(আসন্ন একাদশতম পার্টি কংগ্রেসের এই রাজনৈতিক খসড়া প্রস্তাবনা প্রকাশ করা হল। — সম্পাদকমণ্ডলী)
১) বর্তমানে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামো এবং ভারতীয় জনগণের জীবিকা ও অধিকারগুলির উপর ঘনীভূত আক্রমণের এক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে চলেছি যার সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের উপর অপরিসীম কর্পোরেট লুণ্ঠন। তিন দশক আগে যে দুই যুগ্ম গতিপথ উন্মুক্ত হয়েছিল — যার একটি হ’ল উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ ও বিশ্বায়নের এক নয়া উদারনৈতিক নীতিমালা, আর অন্যটি হ’ল আগ্রাসী হিন্দুত্ব বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে হিন্দুশ্রেষ্ঠত্ববাদের দ্বারা পুনঃসংজ্ঞায়িত করা — একত্রে মিশে গিয়ে ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে এবং সেই থেকে সরকার প্রণালীবদ্ধভাবে এই দ্বিফলা কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে চলেছে। ২০১৯এ মোদী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর এই অভিযান রীতিমতো গতি লাভ করেছে এবং সামনেই ২০২৪’র নির্বাচন এবং ২০২৫এ আরএসএসের শতবর্ষের মুখে আমরা এই বিপদের ভয়াবহ মাত্রার বৃদ্ধির সম্মুখীন।
২) সংবিধানের মূল মর্মবস্তু ও কাঠামোকে অগ্রাহ্য করে সন্দেহজনক পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেই হোক অথবা সংসদীয় বা বিচারবিভাগীয় যাচাই প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে গিয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারির মাধ্যমেই হোক — সংবিধানের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ নামানো হয়েছে। ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত সবকটি মূল সংজ্ঞা — সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক — ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে। প্রতিবেশি দেশগুলি থেকে আসা অভিবাসীদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে পৃথকীকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ইডব্লিউএস (আর্থিকভাবে দুর্বল অংশ) সংশোধনীতে সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য তথাকথিত সংরক্ষণের আওতা থেকে এসসি/ এসটি/ওবিসিদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ৩৭০ ধারা বাতিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা অবলুপ্তি জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণকে ঐতিহ্যবাহী সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে যা রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করার এক অশুভ সংকেত। ইন্দো-বাংলাদেশ ও ইন্দো-পাকিস্তান সীমান্তের ৫০ কিলোমিটার আভ্যন্তরীণ এলাকার মধ্যে বিএসএফকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির নিজস্ব এক্তিয়ারকে অস্বীকার করে, যা আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারের মধ্যে বড়সড় অন্তর্ঘাত।
৩) শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পৃথক পৃথক ক্ষমতার এক্তিয়ার এবং কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন আমাদের সাধারণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোর প্রধান অঙ্গ। মোদী জমানায়, শাসন বিভাগ ক্রমাগত আইনসভা ও বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে গ্রাস করছে। সরকার নিয়ম করে অধ্যাদেশ জারি করছে এবং সংসদে কোনো আলোচনা ও নিরীক্ষণ বাদ দিয়েই বিল পাশ করা হচ্ছে। যে নির্লজ্জতার সাথে বিধায়কদের কেনা হচ্ছে, সরকারগুলিকে ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে এবং অ-বিজেপি দল দ্বারা চালিত রাজ্য সরকারগুলিকে অকার্যকরী ও অস্থিতিশীল করার জন্য রাজ্যপালের দপ্তরগুলিকে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা সংবিধানের মধ্যে অন্তর্ঘাত সৃষ্টির আর এক বিপজ্জনক সংকেত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ও কেন্দ্রীয় (সরকারী) চাকরির ভর্তি, নিয়োগ ও আধিকারিকদের মোতায়েন করার ক্ষেত্র ও প্রক্রিয়ার যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিসরে অনুপ্রবেশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে, রাজ্যগুলিকে অসুবিধায় ফেলে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। জিএসটির মাধ্যমে রাজস্বের কেন্দ্রীভবন রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ভারতের নির্বাচন কমিশনকে পছন্দসই আমলাদের দ্বারা কুক্ষিগত করা এবং সেনাবাহিনীকে অগ্নিপথ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্গঠন করার ঘটনায় সরকারের অভিপ্রায় খুবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যা থেকে বলাই যায় যে সে এবার বিচার বিভাগীয় নিয়োগের ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ জারি করতে চায়। আইনমন্ত্রী তো সংসদ কক্ষে দাঁড়িয়ে জামিনের আবেদন গ্রহণ ও জনস্বার্থ মামলায় সম্মতিদানের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন।
৪) ক্ষমতার বল্গাহীন কেন্দ্রীভবন কার্যত সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থাকে মার্কিন ধাঁচের রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ক্ষমতার প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল — এই ত্রয়ীকে নিয়ে যেন গঠিত হয়েছে মোদী সরকারের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণের রণনৈতিক কেন্দ্র। নোটবন্দি ও জিএসটি থেকে লকডাউন ও কৃষিকানুন সমূহ — এ’রকম বহু উদাহরণ আছে যেখানে দেখা যায় কোনো রকম প্রতিষ্ঠানগত আলোচনা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ঘোষণা করেছেন। জম্মু ও কাশ্মীরের বেলায়, অমিত শাহ তাঁর আকস্মিক ঘোষণার দ্বারা সংসদকে চমকে দিয়ে রাজ্যটির সাংবিধানিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন এবং রাজ্যের মর্যাদা হরণ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিভাজিত করে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে অবনমিত করেন। অগ্নিপথ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সর্বোচ্চ প্রধান যিনি সৈন্যদের চাকরি ও নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ন করে, তার পরিবর্তে স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা বর্জিত স্বল্পকালীন চুক্তির ভিত্তিতে অস্থায়ী সৈনিক নিয়োগের ভাবনার বিরোধিতা করেছিলেন — দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু ঘটার পর, লকডাউনের সুযোগ নিয়ে সরকার এই প্রকল্পটি (অগ্নিপথ) ঘোষণা করেছিল। মোদীর নিজের কথাতেই, সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তরিত করার জন্য এই সমস্ত পদক্ষেপই ছিল সরকারের রণনীতির অঙ্গ।
৫) বিজেপি কর্তৃক সংবিধান অবমাননাকে প্রায়শই সংবিধান উদযাপনের মোড়কে আড়াল করা হয়। ২০১৫ থেকে, মোদী সরকার সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিনটিকে সংবিধান দিবস হিসাবে উদযাপন করে চলেছে আর এই সুযোগে সে আমাদের সংবিধানের মূল্যবোধ ও দিশার সম্পূর্ণ বিপরীতে তার (নিজস্ব) সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার চালায়। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীকে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ বলে উদযাপনের পর, সরকার ২০৪৭ সাল পর্যন্ত আগামী পঁচিশ বছরকে অমৃতকাল বলে চিহ্নিত করেছে আর নরেন্দ্র মোদী তাকে কর্তব্যকাল বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন — যেখানে নাগরিকদের কর্তব্য হবে সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া। ভারতকে গণতন্ত্রের জননী বলে চিত্রিত করে ২০২২এ সংবিধান দিবস পালন করা হয় এবং এতদুপলক্ষ্যে চর্চার জন্য যে নোট প্রচারিত হয় সেখানে ভারতীয় গণতন্ত্রকে এক প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার দ্যোতক বলে বর্ণনা করা হয়, আর এভাবে ভারতের জাত প্রথার যে বাস্তবতা তাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। অথচ এই জাতপ্রথাকেই সমস্ত প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারকরা সামাজিক দাসত্ব বলে চিহ্নিত করেছেন আর ব্যক্ত করেছেন যে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতার বিষময় প্রভাব ভারতীয় সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। বিপরীতে মোদী সরকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা ও বহু ধর্মীয় ভারতীয় সমাজের বর্ণময় সমন্বয়কে আড়াল করে হিন্দুত্বের একমাত্রিক চিত্র হাজির করে চলেছে।
