একাদশ পার্টি কংগ্রেসে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও দেশ-বিদেশের অতিথিদের মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। অরুন্ধতী রায়ের মতো প্রখ্যাত লেখিকা ফ্যাসিস্ট-রাজ বিরোধী লড়াই ও সিপিআই(এমএল)-এর পার্টি কংগ্রেসের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করেন। ফ্যাসিবাদকে রুখতে জাতপাত বিরোধী লড়াই ও পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইকে একসাথে চালাতে হবে বলে তিনি মত দেন।
পার্টি ও মহিলা আন্দোলনের নেত্রীদের মধ্যে কমরড মিনা তেওয়ারি, কমরেড শশী যাদব, কমরেড সুচেতা, অধ্যাপিকা ভারতী এস কুমার, ডঃ রতি রাও মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন ১৪ শতাংশ। এসেছিলেন মধ্যবিত্ত, গ্রামীণ কৃষিমজুর, আশা, মিড-ডে-মিল কর্মী, অঙ্গনওয়ারী কর্মী, শিক্ষিকা, ছাত্রী, গবেষক এবং আদিবাসী, সংখ্যালঘু, দলিত ও অন্যান্য অংশের অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, স্তর, বর্গের মহিলারা। বিভিন্ন বয়সের প্রতিনিধিরা ছাড়া এক ঝাঁক তরুণ প্রজন্মের মেয়েরা মঞ্চে এবং সম্মেলনের বিভিন্ন কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে বা অনুবাদকের কাজে যে নিরলস পরিশ্রম করেন তা সত্যিই উল্লেখযোগ্য। মঞ্চে, প্রেসিডিয়ামের কাজেও মহিলাদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছিল সন্তোষজনক।
বক্তব্য ছাড়াও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে সঙ্গীতে, নৃত্যে পারদর্শিতার সাথে অংশ নিয়ে মহিলা সাথীরা মহাধিবেশনকে এক বিশেষ মাত্রা দিতে সাহায্য করেছেন। মীরা চতুর্বেদির গাওয়া ‘স্বপ্ন দেখো না’ শ্রোতাদের আবিষ্ট করে, আবার বাংলার মেয়েদের সমবেত কণ্ঠে নারী মুক্তি, শোষণ মুক্তির গান সম্মেলনকে উদ্দীপ্ত করে। জয়শ্রী দাস ও সাথীদের ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’ সঙ্গীতের নৃত্য পরিবেশন উৎসাহ ব্যঞ্জক।
বাংলা, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের মহিলা সাথীদের আদিবাসী নৃত্য ‘গাও ছোড়োগ নেহি, জঙ্গল ছোড়োগ নেহি’ কিংবা কারো ‘জোহার’ স্লোগানে উঠে আসে জাতিসত্ত্বার দৃঢ় প্রত্যয় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ার আবাহন। আবার কারো ভাষ্যে উঠে এসেছে ফ্যাসিবাদের সাংস্কৃতিক প্রচার অভিযানের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক বিকল্প গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা।
সমাজের বিভিন্ন নিপীড়িত অংশ থেকে উঠে আসা নারীদের বক্তব্যে ছিল বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারীদের আত্মঘোষণার সংশ্লেষ, কেউ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াই’এর উল্লেখ করেছেন। কলকাতার ছাত্রী ত্রিয়াশা শহরে, জনবসতিতে জনশিক্ষার উদ্যোগের মাধ্যমে সংগঠনের বিস্তার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার প্রয়াসের কথা বলেছেন। কেউ বা প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের লড়াইকে কমিউনিস্ট ধারার আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।
বর্তমান সময়ে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল পার্টি কংগ্রেসে।
দেশজুড়ে বিভিন্ন লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তা সে মজুরির দাবিতেই হোক, জমির লড়াই’এই হোক, পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধেই হোক, নারীর উপর চেপে বসা দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-অসাম্যের বিরুদ্ধে মহিলাদের অধিকার, হক ও মর্যাদার দাবিতে সমাজে, ঘরে বাইরে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র মেয়েদের এগিয়ে আসার প্রবণতা ও সচেতন অগ্রগতি আরো সুনির্দিষ্টভাবে পাটি কংগ্রেসের অধিবেশনের বিভিন্ন পর্বে পরিলক্ষিত হল।
