আবেদন
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস : সমতা, ন্যায় ও সম্মানজনক জীবিকার জন্য লড়ো!
international-women's-day

নারীর স্বার্থবিরোধী কর্পোরেট হিন্দুত্ব হিংসার উপর আঘাত হানো!

বিগত শতাব্দী জুড়ে, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, অর্থাৎ, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে, নারীর আত্মঘোষণাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে। এই দিনটি নারীর অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামের প্রতীক। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম থেকে শক্তি নিয়ে, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন নারীরা এই দিনটিকে সামনে রেখে জীবিকা, সমতা ও ন্যায়ের দাবিতে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শানিয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে, ফ্যাসিবাদের উত্থানের সাথে ইতিহাসের চাকা আজ পিছন দিকে ঘুরছে। বহু রক্ত আর ঘাম দিয়ে আদায় করা ৮ ঘণ্টার কাজের অধিকারের উদযাপন, যা পরে সাম্যবাদী আন্দোলন দ্বারা নামাঙ্কিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে, আজ ফ্যাসিবাদ আর কর্পোরেট শক্তিদের যোগসাজগে চাপিয়ে দেওয়া লেবার কোডের দ্বারা লঙ্ঘিত। সমকাজে সমমজুরি (যা কর্মক্ষেত্রে, লিঙ্গভিত্তিক সমতা নিশ্চিত করার জন্য আশু প্রয়োজন) লাগু করার বদলে, লেবার কোডের বিধান, মজুরির বৈষ্যম্যকে প্রকট করছে। বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়া (যেমন, এন্ড্রোয়েড ফোনের মাধ্যমে প্রত্যেকদিন ডিজিটাল এটেন্ডেন্স নিশ্চিত করা) বাধ্যতামূলক বানিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে, অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত বৃহৎ অংশের মেয়েদের মনরেগা প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ পাওয়ার সুযোগকে দুর্লভ করে দেওয়া হয়েছে, যদিও মনরেগা প্রকল্পের উদ্দ্যেশ্য গ্রামীন গরিব, খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য জীবিকা নিশ্চিত করা। ভারত জুড়ে, লাখ, লাখ মেয়ে, মিড-মে মিল, আশা, অঙ্গনওয়ারী কর্মী হিসাবে, বিভিন্ন সরকারী স্কিমের আওতায় কাজ করছে এবং প্রত্যহ সমাজের উন্নতির জন্য শ্রম দিচ্ছে। অথচ, এদের পারিশ্রমিক হিসাবে এদের হাতে ঠেকানো হচ্ছে নামমাত্র টাকা। সরকারী কর্মী হিসাবে স্বীকৃতিও পাচ্ছে না এরা, যার ফলে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছে। এরাই সেই শ্রমিক, যারা কোভিড মহামারীর সময় নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, তৃণমূল স্তরে, স্বাস্থ্য পরিষেবা, ভ্যাকসিনেশন পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছিলো। স্যানিটাইজেশন কর্মীদের মধ্যে একটি বৃহৎ অংশই নিপীড়িত জাতির মেয়েরা। এরা পৌরসভার আওতায় দেশের রাস্তা-ঘাট পরিষ্কারের কাজ করে, কিন্তু মোদীর ‘স্বচ্ছ-ভারতে’ এদের নূন্যতম মজুরি ও কাজের স্থায়ীকরণ আজও নিশ্চিত নয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেমন, পোশাক রপ্তানি বা ইলেক্ট্রনিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলিতে, মেয়েরা চুড়ান্তভাবে শোষিত হয় এবং সবচেয়ে কম মজুরি পায়। কাজের জায়গায়, শৌচালয়, ক্রেস, মাতৃত্বকালীন ছুটির মতো বুনিয়াদি অধিকারগুলি পান না তারা। সম্প্রতি, মাসিক ঋতুস্রাবের সময় ছুটির জন্য, পড়ুয়া ও শ্রমজীবী মহিলারা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল, কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে, নীতি- নির্ধারকদের দিকে সিদ্ধান্তটি ঠেলে দিয়েছে। আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, মন্দা ও জিএসটির ভারে, গরিব মানুষদের জীবন খাদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে গরিব মেয়েরা, যাদের ভাগে পড়ছে সবচেয়ে কম মজুরি ও অসুরক্ষিত জীবিকাগুলি।

অন্যদিকে, বহু আন্দোলনের ফলে অর্জিত মেয়েদের স্বায়ত্বতা ও স্বাধীনতার অধিকারগুলির উপর হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির ক্রমাগত আক্রমন চালাচ্ছে, কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের লজ্জা যে, বিলকিস বানোকে গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষণ করে, তার সামনেই, তার পরিবারের ১৪ জন সদস্য ও তিন বছরের শিশুকে গুজরাত গণহত্যার সময় খুন করার পর, প্রমাণিত গণধর্ষক ও খুনীদের, ‘সংস্কারী’ ব্যবহারের নামে বেকসুর খালাস করা হচ্ছে, ফুল, মালা, মিস্টি দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হচ্ছে।