৬) ১৯৯০’র দশকে বিজেপি প্রথম যখন জাতীয় স্তরের কোয়ালিশন গঠন করে, তখন সে তার তিন বিতর্কিত কর্মসূচিকে — রামমন্দির, ৩৭০ ধারা ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মুলতুবি রাখতে সম্মত হয়। আজ বিজেপি তার এই কর্মসূচিকে কেবল বাস্তবায়িত করতেই ব্যস্ত তা নয়, সে তাকে সুচারুরূপে প্রসারিত করে চলেছে। সর্বোচ্চ আদালত বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে সংবিধান লঙ্ঘনের জঘন্য ঘটনা বলে আখ্যা দেওয়ার পরও সুপ্রীম কোর্ট (মসজিদ) ধ্বংসকারীদের হাতেই বিতর্কিত জমিকে তুলে দিয়েছে আর ২০২৪’র নির্বাচনের আগে মন্দির উদঘাটন কাজ অপেক্ষা করে রয়েছে। ১৯৯১-তে যে আইন প্রণয়ন করে কোনো উপাসনালয়ের চরিত্র বা এক্তিয়ার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-কে ‘কাট অফ’ তারিখ (ভিত্তিবর্ষ) বলে ঘোষণা করা হয় (এই আইনে অযোধ্যাকে ব্যতিক্রম হিসাবে দেখানো হয়) — সেই আইনকে বিজেপি বাতিল করতে চায় যাতে বিভিন্ন মসজিদ ও ইসলামী স্থাপত্যকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করার সংঘ পরিবারের উদ্যোগকে বৈধ করে তোলা যায়। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এই প্রকল্প রূপায়নের উদ্দেশ্যে যথেচ্ছাচার চালানো হচ্ছে আর সংঘবাহিনীর গুন্ডাদল লাগাতার হামলা নামিয়ে আনছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ধর্মান্তরকরণ ও পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, মাংস বিক্রি ও গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ করা, প্রকাশ্যে ধর্ম প্রার্থনায় বিধিনিষেধ আরোপ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সংঘী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী কর্তৃক গণপিটুনি ও বাছাই করে হিংসা ছড়ানোর হাজারো ঘটনা দেখা যাচ্ছে। ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া, গণহারে গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে আটক, এনকাউন্টার হত্যা হয়ে চলেছে যেখানে পরিবর্তিত আইনে এসব বৈধ হয়ে ওঠে এবং ন্যায্যতা লাভ করে। এ’ধরনের আক্রমণ শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরই নেমে আসছে না, পরন্তু অন্যান্য সম্প্রদায় সহ দলিত, আদিবাসী ও মহিলাদের উপরও যথেষ্ট মাত্রায় নেমে আসছে।
৭) সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক অংশগুলির উপর আক্রমণের সাথে সাথে বিরোধী কণ্ঠস্বর ও গণআন্দোলন সমূহের উপরও বাছাই করে ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো হচ্ছে এবং সংসদীয় ক্ষেত্রে বিরোধিতাকে অবৈধ বলে দেখানোর অপচেষ্টাও ক্রমবর্ধমান। ঔপনিবেশিক যুগের কায়দায় এই জমানায় নাগরিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা আনা হচ্ছে এবং কোনো বিচার বা জামিন ছাড়া দীর্ঘদিন তাঁদের জেলে বন্দি রাখা হচ্ছে। ভীমা-কোরেগাঁও এবং দিল্লী দাঙ্গার মামলাগুলিতে নির্যাতনের এই ছবি সুপরিষ্ফুট যেখানে নানা সন্দেহজনক উপায়ে মিথ্যা বৈদ্যুতিন ‘সাক্ষী’ জোগাড়, রাষ্ট্রদ্রোহের ও সন্ত্রাসবাদের মিথ্যা মামলা দায়ের থেকে শুরু করে ইউএপিএ, এনএসএ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের মতো দানবীয় আইনে প্রতিবাদীদের ঘিরে ফেলা হয়। আমরা দেখেছি, ফাদার স্ট্যানস্বামীকে, যিনি হাজার হাজার আদিবাসী যুবককে মিথ্যা অভিযোগে দীর্ঘদিন কারাবন্দি রাখার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন এবং ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের মুখ হয়ে উঠছিলেন বলে শহীদের মৃত্যু বরণ করতে হয়। ভারতের মধ্যে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে অবদমিত রাখার এই ঘটনা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের উপরও প্রযোজ্য হচ্ছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত যারাই মোদী সরকারের সমালোচনা করছেন এবং ভারতে গণতন্ত্র রক্ষার সপক্ষে কাজ করছেন তাদেরই ওসিআই (বিদেশস্থ ভারতীয় নাগরিক) মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বিভেদমূলক ও বিভাজন সৃষ্টিকারী নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে শাহিনবাগের মতো শক্তিশালী গণআন্দোলন কিম্বা কৃষিকে কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে চিত্রিত করার অপচেষ্টা হয়েছে এবং আন্দোলনগুলির উপর গণহিংসা চাপিয়ে সেগুলিকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্য আন্দোলনজীবী, শহুরে নকশাল বা ‘কলমধারী নকশাল’ শব্দবন্ধ প্রয়োগ করেছেন।
