প্রতিবেদন
ইজরায়েলের নির্বাচনে অতি দক্ষিণপন্থীদের জয়, আতঙ্কে প্যালিস্টিনীয়রা
Palestinians in fear

ইজরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টরপন্থী এবং গোঁড়া ধর্ম-ভিত্তিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব আরও সংঘাতময় হয়ে উঠবে বলে ইজরায়েলের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রবল শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা।

ইজরায়েলে নভেম্বরে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে উগ্র-দক্ষিণপন্থী দল রিলিজিয়াস জায়োনিজম অনেকগুলি আসনে জয়লাভ করেছে। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতাসীন জোটের দ্বিতীয় সবচেয়ে শক্তিশালী শরিক জোট এরাই।

নতুন মন্ত্রীপরিষদে জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রীর পদে নিয়োগ করা হয়েছে ইতামার বেনগ্যভিরকে। ইজরায়েল এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে পুলিশি ব্যবস্থার দায়িত্বও এখন এই পদের অধীনে আনা হয়েছে। এই বেন-গ্যভির হলেন চরম জাতীয়তাবাদী এবং ইহুদী-বসতি সমর্থক দল ওৎজমা ইয়েহুদিৎ’এর নেতা, যে দল আরববিরোধী এবং বৈষম্যমূলক নানা নীতির প্রচারক।

তরুণ জাতীয়তাবাদী ও ধর্মভিত্তিক এক গোষ্ঠী — যারা রাস্তায় বন্দুক হাতে আন্দোলনের সমর্থক, ‘আনুগত্যহীন’ আরবদের ইজরায়েল থেকে বের করে দেবার আহ্বানে মুখর এবং পাথর নিক্ষেপকারী ফিলিস্তিনিদের গুলি করার মতবাদে বিশ্বাসী — তাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন এই ইতামার বেন-গ্যভির। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ইজরায়েলের পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকার সময় ইতামার বেন-গ্যভির আরব বিরোধী বর্ণবাদী আচরণের দায়ে এরআগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। গোঁড়া একটি প্রান্তিক গোষ্ঠীর নেতা থেকে দেশটির রাজনৈতিক মূলধারায় তার উত্থানকে অনেকেই ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতে একটি বিপজ্জনক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসাবে দেখছেন। বিশেষ করে, পশ্চিম তীরে ইতোমধ্যেই ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী যেভাবে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযান চালাচ্ছে এবং সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের দিক থেকেও মারাত্মক হামলা যেভাবে বেড়েছে, সেই পটভূমিতে এই নির্বাচন ও বেন-গ্যভিরের দলের উত্থানকে মারাত্মক বিপদজনক এক বিষয় বলেই মনে করা হচ্ছে।

কিছুদিন আগে হেব্রনে, ১৬ বছরের একজন তরুণসহ দু’জন ফিলিস্তিনিকে শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভের সময় গুলি করে হত্যা করেছে ইজরায়েলি সৈন্যরা। ইজরায়েলি সেনাদের ওপর ছুরি নিয়ে হামলার অভিযোগ তুলে আরও দু’জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। একজন ফিলিস্তিনির চালানো বন্দুক হামলায় নিহত হয়েছে একজন ইজরায়েলি, যে ফিলিস্তিনিকে পরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা শুধু হেব্রনে নয়, আরো নানা জায়গায় চলছে এবং পরিস্থিতি ক্রমশ আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। তবে হেব্রনেই এই সমস্ত ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে।

হেব্রন শহর হল তল্লাশি চৌকির শহর আর এর অধিকৃত এলাকা সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এখানে রয়েছে কয়েকশ ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর ঘর, যারা বাস করে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় এবং পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে। তাদের ঘিরে বসবাস কয়েখ লাখ ফিলিস্তিনি, যাদের না আছে নিরাপত্তা সুরক্ষা, না আছে কোনও অধিকার। অনেকেই মনে করেন প্যালেস্টাইনি এই ভূখণ্ডে এটা ইজরায়েলি দখলদারির চরম নিদর্শন।

ঐতিহাসিক এই শহরের রাস্তায় চোখে পড়ে বেসামরিক মানুষের অনেক বসতবাড়ি আর দোকানপাটের দরজায় কুলুপ আঁটা সামরিক বেড়া। দেয়াল আর নজরদারি টাওয়ার দিয়ে সেগুলো ঘেরা। একসময় ফিলিস্তিনিদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই এলাকায় এখন শুধু অনুমতি সাপেক্ষে ঢুকতে পারেন আগের বাসিন্দারা। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর যুক্তি এলাকাটিকে ‘নিষ্কলুষ’ রাখতে নিরাপত্তার প্রয়োজনেই এই ব্যবস্থা।

হেব্রন ইজরায়েলি কট্টর দক্ষিণপন্থীদের মূল রাজনৈতিক ঘাঁটি। সেখানে যেসব ইজরায়েলি বসতি নির্মাণ করে আছেন, তারা বেন-গ্যভির এবং আরেকজন উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক বেজালেল স্মটরিচের যৌথ নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতি নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন।

