শুভাপ্রসন্নের সাম্প্রদায়িকতা ও আমাদের প্রগতিশীল সমাজ

progressive-society
গত ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় বিশিষ্ট শিল্পি ও শাসকদলের সমর্থক শ্রী শুভাপ্রসন্ন মহাশয় বাংলা ভাষায় প্রচলিত কয়েকটি শব্দের ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ তিনি ‘দাওয়াত’ ও ‘পানি’ শব্দদুটিকে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে ‘এইরকম’ শব্দের ব্যবহার বাংলা ভাষার শুধু ক্ষতি করে না – এগুলি ব্যবহৃত হয় সাম্প্রদায়িক কারণে; অর্থাৎ, এই শব্দগুলি যাঁরা ব্যবহার করেন – তাঁরা সাম্প্রদায়িক। উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তিনি যে পূর্বোক্ত শিল্পির বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন তা নয়। বরঞ্চ তিনি শিল্পির বক্তব্যের মৃদু বিরোধিতা করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা মোটামুটি হল, – ও-দেশ (পড়তে হবে বাংলাদেশ) থেকে আসা মানুষেরা তো তাঁদের ভাষাতেই কথা বলবেন – সেই কথা বলবার অধিকার তাঁদের রয়েছে। পাঠক খেয়াল করবেন, শ্রী শুভাপ্রসন্ন কিন্তু বাংলা ভাষায় চাপিয়ে দেওয়া শব্দ বলতে যে-দুটি শব্দের উদাহরণ টেনেছেন, সেই শব্দগুলি মূলত এপার বাংলার মুসলমানদের কথ্য ভাষা। অধুনা হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেবার যে কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্র চলছে – তা নিয়ে তাঁকে একটা শব্দও খরচ করতে দেখা যায়নি। আবার তাঁর বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পরোক্ষভাবে বলে বসলেন, বাংলায় যারা ‘পানি’, ‘দাওয়াত’ শব্দগুলি ব্যবহার করেন, এপার বাংলার মুসলমানরা, আসলে ওদেশ থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে এসেছেন! শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অতি জনপ্রিয় নেত্রী। সারা বাংলা জুড়েই তাঁর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায় না। ভাবতে অবাক লাগে তাঁর মতো একজন নেত্রী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, রাজনীতির কারণে প্রায় সারা বাংলায় যাঁর অগাধ যাতায়াত; তিনিও কি মনে করেন পশ্চিমবাংলার মুসলমানরা মূলত বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছেন? এ এক চরম বিড়ম্বনা আমাদের – পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের। আমাদের ছোটোবেলা থেকে যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, তা হল – আমরা বাঙালি না মুসলমান? মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরে প্রায় একই রকম প্রতিধ্বনি শোনা গেল।

এখন আসা যাক, শ্রীশুভাপ্রসন্নের বক্তব্যে আমাদের প্রগতিশীল সমাজ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাল?

বাংলার লেখকগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রায় কোনো প্রতিক্রিয়াই পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হল – কিন্তু তাতে লেখকগোষ্ঠীর তেমন হেলদোল পাওয়া গেল না। অবশ্য এটি আর বিস্মিত করে না। বাংলার লেখককূল সঠিক ভাবেই বুঝেছেন শুভাপ্রসন্নের সংশয় অদৌ ভাষা নিয়ে ছিল না। তিনি ভাষা নিয়ে মোটেও মন্তব্য করেননি। ভাষাকে কেন্দ্র করে তিনি শুধুমাত্র অপমান করতে চেয়েছেন পশ্চিমবাংলার ২৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে। মুসলমানদের অপমান করা এখন রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। মুসলমানদের অপমান করে দিব্যি সমাজের জ্যাঠা হয়ে থাকা যায়। এতে কারো আপত্তি থাকে না। ফলে, যাঁদের পেশা বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে, তাঁরাও নির্দ্ধিধায় চুপ থেকে যেতে পারেন। অসচেতন মনেও অপরাধবোধ থাকে না তাঁদের।

কোনো রাজনৈতিক দল এটা নিয়ে সরব হয়নি। বামদলগুলো তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। যেন এটি একটি ছোটো ব্যাপার। যেন এটি কোনো ব্যাপারই নয়। যেন ‘এমন তো হয়েই থাকে’ গোছের অবস্থান তাদের।

