প্রচুর ঢাকঢোল পেটানো ‘গুজরাট মডেল’-এর নকশা ক্রমশই আরও কৌতুহলোদ্দীপক হয়ে উঠছে। এবং ২০২৩-এর শুরু থেকে তার গতিধারায় যে বাঁকগুলো এসেছে সেগুলোকে চাঞ্চল্যকর বললে বেশি বলা হয় না।
বছরের শুরুটা হল বেশ নাটকীয়ভাবে, বিবিসির দুই পর্বের তথ্যচিত্র ‘দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’ সামনে আসার মধ্যে দিয়ে। মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বে গুজরাটে গোধরা-পরবর্তী মুসলিম গণহত্যার আখ্যান বিবিসি-র মতো বিশ্বস্তরের মূলধারার মিডিয়ামঞ্চে পুনরায় প্রদর্শিত হওয়ায় কুড়ি বছর আগের ব্যাপক বিস্তৃত স্মৃতি আবার জেগে ওঠে। কুড়ি বছর আগে যখন ভারতের মিডিয়া আজকের মত গোদি মিডিয়ায় পর্যবসিত হয়নি তখন যেসব ঘটনা বহুল প্রচারিত হয়েছিল সেসব আবার জনস্মৃতিতে জেগে ওঠে। তাছাড়া, তথ্যচিত্রটি এতদিন অজানা আরেকটা বিষয়কেও প্রকাশ করে। ব্রিটিশ হাইকমিশন সেই সময় ঐ গণহত্যার তদন্ত করেছিল। এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলা সুপরিকল্পিত হিংস্র অভিযানে নরেন্দ্র মোদীকেই সরাসরি দায়ী বলে জানতে পেরেছিল সেই তদন্ত। আর এই গণহত্যার ধরনের মধ্যে একটি সম্প্রদায়কে নিকেশ করে দেওয়ার সমস্ত বৈশিষ্ট্যই উপস্থিত ছিল। ব্রিটিশ সরকারের তৎকালীন বিদেশ সচিব জ্যাক স্ট্রও এই বিষয়টা সত্যি বলে জানিয়েছেন। তথ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সে সময় নরেন্দ্র মোদী কেবল আক্ষেপ করছেন ‘মিডিয়াকে ঠিকঠাক সামলাতে না পারার’ জন্য, এবং মিডিয়াকে ঠিকঠাক সামলানো বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন কুড়ি বছর বাদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তা পরিষ্কার করে দিলেন যখন তিনি ভারতের তথ্য প্রযুক্তি আইনের অধীনে জরুরি অবস্থার আশ্রয় নিয়ে ভারতের সমাজমাধ্যমে ঐ ভিডিও দেখানো নিষিদ্ধ করলেন এবং তারপর বিবিসির দিল্লী ও মুম্বই অফিসে আয়কর দপ্তরকে দিয়ে তল্লাশি অভিযান চালালেন।
বিবিসি প্রদর্শিত তথ্যচিত্র যদি গোটা দুনিয়ার সামনে মোদী সরকারের প্রকৃত চরিত্রকে উন্মোচিত করে দিয়ে থাকে, তবে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টও আদানি সাম্রাজ্যে এক অর্থনৈতিক ধ্বস নামায়। আদানি গোষ্ঠীর নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ‘ভারতের গর্বের’ সঙ্গে একাকার করে তোলার প্রচেষ্টা এবং হিন্ডেনবার্গরিপোর্টকে ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করাটা ভারতের জনমতের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পায়নি। আর বাস্তবে যেটা হয়েছে তা হল, আদানি কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত চালাতে একগুঁয়েভাবে অস্বীকার করে চলাটা জনগণের নজরকে আরও টেনে নিয়ে গিয়েছে আদানি কেলেঙ্কারির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টির দিকে — আদানি ও মোদীর সাটগাঁটের বাস্তব চিত্রের দিকে। গুজরাট মডেলের দুটো স্তম্ভ — বেলাগাম গণহত্যার রাজনীতি এবং অবাধ কর্পোরেট জালিয়াতি ও লুণ্ঠন — এমনভাবে উন্মোচিত হয়েছে ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে যা আগে কখনও হয়নি।
এখন আবার গুজরাট মডেলের স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো তৃতীয় এক মাত্রার সন্ধান আমরা পেলাম। এই তৃতীয় দিকটি মূর্তরূপ পেয়েছে কিরণ জগদীশভাই পটেলের মধ্যে যাকে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে এক ঠগবাজ হিসাবে। গত কয়েক মাসে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অতিরিক্ত ডাইরেক্টরের ছদ্ম পরিচয়ে জেড-প্লাস নিরাপত্তা নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা অঞ্চল বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করেন! সমাজমাধ্যমে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে স্পষ্টতই জানা যাচ্ছে যে, বিজেপির সঙ্গে এবং ২০১৪ ও ২০১৯-এ মোদীর নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন এবং তিনি দাবি করেন যে, চরম সামরিক সজ্জায় সজ্জিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে ‘উন্নয়ন ও পর্যটনকে’ গতিশীল করে তিনি কাশ্মীরে মোদীর আরাধ্য কাজকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
