২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেস্টারের উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে শুরু করে, ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ নামক বিবিসির ডকুমেন্টারি (ভারতে যা কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ ছিল) ও মোদীর ঘনিষ্ঠ দোসর তথা শিল্পপতি গৌতম আদানীর ব্যাপক জালিয়াতির পর্দা ফাঁস হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ব্রিটেনের বামপন্থীদের কাছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। তাঁরা সচেতন হয়েছেন একাধারে, মোদী সরকারের চরম হিন্দু আধিপত্যবাদি শাসন, চূড়ান্ত মুসলিম-বিরোধিতা এবং হিংসাত্মক ও দমনমূলক প্রকৃতি সম্পর্কে। তৎসত্ত্বেও, ব্রিটেনের স্বল্প সংখ্যক মানুষই ভারতের বামপন্থীদের কার্যকলাপ নিয়ে ভাবিত ও জড়িত হচ্ছেন। আমরা প্রত্যেকেই জানি, আন্তর্জাতিকতার জন্যে বাম আন্দোলন ও দলগুলির মধ্যে সমন্বয় ও সংহতি স্থাপন অপরিহার্য।
সাউথ এশিয়ান সলিডারিটি গ্রূপ (মূলত ব্রিটিশ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়) দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের সংগ্রামকে সমর্থন জানায়। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার বিপ্লবী বামপন্থী ও বহুমুখী প্রাণবন্ত জনআন্দোলনের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে চাই। গণতন্ত্রের জন্য, ফ্যাসিবাদকে রোখার জন্য সংগ্রামের দাবিগুলিকে সম্প্রসারিত করতে চাই।
আমাদের মধ্যে কয়েকজন ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের পাটনা শহরে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ১১তম পার্টি কংগ্রেসে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই সম্মেলন ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকার তথা মোদী সরকারের শাসনকে প্রতিহত করার দিকনির্দেশক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাঁদের সম্মেলনের আলোচ্য বিষয়ে ‘প্রতিরোধের’ সংজ্ঞা কেবলমাত্র শ্রমিকদের সংগ্রাম কিংবা বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলির প্রচলিত কার্যকলাপের সাথে জড়িত নয়। সেখানে গুরুত্ব পায় একাধারে জাতপাত বিরোধী সংগ্রাম, পিতৃতন্ত্র বিরোধী লড়াই এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদ বিরোধী সংগ্রাম। বর্তমান ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপির ব্রাহ্মণ্যবাদী মুসলিম-বিরোধী মতাদর্শ ও হিন্দু আধিপত্যবাদী সংগঠনগুলির চালানো নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে এগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারতের বৈচিত্র্যময় বাম পরিসরের মধ্যে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন এক ভিন্ন ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা আন্তর্ভৌম মাওবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন থেকে পৃথক। অন্যদিকে তা, বর্তমানে মূলত দক্ষিণ ভারত ভিত্তিক সিপিআই(এম)’র সংসদীয় রাজনৈতিক কৌশলের থেকেও পৃথক ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, আমরা দেখেছি উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগের চেষ্টায় কিভাবে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের সিপিএম সরকার মুখ থুবড়ে পড়ে।
বর্তমান ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধে সিপিআই(এমএল) উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। কারণস্বরূপ, দুটি বিষয় খুবই নজরকাড়া – প্রথমত, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে আন্দোলনগুলি আজও চিরন্তন তার কেন্দ্রবিন্দুতে অগ্রণী ভূমিকায় থেকেছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের বৃহৎ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারে (এটি ভারতের ‘হিন্দি-বেল্টের’ আওতায় থাকা অন্যতম একটি রাজ্য, যাকে বিজেপির সরকার হিন্দু আধিপত্যবাদের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করে) বিধানসভায় (স্বল্পসংখ্যক হলেও গুরুত্বপূর্ণ) ১২টি আসনে প্রতিনিধিত্ব করে। বিহারে তারা বামদলগুলির মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বিহার নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী মহাজোটে যুক্ত হয়ে, বিহারের মসনদে মোদী সরকারকে ক্ষমতা বিস্তারে বাধ সাধতে সচেষ্ট হয়েছে।