শুধু বাইরের জগতে কথায়, ভাষণে প্রগতিশীল কথাবার্তা নয়, ব্যক্তি জীবনেও কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও রাজনীতির অনুশীলন, লিঙ্গ রাজনীতির বিরুদ্ধে, নারীর প্রতি মর্যাদা ও পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা পরিহার করার আকাঙ্খা ও আহ্বান বিভিন্ন মহিলা কমরেডের বক্তব্যে তাদের অভিজ্ঞতায় উঠে আসে। ব্যক্তিগত জীবন ও বৃহত্তর রাজনীতি এই দুই পরিসরের মধ্যে একটা সংহতি তৈরি করতে হবে বলে কেউ কেউ মত দেন।
সমাজে মহিলাদের উপর যে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাগুলো টিঁকে আছে শোষণভিত্তিক ব্যবস্থাগুলোর উপর — অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক ও সংস্কৃতিকভাবে তার বিরুদ্ধে একমাত্রিকভাবে নয়, শুধু লিঙ্গভিত্তিক দিক থেকেই নয়, সামগ্রিক ভাবেই শ্রেণী, জাত, বর্ণ, লিঙ্গভিত্তিক লড়াইয়ের এক সোচ্চার কণ্ঠস্বর এবারের পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত মহিলা প্রতিনিধি ও অতিথিরা তুলে ধরলেন।
তৃণমূল স্তরে যে মহিলা কমরেডরা কাজ করছেন — গ্রাম পঞ্চায়ত স্তরে লড়ছেন বা জেলা পরিষদে নির্বাচনে লড়ছেন, তাদের লড়তে হয় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তারা মোদী/বিজেপির মতো শক্তিকে মেয়েদের অধিকার ও স্বাধীনতার বিরোধী, চূড়ান্ত ক্ষতিকারক এক শক্তি হিসাবে প্রত্যহিক ও জীবন্ত অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করেন। তাদের বক্তব্যে সেই জীবন্ত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি তারা এই পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে তুলে ধরেন।
জমির লড়াই যে মহিলাদের লড়াইয়ের অন্যতম ক্ষেত্র তা উঠে আসে ঝাড়খণ্ডের সাথী কুসুম কুমারীর কথায়। তাদের এলাকায় উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের মানুষদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের জমির লড়াইয়ের ফলে গরিব মানুষ, জনমজুররা (এতে মহিলাদের অংশগ্রহণ যথেষ্ঠ মাত্রায়) নিজেদের জন্য কিছু জমি সংরক্ষণ করতে পেরেছিলেন, আজ উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের মানুষরা সেই জমি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, এবং এতে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত থাকায় ওই উচ্চবর্ণের মানুষদের সহযোগিতা করছে এবং তারফলে মহিলারা তাদের হকের জমি হারাচ্ছেন।
বিজেপি আরএসএস যে মতাদর্শ মেনে চলে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুবাদি চিন্তা চেতনা অনুযায়ী তারা পরিবারের মেয়েদের জমির অধিকার বা হক মেনে নেয় না। এমনকি হিন্দু আইন অনুসারে মহিলারা জমির আইনি অধিকার পেলেও কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ খুব কম। বরং মহিলাদের হাতে যাতে কোনও জমি না যায় তার চেষ্টা চলে পরিবারতন্ত্রের মধ্যেই। যেমন কোনও মহিলার স্বামী মারা গেলে তার সাথে ওই পরিবারের অন্য পুরুষের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় আজও। এই জোর জুলুম চলে, যাতে ওই জমি পরিবারের পুরুষদের মধ্যেই থেকে যায়। দরিদ্র গ্রামীণ মজুর, দলিত এবং মহিলাদের জমির অধিকার আজ মূল স্তরের পার্টি ও নারী আন্দোলনের এজেন্ডা হয়ে উঠছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পশ্চিমবাংলার মহিলাদের কয়েক জনের পক্ষে মিতালী বিশ্বাস পার্টিতে আরো মহিলাদের নিয়ে আসার প্রয়োজন, পার্টির অভ্যন্তরেও মহিলাদের আরো বেশি মাত্রায় সুযোগ, সহযোগিতা ও স্থান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। মহিলাদের রাজনীতিকরণের ক্ষেত্রে পার্টিকে সামগ্রিকভাবে আরো মনোযোগী হতে আহ্বান জানান। পার্টির মধ্যে লিঙ্গসাম্যের জন্য প্রস্তাবিত লিঙ্গন্যায় সেলকে স্বাগত জানিয়ে তিনি এই সেলের কমরেডদের আরো বেশি সংবেদনশীল হওয়ার প্রয়োজন বলে মত দেন।
সামগ্রিকভাবে এবারের পার্টি কংগ্রেসে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি সচেতন, পরিপক্ক এবং উৎসাহব্যঞ্জক।
- ইন্দ্রানী দত্ত