৮) কোনো প্রতিষ্ঠানগত নজরদারি না থাকায় এবং যথেচ্ছ অর্থক্ষমতার জোরে বিজেপি এখন বিধায়ক কেনাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে আর এভাবে অ-বিজেপি সরকারগুলিকে ফেলে দেওয়ার লক্ষ্যপূরণও তাদের সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র হ’ল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে বিধায়ক কিনে সরকার পাল্টে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যপালের দপ্তর ও সিবিআই, ইডি, এনআইএ ইত্যাদি কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে কাজে লাগিয়ে কদর্যভাবে অ-বিজেপি সরকারগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করা ও তাদের স্থিতিশীলতা ভাঙ্গার চেষ্টা হচ্ছে। ২০১৪-তে ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারতের’ যে অভিযান বিজেপি শুরু করেছিল এখন তা বিরোধীমুক্ত গণতন্ত্রের ভাষ্য হয়ে উঠেছে আর তারা এখন প্রকাশ্যেই একদলীয় রাষ্ট্রের ওকালতি করছে যেখানে বিজেপি সারাদেশে তাদের আধিপত্য কায়েম করে আগামী পঞ্চাশ বছর অবধি দেশ শাসন করতে চায়।
৯) নাগরিকদের কড়া নজরদারিতে রাখা ও সর্বগ্রাসী এক ভয় ও নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ কায়েমের মধ্য দিয়ে মোদী জমানা ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি ও পরিষেবার আর্থিক ও নিয়ন্ত্রণভার বাছাই করা কিছু কর্পোরেট গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিচ্ছে। বেসরকারীকরণ এখন রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তিকে খোলাখুলি বেচে দেওয়া অথবা প্রায় চিরস্থায়ী লিজে দেওয়ায় পর্যবসিত হয়েছে — যাকে অলস পড়ে থাকা সম্পদ থেকে অর্থ উপার্জন বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। নোটবন্দির মতো মানিটাইজেশন পাইপলাইনও এক ভয়ংকর ধারণা, যার দ্বারা জনগণের অর্থ ও শ্রমে অর্জিত রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করা হচ্ছে। বেসরকারীকরণের প্রবক্তারা বেসরকারীকরণকে বাড়তি দক্ষতা ও বিকাশের পথ বলে যুক্তি দিচ্ছে, বাস্তব কিন্তু তাদের মনগড়া যুক্তি ও বিভ্রান্তিকর প্রচারকে চপেটাঘাত করছে। আমরা এখন সহজেই দেখতে পাই, ক্রমবর্ধমান বেসরকারীকরণ কেবল গণহারে বেকারত্ব, দারিদ্র্য আর প্রবল বৈষম্যেরই জন্ম দিচ্ছে। বেসরকারীকরণ উচ্চশিক্ষাকে মহার্ঘ করে তুলেছে আর ভালো মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা গরিব এমনকি মধ্যবিত্তদেরও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবেই উপরের দিকে পৌঁছানোর সামাজিক গতি রুদ্ধ হচ্ছে এবং প্রধানত ব্রাহ্মণপ্রধান সামাজিক উচ্চকোটির লোকরাই আরও বেশি সুবিধা ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ পাচ্ছে।
১০) মোদী জমানায় ক্রোনি পুঁজিকে যেভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে তার ফলে ধনী দরিদ্রের মধ্যকার ব্যবধান নিদারুণভাবে বেড়ে চলেছে। মোদী জমানায় ভারতে ডলার বিলিয়নারের (অর্বুদপতি) সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২২ অতিমারীর এই দু’বছরে বিলিয়নারের তালিকায় নতুন ৬৪টি নাম যুক্ত হয়েছে। আর্থিক পুনর্বণ্টন ও সমতা আনার জন্য কর ব্যবস্থাকে ব্যবহার করার পরিবর্তে সরকার এটাকে গরিবদের লুণ্ঠন করে ধনীদের পুষ্ট করার উপায় হিসাবে ব্যবহার করছে। ভারতে কোনো সম্পদ কর বা উত্তরাধিকার করের সংস্থান নেই, কর্পোরেট কর ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা হচ্ছে, বেশি বেশি করছাড় দেওয়া বা কর ব্যবস্থাকে এড়ানোর সুবিধা তো রয়েইছে। পরিসংখ্যান বলছে, মোট সংগৃহীত জিএসটির দুই তৃতীয়াংশ আসে ভারতীয় জনগণের নিচের তলার অংশ থেকে, এক তৃতীয়াংশ পরবর্তী ৪০ শতাংশ মানুষ থেকে আর মাত্র তিন থেকে চার শতাংশ আসে ভারতীয় সমাজের চূড়ায় বসবাসকারী দশ শতাংশ লোকদের থেকে।
