রক্তচোষা শার্দূল যেন ওৎ পেতেই ছিল।
২০১৯-এ লোকসভা ভোটের প্রচারের সময় মোদী পদবি সংক্রান্ত রাহুলের মন্তব্যের দরুন যে মামলা হয়, তা ঝুলেই ছিল। আদানি মোদী-র সম্পর্ক নিয়ে রাহুল লোকসভায় যে বক্তৃতা দেন, তারপরই সেই চার বছর আগেকার ইস্যুটা যেন হঠাৎ প্রাণ ফিরে পেল। রাহুলের বক্তৃতা লোকসভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিলেন স্পিকার। আর ন’ দিনের মধ্যে সুরাতের আদালতে রাহুলের মামলা ‘ ফাস্ট ট্র্যাক-এ চলে যায়। কর্ণাটকে করা মন্তব্যে মানহানি মামলার বিচার হল গুজরাতের সুরাতে। আর, সুরাতের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট মানহানির ফৌজদারি মামলায় রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে দু’ বছরের কারাদন্ডের সাজা ঘোষণা করলেন। আর তার ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই লোকসভার সচিবালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেরলের ওয়েনাড়ের সাংসদ পদ খারিজ করে দিল। এবার শুরু হয়েছে পরবর্তী ঘুঁটির চালের প্রস্তুতি। নিজের পোষ মানা পা-চাটা ভৃত্য কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে আচমকা ওই সংসদীয় আসনে উপনির্বাচনের ঘোষণা! এইভাবে সমগ্র বিরোধী দলগুলোর কাছে কঠোর এক বার্তা দেওয়া – মোদী-বিরোধী যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে যেন তাঁরা তার পরিণতির কথা আগাম ভেবে রাখে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে নির্মম স্বৈরশাসক ইডি আমিনের কথা। তিনি বলেছিলন, “কে বলল আমার দেশে বাক স্বাধীনতা নেই! তবে বাকস্বাধীনতা প্রয়োগ করার পর তোমাদের স্বাধীনতা থাকবে কিনা তার গ্যারান্টি আমি দিতে পারবো না।” এদিকে, আলোচনা ছাড়াই পাস হল ফিনান্স বিল। আর সমস্ত বিতর্ক নির্বাসনে পাঠিয়ে পাস হল এবারের ৪৫,০৩,০৯৭ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব! অতিমারীর সুযোগে আমরা দেখেছিলাম, কিভাবে মোদী সরকার সংসদে একের পর এক বিলগুলোকে পাস করাল আলোচনা বিতর্ক ছাড়াই। গণতন্ত্রের সমস্ত ভড়ংকে ছিন্ন ভিন্ন করে।
পরের পর কিছু ঘটনা ঘটল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। রাহুলের সাংসদ পদ খারিজের বিরুদ্ধে কংগ্রেস রাজঘাটে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিলে দিল্লি পুলিশ তা আটকে দেয়। দিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দপ্তরের বাইরে ১৪৪ ধারা জারি হল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী, প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী জ্যাঁ দ্রেজ, রিচা সিং সহ আরও বেশ কয়েকজন কাজের অধিকার ও নরেগার উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নামিয়ে আনা হামলার বিরুদ্ধে কর্মসূচি নিলে, দিল্লি পুলিশ তা থামিয়ে কয়েকজনকে থানায় আটকে রাখে। “মোদী হঠাও - দেশ বাঁচাও” এই স্লোগানের পোস্টার দিল্লিতে দেখা দেওয়া মাত্র দিল্লি পুলিশ তুমুল সক্রিয়তা দেখিয়ে ১৪৪ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে দু’জন প্রেস মালিক সহ ছ’জনকে গ্রেপ্তার করে দু’হাজারের বেশি পোস্টার বাজেয়াপ্ত করে নেয়। বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি কর্মচারীরা পুরনো পেনসন স্কিম ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ এমনকি ধর্মঘটে সামিল হচ্ছেন। এর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি বিজ্ঞপ্তি জারি করে যে কোনো বিক্ষোভ, প্রতিবাদ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসল।
দেশে একচক্ষু বিচারব্যবস্থার কাছে বিজেপি-কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের জন্য রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। নূপুর শর্মা, কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুরের চরম উস্কানিমূলক বিবৃতি বা ধর্ম সংসদের সেই সমস্ত গেরুয়াধারীরা খোলাখুলি সংখ্যালঘুদের গণ হত্যার আহ্বান জানালেও দেশের আইন তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে না। আইনমন্ত্রী বিচারব্যবস্থা ও কিছু বিচারপতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। বধির ভাবলেশহীন গোদী মিডিয়া ক্ষমতাকে তোষামোদ করতে নিজের গলায় স্বেচ্ছায় শেকল পড়েছে। গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান, স্তম্ভ আজ অচল, অপ্রাসঙ্গিক। গভীর তমসাচ্ছন্ন আমাদের দেশ।
দেশবাসীর মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সংসদে প্রথম প্রবেশ করার আগে মোদী সাষ্ঠাঙ্গে প্রণিপাত করে বলেছিলেন এটা গণতন্ত্রের মন্দির!
গণতন্ত্রকে কন্ঠরুদ্ধ করে কবরে পাঠানোর আয়োজন সেদিনই তিনি শুরু করেছিলেন, আর সাষ্ঠাঙ্গে প্রণিপাত ছিল যেন আগাম শব সাধনা!