যারা কেড়ে নিল ৮১ কোটির মুখের গ্রাস
81 crores

নতুন বছর থেকেই মোদী সরকার ৮১ কোটি ভারতবাসীর মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল।

জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন ২০১৩ অনুসারে যাদের রেশন কার্ডরয়েছে, মাথাপিছু তারা পেতেন ৫ কেজি করে গম অথবা চাল। আর, অন্ত্যোদয় কার্ড যাদের রয়েছে, তারা পেতেন মাসে ৩৫ কেজি খাদ্য শস্য। খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী চাল ও গমের দাম হচ্ছে যথাক্রমে কেজি পিছু ৩ টাকা ও ২ টাকা। কোভিডকালীন নজিরবিহীন দুঃসময়ে, এপ্রিল ২০২০-তে, কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার অধীনে প্রত্যেকে ৫ কেজি করে নিঃশুল্ক খাদ্যশস্য পাবেন, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে ৫ কেজি করে ভর্তুকি যুক্ত খাদ্যদ্রব্যের সাথে। অর্থাৎ, প্রতি কার্ড হোল্ডারকে ২০২০’র এপ্রিল থেকে মাথা পিছু ১০ কেজি করে খাদ্য শস্য দেওয়া হতো (এর মধ্যে ৫ কেজি হল জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী ভর্তুকিতে আর বাকি ৫ কেজি প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার অধীনে নিঃশুল্কে)।

কিছুদিন আগে, ২০২২’র ২৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা এই নতুন বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর অর্থ হল, জানুয়ারি ২০২৩ থেকে রেশন প্রাপকদের বরাদ্দ অর্ধেক করা হল। চলতি মাথা পিছু ১০ কেজি’র (জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন ও প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা মিলিয়ে) বদলে তাঁরা শুধুমাত্র পাবেন মাথাপিছু ৫ কেজি (যা জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী প্রাপ্য)। যদিও, এই কঠোর সিদ্ধান্তকে গেলাতে কেন্দ্রীয় সরকার একটা চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে। সরকার জানিয়েছে, জানুয়ারি ২০২৩ থেকে শুরু করে এক বছরের জন্য জাতীয় খাদ্যসুরক্ষা আইন অনুসারে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হবে নিঃশুল্কে অর্থাৎ কেজি প্রতি ৩ টাকার বিনিময়ে চাল ও কেজি প্রতি ২ টাকার বিনিময়ে গমের মূল্যে ছাড় দেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় সরকার তার এই ঘোষণাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, এই ঘোষণার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বিরাট পরিমাণে বরাদ্দ রেশন কাটছাঁট করে ফেলল। দেখা যাচ্ছে, এরফলে মাথা পিছু সরকারের সাশ্রয় হচ্ছে মাসিক ১১ টাকা আর অন্যদিকে, যে ৫ কেজি খাদ্যশস্য ছেঁটে ফেলা হল, তা বাজার থেকে কিনতে চাল প্রতি কেজি বাবদ ১৫০-১৭৫ টাকা, আর গম প্রতি কেজি ৩০-৩৫ টাকা ব্যয় হবে। পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ঠ পরিবারের এরফলে রেশন থেকে প্রাপ্ত খাদ্য সামগ্রির পরিমাণ বাজার থেকে ক্রয় করতে হলে খরচ হবে ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকা। এই পরিবারগুলো মাত্র ৫৫ টাকা সাশ্রয় করতে পারবে, তাই কোনোমতেই মোদীর এই নতুন ঘোষণাকে ঐতিহাসিক হিসাবে আখ্যা দেওয়া যায় না। এই পশ্চাদমুখী ঘোষণা এমন সময়ে করা হল যখন কেন্দ্রীয় সরকার আশঙ্কা করছে আবার একটি কোভিড-তরঙ্গ আসতে পারে, আর সে লক্ষ্যে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার নির্দেশ আসতে শুরু করেছে।

জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন ও প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা হত-দরিদ্র বিপুল সংখ্যক শহুরে ও গ্রামীণ দিনমজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিকদের পরিবারগুলোর জন্য মাথাপিছু ১০ কেজি করে খাদ্য নিশ্চয়তা সুনিশ্চিত করেছিল। কোভিডের সময়ে বিপুল সংখ্যক এই মানুষগুলো তাদের রুটি রুজি হারায়, আর এখনো পর্যন্ত সে দুরাবস্থা তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সরকারের এই ঘোষণা অগণন গরিব মানুষকে ঠেলে দেবে অথৈ জলে।

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থার তরফ থেকে করা নানা অনুসন্ধান রিপোর্ট গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ছবি সামনে তুলে ধরেছে। ‘রাইট টু ফুড ক্যামপেন’এর তরফ থেকে যে সমীক্ষাগুলো করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রাক-কোভিডের তুলনায় পরবর্তীকালে সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। ওই সমস্ত সমীক্ষা দেখিয়েছে, উপরে উল্লিখিত দু’টি প্রকল্প মারাত্মক অতিমারীর সময়ে সেই সমস্ত মানুষদের কিছুটা সুরাহা দিতে পেরেছিল যাদের ছিল ওই রেশন কার্ড। কিন্তু এর বাইরে অগুন্তি মানুষ — যারা দুঃস্থ, সমাজের প্রান্তসীমায় নিক্ষিপ্ত, তার থেকে যাচ্ছেন এই রেশন ব্যবস্থার বাইরে। গত ১২ বছরের ও বেশি সময়কালে জনসংখ্যার অনেক বৃদ্ধি হলেও তাদের এই গণবণ্টন ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়নি। ২০১১ সালের সেন্সাসের পর জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধি হলেও সেই সমস্ত নাগরিকদের আনা হয়নি রেশন ব্যবস্থার অধীনে, কারণ তারপর আর সেন্সাস হয়নি। ২০২১’র জুনে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘিরে যে সমস্ত মামলাগুলো হয়েছিল, তখন সেগুলো নিষ্পত্তির সময় শীর্ষ আদালত স্পষ্টভাবেই জানায় যে যেহেতু বর্তমানে ২০১১’র সেন্সাসের ভিত্তিতে গণবন্টন ব্যবস্থার তালিকাটি রয়েছে, আর তারপর জনসংখ্যার বৃদ্ধি এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত নেই, তাই কেন্দ্রীয় সরকারকে নতুন করে তার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের ৯নং ধারা অনুযায়ী নথিভুক্ত করতে হবে গ্রামীণ ও শহরের প্রকৃত মানুষদের তালিকা। এই স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পিছিয়ে দিল ২০২১-কে ভিত্তি করে সেন্সাসের কাজ।

দেশের বহু গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন নাগরিক ও খাদ্য সুরক্ষা গ্যারান্টি ফোরামের বুদ্ধিজীবীরা দাবি তুলেছেন, অবিলম্বে ব্যাপকতম মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় এনে তাঁদের খাদ্য সুনিশ্চিত করা হোক। তাঁদের দেওয়া হোক মাথাপিছু ১০ কেজি করে খাদ্যশস্য, খাদ্য সামগ্রির তালিকা আরও প্রসারিত করে পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্যকেও তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হোক, ডাল, তেলও আসুক খাদ্য তালিকায়।

বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ক্রমেই নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে ভারতবর্ষ। নজিরবিহীন বেকারত্ব, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমে হ্রাসপ্রাপ্ত মজুরি প্রভৃতির চৌতরফা হামলায় বিপর্যস্থ দেশবাসী। দেশবাসীকে ঠিক মতো পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব। এই দাবিতেই সোচ্চার হতে হবে।

(তথ্যসূত্র: নিউজ ক্লিক)

খণ্ড-30
সংখ্যা-2