বিহারের রাজধানী পাটনায় সিপিআই(এমএল)’র পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল, বিহার। সেই বিহারের মাটিতেই কান পাতলে বৈপ্লবিক ইতিহাসের কথা ধ্বনিত হয়। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি হিসেবে থেকেছে বিহার। ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনের জন্ম এখান থেকেই, এই মাটিতেই সম্প্রসারিত হয়েছিল ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে ৭০ দশক জোড়া বিপ্লবী নকশালবাড়ি আন্দোলন। যা ঝড় তুলেছিল গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। যে উত্থানকে নির্মমভাবে চূর্ণ করেছিল দমনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। পুনরায় ভূমিহীন, দলিত এবং অন্যান্য নিপীড়িত জাতির ভূমি-মজুরি-মর্যাদা-অধিকারের জন্য গণরাজনৈতিক সংগ্রামের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৮০ দশকে রাম নরেশ রামের মতন দলিত নেতারা বিহারের আন্দোলনের রূপরেখা গড়ে তোলেন।
সিপিআই(এমএল) পার্টি আত্মগোপনে থাকালীন সময়ে সফলভাবে বহু এলাকায় জমিদারদের (এই জমিদারদের নিজেস্ব ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী ছিল যা ছিল হিন্দু আধিপত্যবাদী শক্তি দ্বারা সমর্থনপুষ্ট) মোকাবিলা করেছিল। পরবর্তীতে তারা জমি পুনর্বণ্টন, কৃষি-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, যৌন হিংস্রতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। উচ্চবর্ণের জমিদাররা প্রান্তিক জাতের মানুষদের নিপীড়ন করা তাদের জন্মগত অধিকার বলে মনে করতেন। এই আন্দোলন তার অবসান ঘটিয়েছে, অবসান ঘটিয়েছে ভোটকেন্দ্রের উপর জমিদারদের দমনপীড়ন ও একাধিপত্যের।
একই সময়ে পার্টি গ্রামীণ ও শহুরে শ্রমিক, কৃষক, মহিলা ও ছাত্রদের উন্মুক্ত গণসংগঠন গড়ে তোলার উপর ক্রমবর্ধমান সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে। ১৯৯২ সালে পার্টি নিজেই মাঠে নেমে গ্রামীণ কৃষক, নিপীড়িত জাতিগুলির মধ্যে তাদের ভিত্তি এবং সমর্থন বজায় রেখে এবং সুপরিচিত ছাত্র সংগঠন আইসা, মহিলা সংগঠন আইপয়া, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এআইসিসিটিইউ এবং আয়ারলার মতো গ্রামীণ শ্রমিকদের সংগঠন শক্তিশালী করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থে।
আমরা বিহারে পৌঁছাই পার্টি কংগ্রেস শুরুর একদিন আগে, যোগ দিই সিপিআই(এমএল) আয়োজিত “ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ কর, গণতন্ত্র বাঁচাও” স্লোগানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা একটি গণসমাবেশে।
রাস্তাগুলো মাইলের পর মাইল লাল পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। কাস্তে-হাতুড়ির কমিউনিস্ট চিহ্ন দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। জানতে পারি, পুলিশি হয়রানি এড়াতে রাস্তায় এসব আয়োজন সেরে ফেলতে হয়েছে ভোররাতের মধ্যেই। ভোরের আলোতে আকাশ রাঙিয়ে ওঠার সাথে সাথে পাটনার মাটিতে ভিড় জমতে থাকে মানুষের। তাঁরা মূলত গ্রামীণ দরিদ্র মজদুর-মহিলা, কৃষি শ্রমিক, ক্ষুদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র শিল্পের শ্রমিক, স্কুল ও কলেজের ছাত্র এবং বেকার যুবক। তাঁরা কেউ এসেছেন ট্রেনে, সাইকেলে এবং অনেকে পায়ে হেঁটে।
সমাবেশ স্থলে রাত্রিযাপনের জন্য তাঁদের জিনিসপত্রের পাশাপাশি তাঁরা লাল পতাকা ও ব্যানার এনেছিলেন। তাঁদের মেজাজ ছিল, তাঁদের নিজস্ব দল, মা-লে-এর জন্য শহরের স্থান দাবি করার। সিপিআই(এমএল) বিহারে ‘মা-লে’ নামে পরিচিত।
ইতিমধ্যে ভেনিজুয়েলা, বাংলাদেশ, নেপাল এবং অস্ট্রেলিয়া, ভারতে অবস্থিত ইউক্রেনীয় সমাজতন্ত্রী এবং অন্যান্যদের সাথে অন্যান্য আন্তর্জাতিক অতিথিদের সমাগম শুরু হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের অতিথিদের ভিসা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং শ্রীলঙ্কা থেকে আসা অতিথিরাও সমস্যায় পড়েছিলেন, তাই তাঁরা প্যালেস্টাইন এবং কিউবার আমন্ত্রিতদের মতোই ভিডিওর মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