১১) বিমুদ্রাকরণ যদি আমাদের দেশব্যাপী মোদী জমানার নির্বিকার ও বিপর্যয়কর চরিত্রের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে থাকে, তাহলে কোভিড১৯ অতিমারীর দীর্ঘ সময়ে আমরা মানবসম্পদের যন্ত্রণাবিধুর সেই একই স্বাদ পেয়েছি। অতিমারীর শুরুর দিনগুলিতে, ভাইরাস মোকাবিলার নামে সরকারকে যাবতীয় শঠতাপূর্ণ ও যুক্তিহীন ধারণা ফেরি করতে দেখেছি। কোনো পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়া আচমকা লকডাউন ঘোষণা সারা দেশকে এক মানবিক সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দেয়। পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবার পরিজনকেই সবথেকে বেশি আঘাত সইতে হয়। পায়ে হেঁটে তাদের শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এবং পথে ও তথাকথিত কোয়ারান্টাইন সেন্টারগুলিতে তাদের অশেষ দুর্ভোগ ও অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। লক্ষ লক্ষ পরিবার খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য চরম দুর্গতির মুখে পড়ে। লকডাউন হ’ল স্পষ্টতই এক দমনমূলক ও বিপর্যয়কর পদক্ষেপ। বহু দেশই এই পদক্ষেপ নিয়েছে সাময়িক এক ব্যবস্থা হিসেবে যাতে করে ভাইরাস সংক্রমণের গতিকে কমানো যায় এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলার জন্য অনেকটা সময় পাওয়া যায়। ভারতে লকডাউনকেই অন্তিম উপায় (end in itself) ধরে নিয়ে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় — যার লক্ষ্য ছিল বিধিনিয়মের নাগপাশে মানুষকে বেঁধে ফেলা ও জনগণকে বশীভূত করা। অপ্রতুল ও যথেষ্ট সাজসরঞ্জাম বিহীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ব্যাপক মাত্রার সংকট মোকাবিলায় ছিল নিদারুণ অপ্রস্তুত অবস্থায়। অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়, ঠিক সময়ে ও পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ না হওয়ায় যে ব্যাপক হারে মৃত্যু ও বিভীষিকা নেমে আসে তাকে যথার্থভাবে রোধ করার পরিবর্তে, বাস্তব পরিস্থিতিকে গোপন করার জন্য অভূতপূর্ব মাত্রায় প্রচার চালানো হয় এবং ব্যর্থ শাসককেই পরিত্রাতা হিসাবে মেলে ধরা হয়।
১২) নির্বিচারে যে বেসরকারীকরণ এবং চরম উন্নাসিক, অবিবেচক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকার পরিচালনা দেশকে নিম্নমুখী আর্থ-সামাজিক পাকচক্রের দিকে নিরন্তর ঠেলে নিয়ে চলেছে যার প্রতিফলন হ’ল বিশ্বের তুলনামূলক সবকটি সূচকের নিরিখে ভারতের অবস্থা ক্রমশ নিচের দিকে চলে যাওয়া। অনগ্রসরতা ও বঞ্চনার ফলে ভারতীয় জনগণের সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তারজন্য বর্তমান শাসকরা কেবলই অতীতের উপর দোষারোপ করে এবং পঁচাত্তর বছর তথাকথিত কোনো কাজ না হওয়াকেই দায়ী করে, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির একটাও কেন পূরণ হল না সেই চরম ব্যর্থতার প্রশ্নে তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। ২০২২’র মধ্যে বিদ্যুৎ, শৌচালয়, পানীয় জলের নিশ্চয়তা সহ সকলের জন্য ঘরের প্রতিশ্রুতি, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতেও, আগের মতোই অধরা থেকে গেছে। বর্তমান জমানা এখন গোলপোস্টকে সরিয়ে ২০৪৭-এ নিয়ে গেছে, আর ভারতের জনগণকে বিশ্বের দরবারে গল্পকথার মতো উত্থানের কাহিনী শোনাতে এক প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে যা ক্রমেই উত্তুঙ্গ হবে এ’বছরের শেষে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০’র শিখর সম্মেলনকে সামনে রেখে। পরিহাসের যা তা হ’ল, সরকার যত বিশ্বের আঙিনায় বিশ্বগুরু হিসেবে নতুন ভারতের গীত শোনাচ্ছে ততই বেশি বেশি সংখ্যায় ধনী ও সুবিধাভোগী ভারতীয়রা আমেরিকা ও পশ্চিমী দুনিয়ার উন্নত দেশগুলিতে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে, বেশি বেশি সংখ্যায় শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভারতীয়রা নিপীড়নমূলক ও কষ্টকর কাজ এবং বিভেদমূলক অভিবাসী আইনের ঝুঁকি নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে জীবিকার সন্ধানে পশ্চিম ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে পাড়ি দিচ্ছেন। মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন এমন ভারতীয়দের সংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
