২০২৩-২৪’র কেন্দ্রীয় বাজেট বিজেপির মার্কামারাই এক বাজেট, যাতে বড় বড় কথা বলা হয়েছে কিন্তু ইতিবাচক ফলাফল নিম্ন মানের। ২০১৪ থেকে যত বাজেট হয়েছে সেগুলোর প্রতিটিতেই কিছু নতুন চটকদার বুলি আনা হয়েছে, এবারের বাজেটে আমরা পাচ্ছি ‘সপ্তঋষি’কে যা আমাদের অমৃতকালের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত করছে। কিন্তু আমরা যদি ‘একনজরে বাজেট’এর দিকে তাকাই তবে তারমধ্যে দেখতে পাব সরকারের দেওয়া অতীতের সেই সমস্ত প্রতিশ্রুতিকে যেগুলোর কোনোটাই এখনও পূরণ হয়নি, যেমন, ‘সকলের জন্য বাড়ি’, ‘কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা’, ‘পরিকাঠামো ক্ষেত্রে পাঁচ বছরে এক লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ’, ‘২০২৪ সালের মধ্যে পাঁচ ট্রিলিয়নের অর্থনীতি করে তোলা’, ইত্যাদি।
২০২৩’র বাজেটে সিজিএসটি যত সংগ্ৰহ হবে বলে আনুমানিক হিসাব দেওয়া হয়েছে তা প্রত্যক্ষ কর্পোরেট করের চেয়ে বেশি। ধনী এবং সুবিধাভোগীদের ওপর কর চাপাতে সরকারের অনাগ্ৰহ এই বাজেটেও দেখা গেল, কেননা, ক্রমবর্ধমান বিপুল অসাম্যের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থশাস্ত্রীরা সম্পদ ও উত্তরাধিকারের ওপর করের পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেও অর্থমন্ত্রী তা চালু করতে অস্বীকার করেছেন।
যুবকদের মধ্যে বেকারি ও আধা-বেকারি নিয়ে প্রবল ক্ষোভ থাকায় আশা করা গিয়েছিল যে সরকারি দপ্তরগুলির অথবা কেন্দ্র-চালিত প্রকল্লগুলির শূন্য পদগুলি পূরণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হবে, কিন্তু বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না।
রাস্তার সাধারণ জনগণ ও যুবকরা, কৃষক ও শিল্প শ্রমিকরা যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি সেগুলোর সমাধানের কোনো দিশা বাজেটে নেই। পণ্যের মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও বেকারির প্রশমনের কোনো পরিকল্পনা বাজেটে দেখা গেল না, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যগুলির জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে বাজেটে একটা শব্দের উল্লেখও হলো না। বিপরীতে দেখা গেল যে এফসিআই’কে দেয় খাদ্য ভর্তুকির সংশোধিত আনুমানিক পরিমাণ ২,১৪,৬৯৬ কোটিকে ছেঁটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১,৩৭,২০৭ কোটিতে; এনএফএসএ’এর অধীনের ভর্তুকিরও হ্রাস ঘটিয়ে ৭২,২৮৩ কোটি থেকে করা হয়েছে ৫৯,৯৭৩ কোটি। ইউরিয়ার জন্য প্রদেয় ভর্তুকি ১,৫৪,০৯৮ কোটি (সংশোধিত আনুমানিক পরিমাণ) থেকে নেমে এসেছে ১,৩১,১০০ কোটিতে। পুষ্টি-ভিত্তিক ভর্তুকিতেও কাটছাঁট করা হয়েছে। অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় প্রকল্প পিএমকিষাণ-এ বরাদ্দ করা হয়েছে ৬০,০০০ কোটি, যেখানে বর্তমান বছরে ঐ প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছিল ৬৮,০০০ কোটি।
শ্রমিকরা নিয়মিত কাজ না পাওয়ায় গ্রামাঞ্চল এখনও সংকটের কবলে, এ’সত্ত্বেও এ’বছরের সংশোধিত আনুমানিক পরিমাণের তুলনায় একশ দিনের কাজের বাজেটকে হ্রাস করে নামিয়ে আনা হয়েছে ৬০,০০০ কোটিতে।
উল্লেখ্য যে, সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য সামূহিক কর্মসূচিতে বরাদ্দ হয়েছে ৬১০ কোটি, যেখানে এ’বছরের অর্থবর্ষে ঐ খাতে বরাদ্দ হয়েছিল ১,৮১০ কোটি।