সমাবেশের দিন, বিস্তীর্ণ গান্ধী ময়দান আনুমানিক ১,৫০,০০০ লোকে পরিপূর্ণ ছিল। বক্তাদের ডাকে, তাঁদের দৃপ্ত কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি সহজে পরাজিত হবে এমন কোনো বিভ্রমের মধ্যে কেউ নেই। কিন্তু এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং জয়ী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে একটি প্রচন্ড তৎপর ও শক্তিশালী শক্তি।
বক্তাদের কথায় উঠে আসে একাধারে, ভারতের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, বিজেপি সরকারের তীব্র মুসলিম ও খ্রিস্টান বিরোধী উন্মাদনা, দলিত নিপীড়িত বর্ণের মানুষদের উপর হামলা, পিতৃতান্ত্রিকতা ও দমনমূলক রাষ্ট্রীয় আক্রমণ ও খর্ব হওয়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।
তাঁরা মোদির কুখ্যাত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করেন যা দেশের মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়। বিজেপি সরকার ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে, যে ধারা কার্যকরভাবে কাশ্মীরকে ভারতের সাথে সংযুক্ত রেখেছিল। এই ধারা বিলোপের মাধ্যমে কাশ্মীরের এতদিনকার সীমিত স্বায়ত্তশাসনটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। নতুন শ্রম-কোড নিয়ে এসেছে মোদি সরকার যা শ্রমিকদের অধিকারকে পদদলিত করছে। বক্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পার্টির বিহার বিধানসভার জনপ্রিয় বিধায়করা। তাঁরা প্রায় সকলেই নিপীড়িত জাতি বা মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্গত এবং পার্টির তৃণমূল স্তরের কাজে অভিজ্ঞ। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শশী যাদব। তিনি স্কিম ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নেতা যা হাজার হাজার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, যারা ‘স্বেচ্ছাসেবক’ স্বাস্থ্যকর্মী, স্কুলের রন্ধনকর্মী এবং ক্রেশকর্মী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাঁরা লড়াই চালাচ্ছেন সরকারি কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য। উপস্থিত ছিলেন গণ-ভিত্তিক মহিলা সংগঠন ও অল-ইন্ডিয়া প্রগ্রেসিভ উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মীনা তেওয়ারি। তিনি মহিলাদের প্রতি আহ্বান জানান, আন্তঃধর্মীয় বিবাহকে অপরাধী করার নতুন আইন এবং মুসলিম ও দলিত মহিলাদের ধর্ষকদের প্রকাশ্যে অভিনন্দিত করার রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার।
সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় স্মরণ করিয়ে দেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং-এর কথা। তাঁকে ব্রিটিশদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। তিনি ‘বাদামী বর্ণের সাহেবদের’ বিষয়ে সতর্ক করে গিয়েছিলেন যারা সাদা সাহেবদের খালি করা চেয়ার অধিগ্রহণ করতে উদ্যত। প্রকৃতপক্ষে আজ সেটাই বাস্তব হয়েছে, কারণ এরাই আদানির মতো কর্পোরেটদের হাতে অভূতপূর্বভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত গণতন্ত্রের রাস্তা সেই গ্রাম থেকে শুরু হয় যেখান থেকে মানুষ সমাবেশে এসেছেন এবং সবচেয়ে নিপীড়িত ও শোষিতদের দাবিতেই তা ধ্বনিত হয়।’
পরের দিন, প্রায় ১,৭০০ জন প্রতিনিধি মধ্য পাটনায় উপস্থিত হয়। তাঁরা কেউ এসেছেন উত্তরে হিমাচল কিংবা দক্ষিণে পন্ডিচেরি থেকে। কেউ কেউ কেরালা, পূর্বে কার্বি অ্যাংলং, আসাম থেকে, পশ্চিমে মহারাষ্ট্র থেকে। প্রাথমিক সেশনের পরে আগত অতিথিদের স্বাগত জানানো হয় একটি প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিনিধিরা বিভিন্ন খসড়া প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনার কাজ শুরু করেন। প্রথম নজরে ভয়ঙ্করভাবে দীর্ঘবলে মনে হলেও, পরে আলোচনা আকর্ষণীয় এবং উদ্দীপক রূপ ধারণ করে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে মতবিরোধ এবং বিতর্ক চলে। প্রতিনিধিরা হিন্দি বা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য রাখেন। অনুবাদকদের একটি দল অসাধারণ গতি এবং দক্ষতার সাথে কাজ করে প্রতিনিধিদের বক্তব্য ইংরেজি এবং হিন্দি উভয় ভাষাতেই প্রয়োজনমতো রূপপ্রদান করেছিলেন।
