গুজরাট গণহত্যা : সত্যিটা বারবারই ফিরে এসে হানা দিতে থাকবে
gujarat-genocide

বিবিসি তাদের তথ্যচিত্র ‘ইণ্ডিয়া : দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’এর প্রথম পর্বটি প্রদর্শিত করে গত ১৭ জানুয়ারি ২০২৩। এই তথ্যচিত্রে আলোকপাত করা হয়েছে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদীর সেই সময়ের ভূমিকার ওপর যখন গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের পর এক ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। ঐ তথ্যচিত্রটা ভারতে দেখানো হয়নি এবং মোদী সরকার অতি সত্ত্বর টুইটারকে বলে ঐ ভিডিওর টুইট ও লিংকগুলোকে নামিয়ে নিতে এবং ইউটিউব’কে নির্দেশ দেয় তারা যেন ঐ ভিডিও ও তার লিংকগুলোকে না তোলে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের এক মুখপাত্র ঐ তথ্যচিত্রকে এক বৈরি ভাবাপন্ন প্রচার বলে বর্ণনা করেন যা ঔপনিবেশিক মানসিকতা দ্বারা চালিত এক কলঙ্কিত ভাষ্যকে চালাতে চাইছে। ২০২১ সালের আইটি বিধির ১৬নং ধারার বলে জরুরি ক্ষমতার আশ্রয় নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোর মঞ্চে তথ্যচিত্রটি প্রদর্শিত না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

গুজরাটে ২০০২ সালে সংঘটিত গণহত্যায় সারা দুনিয়া মর্মাহত হয়েছিল। মানসিকভাবে আহত ভারত ২০০৪ সালে বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে অপসারিত করে, এবং ২০০৪’র নির্বাচনী ফলের পিছনে ২০০২’র গুজরাটের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্বের অনেক দেশই তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করত এবং তা মূলত সেই সময়ের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ভূমিকার জন্য, যখন ঐ’রাজ্যে স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বেদনাবহ ও ভয়াবহ গণহত্যার অন্যতমটি সংঘটিত হয়েছিল। এটা ঠিকই যে সুপ্রিম কোর্ট এখন গুজরাট গণহত্যা সম্পর্কিত সমস্ত মামলারই ইতি ঘটিয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে মামলা চালানোর মতো কোনো তথ্যপ্রমাণ বাহ্যত পায়নি। এটাও ঘটনা যে মোদী ২০১৪ সাল থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রয়েছেন। কিন্তু তার মানে কি এই যে দুনিয়া ২০০২’র গুজরাট নিয়ে কোনো কথা আর বলতে পারবে না?

বিজেপি বস্তুত এটা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে গুজরাট গণহত্যাই তাদের গুজরাট মডেলের কেন্দ্রীয় উপাদান ছিল। অমিত শাহ ২০২২ সালে বলেছিলেন ঐ গণহত্যা কিভাবে গুজরাটে ‘স্থায়ী শান্তি’ সুনিশ্চিত করেছিল এবং বিলকিস বানোকে ধর্ষণের ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার জন্য যারা সাজা পেয়েছিল জেল থেকে তাদের মুক্তি দিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে বিজেপি ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীকেই বেছে নিয়েছিল। আমাদের কাছে তাই ২০০২’র গুজরাটকে তার রক্তস্নাত আখ্যান-সহ সবিস্তারে মনে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। বিবিসির তথ্যচিত্র ঠিক এটাই করেছে এবং আমাদের জানিয়েছে যে ২০০২ সালে ব্রিটিশ হাইকমিশনের চালানো এক নিজস্ব তদন্তের রিপোর্ট জাতি বিশুদ্ধকরণের সমস্ত লক্ষণের সন্ধান পেয়েছিল এবং নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি দায়ী করেছিল। বিবিসি তথ্যচিত্র নিয়ে মোদী সরকার রুষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখানোর পর সে সময়ের ব্রিটিশ সচিব জ্যাক স্ট্র করণ থাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঐ রিপোর্টের সত্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ক্যারাভান পত্রিকা ঐ রিপোর্টের পুরোটাই প্রকাশ করেছে এবং রিপোর্টে গোধরাকে অজুহাত করে চালানো গুজরাট গণহত্যাকে এক পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ বলে বলা হয়েছে।

তথ্যচিত্রের একটা শক্তিশালী বিষয় হলো যে তাতে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীর একটা সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যাতে তাঁকে সাক্ষাৎ গ্ৰহণকারীর দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে অবজ্ঞাসূচকভাবে বলতে শোনা যাচ্ছে যে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ চমৎকার কাজ করেছে। সেটা ছিল মোদীর প্রথম দিককার সময় যখন তিনি মিডিয়ার সঙ্গে কথাবার্তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কলাটিকে রপ্ত করে উঠতে পারেননি। ঘটনা হলো, ঐ সাক্ষাৎকারে মোদী একমাত্র যে ‘আত্মসমালোচনাটা’ করেন তা হলো তাঁর সরকার মিডিয়াকে খুব ভালোভাবে সামলাতে পারেনি। সে সময় মিডিয়ার ওপর বিজেপির পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না, আর গুজরাট গণহত্যার সত্যিটাকে তাই চাপা দেওয়া যায়নি। আমরা খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি যে কেন্দ্রের মোদী সরকার কেন নজরদার মিডিয়ার মুখোমুখি আর যাতে হতে না হয় সেটা সুনিশ্চিত করাটাকেই তাদের পছন্দের একটা বিষয় করে তুলল। মূল ধারার মিডিয়ার মোদী সরকারের মুখপাত্রে পরিণত হয়ে পড়ার এই রূপান্তরণ এবং সমালোচনামূলক প্রশ্ন তুলতে পারে এমন সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর পর্বকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলাটা হলো দুটো ‘সংশোধনমূলক শিক্ষা’ যেগুলো নরেন্দ্র মোদী ২০০২’র গুজরাটের ঘটনার সময় মিডিয়াকে সামলানোর কবুল করা ব্যর্থতা থেকে নিয়েছিলেন।

এই সেদিনই আমরা দেখলাম মোদী সরকার কিভাবে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রটায় মদত দিতে ও তাকে প্রচারের এক অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগাতে উঠেপড়ে লাগল। আর এখন তারা বিবিসির তথ্যচিত্রটাকে প্রচারের উদ্যোগ বলে খারিজ করছে আর ভারতে সামাজিক মাধ্যমের মঞ্চগুলোতে সেটির প্রদর্শন বন্ধ করতে জরুরি অবস্থার আশ্রয় নিচ্ছে! এ’সত্ত্বেও ভারতের জনগণ যদি ইন্টারনেটে বা তাঁদের ডিজিটাল যন্ত্রে ঐ তথ্যচিত্র দেখেন, সরকার সেক্ষেত্রে তার ক্ষমতার জোরে দেখা বন্ধ করতে চাইছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা তথ্যচিত্রটির প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে সেটি দেখতে চাইলে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করা হয় এবং এবিভিপি হিংসা নামায়। আর তথ্যচিত্রটা যেহেতু বিবিসিতে দেখানো হয় মোদী সরকার সেটাকে তাই উপনিবেশবাদী মানসিকতা দ্বারা চালিত বলে অভিহিত করছে, যদিও সরকার নিজে ক্রমেই বেশি করে সেভাবেই শাসন করছে যেভাবে ঔপনিবেশিক শাসকরা করত, প্রতিটি বিরোধিতাকে দমন করতে এবং নাগরিকদের সমস্ত স্বাধীনতাকে খর্বকরতে প্রয়োগ করা হত দানবীয় আইনগুলোকে।

গণহত্যার অপরাধকে কখনই ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব নয়। সত্যিটা সবসময় ফিরে এসে সংঘটকদের হানা দেবে। সেন্সরশিপের ‘জরুরি ক্ষমতা’ একটা তথ্যচিত্রের প্রদর্শন সাময়িকভাবে বন্ধ করতে পারে, কিন্তু তা কখনই সত্যিটাকে চিরদিন চেপে রাখতে পারবে না।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩)

খণ্ড-30
সংখ্যা-3