চলেছেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা পার্টির ভেতরে কথা বলেছি। আমরা ঘোষণা করেছি দশ লাখ লোককে চাকরী দেবে সরকার। সব এলাকার উন্নতির চেষ্টা চলছে। একটি বড় যাত্রাতে বেরিয়েছিলাম। দেখে ভালো লাগল যে সরকার সব ধরনের মানুষের জন্য কাজ করছে এবং সব ধরনের মানুষ এতে খুশি। আমাদের নয়া সিদ্ধান্ত সবাইকে খুশি করেছে।

বিহারে আমরা তো যা করার করছি। গোটা দেশে যত বেশি সম্ভব দল এক হয়ে ২০২৪-এ যদি আমরা লড়তে পারি তাহলে জিততে পারব। স্বাধীনতার লড়াইকে পর্যন্ত এরা ভুলিয়ে দিচ্ছে। কাজের কাজ কিছু না করে তারা কেবল আত্মপ্রশংসা করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সময়ে দেশভাগ সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল। কিন্তু এখন অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চলছে প্রতিদিন।

অনেক দল একসঙ্গে লড়তে চাইছি। যত দ্রুত জোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা আসন সমঝোতা করতে পারব ততই ভালো। বিহারে তো আমরা একসঙ্গেই আছি। অন্যত্রও এটা করতে হবে। সিপিআই(এমএল)’কে আমরা শ্রদ্ধা করি। নিজের জন্য আমি কিছু চাই না। আমি চাই দেশের জন্য কাজ করতে। আগেও আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম এটা মনে রেখে আপনারাও এগিয়ে আসুন আবার। আপনারা যে পার্টি কংগ্রেসের জন্য পাটনাকে বেছেছেন এজন্য আপনাদের ধন্যবাদ।

বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব তাঁর বক্তব্যে বলেন যে আজকে যে স্লোগান রাখা হয়েছে সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও — এটাই আসল কথা। ব্যক্তি নয়, বিষয় নিয়ে কথা হোক — এটাই আমরা বলছি। গরিবী, দারিদ্র এসব নিয়ে কথা হবে না, কথা হবে বিদ্বেষ ও বিভাজন নিয়ে, ঘৃণা নিয়ে এটাই বিজেপি চায়। মনুস্মৃতির অনুপ্রেরণা নিয়ে লেখা গোলওয়ালকরের বাঞ্চ অব থটসকে এদেশের সংবিধান বানাতে চায় বিজেপি। বিজেপির বিরুদ্ধে গেলে আপনার চরিত্র হনন করা হবে, জেলে ঢোকানো হবে। আর বিজেপির সঙ্গে থাকলে আপনি রাজা হরিশচন্দ্র।

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা দেশের স্বার্থে নিয়েছেন। এজন্য তাঁকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। আমরা তো আঞ্চলিক দল। কংগ্রেস তো জাতীয় দল। বিজেপিকে হারাতে হলে একটি স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হবে। কংগ্রেসকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার যে কথা মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলেছেন, সেটা খুব জরুরি কথা।

দেশে বিভিন্ন সরকারকে কিনে নেওয়া হচ্ছিল। বিজেপি যা করছিল তার বিপরীত ঘটনা বিহারে ঘটেছে। বদলটা টাকার জোরে এখানে হয়নি। হয়েছে নীতি আদর্শের জায়গা থেকে।

লালুজীর (তেজস্বী যাদবের পিতা তথা রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা ও বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের) কিডনি বদল হয়েছে। তাঁর তরফ থেকেও আমি আপনাদের শুভেচ্ছা জানাই।

বিজেপি বলে মুসলিমদের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া দরকার। আমরা বলতে চাই ভোটাধিকার বিজেপি বাবার সম্পত্তি নয় যে কেড়ে নেবে। এই দেশ বহুত্বের দেশ। সেটাই এই দেশের পরিচয়।

প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদ তাঁর বক্তব্যে ছিলেন শাণিত ও কৌতুকময়। তিনি উপস্থিত সকলকে তেজস্বী যাদবের লাল সেলাম জানানোর প্রসঙ্গটি দিয়ে তাঁর কথা শুরু করে বলেন যে তেজস্বী যাদব লাল সেলাম জানালেন। লালের মধ্যে বিপ্লবের ভাবনা আছে। আপনাদের পার্টি সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অসামান্য। দেশে গুজরাট মডেলের কথা হয়, আমি বিহার মডেলের কথা সব জায়গায় বলব। আপনারা যা চান কংগ্রেসও তা চায় বলে আমার মনে হয়।

রাহুল গান্ধীর যাত্রায় আপনারা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আপনাদের ধন্যবাদ। সেই যাত্রায় রাহুল গান্ধী ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসার কথা বলেছেন।

নীতীশ কুমার যা বলেছেন (কংগ্রেসকে জোট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার কথা) তা আমি যথাস্থানে পৌঁছে দেব। একজন উকিল হিসেবে উকিলের মতো জোটের পক্ষে ওকালতিও করব। জোটের ঘোষণা আমিও মনে করি জরুরি। এই ঘোষণা হলে তা অনেকের মনেই ভয় ধরিয়ে দেবে।

তামিলনাড়ুর সাংসদ ও বামপন্থী দলিত নেতা থল থিরুমাভালাভন বলেন ফ্যাসিবাদ সুনামির মতো ভারতের গণতন্ত্রের তটে আছড়ে পড়ে তাকে বিপর্যস্ত করেছে। একে প্রতিরোধ করতে হবে।

ফ্যাসিবাদ বিরোধী বৃহৎ জোট ও আন্দোলনের বার্তা দিয়ে সভা সমাপ্ত হয়। এই সভাকে ঘিরে সম্মেলনের প্রতিনিধি, অতিথি, পর্যবেক্ষক, সংবাদ মাধ্যম সকলের উৎসাহ উদ্দীপণাই ছিল চোখে পড়ার মতো।

খণ্ড-30
সংখ্যা-4