মূল্যস্ফীতির হার যথেষ্ট বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাজেটে সাধারণ জনগণের ব্যবহার্য পণ্যে অপ্রত্যক্ষ কর লাঘবের ব্যবস্থা করা হয়নি। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে জনগণ আয়কর ছাড়ের প্রত্যাশা করছিলেন তাঁদেরও আতান্তরের মধ্যে ফেলা হয়েছে, কেননা, যাঁরা নতুন আয়কর ব্যবস্থার মধ্যে যাবেন কেবলমাত্র তাঁরাই আয়কর ছাড়ের কিছু সুবিধা পাবেন। সরাসরি পাঁচ লক্ষ টাকা করমুক্ত হওয়ার যে প্রত্যাশা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমস্ত আয়কর দাতার ছিল, অর্থমন্ত্রীর কাছে তার কোনো অনুরণন হয়নি। অধিকন্তু, বেতনভোগী কর্মচারীদের এবার থেকে প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে অর্থ দিতে হবে, তাঁরা বাড়ি কেনা বা তৈরির জন্য ঋণ নিতে পারেন এবং চিকিৎসা বীমার প্রিমিয়াম দিতে পারেন, কিন্তু তারজন্য কর ছাড়ের কোনো সুবিধা তাঁরা আর পাবেন না।
বাজেট বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বরাদ্দ ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৯,০০০ কোটিরও বেশি করা হয়েছে বলে জোর দেওয়া হয়েছে। বাস্তব ঘটনা হলো ২০২১-২২ অর্থবর্ষে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯০,০২০ কোটি টাকা! এই মার্কামারা আর্থিক কারচুপিই শাসক দলের অর্থনৈতিক নীতি ও বাজেট তৈরির বিশেষ কসরত হয়ে উঠেছে।
জনগণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যয় করলে বাজেটে সুরাহার কোনো ব্যবস্থা নেই, কেননা, বরাদ্দ ততটুকুও বাড়ানো হয়নি যা মূল্যস্ফীতির ক্ষতিটুকু পূরণ করতে পারে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয়ে ১০ লক্ষ টাকা বৃদ্ধিকে সমস্ত সংকটের সুরাহা বলে চালানো হচ্ছে। জিডিপির ওপর নিম্নমুখী চাপ সামলানোর লক্ষ্যে মূলধনী ব্যয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দে ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি যে বহুবিধ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে তা ঘটবে বলে মনে হয় না।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, পণ্যের মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার, সুদের হার এবং স্তিমিত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মুনাফার সম্ভাব্যতার পরিমাণ থেকে সংকেত পেয়ে বেসরকারি মূলধনী ব্যয় বাস্তবে ঘটবে বলে মনে হয় না প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ এবং বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ওপর নির্ভরতার কারণে। প্রয়োজনটা ছিল স্থায়ী অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক ধারায় সমষ্টিগত চাহিদার বৃদ্ধিতে মদত প্রদান যেটা বাজেট দিতে পারেনি।