১৩) যে সমাজে রয়েছে চরম সামাজিক অসাম্য সেখানে উপরের দিকে সামাজিক গতি সঞ্চারের একমাত্র উপায় যে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান তা আবারও ধনীদের জন্যই সংরক্ষিত হচ্ছে। সরকার চালনায় অভিজাতমুখী প্রবণতা প্রতিদিন নগ্নভাবে ফুটে উঠছে। যে প্রধানমন্ত্রী গরিবের প্রয়োজন ও অধিকারগুলিকে এবং সাধারণ মানুষের চাহিদাকে ‘মাগনা খাওয়ানোর রেওয়াজ’ বলে ব্যঙ্গ করেন তিনিই আবার বন্দে ভারত ট্রেনগুলি এবং অতীব বিলাসবহুল প্রমোদতরী গঙ্গাবিলাসকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে দেখিয়ে ঝান্ডা নেড়ে উদ্বোধন করছেন। সরকারী নীতি ও শাসন প্রণালীর নির্লজ্জ ধনীঘেঁষা অভিঘাত, যার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম অবহেলা এবং জনগণের জীবনে বেড়ে চলা অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা ও অবমাননা সমাজে প্রবল হতাশা ও শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এই হতাশাকে কাজে লাগানোর জন্য সংঘ বাহিনী ঘৃণা, মিথ্যাচার ও হিংসার নিখুঁত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যুব সম্প্রদায় ও মহিলাদের মধ্যে, বিশেষত সমাজের নিপীড়িত ও বঞ্চিত অংশের মধ্যে সংঘ বাহিনীর লাগাতার অনুপ্রবেশ উৎকণ্ঠার কারণ এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে একে প্রতিহত করতে হবে।
১৪) সংকটের গভীরতা, সংবিধানের উপর চলমান নির্লজ্জ আক্রমণ এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতিমালা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ভিন্নমত পোষণের অধিকারসমূহের ভয়াবহ ক্ষয়প্রাপ্তি শক্তিশালী প্রতিবাদ ও গণআন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে। সিএএ বিরোধী প্রবল প্রতিবাদসমূহ বিশেষত সেখানে মুসলিম মহিলাদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ এবং দিল্লী সীমানায় ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন হ’ল দুই ঊর্ধবিন্দু যা সমগ্র ভারতজুড়ে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসকদের পথ অনুসরণ করে সরকার এই আন্দোলনগুলি দমন করার জন্য পাশবিক নিপীড়ন চালিয়েছে এবং ইজরাইল থেকে আমদানি করা স্পাইওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। কিন্তু যে সাহস ও সংকল্প নিয়ে নিগৃহীত সমাজকর্মীরা অত্যাচারের মোকাবিলা করেছেন তা ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে তীক্ষ্মতর করতে সকলের মনোবলকে উত্তুঙ্গ ও মজবুত করে তুলেছে।
১৫) জনগণের অসন্তোষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া এবং গণআন্দোলনগুলির প্রবল চাপ রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ক্ষেত্রেও অনুভূত হচ্ছে। শাসক এনডিএ জোটের মধ্যে মতবিরোধের লক্ষণও প্রকাশ পাচ্ছে — যেখানে তার সবচেয়ে পুরানো তিন মিত্র আকালি দল, শিবসেনা ও জেডিইউ জোট ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অকালি দল কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জোট ছেড়েছে, শিবসেনা অ-বিজেপি জোট গঠনের জন্য কংগ্রেস ও এনসিপির সাথে হাত মেলায় এবং (শিব)সেনার মধ্যে বিজেপি ভাঙ্গন ঘটিয়ে রাজ্যটিতে ক্ষমতা হস্তগত করতে সফল হওয়ার আগে পর্যন্ত আড়াই বছর সরকার পরিচালনা করে। আর নীতীশ কুমার ২০২২’র আগস্টে আবার এনডিএ ত্যাগ করেছেন এবং ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে হটাতে আরজেডি, কংগ্রেস ও বামদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন। পাঁচবছর আগে নীতীশ কুমার যেভাবে আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর স্বল্পকালীন জোট ভেঙ্গে এনডিএতে ফিরে গিয়েছিলেন, এক অর্থে, এটা যেন সেই ঘটনারই উল্টো চিত্র।
