জোশীমঠের সামনে এখন অস্তিত্বের সংকট — পাহাড়ের বুকে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এখানকার বাসিন্দাদের। প্রতিদিনই আরো বেশি সংখ্যক বাড়ি, রাস্তাতে ফাটল ধরা পড়ছে। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর একটা প্রতিবেদনে ধরা পড়েছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা। ইসরো আগেই জানিয়েছিল যে, ২০২২’র এপ্রিল থেকে সাত মাসে জোশীমঠের মাটি বসেছিল ৯ সেন্টিমিটার। এখন এটা স্পষ্ট যে, সেই রিপোর্ট উত্তরাখণ্ডের ও কেন্দ্রের শাসকদের কাছে কোনো গুরুত্বই পায়নি। আর ২০২২’র ২৭ ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি আরও সংকটজনক হয়ে ওঠে। ইসরো জানায়, ২০২২’র ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩’র ৮ জানুয়ারি মাত্র এই ১২ দিনেই জোশীমঠের মাটি বসে যায় ৫.৪ সেন্টিমিটার (জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কতৃপক্ষের নির্দেশে ইসরো সেই রিপোর্ট অবশ্য তাদের ওয়েবসাইট থেকে তুলে নেয়)। নিরাপদ নয় বলে অন্তত ১৭টা বহুতল ও হোটেল ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়েছে, কমপক্ষে ৮৭০টা বাড়িতে ফাটল ধরা পড়েছে, বসবাসের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত বলে নির্দেশিত হয়েছে ১৮১টা বাড়ি এবং চূড়ান্ত বিপন্ন ২৫টা পরিবারের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সরকারের ঠিক করে দেওয়া আশ্রয় শিবিরে। সেখানেও মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই, উত্তরাখণ্ডের তীব্র ঠাণ্ডা-বৃষ্টি-তুষারপাতের অসহনীয় পরিস্থিতিতে দিন কাটাতে হচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড তৈরি হয় ২০০০ সালে। নতুন রাজ্যের এই গঠনই শাসকদের কাছে হয়ে ওঠে প্রকৃতিকে লুন্ঠনের, কর্পোরেট লালসা পূরণের এক লাইসেন্স। সেই ১৯৭৬ সাল থেকেই বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবিদরা সতর্ককরে আসছেন যে জোশীমঠকে মাটির নীচে বসে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে উন্নয়ন ভাবনাকে পাল্টাতে হবে, বাড়িঘর ও রাস্তার যথেচ্ছ নির্মাণে লাগাম পরাতে হবে, প্রকৃতির সংবেদনশীলতার সহমর্মি হতে হবে। কিন্তু এইসব সতর্কীকরণকে উপেক্ষা করে চলতে থাকে অপরিণামদর্শী নির্মাণ, উত্তরাখণ্ডের বাইরের কর্পোরেট সংস্থাগুলোও ঐ রাজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘উন্নয়নের’ ফসল কুড়োতে। উত্তরাখণ্ডের সৃষ্টির সময় নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিলেন না, কিন্তু তিনি কেন্দ্রে আসার পর প্রকৃতির ওপর পীড়ন এবং ‘উন্নয়নে’ কর্পোরেট হানাদারির মাত্রা অনেক গুণ বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০০০ সালে রাজ্য গঠনের সময় উত্তরাখণ্ডের রাস্তার নেটওয়ার্কছিল ৮,০০০ কিলোমিটার, এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০,০০০ কিলোমিটারে! নরেন্দ্র মোদী বদ্রিনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনেত্রী, হিন্দুধর্মের এই চার বিশিষ্ট দেবালয়কে পারস্পরিক ভাবে সংযোজিত করার চারধাম প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ২০১৬’র ২৭ ডিসেম্বর। প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯০০ কিলোমিটারের বেশি জাতীয় সড়কের এই প্রকল্পের পিছনে শুধুই উন্নয়ন ভাবনা কাজ করেছিল, তারমধ্যে হিন্দুভাবধারাকে তুষ্ট করে ভোটলাভের অভিপ্রায় ছিল না — এটাকে আজ কেউই সত্যি বলে মানতে চাইবেন না। প্রসঙ্গত, সরকার পরিবেশবিদ রবি চোপরাকে চারধাম সংযোগকারী প্রকল্পের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির চেয়ারম্যান করেছিল, তিনি এই প্রকল্পকে হিমালয়ের ওপর হামলা বলে অভিহিত করে ২০২২’র ফেব্রুয়ারিতে ঐ কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। উত্তরাখণ্ডে হড়পা বানের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। রাজ্য গঠনের আগে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯’র মধ্যে বড় ধরনের হড়পা বান হয়েছিল মাত্র