নির্বাচনের পরের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে সেখানে তরুণ ইজরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরের ওপর হামলা চালিয়েছে। এমনকী ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের সমর্থনে সেখানে সফররত একজন বামপন্থী ইজরায়েলি অধিকার কর্মীকে মারধর করেছে একজন ইজরায়েলি সৈন্য। একজন সৈন্যকে দেখা যায় এক ভিডিও বার্তায় বেনগ্যভিরের প্রশংসা করে বলছেন, তিনিই এই এলাকাকে ঠাণ্ডা রাখার উপযুক্ত ব্যক্তি।

নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় যাদের ঘরবাড়ির ওপর হামলা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু মারখিয়া এবং তার প্রতিবেশি ইমাদ আবু শামসিয়েহ। তারা দু’জনেই গত কয়েক বছর ধরে ফিলিস্তিনি একটি মানবাধিকার সংগঠনের হয়ে কাজ করেছেন এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলো নথিবদ্ধ করেছেন। অনেকেই মনে করছেন সে কারণেই তাদের নিরাপত্তা নিয়ে এখন প্রবল ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

“এখানে দাঁড়িয়ে ইহুদি তরুণরা আমাদের দিকে পাগলের মত পাথর ছুঁড়েছে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে আমাদের অভিশাপ দিয়েছে, বর্ণবাদী মন্তব্য করেছে, বলেছে, ‘আরবরা মরুক’ বলেছে ‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে। এসব ঘরবাড়ি আমাদের, আমরা সব কেড়ে নেব’,” বিবিসির প্রতিবেদককে বলেন আবু শামসিয়েহ।

তিনি বলছিলেন, বসতিস্থাপনকারীরা বিপুল সংখ্যায় এসেছিল। “আমার নিজের জন্য, স্ত্রীর জন্য আর বাচ্চাদের জন্য ভয় করছিল।”

বেন-গ্যভিরের প্রশংসা করে ভিডিও তোলা সৈনিককে পরে কয়েকদিনের জেল দেয়া হয়েছিল। তবে তার কারাবাস নিয়ে ইজরায়েলে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। জাতীয়তাবাদীরা যুক্তি দিয়েছেন সামরিক বাহিনীর নেতারা উদারপন্থীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে দেশের সুরক্ষায় নিবেদিত-প্রাণদের শাস্তি দিচ্ছেন।

ইজরায়েলি সমাজের ভেতর বিষয়টি নিয়ে বহুদিনের যে টানাপোড়েন রয়েছে অধিকৃত হেব্রনের পরিস্থিতি সেই চাপা আগুনকে আবার উস্কে দিয়েছে।

ইশাই ফ্লেইশার বসতি নির্মাণকারীদের অধিকারের পক্ষে। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন হেব্রনের ইহুদীদের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হিসাবে। হেব্রন সফরে যাওয়া ইজরায়েলের শান্তিকামী কর্মীদের বিরুদ্ধে তার সমর্থকদের স্লোগান ছিল — তারা ‘বিশ্বাসঘাতক’।

অধিকৃত পশ্চিম তীরে থাকেন প্রায় ৩০ লক্ষ ফিলিস্তিনি। ইহুদীদের বসতি এলাকায় বাস করেন প্রায় পাঁচ লাখ ইজরায়েলি। ইহুদী বসতিতে বসবাসকারী সবাই আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বলে বিবেচিত, যদিও ইজরায়েল তা মানে না।

দেশে বিদেশে ইজরায়েলের এই আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও ধ্বনিত হচ্ছে। এই এলাকায় জাতিসংঘের দূত টর ওয়েনেসল্যান্ড সেখানে ক্রমাগত বাড়তে থাকা হিংসার নিন্দা করেছেন। ইজরায়েলের বিদায়ী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গানৎজও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, বেন-গ্যভির দেশে আগুন জ্বালানোর ঝুঁকি তৈরি করছেন। তবে মার্কিন নীতির মদত বরাবরই ইজরায়েল পেয়ে থাকে এবং বিশ্বের নানা জায়গায় মার্কিনীরা নানা সময় হস্তক্ষেপ করলেও প্যালেস্টাইনের জমিতে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলা আক্রমণ নিয়ে তারা বরাবরের মতো এখনো চুপ করে আছে। ভারতও মোদী জমানায় ক্রমশ বেশি বেশি করে ইজরায়েলের সঙ্গে নানা ধরনের রণনৈতিক ও অন্যান্য সমঝোতায় জড়িত হয়ে পড়ছে। এর কিছু প্রকাশ্য হলেও অনেক কিছুই গোপন। পেগাসাস নজরদারির সময়ে যা ভীষণভাবে সামনে এসেছিল। ইজরায়েলের তরফে প্যালিস্টিনীয়দের ওপর ক্রমাগত অন্যায় আক্রমণের ঘটনাগুলিতে প্রতিবাদের কোনও লক্ষণ ভারতের শাসকদের তরফে স্বাভাবিকভাবেই নেই। এই অবস্থায় ভারতের জনগণ, বিশেষত বাম ও গণতান্ত্রিক শিবিরের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে এইসমস্ত ঘটনাগুলিকে নিয়ে প্রতিবাদ জারি রাখার।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-30
সংখ্যা-2