শংকর রায় এক ঘরানা, এক মার্ক্সিয় চিন্তক : স্মরণ সভা
a-marxist-thinker

২৩ মার্চ শিয়ালদার বিএমপিইইউ হলে প্রয়াত প্রথিতযশা সাংবাদিক শংকর রায়ের স্মরণ সভা পালিত হল। গত ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন তিনি প্রয়াত হন। এই সভায় বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অনাথবন্ধু দে, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, শোভনলাল দত্ত গুপ্ত, সিজিসিআরআই থেকে দীপ্তেন ভট্টাচার্য, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ।

শংকর রায় যদিও পেশাগতভাবে ছিলেন একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিক, পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন পরোপকারী মানুষ এবং সঙ্গী। সাথে গান বাজনার প্রতি ছিল তাঁর ভালোলাগা এবং সেই কথাই উঠে আসে, অনুষ্ঠানের প্রথম বক্তা অধ্যাপক তুষার মজুমদারের বক্তব্যে। তিনি জানান তাঁর সাথে শংকর রায়ের সম্পর্ক কতটা আন্তরিক ছিল। পাশাপাশি কীভাবে তিনি বিভিন্ন ক্লাসিকাল ঘরানার সংগীত সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করতেন। শংকর রায় ছিলেন সাংস্কৃতিক মনস্ক ব্যক্তিত্ব।শংকর রায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তিনি একটি উচ্চাঙ্গ সংগীতও পরিবেশন করেন।এরপর দিগন্ত বলয়-এর সম্পাদক বরুণ দাস শোক প্রস্তাব পাঠ করে শোনান। তাঁর পরবর্তী বক্তা ছিলেন, কফিহাউসের কনজুমার কো-অপারেটিভের সভাপতি অনাথবন্ধু দে। তিনি জানান যে, কতটা মানবিক এবং আন্তরিক ছিল তাঁর ব্যবহার। তিনি শুধু শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, বিচক্ষণতার দিক থেকেই নয়, মানবিকতার দিক থেকেও তিনি ছিলেন একজন সম্পূর্ণ মানুষ। অনাথ বাবুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন, তাঁর পুত্রবধূ অমৃতা রায়। অমৃতা দেবীর পর বক্তব্য রাখেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক তথা মার্ক্সিয় চর্চাকারী শোভনলাল দত্ত গুপ্ত। তিনি জানান যে, তাঁর সাথে শংকর রায়ের আলাপ ১৯৬৫ সালে, ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকার প্রকাশনার সময়। তারপর ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর সাথে শংকর বাবুর আলাপচারিতা হয় মার্ক্সবাদ নিয়ে আলোচনার সূত্রে। শোভনবাবু জানান যে, মার্ক্সবাদ নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে শংকর বাবুর হয়তো মনে হয়েছিল যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চিনে যেসব ঘটনাগুলি ঘটে সেগুলি ছিল মানবতাবাদ বিরোধী, এবং এই সূত্র ধরেই তিনি মার্ক্সবাদের ভিন্ন ঘরানা নিয়ে আরও চর্চা এবং আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এরপর শংকর রায়ের পুত্র যুধাজিৎ রায় দুটি রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন। এবং তাঁর পরেই সভার মূল বক্তা কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বর্তমানের মার্ক্সিয় চর্চা নিয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। তিনি শংকর রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন কীভাবে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সাথে শংকর রায়ের সম্পর্ক ছিল। তিনি মনে করেন যে শংকর রায় নিজেই মার্ক্সবাদ চর্চার একটি ঘরানা। তবে মার্ক্সবাদ নিয়ে তাঁর সাথে শংকর রায়ের খুব বেশি কথা না হলেও মার্ক্সবাদ অনুশীলন এবং অনুশীলনের তত্বের মিল নিয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন। তাঁর সাথে শংকর রায়ের আলাপ ১৯৯৫ সালে একটি ওয়ার্কশপে। রাজনৈতিক দিক থেকে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও শংকর রায় একজন উদারমনস্ক মানুষ ছিলেন তার প্রমাণ মেলে বহু জায়গায়। কমরেড দীপঙ্কর তাঁর আলোচনার প্রসঙ্গে চিনের বর্তমান সমাজতন্ত্রের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, পুঁজির বিরুদ্ধে যে লড়াই করতে আমাদের মার্ক্সের কমিউনিস্ট ইস্তাহারেই ফিরে যেতে হবে। আর সাধারণ মানুষ বা সংখ্যাকে, মার্ক্সের কথায়, যদি এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহলে আমরা সেই সংখ্যা নিয়ে পুঁজির মতো একটা কন্সেন্ট্রেটেড পাওয়ারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব। দীপঙ্কর