১৬) সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলির মধ্যে আমরা শক্তিশালী বিজেপি-বিরোধী গণরায় দেখেছি ঝাড়খণ্ডে ২০১৯-এ, পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এ এবং অতি সম্প্রতি ডিসেম্বরে হিমাচল প্রদেশে। তামিলনাড়ু, কেরল ও পঞ্জাবে — যে সমস্ত জায়গায় বিজেপির কেবেদিনই তেমন নির্বাচনী উপস্থিতি ছিল না — সে খুবই খারাপ ফল করেছে। কিন্তু বিজেপি প্রভূত সাফল্য পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে। বস্তুত, সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস কোনো আসন জিততে না পারায়, বিধানসভার পরিসরে বাম সমর্থিত একমাত্র আইএসএফ বিধায়ক বাদ দিলে, বিজেপিই হয়ে উঠেছে একমাত্র বিরোধী পক্ষ। পঞ্জাবে আপের সাফল্যের পর গুজরাটেও সে যথেষ্ট ভালো ফল করেছে — যেখানে ভালো পরিমাণে ভোট পাওয়া এবং কয়েকটি আসনলাভ তাকে জাতীয় দলের স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। বিজেপির সর্বাত্মক অপকৌশল সত্বেও, দিল্লী পৌরসভা নির্বাচনে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।
১৭) বিভিন্ন রাজ্যে পরাজিত হওয়া সত্বেও, বিজেপি এখন সর্বভারতীয় স্তরে সামগ্রিক আধিপত্যের এক উচ্চ সোপানে পৌঁছেছে। জাতীয় স্তরে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস — কী ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে, কী আসন সংখ্যার বিচারে — সর্বকালীন নিঁচু জায়গায় নেমে এসেছে। কিছু আঞ্চলিক দল যদিও বিজেপি থেকে তাদের দূরত্ব বজায় রেখেছে, তাদের অল্প কয়েকটিই কেবল সরাসরি বিরোধী ভূমিকা পালন করছে। উড়িষ্যায় বিজেডির মতো দল অথবা অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআরসিপি হ’ল, আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে যারা মুখ্য সমস্ত প্রশ্নেই বিজেপির সঙ্গে থাকে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রধানত কংগ্রেসকে দুর্বল করে বেড়ে ওঠা আপ বস্তুগতভাবেই এখন যে জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে তাকে বিজেপির সাথেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। কিন্তু সে নরম হিন্দুত্বের এক প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে হাজির করে, সে প্রতিযোগী হিসেবে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাইছে বিজেপিরই তৈরি করা ভাষাতে (term)। আর পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি চালিত সরকার বা তেলেঙ্গানায় টিআরএস (এখন হয়েছে বিআরএস) মোদী জমানার বিরুদ্ধে খুবই সরব হলেও দুর্নীতি ও অপশাসনে কালিমালিপ্ত। অধিকাংশ পরিচিতি ভিত্তিক দল কোনো মতাদর্শগত অবস্থান নেয় না এবং সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলে এমন গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত প্রশ্নে নীরব থেকে যায় এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং পরিচিতিকে আত্মসাৎ করার জন্য বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতির মুখে তারা নতিস্বীকার করে (vulnerable)। উত্তরপ্রদেশে বিএসপির দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্তি, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের মুখে মতাদর্শরহিত পরিচিতি রাজনীতির নতিস্বীকারের এটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
১৮) এটি আমাদের বোঝা প্রয়োজন, দক্ষিণপন্থা ঘেঁষা নীতি পরিবর্তন ও হিন্দুত্বের সাধারণ ধারণার অস্তিত্ব থেকে গত তিন দশকে বিজেপিই লাভবান হয়েছে। এই বড়মাত্রায় সহমত হওয়া ও নয়া উদারবাদী নীতিগুলির দীর্ঘ অনুসরণ এবং হিন্দুশ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতির নিরবচ্ছিন্নতা, পার্থক্যরেখাকে প্রায়ই ঝাপসা করে দেয় এবং বিরোধীপক্ষ নির্বাক থেকে যায়। বিজেপি যদি লাগামহীন কর্পোরেট লুণ্ঠনের সঙ্গে আক্রমণাত্মক হিন্দুত্বের সমন্বয় ঘটায় এবং এই সমন্বয়কে পাশবিক রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও নগ্ন বিচারবিভাগ বহির্ভুত হিংসার দ্বারা দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় তাহলে এই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের প্রতি বিরোধিতাকে সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ভারতের দিশার প্রতি ধারাবাহিক ও সাহসী দায়বদ্ধতার দ্বারাই চালিত হতে হবে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্তব্য হ’ল, আধুনিক ভারত গড়ার এই জটিল সন্ধিক্ষণে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নির্বাহ করা।