তবে সবাই যে চুপ থেকেছেন – তা নয়। কিছু ব্যাক্তি মানুষ মূলত সামাজিক মাধ্যমে শ্রী শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যকে খারিজ করেছেন। শিল্পির বক্তব্যকে খারিজ করতে গিয়ে তাঁরা বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখা উদ্ধৃতি করেছেন, যেখানে তৎসম-তৎভব শব্দের সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দের প্রভূত ব্যবহার রয়েছে। কেউ আবার বাংলাভাষার ইতিহাসের দিকে গিয়েছেন। তাঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, যে-ভাষা অন্য ভাষার শব্দকে সহজে আপন করে নিতে পেরেছে – সেই ভাষার উন্নতি তত দ্রুত ঘটেছে। একটি ভাষার ব্যাপ্তি নির্দ্ধারিত হয় অপর ভাষার সঙ্গে তার সহিষ্ণুতার সম্পর্কে। এখানে ছুৎমার্গ থাকলে ভাষা বস্তুত বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়। সেই ভাষা অচিরে ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

যে-সকল ব্যাক্তি শ্রী শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। ভাষার নিরিখে তাঁদের যুক্তিগুলি বহুলপ্রচলিত এবং প্রামাণ্য হিসেবেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। ফলে তাঁদের বিরোধিতাগুলি যে যুক্তিগ্রাহ্য তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে মনে প্রশ্ন জাগে পদ্ধতি নিয়ে। আমি তাঁদের অনুরোধ করব শ্রী শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যের দিকে আরো একটু মনোনিবেশ করতে। খেয়াল করুন শ্রী শুভাপ্রসন্ন ভাষার শুদ্ধতা (এই ধারনাটাই অতি প্রতিক্রিয়াশীল) নিয়ে বলতে গিয়ে শুধু বাংলার মুসলমানদের কথ্য ভাষাকেই আক্রমণ করছেন। তিনি বাংলা ভাষায় প্রচলিত ইংরাজি, ফরাসি, পর্তুগিজ সহ অন্যান্য ভাষার শব্দের উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ, তাঁর মতে বাংলার মুসলমানরাই বাংলার ভাষাটিকে নষ্ট করছে। তিনি সরাসরি আক্রমণ করছেন এই বাংলায় বসবাসকারী মুসলমানদের। এই জিনিসটি তিনি বেশ কিছুকাল যাবতই করে আসছেন। এবং কখনোই তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হননি। অর্থাৎ, তাঁর বিরোধিতা করতে দরকার ছিল তাঁর সাম্প্রদায়িক মন-টিকে চিহ্নিত করা। আমরা সেটার দিকে বেশি নজর না দিয়ে চলে গেলাম ভাষাতত্ত্বের দিকে। অথচ শ্রী শুভাপ্রসন্ন ভাষাতত্ত্বের প্রশ্নটিই তোলেননি, প্রকৃতপক্ষে সেই যোগ্যতাও তাঁর নেই। তিনি একজন হিন্দুত্ববাদী, মুসলমান-বিদ্বেষী মানুষ। আমরা তাঁকে ভাষার তর্কে না গিয়ে, এইভাবে চিহ্নিত করে আমাদের বিরোধিতার সুর চড়াতে পারতাম। কিন্তু তা করলাম না।

কিছুদিন আগে হরিয়ানায় দুজন মুসলমানকে গাড়িতে আটকে রেখে পুড়িয়ে খুন করা হল। আমাদের ভারতবর্ষেই। এক্ষেত্রেও বাংলার নাগরিক সমাজকে প্রায় কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা গেল না। যেন ঘটনাটি আমাদের দেশে ঘটেনি। যেন ঘটনাটি দূরের কোনো দেশে ঘটেছে। যেন মৃত ব্যাক্তিদুটি আমাদের সহনাগরিক ছিল না।

তাহলে কি বাংলায় ‘প্রগতিশীল’ ধারনাটার মধ্যেই কিছু খুঁত রয়ে গিয়েছে। আমরা আর মুসলমান বিদ্বেষীদের চিনতে পারছি না? কিংবা চিনে ফেলেও না চেনার ভান করছি?

আপনারা যদি মনে করেন, হিন্দুত্ববাদ এক ধরনের ফ্যাসিবাদ, তাহলে মেনে নিন, শ্রী শুভাপ্রসন্নের মতো ব্যাক্তিরা সেই ফ্যাসিবাদের সহযোগী। আর যদি হিন্দুত্ববাদকে শত্রু হিসাবে না মনে হয় – তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। ভাষার ব্যবহার নিয়ে কোনো সেমিনারে আলোচনা করা যাবে তখন।

- সাদিক হোসেন

খণ্ড-30
সংখ্যা-4