কর্ণাটকের একজন মহিলা স্যানিটেশন কর্মী ও ইউনিয়ন নেত্রী সাম্প্রতিক কিছু অনুপ্রেরণাদায়ক বিজয়ের বর্ণনা করেন৷ হিমালয়ের কোলের উত্তরাখণ্ড রাজ্য থেকে আগত একজন প্রবীণ পরিবেশবাদী এবং পার্টি কর্মী বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পরিবেশগত ধ্বংসের ভয়ঙ্কর প্রভাব সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। যে প্রভাব সম্প্রতি একটি ঐতিহাসিক শহরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে ফেলেছে এবং ফাটল ও ধ্বসে বাড়িঘর এবং জমি ডুবে গেছে। দিল্লির একজন তরুণ মহিলা ছাত্রকর্মী পার্টিকে এলজিবিটিকিউ+ বিষয়গুলিতে আরও বেশি কিছু করার আহ্বান জানায়৷ অন্যরা ক্ষুদ্র-অর্থায়ন স্কিমগুলির দ্বারা সৃষ্ট ঋণের বিরুদ্ধে চলমান সম্মিলিত আয়োজন নিয়ে আলোচনা করেন। কেউ বা আবার জলবায়ু ন্যায়ের আন্দোলনকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
এই সম্মেলনের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল মোদি সরকারকে ফ্যাসিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা। মোদি শাসন কেবল ‘স্বৈরাচারী’ নয় কারণ এটি ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্টের আদলে তৈরি প্রকাশ্যভাবে ফ্যাসিবাদী একটি ক্যাডার-ভিত্তিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক সংঘের(আরএসএস) অন্তর্গত এবং জবাবাধীন। তাবড় তাবড় হিন্দু আধিপত্যবাদী নেতারা খোলাখুলিভাবে তাদের প্রশংসা করেন এবং ভারতে হিটলার এবং নাৎসিদের অনুকরণে ফ্যাসিবাদ স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন। হিন্দুত্ববাদ প্রচারের স্বার্থে ব্যবহৃত ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ শব্দবন্ধটি একটি ভুল ধারণা, ঠিক যেমন ভাবে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের কোনো চিহ্ন মেলে না। বৈশ্বিক কর্পোরেট পুঁজি ও চলমান কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। এর পাশাপাশি সরকারের নিও-লিবারাল নীতি দেশটিকে ধীরে ধীরে বিদেশী কিংবা ভারতীয় পুঁজিপতিদের হাতে বেচে দিচ্ছে।
সম্মেলনে যোগ দিতে উপস্থিত ছিলেন, বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায়। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে এই সময়ে সকল জাতপাত বিরোধী ও পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনগুলির একত্রিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা। তিনি বলেন, “বর্তমানে চারজন দ্বারা আমাদের দেশ ভারতবর্ষ পরিচালিত হচ্ছে : দু’জন দেশকে বিক্রি করছে (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ), আর দু’জন পুঁজির বিনিময়ে কিনছে : আম্বানি ও আদানি”। বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী হিসেবে শ্রেণিকরণ করা কেবল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন নয়: আগামী দিনের কৌশল পরিকল্পনার জন্যও অপরিহার্য। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে, ফ্যাসিবাদী শক্তির মোকাবিলায় সম্ভাব্য বিরোধী জোট গঠন করা প্রয়োজন, যার মধ্যে বিগত দিনের প্রতিপক্ষরাও থাকতে পারে।
বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যে ফাঁক থেকে গেলেও, সাম্প্রতিককালে গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলি একে একে বিপন্ন হচ্ছে: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচারবিভাগ, ভোটাধিকার। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে বিরোধিদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। মোদীকে নির্বাচনে পরাজিত করতে হলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তথাপি এই সম্মেলন একদিকে ভারত ও বিশ্বব্যাপী উগ্র দক্ষিণপন্থী দলগুলির সাথে দীর্ঘলড়াইয়ের আহ্বান দেয়। অন্যদিকে, সিপিআই(এমএল)’র একাদশ পার্টি কংগ্রেস ডাক পাঠায় এক আমূল পরিবর্তনের : রাজনৈতিক ও সামাজিক দুই ক্ষেত্রেই। এই সম্মেললে প্রতিনিধিরা এই স্বপ্নকেই কীভাবে বাস্তবায়িত করবে তার পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা করেন।
labourhub.com.uk-তে প্রকাশিত।
ছবি প্রতিবেদকের।
ভাষান্তর: অনন্যা চক্রবর্তী