চারটে। পরবর্তী এক দশকে (২০০২ থেকে ২০১২) ঐ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২। হড়পা বানের এই আধিক্যের পিছনে কারণ হিসাবে থাকছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের যথেচ্ছ নির্মাণ, যে নির্মাণের জন্যই ২০১৩’র বন্যা যা উত্তরাখণ্ডে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘনিয়ে তোলে, তাতে মারা যায় ৬,০০০ মানুষ এবং তারসাথে অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতিও হয়। রবি চোপরার নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের রিপোর্টে ২৩টা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে বন্ধ করার পরামর্শদিয়েছিল, সেই পরামর্শেকান দেওয়া হয়নি। আজকের জোশীমঠ বিপর্যয়ের পিছনেও স্থানীয় জনগণ তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে দায়ী করেন যথেষ্ট দীর্ঘসুড়ঙ্গ খননের জন্য। সূচনার সময় স্থানীয় জনগণ এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় সেখান থেকে ২৫০ কিমি দূরে দেরাদুনে এবং নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় এনটিপিসি’কে যারা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পেই অভিজ্ঞ। বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দা রিতু শাহ বলেছেন, “সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। ওরা দেবদেবীর ওপর নির্ভর করছে। বাস্তব ঘটনা এটাই যে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সুড়ঙ্গ খনন ও রোপওয়ে জোশীমঠের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। কোন সরকার এসব করেছে তা আমরা জানি না, কিন্তু আমরা এটা জানি যে বর্তমান সরকার আমাদের নিয়ে ছেলেখেলা করছে।”
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো রোপওয়েও নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়ন ভাবনায় জোরালোভাবেই ঠাঁই করে নিয়েছে। উত্তরাখণ্ডে রোপওয়ে প্রথম চালু হয় ১৯৯৪ সালে মূলায়ম সিং জমানায়, জোশীমঠ থেকে আউলি পর্যন্ত ৪.৫ কিমি দূরত্ব অতিক্রমের। সম্ভবত এর থেকেই প্রেরণা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ২০২২’র ২১ অক্টোবর দুটো রোপওয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন — পরিকল্পনা অনুযায়ী একটার দূরত্ব অতিক্রম করার কথা ছিল ১১ কিমি, রুদ্রপ্রয়াগ জেলার গৌরকুণ্ড থেকে কেদারনাথ, আর অন্যটার দূরত্ব অতিক্রম করার কথা ছিল ১৩ কিমি, চামোলি জেলার গোবিন্দঘাট থেকে হেমকুণ্ড সাহিব। নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, এই দুটো রোপওয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য অনেক দেশই তাঁর ওপর খুশি হবে। মূলায়ম জমানায় চালু হওয়া রোপওয়ে যে নরেন্দ্র মোদী পরিকল্পিত এই রোপওয়েগুলোর পাশে ম্লান হয়ে যেত তা বলাই বাহুল্য। তবে, স্থানীয় জনগণ রোপওয়ে সৃষ্ট ক্ষতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখানোয় মূলায়ম জমানার রোপওয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, এবং মোদীর মস্তিষ্ক প্রসূত রোপওয়েগুলোর চালু হওয়ার আশু সম্ভাবনাও একেবারেই ক্ষীণ।
উত্তরাখণ্ডের আজকের বিপর্যয়ে আদালতগুলোও তাদের দায়কে অস্বীকার করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট চারধাম প্রকল্পের অধীনস্থ রাস্তাকে চওড়া করার সরকারের আর্জিতে সায় দেয়, আরও বনভূমি ধ্বংস, পাহাড়ের মাঝে আরও বিটুমিন ও কংক্রিট জমা হওয়ার আয়োজনে সায় দেওয়ার এই রায়ে উপেক্ষিত থেকে যায় প্রকৃতির ক্ষতির সম্ভাবনার প্রতি সুবিচার। আর উত্তরাখণ্ডের হাইকোর্ট যেন বিজেপি সরকারের স্বার্থসিদ্ধিতেই ব্যস্ত। তারা যেমন হলদোয়ানির ৪,০০০ পরিবার বা ৫০,০০০ মানুষকে উৎখাতের এবং প্রয়োজনে সেনার সাহায্য নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল (সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তা অবশ্য স্থগিত হয়), তেমনি কিছু আবেদনকারীর আবেদনকে খারিজ করে তাদের ওপর জরিমানা আরোপও করেছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভয়াবহ হড়পা বানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর কিছু মানুষ সুরাহা চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। আবদনকারীদের মধ্যে ছিলেন চিপকো আন্দোলনের ধাত্রীভূমি রেনি গ্রামের বাসিন্দারা এবং জোশীমঠ বাঁচাও সংগ্রাম কমিটির নেতা ও সিপিআই(এমএল)-এর উত্তরাখণ্ড রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড অতুল সতি। আবেদনে তাঁরা জানান, তপোবন-বিষ্ণুগড় ও ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে এবং হেলাং-মারওয়ারি বাইপাসের নির্মাণকে অবিলম্বে স্থগিত করা হোক, এবং বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্ৰস্ত সমস্ত জনগণকে পুনর্বাসন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হোক। হাইকোর্ট সেই আবেদনকে শুধু খারিজই করেনি, আবেদনকারীদের কায়েমি স্বার্থের হাতের পুতুল বলে অভিহিত করে তাদের ওপর জরিমানাও চাপায়।
জোশীমঠের মর্মান্তিক বিপর্যয়ে সরকারের দায়িত্বজ্ঞানের অভাবই প্রকট হয়েছে। জনগণের দুর্দশার সুরাহা করার পরিবর্তে তাঁরা বেশি তৎপর হয়েছেন তথ্য ধামাচাপা দিতে, বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘোরাতে। জনগণও ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবিতে লাগাতার প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন। জোশীমঠের রাস্তার ধারে, দেওয়ালে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় সর্বত্রই পোস্টারে দেখা যাচ্ছে শ্লোগান — “এনটিপিসি গো ব্যাক”। গত ১৯ জানুয়ারি সিপিআই(এমএল)-এর ডাকে জোশীমঠের জনগণের অস্তিত্বের সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানাতে সারা রাজ্যে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। সিপিআই(এমএল) আটদফা দাবি জানিয়ে সরকারের কাছে এক স্মারকলিপি পাঠায়। ঐ দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটা হলো — জোশীমঠের জনগণের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারকে অবিলম্বে শুরু করতে হবে; তপোবনবিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এনটিপিসি যে সুড়ঙ্গ খনন করেছে সেটাই জোশীমঠের বিপর্যয়ের কারণ এবং তারজন্য এনটিপিসি’কে জরিমানা করতে হবে; নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নতুন জোশীমঠ শহর নির্মাণের জন্য কেন্দ্র সরকারকে উচ্চ পর্যায়ের উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরি করতে হবে; হিমালয় অঞ্চলে পঞ্চেশ্বরের মতো বিশাল বাঁধ নির্মাণ চলবে না; হিমালয়ের সংবেদনশীল প্রকৃতিকে মাথায় রেখে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী উন্নয়নের জন্য নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্ৰহণ করতে হবে। গত ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ জোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতির ডাকে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা ও এনটিপিসি’কে রাজ্য থেকে বহিষ্কারের দাবিতে ৫,০০০ জনগণ এক বিক্ষোভ মিছিলে শামিল হন। তপোবন ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনগণ সিংহের ওয়ার্ডের ভেদ ভেজাল মাঠে সমবেত হন এবং যেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
জোশীমঠের বিপর্যয় দেখিয়ে গেল, এটা মূলত সেই সব শাসকদেরই কর্মকাণ্ডেরই ফসল, যাদের কাছে দুর্নীতিপরায়ণ, কর্পোরেট লালসার চরিতার্থতা সর্বাধিক গুরুত্ব পায়, জনগণের দুর্দশায় যারা নির্বিকার থাকে এবং ভোগ করে লাগামহীন ক্ষমতা। প্রশাসন-কর্পোরেট গাঁটছড়া শুধু জোশীমঠ ও উত্তরাখণ্ডের জন্যই নয়, সারা ভারতের কাছেই বিপদ সংকেত বহন করছে। ভারতকে এই গাঁটছড়ার কব্জা থেকে বার করে আনতে হবে, আর তখনই উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বিপর্যয়মুখী হওয়া থেকে মুক্ত হবে। উত্তরাখণ্ড যে লড়াইটা শুরু করেছে সেই লড়াই কর্পোরেট লোলুপতা ও স্বৈরাচারী প্রশাসনের শক্তিগুলোকে মুখের মতো জবাব দিক, সুস্থায়ী উন্নয়ন ও সংবেদনশীল গণতন্ত্রের লড়াইয়ে উদ্দীপনার সঞ্চার করুক।