বলেন, রুশ বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে পতন ঘটে তা কখনোই মার্কিন কোনো আক্রমণের জন্য ঘটেনি বরং নিজে থেকেই যেন এটি খসে পড়ল। তাতে কোনো প্রাণ ছিল না। তিনি আরও বলেন যে, যেদিন সমাজতন্ত্র গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে তখনই হয়তো আমরা পুঁজিবাদের বিরোধাভাসে তাকে সমৃদ্ধশালী একটি সমাজতন্ত্রের কথা বলতে পারবো। অর্থাৎ কোনো একটি সমাজে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার যাত্রা শুরু করতে হয় সমকালীন সময়ে যা কিছু বিদ্যমান, তার কাছে যা ইতিহাস দিয়েছে বা সেই সমাজটি যা কিছু পেয়েছে তা নিয়েই গড়তে হবে। ফলে যেকোনো সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য যে জিনিসগুলো রয়েছে সেটা সেই সময়ের সেই যুগের সেই ইতিহাস প্রদত্ত উপাদান নিয়ে তখনকার মতো সর্বোচ্চ মানের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং তা অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য, যা মার্ক্সের কথায় নির্মম সমালোচনা নামে পরিচিত। এর দুটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগে বলা হয়েছে যে, যে সমালোচনায় সেই সমাজ ভয় পাবে না, এবং তাকে অনেক মূল্য দিতে হবে তার জন্য। এবং দ্বিতীয় ভাগটি আরও মারাত্মক। সেটি হল, সমালোচনা থেকে যে উপসংহার বা পরিশেষ আসবে সেটাকেও যদি সমালোচনা করা হয় সেই সমালোচনাটিকেও গ্রহণ করে বেরিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ আত্মসমালোচনাও যদি করা যায় তাহলে তা নিশ্চয়ই একটি উন্নতির দিক। নতুন যুগের মার্ক্সিয় চর্চা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, আজ আমরা যেখান থেকে মার্ক্সকে দেখি সেই সমাজতন্ত্রের একটি সীমাবদ্ধতা আছে, সেখানে হয়তো আমরা পুঁজিবাদকে টেক্কা দিয়েছি কিন্তু উৎপাদনের যে দিকটা আছে, সেটা অনেকটাই পুঁজিবাদের সাথে যুক্ত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃতি বা জলবায়ু সেই দিক থেকে এই জিনিসটা সম্মতি দিচ্ছে না। এবং সেই দিক থেকে মার্ক্সকে চর্চা করা প্রয়োজন। মার্ক্স নিজে সবসময় প্রকৃতির সাথে পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত থাকতে, কথোপকথন করার কথা বলেছেন। হয়তো নতুন মার্ক্সবাদ চর্চাকারীরা নিজেদের আর মার্ক্সিস্ট বলবেন না তাঁরা হয়তো নিজেদের মার্ক্সিয়লজিস্ট বলে পরিচয় দেবেন। শেষে শংকর রায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, শংকর রায়ের মতো এইরকম মানুষ খুব কম যিনি মার্ক্স চর্চাতেও সক্রিয়, জনস্বার্থতেও সক্রিয় ছিলেন। তাই অনেক খারাপের মধ্যেও যেন মানুষ তাঁর নিজের স্বপ্ন দেখতে না ছাড়েন। মানুষ যদি নিজের স্বপ্নগুলোকে হারিয়ে ফেলে তা খুবই বিপজ্জনক। এবং এটিই মার্ক্সবাদের বুনিয়াদি কথা, যা হয়তো শংকর রায় নিজেও মানতেন। তাই ব্যাখ্যা অনুশীলন, পর্যালোচনা এসবের মধ্যে দিয়েও মার্ক্সবাদ নিয়ে চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। এবং মানুষের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে হবে। তা মানবতাবাদ নিয়েও যদি কথা হয় তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। তবে, বর্তমানে পুঁজিবাদ মানবতাবাদকে দাসে পরিণত করেছে। তাই এই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানবতাবাদের লড়াই হয়, এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। কারণ পুঁজিবাদের ভিতরে মানবতাবাদের জন্ম হতে পারে না। বর্তমানের এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে শংকর রায়ের ঘরানাকে অনুসরণ করতে পারি সেই চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি তিনি যেভাবে হাসি মুখে সকলের সাথে মিশতেন সেই চেষ্টাও করতে হবে। এরপর অধ্যাপিকা দীপিকা দত্ত, দীপ্তেন ভট্টাচার্য, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

খুবই ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই স্মরণ সভা হয়, যার সঞ্চালনা করেন নিত্যানন্দ ঘোষ। এআইসিসিটিইউ, উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া, দিগন্ত বলয়-এর যুক্ত উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানটি সংগঠিত হয়।

– অবন্তী ভট্টাচার্য

খণ্ড-30
সংখ্যা-8