এ’সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এবং অর্থমন্ত্রীর ভাষণে দাবি করা হয়েছে যে অর্থনীতি অতিমারীর ধাক্কাকে কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবটা হলো এই যে, ধাক্কাটা সম্পূর্ণ রূপে কাটিয়ে ওঠা যায়নি, আবার এমন ধারায় তা হয়নি যাতে শ্রমিক, কৃষক এবং কঠোর পরিশ্রমকারী ভারতীয়দের কল্যাণ সুরক্ষিত হয়েছে। অতিমারীর সময় বিজেপি সরকার যে আপডা মাই অবসর মডেল গ্ৰহণ করে তা বেসরকারিকরণ, সরকারি সম্পদের বিক্রি এবং অর্থনৈতিক বোঝা সাধারণ জনগণের ঘাড়ে পাচার করার কারণে কোভিড বছরগুলোতে আয়ে সামঞ্জস্যহীন ফারাক ঘটিয়েছে। লকডাউন কালে পরিযায়ী শ্রমিক, দিনমজুর ও কৃষকদের দুর্দশা বাড়লেও মোদী সরকারের ঘনিষ্ঠ সাঙাতদের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অক্সফ্যাম’এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট দেখিয়েছে যে ভারতের সবচয়ে ধনী ব্যক্তিদের ৫ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের সম্পদের ৬০ শতাংশ আর একেবারে নীচের ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদ যদিও মোট জিএসটি’র ৬৪ শতাংশই আদায় করা হয় তাদের কাছ থেকে।
২০২১-২২ অর্থবর্ষের জিডিপি পরিসংখ্যান অতিমারী পূর্ববর্তী অর্থবছর ২০১৯-২০’র প্রায় সমান স্তরের। গতবছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় পূর্বাভাস ছিল যে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধি ঘটবে ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশ হারে, কিন্তু এখন ঐ হার সংশোধিত করে হ্রাস করা হয়েছে ৭ শতাংশে। এই বৃদ্ধি আবার শুধু অর্থবর্ষ ২০১৯- ২০’র জিডিপির ভিত্তিতে যে বছর অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটেছিল ৪ শতাংশেরও কম হারে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে প্রকৃত বৃদ্ধির হার হবে ৬ থেকে ৬.৮ শতাংশ, আর নমিনাল জিডিপির আনুমানিক বৃদ্ধির হার হবে ১১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার সাম্প্রতিক সময়ে লাগাতারভাবে ৬ শতাংশের বেশি হতে থাকায় স্ফীতিহ্রাসককে নিম্নসীমায় নির্ধারণ করা হয়েছে বলে মনে হয় যার ফলে জিডিপি বৃদ্ধির হারকে কিছুটা উৎকৃষ্টতর দেখাচ্ছে। বাস্তবে তার রূপায়ণ কি হয় তা যে কেউই দেখতে পাবেন। কিন্তু এই পরিসংখ্যানগুলোকে অতিরঞ্জিত বলেই গ্ৰহণ করতে হবে, কেননা নগদ সরবরাহ সম্ভবত নিয়ন্ত্রিত হবে, চলতি খাতে ঘাটতি বেড়ে যাবে, দুর্বল টাকা বৃহত্তর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যেখানে কর্মনীতির পরিমার্জনার অবকাশ সীমিত হবে এবং তা বিশেষভাবে হবে সরকারের হাত নয়া-উদারবাদী নীতির কাঠামোয় শৃঙ্খলিত থাকায় আর্থিক ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রিত করার চাপ থাকার কারণে যার আনুমানিক হার বেশ কিছুটা বেশি হয়ে হবে জিডিপির ৫.৯ শতাংশ।
৪৫ লক্ষ কোটি আয়তনের বাজেটের মধ্যে অতীতে নেওয়া ঋণের জন্য ১০.৮০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ঋণ গুণতে হওয়ায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির জন্য আরও ঋণ নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে।
জনগণের প্রত্যাশা ছিল অর্থনৈতিক অসাম্যের প্রশমন হবে, জন পরিষেবাগুলোতে সরকারি ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে এবং উচ্চ হারের মূল্যবৃদ্ধি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে — কিন্তু ২০২৩’র বাজেট এসবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
- সিপিআই(এমএল), কেন্দ্রীয় কমিটি