ধর্ম পালনের সংবিধান স্বীকৃত অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কর্ণাটকে হিজাব পরিহিতা পড়ুয়াদের উপর আক্রমণ, ইউনিফর্ম সিভিল কোডের নামে মৌলবাদী হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা, প্রকাশ্যে আজান দেওয়ার উপর বিধিনিষেধ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য প্রকাশ্য মিছিল, সমাবেশ, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া, গরু-পাচার রোখার নামে স্ব-ঘোষিত গো-রক্ষকদের দ্বারা মুসলিম যুবকদের জ্বালিয়ে, পিটিয়ে মেরে ফেলা ও ভিডিও তুলে সগর্বে এই হত্যার প্রচার – এসবই ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ফ্যাসিবাদী মোদী সরকারের আগ্রাসনের নমুনা।

বর্তমান ভারতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আঘাত, নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। কিছু সাম্প্রতিক উদাহরণ, “ভারত : মোদী প্রশ্ন” নামের বিবিসির তথ্যচিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা, জনপ্রিয় লোকগায়িকা নেহা সিং রাঠোরকে উত্তরপ্রদেশে বুলডোজার-রাজের সমালোচনা করে ‘ইউপি মে কা বা’ (অর্থাৎ “ইউপি-তে কী চলছে) গান গাওয়ার জন্য পুলিশের নোটিশ ও হয়রানি, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের হুমকি, দেশদ্রোহের দায়ে জেলে ভরা। সনাতন ধর্মের ধ্বজাধারীদের ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিবিদ্বেষের আক্রমনের মুখে সবচেয়ে বেশি পড়ছে ভারতের মেয়েরা। যেমন, সম্প্রতি ১৪ই ফেব্রুয়ারি, প্রেম দিবসকে, গরু জড়িয়ে ধরার দিবস ঘোষণা করেছিল ভারতের অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার বোর্ড। মেয়েদের শরীর নিয়ন্ত্রনে নীতি-পুলিশি উত্তরোত্তর বাড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও পরিবার জুড়ে। মেয়েদের স্বায়ত্ততার অধিকার আজ চরম বিপন্ন।

বিগত ৪০ বছর ধরে, ভারতের নারী-আন্দোলন চেষ্টা করছে মেয়েদের উপর সামাজিক হিংসাকে প্রতিহত করার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ও বিভিন্ন ধরনে এই হিংসা হয়ে থাকে। যেমন, বাড়িতে, কাজের ক্ষেত্রে বা রাস্তায়। বিভিন্ন আইন আসা সত্ত্বেও, এই হিংসাকে প্রতিহত করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের গণতন্ত্র চুড়ান্তভাবে ব্যার্থ তার নাগরিকদের, বিশেষ করে, মেয়েদের সুরক্ষা দিতে। প্রতিটি সামাজিক ক্ষেত্র, যেমন, ধর্মীয়, শিক্ষাঙ্গন, কর্মক্ষেত্র, বিনোদন জগত, প্রতিটি জায়গায়, মেয়েদের আক্রমনের নিশানা বানানো হচ্ছে। দীর্ঘ ৪০ বছর পরেও ভারতে শ্রদ্ধা কাপুরের হত্যার মতো নির্মম ঘটনা ঘটছে। দিল্লীতে নির্ভয়া কাণ্ডের পর মেয়েদের উপর হিংসা বন্ধ করার জন্য ভার্মা কমিটির দেওয়া সুপারিশগুলি আজও লাগু হয়নি। যেমন, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট, সবকটি সংগঠিত ও অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থা বন্ধ করার জন্য হেনস্থা-বিরোধী কমিটির মতো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। সবকটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যেমন, বিচার বিভাগ, আইনসভা, মিডিয়া হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর পিতৃতান্ত্রিক ফতোয়া জারি করার কাজ করছে। কারণ, বর্তমান সময়, মৌলবাদী ফ্যাসিস্টদের অমৃতকাল!

আসুন, আমরা একত্রিত হই, কর্পোরেট হিন্দুত্ব আঁতাতের ফ্যাসিবাদী হিংসার বিরুদ্ধে সংগঠিত হই।

আমাদের দাবি,
১। সমকাজে সমমজুরি চাই
২। স্থায়ী কাজ চাই, আশা, অঙ্গনওয়ারী, মিড-ডে-মিল, স্যানিটাইজেশন, রন্ধন কর্মীসহ সমস্ত শ্রমজীবী মেয়েদের জন্য ন্যুনতম মজুরি চাই
৩। মনরেগা প্রকল্পের আওতায়, বছরে ২০০ দিনের কাজ ও কাজের আবেদন করার জন্য সুবিধাজনক প্রক্রিয়া চাই 
৪। বিলকিস বানোর জন্য ন্যায় চাই
৫। প্রতিটি জেলায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠন করা চাই
৬। সংগঠিত ও অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থা বিরোধী কমিটি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গ সচেতনতামূলক সেল চাই

ফ্যাসিবাদ, পিতৃতন্ত্র, ধর্মীয় মৌলবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও কর্পোরেট-হিন্দুত্ববাদের আঁতাতের বিরুদ্ধে লড়ো!
সাম্যকে আপন করো!

খণ্ড-30
সংখ্যা-4