যে সরকার মিথ্যা দাবির মধ্যে দিয়ে জনগণকে প্রতারিত করায় সবিশেষ দক্ষতা অর্জন করে, মিথ্যাচার উন্মোচিত হয়ে পড়লে যারা নির্লজ্জভাবে ‘জুমলা’ বলে খারিজ করে দেয়, আদানি কেলেঙ্কারির মতো বিশালাকায় কর্পোরেট জালিয়াতি নিয়ে যারা মুখ বুজে থাকে, সেই সরকার যে কিরণ পটেল আখ্যান নিয়েও টুঁ-শব্দটি করবে না তা স্পষ্ট। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এই ধরনের বড় মাপের বিচ্যুতি বা আরও ক্ষতিকারক ঘটনা থেকে যে প্রশ্নগুলো উঠে আসছে সেগুলো অবশ্যই উত্তর দাবি করে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অফিসারের মিথ্যা পরিচয় নেওয়াটা গুজরাটের এক ঠগবাজের পক্ষে স্বাভাবিক ফন্দি হতে পারে, কিন্তু কে তাকে জেড-প্লাস নিরাপত্তা দিল এবং তাও আবার জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্যে? হয় ব্যবস্থাটা এতই নিষ্ফলা যে, কোনো একটা নাম নিয়েই এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগ থাকার ছলনা করেই যে কেউ এরকম ধাপ্পা দিতে পারে। আর সেটাই যদি উত্তর হয় তবে তথাকথিত রণনৈতিক গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে মোদী সরকার যে লম্বাচওড়া দাবি করে থাকে তা কালো টাকা ধ্বংসের জন্যই নোটবন্দী করার দাবির মতো নির্জলা মিথ্যা। অন্যথায় আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, কিরণ পটেল রাষ্ট্রের সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। এই অভিযোগও উঠেছে যে, কিরণ পটেলকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় সে সময় তার দুই সঙ্গিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ঘটা পুলওয়ামার বিস্ফোরণ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনো উত্তর আমরা এখনও পাইনি। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক ভর্তি একটা গাড়ি কী করে উচ্চ নিরাপত্তার একটা কনভয়ে আক্রমণ চালিয়ে চল্লিশ জন সিআরপিএফ জওয়ানকে হত্যা করতে পারল? পুলওয়ামা আক্রমণ থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলোর মতোই আমরা জানতে পারিনি যে, সন্ত্রাসবাদী বলে কথিতদের পার করার সময় গ্রেপ্তার হওয়া ডিএসপি দাবিন্দার সিংকে কেন ভারতীয় রাষ্ট্র শুধু চাকরি থেকে বরখাস্ত করেই ছেড়ে দিল। কাশ্মীর এখন পুরোদস্তুর কেন্দ্রশাসিত এবং প্রবল রূপে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত অঞ্চল এবং দাবিন্দার সিং আখ্যান বা কিরণ পটেল বৃত্তান্তর মতো গুরুতর গোয়েন্দা গাফিলতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিচ্যুতির দায় সরাসরি বর্তায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ওপরই। আর একটা উদ্বেগজনক এবং একই ধরনের কদর্য ঘটনা এই মুহূর্তে পাঞ্জাবে ঘনিয়ে উঠছে অমৃতপাল সিংকে কেন্দ্র করে, পাঞ্জাবে যার উত্থানকে অনেকেই ভিন্দ্রানওয়ালের পরিঘটনার পুনরাবৃত্তি হিসাবেই দেখতে পাচ্ছেন। কিরণ পটেলের ঘটনার ক্ষেত্রে তার সঙ্গীদের ছেড়ে দেওয়া হয়, আর অমৃতপাল সিং ঘটনার ক্ষেত্রে তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে যদিও তিনি নিজে গ্রেপ্তারি এড়াতে সক্ষম হয়েছেন। অমৃতপাল সিং-এর দ্রুত উত্থান ঘটছে দীপ সিধুর উত্তরাধিকারী হিসাবে। এই দীপ সিধু হলেন পাঞ্জাবের এক অভিনেতা যিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রচার করেন এবং কৃষক আন্দোলন চলার সময় ২০২১ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে লাল কেল্লায় ঘটা হিংসার ঘটনায় এক মূল অভিযুক্ত এবং পরে যিনি মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় রহস্যজনকভাবে মারা যান। অমৃতপাল সিং-এর উত্থানের ঘটনাকে পাঞ্জাবে ব্যাপকতর স্তরেই বিশ্বাস করা হচ্ছে ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকের স্মৃতি-উদ্রেককারী সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে রাজ্যটাকে ঠেলে দেওয়ার বৃহত্তর দুরভিসন্ধির অংশ রূপে যে পর্বে পাঞ্জাব খালিস্তানী সন্ত্রাসবাদ এবং রাষ্ট্রের নামানো বিচার-বহির্ভূত সন্ত্রাস ও নিপীড়নের দ্বিমুখী আক্রমণে টলমল করছিল।
‘গুজরাট মডেল’-এর পাক যখন খুলে চলেছে এবং ভারত মোদী-আদানি গাঁটছড়ার বিপর্যয়কর অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠছে, সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান তখন স্পষ্টতই মরিয়া হয়ে উঠে প্রতিটি চ্যুতি রেখাকে কাজে লাগিয়ে নিয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব ও বিভাজনকে গভীরতর করতে চাইছে, এবং ভারতকে আরও একনায়কতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনার লক্ষ্যে তারা সবকিছুই করবে। সজাগ থেকে বিক্ষিপ্ত বা বিভাজিত হতে অস্বীকার করা জনগণের শক্তিশালী ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনই এই দুরভিসন্ধিকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২১ মার্চ ২০২৩)