১৯) দুর্ভাগ্যক্রমে, যখন বিজেপি তার উচ্চতার শীর্ষে পৌঁছেছে, সেই সময় বাম শিবিরের নির্বাচনী শক্তির বিশাল ক্ষয় ঘটেছে। যদিও নির্বাচনী শক্তির ক্ষয়ের দ্বারা বামদের কোনোভাবেই মতাদর্শগত- রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া অথবা সেকেলে হয়ে যাওয়াকে সূচিত করে না। বামেদের বিধায়ক ও সাংসদ সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাওয়াটা প্রায় সবটাই ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) নেতৃত্বে চালিত সরকারগুলির পতনের জন্য এবং এর নিজস্ব কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতও আছে। চৌত্রিশ বছরের শাসনকালে জমা হওয়া প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মুখে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) তার নিজের নির্বাচনী (গণ)ভিত্তি থেকে ভীষণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যা আরও প্রকট হয় তার বড় বড় নীতিগত ভুল বিশেষত কর্পোরেটমুখী আর্থিক নীতি গ্রহণ, জোর করে কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও ক্ষমতার দম্ভের কারণে। অবশেষে সে পরিস্থিতির এমন এক ফাঁদে জড়িয়ে যায় যেখানে রাজনৈতিক দৃশ্যপট ক্রমাগত শাসক টিএমসি এবং আগ্রাসী ও উত্থানমুখী বিজেপির মধ্যে মেরুকৃত হয়ে পড়ে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে স্বীকার ও মোকাবিলা না করতে পারার ব্যর্থতা ও বিশেষত ত্রিপুরায় আশ্চর্য্যজনকভাবে বিজেপির কাছে ক্ষমতা হারানোর পরও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের প্রতি তার আত্মঘাতী ঔদাসীন্য বিষয়টিকে আরও শোচনীয় করে তোলে। কিন্তু একই সময়ে সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামরা কেরল ও তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে ভালো ফল করার পাশাপাশি বিহারে সিপিআই(এমএল)-এর জোরালো নির্বাচনী উত্থান, পরিস্থিতির দাবিগুলির সাপেক্ষে বামেদের পুনরুত্থানের নতুন সম্ভাবনাগুলিকে উন্মুক্ত করেছে।
২০) আধুনিক ভারতের ঠিক এই অভূতপূর্ব জটিল সন্ধিক্ষণে সিপিআই(এমএল) এবং বাম আন্দোলনকে অবশ্যই তাদের অগ্রাধিকারগুলিকে রূপায়িত করতে হবে। পশ্চাদমুখী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডার সাহসী, ধারাবাহিক ও ধৈর্যশীল উপায়ে মতাদর্শগত প্রতিরোধ গড়ে তোলা; জনগণের অবিচল ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে শক্তিশালী ও দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ; এবং সিপিআই(এমএল) ও বামেদের রাজনৈতিক উত্থান ও অগ্রগতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ব্যাপকতম সম্ভাব্য মতাদর্শগত-রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও নির্বাচনী সমঝোতা গড়ে তোলা — এই অভিমুখে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে আমাদের দৃঢ়পণ হতে হবে। ভারতের ত্রি-স্তরীয় রাজনৈতিক কাঠামোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে একটি সমতল রাজনৈতিক (flattened) চারণভূমি গড়ে তোলা — যেখানে বিজেপি সমগ্র ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাবে — এমন এক ফ্যাসিবাদী আক্রমণের জন্য যতই আতঙ্ক ছড়ানো হোক, পরিস্থিতির প্রতিটি দাবি ও প্রতিটি স্তরে সাড়া দেওয়ার জন্য আমাদের সক্রিয় থাকতে হবে। পঞ্চায়েত ও পুরসভা পরিচালনার ক্ষেত্রগুলিতে প্রায় সর্বত্রই মানুষকে সীমাহীন দুর্নীতি এবং সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরিস্থিতিতে সকলের জন্য শিক্ষা ও কাজ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়টি প্রায় সমস্ত রাজ্যে যুবসমাজের নিকট গভীর উৎকণ্ঠার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, জাতিগত ও লিঙ্গ উৎপীড়ন, অবিচার ও প্রশাসনিক নির্লিপ্ততার দৃষ্টান্ত সারা দেশেই প্রচলিত ব্যাধি হয়ে উঠেছে। সংঘ বাহিনীর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ মোকাবিলার প্রধান লক্ষ্যকে বিস্মৃত না হয়েও, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের মূলবিন্দু (focus) আমাদের দাবি জানাচ্ছে, জনগণের স্বার্থকে আমাদের ঊর্ধে তুলে ধরতে হবে ও এ’প্রশ্নে প্রতি ক্ষেত্রে তাদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে।