বেলেঘাটায় পূর্ব কলকাতা ‘বিদূষক’ নাট্যমণ্ডলীর ওপর গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ টিএমসির স্থানীয় নেতা হম্বতম্বি ও হামলা চালায়। এখানে রাসমেলা প্রাঙ্গণে ২৪-২৫ ডিসেম্বর দু’দিনের নাট্য উৎসব আয়োজন করেছিল বিদূষক। সমস্ত প্রস্তুতিই সম্পন্ন হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সাধারণ মানুষের সহযোগিতায়। কিন্তু টিএমসির ‘কেক উৎসব’ আছে তাই এলাকায় অন্য কোনও কার্যকলাপ চালানো যাবে না — এই কথা বলে টিএমসির স্থানীয় নেতারা হামলা চালায়। নাট্যকর্মী অমিত সাহা সহ কয়েকজনকে মারধোর করা হয়। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলার নাট্যকর্মী ও অভিনয় জগতের কর্মীদের মধ্যে থেকে অত্যন্ত দ্রুত, সময়োচিত ও আশাপ্রদ প্রতিবাদ উঠে আসতে দেখা গেল। প্রতিবাদের চাপে টিএমসির বিভিন্ন উচ্চতর স্তরের নেতারা প্রকাশ্যে ‘ভুল’ স্বীকার করেন এবং হামলাকারী স্থানীয় নেতাও শেষ পর্যন্ত নাট্যদলের কাছে ভুল স্বীকার করে মার্জনা চেয়েছে।
বিদূষক নাট্যদলের কর্মীরা এই অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিতে চাননি, তাঁরাই প্রথম রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। সামাজিক গণমাধ্যমে ঘটনাটিকে তুলে ধরার সাথে সাথে তাঁরা বাংলার বেশ কয়েক শত নাট্যগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন এবং ফুলবাগান সুকান্ত মঞ্চের সামনে ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ এক প্রতিবাদসভার ডাক দেন। ক্ষমতার দম্ভের বিরুদ্ধে, সুস্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ বজায় রাখার দাবিতে পথে নামার আহ্বান জানিয়ে তাঁরা প্রচারপত্রে লেখেন, “ব্রিটিশদের সময়ে নীল দর্পন নাটক নিষিদ্ধ করা, সত্তর দশকে নাটক প্রদর্শনের সময় নিহত হন প্রবীর দত্ত, তারপর পশুখামার, উইংকেল টুইংকেল’এর ওপর হামলা — এই ধারা আজও অব্যাহত।… আমরা প্রত্যয়ের সাথে বলতে চাই যে আবারও আমাদের নাট্যচর্চা তথা সংস্কৃতির প্রবাহমান ধারাকে পুষ্ট করে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।” বস্তুত পূর্বতন সরকারের আমলে এই বেলেঘাটার কাদাপাড়াতেই বিদুষকের রিহার্সাল রুম কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং পথনাটক করতে গিয়ে তৎকালীন শাসকদলের হাতে আক্রান্তও হতে হয়েছিল। স্বাধীন নাট্যচর্চা, সংস্কৃতি চর্চা ও মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে সকলকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাজ্যজুড়ে মুক্ত পরিবেশের দাবি তোলা হয় প্রচারপত্রে। বিদূষক নাট্যদলের অন্যতম কর্মী তথা সিপিআই(এমএল) সদস্য শুভ মাইতি জানিয়েছেন, সুকান্ত মঞ্চের সামনে প্রতিবাদ সভা ভালো সাড়া ফেলে। শুরুতে যে পুলিশ কোনও কথা শুনতেই রাজি ছিল না, তারাই জিডি নেয়। প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মী এবং গণতন্ত্র প্রিয় মানুষজন। বক্তব্য রাখেন বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, সুজাত ভদ্র, বিশিষ্ট অভিনেতা দীপক হালদার, নাট্যকার তীর্থঙ্কর চন্দ এবং আরো অনেকে। উপস্থিত ছিলেন পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, সায়ন, নৃত্যশিল্পী এবং অভিনেত্রী শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য সহ আরো অনেকে। সভা থেকে তৈরি হওয়া দাবিপত্রে প্রায় ১৫০ জন সম্মতি জানিয়ে সই করেন।
অভিনেতা এবং পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য তাঁর প্রতিবাদ লিখিতভাবে বিদুষককে পাঠিয়েছেন এবং সামাজিক মাধ্যমে তা ব্যক্ত করেছেন। অভিনেতা কৌশিক সেন ও ঋদ্ধি সেনও প্রতিবাদ প্রকাশ্যে আনেন। তাঁদের এই প্রতিবাদগুলি সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে, সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। ঋদ্ধি লেখেন, “শিল্পীরা এগিয়ে আসুক, দেখা যাক কত জনের গায়ে হাত তুলবে তৃণমূলের লুম্পেন গুণ্ডাবাহিনী”। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ব্যাপক ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদপত্রে তিনি লেখেন, “আমাদের যেন এসে বেদম মার দেওয়া হয়, যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়… ভোট রাজনীতিতে কাজে আসে না, এমন শিল্পীদের মেরে ঠাণ্ডা করে দেওয়া হচ্ছে… আমার পরের অভিনয় ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, রবীন্দ্রসদন মঞ্চে, এসে মেরে যান। আমি প্রতিবাদ করছি এটা জেনেই যে এই প্রতিবাদ ব্যর্থ হবে”।
কলকাতার বাইরেও বারাকপুর, বহরমপুর সহ বিভিন্ন স্থানে নাট্যগোষ্ঠী প্রতিবাদে পথে নামে। বিদূষক নাট্যগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জারী করা সর্বশেষ বিবৃতিতে সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়েছে যে, শাসকদলের পক্ষ থেকে ভুল স্বীকার করে নেওয়া পদক্ষেপসমূহকে তাঁরা স্বাগত জানাচ্ছেন এবং আগামি ১৪-১৫ জানুয়ারি ২০২৩ বেলেঘাটা রাসমেলা মঞ্চেই তাঁদের নাট্যোৎসব হবে। তাঁরা এই বিবৃতিতে প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, “ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও সংস্কৃতি চর্চাকে বাধা দেবার প্রচেষ্টা হলে আমরা প্রতিবাদে সামিল হব”।