সিদ্ধান্ত
ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধের প্রেক্ষাপট, দিশা ও কর্তব্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত
Ainti-Fascist Resistance

(আসন্ন একাদশতম পার্টি কংগ্রেসের এই রাজনৈতিক খসড়া প্রস্তাবনা প্রকাশ করা হল। — সম্পাদকমণ্ডলী)

১) নরেন্দ্র মোদী সরকার এখন আট বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। মোদী সরকারের প্রথম মেয়াদটি ছিল সেই সময়ের দিনগুলিতে যা ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে এক প্রাথমিক হুঁশিয়ারি, আর দ্বিতীয় মেয়াদটি হল তীব্র গতিতে বেড়ে চলা এক সুসমন্বিত বহুমুখী আক্রমণের সময়কাল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে অজিত ডোভাল — এই জুটির মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র এক অভূতপূর্বভাবে দমনমূলক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাষ্ট্র হিসেবে উঠে এসেছে। শাসকের ছাড়পত্র ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে উৎসাহিত বিভিন্ন ব্যক্তিগত সেনা ও ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী এবং এক তাণ্ডবকারী রাষ্ট্রের নাগপাশে ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র আজ ছটফট করছে। জাতীয়তাবাদের নামে নিরবচ্ছিন্ন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং ‘আভ্যন্তরীণ শত্রু’ তকমা দিয়ে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী রাষ্ট্র-সমর্থিত সন্ত্রাস ও অত্যাচারের এই সমন্বয় ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত। ভারতে এই ফ্যাসিবাদ নিজেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক হিন্দু আধিপত্যবাদ বা ‘হিন্দুত্ব’র ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত জাতীয়তাবাদ হিসেবে তুলে ধরে।

২) আরএসএস বরাবরই আদর্শগতভাবে ফ্যাসিবাদী। ফ্যাসিবাদী এজেন্ডা কার্যকর করার আরএসএসের সক্ষমতা নির্ভর করে কতটা ক্ষমতা সে অর্জন করেছে তার ওপর — রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং রাস্তার ক্ষমতা উভয়ের উপরই। নিরন্তর ঘৃণা, মিথ্যা ও গুজব ছড়ানো এবং মূল মূল প্রতিষ্ঠানগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ ও ভেতর থেকে তাদের বদলে দেওয়ার নিরলস অভিযান চালিয়ে ওরা ওদের প্রায় এক শতাব্দীর বিগত জীবনজুড়ে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। রাম মন্দির অভিযান ছিল তার উত্থানের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক পর্যায় যা উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। রথযাত্রার উন্মাদনায় চড়ে বিজেপির এই উত্থানকে আমরা সেই সময়েই সঠিকভাবে চিহ্নিত করে বলেছিলাম যে, এটা নিছক সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ বা ধর্মান্ধতা নয় বরং সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ। কারণ আমরা সেই অভিযানকে দেখেছিলাম ভারতের পরিচিতির নতুন সংজ্ঞা নির্মাণের প্রচেষ্টা হিসেবে এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রের কাঠামো খর্ব করার চেষ্টা হিসাবে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে শুরু করে ২০০২ সালে গুজরাটে গোধরা-পরবর্তী গণহত্যা সংগঠিত করা পর্যন্ত এই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ বিস্তার ও প্রভাব তখন প্রত্যক্ষ করেছি আমরা।

৩) এই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ পর্যায়ক্রমিক উন্মাদনা তৈরি করেছিল। আবার, চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে এবং তার স্বরূপ ব্যাপকভাবে উন্মোচিত হয়ে গিয়ে সে পর্যায়ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। গুজরাট ২০০২’র পর ২০০৪ সালে এনডিএ ভারতের ক্ষমতা হারায়। গুজরাট গণহত্যা নরেন্দ্র মোদীকে আন্তর্জাতিক অভিযোগের মুখে দাঁড় করিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল। সেই পরিস্থিতিতে কর্পোরেট ইন্ডিয়া ‘ভাইব্রেন্ট গুজরাট’এর ব্যানার সামনে এনে নরেন্দ্র মোদীর পাশে সমাবেশিত হয়। কর্পোরেট শক্তির এই অনুগত সমর্থন ওদের বিপুল শক্তি যুগিয়ে বিরাট গতি দেয় এবং ২০১৪ সালে সংঘ-বাহিনীর প্রচারাভিযানকে ক্ষমতা হাসিলের দিকে নিয়ে যায়। তারপর থেকে আম্বানি গোষ্ঠী এবং দ্রুত উঠে আসা আদানি গোষ্ঠীর (যার সাথে টাটারাও এগিয়ে আসছে তাদের হারানো জমির অনেক অংশ পুনরুদ্ধার করে) নেতৃত্বে সংঘ বাহিনীর সাথে কর্পোরেট ভারতের জোট আঁটোসাঁটো হতে হতে এখন দেশে তাণ্ডবলীলার বুলডোজারে পরিণত হয়েছে যেখানে কর্পোরেট ভারত বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখার জন্য অর্থ ঢালছে আর বিনিময়ে বিজেপি একের পর এক আইন প্রণয়ন করে সমস্ত সম্পদকে — মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ, সরকারি লগ্নিভাণ্ডার ও সরকারি পরিকাঠামো — গুটিকয় কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিচ্ছে। স্পষ্টতই, কর্পোরেট লুণ্ঠন এবং ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং একে অপরকে পুষ্ট করে চলে।

৪) সঠিকভাবেই আমরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের উত্থানের প্রথম সুনির্দিষ্ট লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলাম এবং এই ক্রমবর্ধমান হুমকির বিরুদ্ধে একটি টেকসই মতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রচারাভিযান শুরু করেছিলাম। রাঁচি পার্টি কংগ্রেসে আমরা যথাযথ মনোযোগ দিয়েছিলাম, নরেন্দ্র মোদীকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আনার ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট কোলাহলের বিশ্লেষণে; মনোযোগ দিয়েছিলাম কীভাবে এই কর্পোরেট সমর্থনপুষ্ট দুর্নীতি ও বংশ-নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির বিপরীতে বহুপ্রতীক্ষিত সৎ বিকল্প তথা উন্নয়নের প্রতিমূর্তি হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তির নতুন মোড়ক নির্মাণ করে ফ্যাসিবাদকে নতুন নতুন সামাজিক ও ভৌগোলিক পরিসরে ঢুকে পড়ার রাস্তা খুলে দিচ্ছিল। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমরা যখন মানসাতে আমাদের দশম পার্টি কংগ্রেস আয়োজন করছি ততদিনে কেন্দ্রে মোদী সরকারের প্রায় চার বছর শাসনের অভিজ্ঞতা আমরা অতিক্রম করে এসেছি। বামপন্থীদের একটি নির্দিষ্ট অংশ সহ ভারতের বেশিরভাগ বিরোধী দল তখন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে কোনও উদ্বেগজনক বাস্তবতা হিসাবে স্বীকার করেনি, যাকে সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে প্রতিরোধ করাটা দরকার। লাগামহীন ক্রোনি পুঁজিবাদ, তীব্রতর হতে থাকা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং সংবিধানের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণগুলিকে আলাদা আলাদাভাবে স্বীকার করা হলেও এই প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যগুলি যুক্ত হয়ে যে ফ্যাসিবাদের ভারতীয় সংস্করণ প্রসারিত হচ্ছে। তার ক্রমবর্ধমান শক্তি ও নির্বাচনী সাফল্যের সম্প্রসারণ যে ভারতে এক অভূতপূর্ব বিপর্যয় ঘটিয়ে আধুনিক সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে ভারতের ধারণা ও অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে তা তাঁরা চিহ্নিত করতে চাননি। বামপন্থীদের একাংশ ‘কর্তৃত্ববাদ’ শব্দটির বাইরে বেরোতে অস্বীকার করে। আদতে এই শব্দটা দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের হাজির করা বিপদের মাত্রা ও প্রকৃতি মোটেই প্রতিফলিত করা যায় না।

৫) এই মতাদর্শগত বিভ্রান্তি অব্যাহত ছিল এমনকি যখন উত্তর-পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা, উত্তরে উত্তরপ্রদেশ এবং দক্ষিণে কর্ণাটকের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলিকেও বিজেপি পকেটে পুরে ফেলল এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে নেতৃস্থানীয় বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হল আর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার ক্ষমতা দখলের তোড়জোড় শুরু করল তখন পর্যন্ত। কেন্দ্রে বা কিছু রাজ্যে শাসন চালাচ্ছে আবার অন্য কিছু রাজ্যে বিরোধী দল হিসাবে কাজ করছে এমন ‘যেমনটা সবসময় হয়ে আসছে’ তেমন ধারার আর পাঁচটা শাসক শ্রেণীর দলের মতোই একটা দল হিসেবে বিজেপিকে দেখার তীক্ষ্ণ বৈপরীত্যে আমরা আমাদের মানসা কংগ্রেসে মোদী শাসনকে ফ্যাসিবাদী শাসন হিসাবে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করি এবং এই দ্রুত জমাট হতে থাকা ফ্যাসিবাদ ও তার ক্রমবর্ধমান হামলার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধের আহ্বান জানাই। আমরা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ গণসংগ্রামের মাধ্যমে মোদী শাসনের আক্রমণাত্মক বিরোধিতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার উপর এবং বিজেপি-বিরোধী ভোটের বিভাজন আটকাতে বিরোধী দলগুলির মধ্যে ব্যাপক-ভিত্তিক নির্বাচনী সমন্বয়ের সম্ভাবনাগুলি অন্বেষণ করার উপর জোর দিয়েছি। আজ, আমরা এমন এক ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করছি যা হল — আক্রমণাত্মক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আনুগত্য, সংবিধান ও গণতন্ত্রকে ভেঙে ফেলা, যেকোনো আদর্শিক ভিন্নমতের ওপর লাগাতার নিপীড়ন এবং বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং দলিতদের ওপর সহিংসতা চালানোর বেসরকারি অধিকার হিন্দু আধিপত্যবাদী সংগঠনগুলির হাতে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি জাতব্যবস্থা ও পিতৃতন্ত্রের বেড়ে চলা আগ্রাসন। মোদী শাসন এবং সংঘ ব্রিগেডের ফ্যাসিবাদী আক্রমণের ক্রমবৃদ্ধির সাথে সাথে একে এক অঘোষিত কিন্তু সর্বব্যাপী ও স্থায়ী জরুরি অবস্থা হিসাবে উপলপব্ধি করার পরিধিও বিস্তৃত হচ্ছে এবং গণবিরোধিতার সম্ভাবনাও বাড়ছে। আমাদের এই সম্ভাবনাকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রতিরোধের শক্তিশালী স্রোতে পরিণত করতে হবে।

৬) একটি তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রবণতা এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলন হিসাবে ফ্যাসিবাদ বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভিত্তি লাভ করতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয় এবং ইউএসএসআর আকারে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল এ বিশ্ব। আর তার পাঁচ বছর পরে ইতালিতে প্রথম ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থানও প্রত্যক্ষ করে দুনিয়া। ইতালির পরে ফ্যাসিবাদ ইউরোপের দুটি প্রধান দেশ স্পেন ও জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করতে সফল হয় এবং সমগ্র ইউরোপ জুড়ে সমাজতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও মানবিক আবেদনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রবণতা হিসাবে ফ্যাসিবাদ আবির্ভূত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ভারতসহ এশিয়ায় এই প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ভারতে ফ্যাসিবাদ অনুরণন তুলেছিল হিন্দুত্বের আদর্শের মধ্যে, যার মূল ভিত্তি ছিল — হিন্দুদের সাথে মুসলিম ‘হানাদারদের’ এক অবিরাম সংঘাত হিসেবে ভারতের ইতিহাসকে ১৮৫৭ পরবর্তীকালের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুনর্লিখন প্রক্রিয়া এবং আরএসএস সংগঠন।

৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্য শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি বিশ্বব্যাপী সামরিক মহরায় পরিণত হয় যা ইতালি এবং জার্মানির ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটায় এবং ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও আন্দোলনেকে আন্তর্জাতিক স্তরে পরাজিত ও চরম ধিক্কৃত করে দেয়। ফ্যাসিবাদের এই সামরিক পরাজয় যদিও বিশ্বযুদ্ধের নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও গতিপথের ফসল ছিল, তথাপি ফ্যাসিবাদকে বোঝার এবং প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতাগুলি আজকের ভারতীয় ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় প্রাসঙ্গিক আকর হিসেবে আছে।

৮) ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আলোচনা ১৯২০’র দশকের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রাধান্য লাভ করেছিল। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিপদের গভীরতা সঠিকভাবে বুঝতে লেগেছিল আরও কিছুটা সময়। আন্তোনিও গ্রামসি ১৯২০ সালে ইতালিতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে পেশ করা প্রতিবেদনে ইতালিতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার উত্থানের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এবং দুই বছর পরে যখন মুসোলিনি বাস্তবে ক্ষমতা দখল করল তখন তিনি এটিকে মোটেই এক ক্ষণস্থায়ী পর্যায় হিসাবে দেখেননি। তবুও, তাঁর প্রাথমিক মূল্যায়নে তিনি ইতালীয় ফ্যাসিবাদকে কৃষিভিত্তিক বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন এবং ভাবতে পারেননি যে শিল্প বুর্জোয়ারাও মুসোলিনির চারপাশে সমাবেশিত হবে। ১৯২৩ সালের জুন মাসে কমিন্টার্নের কার্যনির্বাহী কমিটির তৃতীয় প্লেনামে ক্লারা জেটকিন উপস্থাপিত ফ্যাসিবাদের উপর প্রথম কমিন্টার্ন রিপোর্ট ফ্যাসিবাদের ব্যাপক সামাজিক প্রভাবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং স্পষ্ট করে যে “কেবলমাত্র সামরিক উপায়ে একে পরাজিত করা যায় না… একদম মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ভাবেও অবশ্যই লড়তে হবে আমাদের”। নির্দিষ্ট পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে প্রতিটি দেশে ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য স্বীকার করে নিয়েও রিপোর্টটি ফ্যাসিবাদের নিম্নলিখিত দুটি অপরিহার্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে : “একটি জাল বিপ্লবী কর্মসূচি, যা অত্যন্ত চতুরতায় ব্যাপক বিস্তৃত সামাজের জনগণের মেজাজ, আগ্রহ ও চাহিদার সাথে নিজেকে যুক্ত করে; এবং নৃশংস ও সহিংস সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করে”।

৯) ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ঐতিহাসিক সপ্তম তথা শেষ কংগ্রেসে এসে অবশেষে এক সার্বিক বিশ্লেষণ ও সিরিয়াস কৌশলগত দিশা উঠে আসে। বুলগেরিয় কমিউনিস্ট নেতা জর্জি দিমিত্রভ, যিনি নাৎসি আদালতে বিখ্যাত লিপজিগ ট্রায়ালে নিজে সওয়াল করে নিজেকে রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগানোর মিথ্যা অভিযোগ থেকে রক্ষা করে বেকসুর খালাস করতে পেরেছিলেন, তাঁর পেশ করা প্রতিবেদনে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে লগ্নিপুঁজির সবচেয়ে কট্টর সাম্রাজ্যবাদী, সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশের প্রকাশ্য সন্ত্রাসী একনায়কত্ব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তাঁর প্রতিবেদনটি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সতর্ক করে বলেছিল যে, ফ্যাসিবাদী শাসন ক্ষমতাতে আসার বিষয়টিকে একটি বুর্জোয়া সরকার গিয়ে আরেকটি বুর্জোয়া সরকার আসার মতো স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে দেখলে খুব ভুল হয়ে যাবে। বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদী ধারণা ও ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানকে উপেক্ষা করার ভুলের বিরুদ্ধেও সতর্ক করেছিল প্রতিবেদনটি। দিমিত্রভের প্রতিবেদনটি ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রাথমিক পর্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং ফ্যাসিবাদের অধীনে রাষ্ট্র ও শাসনের প্রকৃতি কেমন তার উপর বেশি মনোযোগ দিয়েছে। নাৎসি প্রকল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় যে ছিল বিষাক্ত ইহুদি বিদ্বেষ সে সম্পর্কে প্রথম থেকেই সামনে আসা লক্ষণগুলির দিকে তথা আগ্রাসি সমাবেশ ও গণআন্দোলন হিসেবে ফ্যাসিবাদের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের দিকে দিমিট্রভের প্রতিবেদনটি যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি।

১০) ১৯৪৫ সালে হিটলারের পরাজয়ের পরই কেবল হলোকাস্টের অত্যাশ্চর্য মাত্রা এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে দুনিয়া জানতে পেরেছিল, যে হলোকাস্টে অন্তত ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে দমন ও বিরোধী কণ্ঠকে নিস্তব্ধ করে দেওয়াটা ‘অভ্যন্তরীণ শত্রুদের’ (ইহুদি, যাযাবর জিপসি, কমিউনিস্ট ও সমকামীরা হল নাৎসি জার্মানিতে রাষ্ট্রের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিতদের অন্যতম) সম্পূর্ণ নিকেশ করে দেওয়ার ভয়ঙ্কর প্রচারণা চালানোর রাস্তা সহজতর করে দিয়েছিল। নাৎসি শাসনে জার্মানির অভিজ্ঞতা ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি করেছিল এবং সারা বিশ্বে ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি পরাজিত ও ধিক্কৃত হয়ে পেছনে চলে গিয়েছিল। ভারতেও, আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রান্তিক শক্তি হিসেবেই ছিল, এবং দেশভাগের দগদগে ক্ষত থেকে যাওয়া সত্ত্বেও, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আরএসএস খুব বেশি জায়গা করতে পারেনি। কারণ, ভারত তার সংসদীয় গণতন্ত্রের নতুন পাওয়া সাংবিধানিক কাঠামো নিয়েই এগোয়। আরএসএস সংবিধান ও জাতীয় পতাকার বিরোধিতা করেছিল, আর গান্ধীহত্যা ছিল সদ্যজাত প্রজাতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করে দেওয়ার এক সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডটি আরএসএসকে সাংগঠনিক মতাদর্শগতভাবে বিচ্ছিন্ন ও কুখ্যাত করে তোলে। ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ থেকে জুলাই ১৯৪৯ পর্যন্ত আরএসএসকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল, “ঘৃণা ও অমঙ্গলের যে শক্তিটি জাতিকে বিপন্ন করছে” তা নির্মূল করতে। কিন্তু এখন পিছনে ফিরে তাকালে আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তী গভীর বিচ্ছিন্নতার পরবর্তীকালে অনেক ঐতিহাসিক মোড় দেখতে পাই যেখানে রাষ্ট্র ও শাসক কংগ্রেস, আর তার ফলে অন্যান্য অ-বিজেপি ক্ষমতাসীন দলগুলিও, আরএসএস ও তার অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে — ভারতীয় জনসঙ্ঘ ও তার উত্তরসূরী ভারতীয় জনতা পার্টিকে — সকল অপকর্ম তথা মৌলিক সাংবিধানিক নিয়মনীতির চরম লঙ্ঘন সত্ত্বেও, নাদানের মতো ছাড় দিয়ে দিয়ে তাদের বৈধতা ও শক্তি অর্জন করে নাটকীয়ভাবে প্রত্যাবর্তনে সমর্থ করে তুলেছে, বিশেষত অযোধ্যা আন্দোলন ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়পর্ব থেকে।

১১) ১৯২০ ও ১৯৪০’র দশকের মতো ফ্যাসিবাদ এখন আরও একবার একটি আন্তর্জাতিক প্রবণতা হিসাবে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। পূর্ববর্তী শতাব্দীর প্রথমার্ধে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হওয়া মহামন্দার পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট ও হতাশা থেকে উদ্ভুত উগ্র জিগির ও নৈরাজ্যবাদের আবহাওয়ায়। ইউরোপ জুড়ে সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ার ‘বিপদও’ অনেক দেশে বুর্জোয়াদের ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত করেছিল। আজ আবারও বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ গভীর সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে নিমজ্জিত এবং যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদ ঘনীভূতকরণ তথা বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে খর্ব করার মাধ্যমে তারা এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিশ শতকের পর্বের মতোই বর্তমান পর্বেও বিভিন্ন দেশের ফ্যাসিবাদ সেই দেশের সুনির্দিষ্ট জাতীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ি রূপ পরিগ্রহ করতে বাধ্য। ভারতীয় পরিঘটনাটি বিশেষভাবে অনন্য হয়ে উঠেছে এক শতাব্দী ধরে ফ্যাসিবাদী প্রকল্পকে লালন-পালন করে আসা আরএসএস’এর কেন্দ্রীয় ভূমিকার কারণে। ভারতে ফ্যাসিবাদের উত্থান প্রাথমিকভাবে ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিকাশের দ্বারাই চালিত হয়েছে বটে কিন্তু বর্তমান আন্তর্জাতিক আবহ তাকে যথেষ্ট স্ট্র্যাটেজিক সমর্থন ও বৈধতা যোগাচ্ছে।

১২) প্রথমে গণহত্যা এবং বিচারবহির্ভূত সন্ত্রাসের সুব্যবস্থিত ও ব্যাপক প্রয়োগের ভিত্তিতে গুজরাটে ক্ষমতা সুসংহত করে তারপর ২০১৪ সাল থেকে সেই গুজরাট মডেল দেশজুড়ে অনুকরণের নামে, মোদী শাসন গত দুই দশকে যেভাবে বিকশিত হয়েছে তার সাথে নাৎসি জার্মানির সাদৃশ্য কোনোভাবেই দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। মিলগুলি কেবল এই দুই শাসনের বাহ্যত স্পষ্ট হিটলার ও মোদী পার্সোনালিটি কাল্টের বিশিষ্ট ধরনের মধ্যে নয়, বা মিথ্যা প্রপাগাণ্ডার ব্লিটজক্রেগগুলির মধ্যেই নয়, বরং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে আদর্শ, রাজনীতি, আইন ও বিধান প্রণয়নে এই দুটি শাসনের কার্যকরী কাঠামোতে এই মিলগুলি নিহিত। নাৎসি জার্মানির অ্যান্টি-সেমেটিক অভিযান, যা হলোকাস্টের ভয়াবহতা এবং প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি নির্মূলকরণের দিকে পরিচালিত করেছিল, ছিল এক ভয়ঙ্কর প্রচারণার দ্বারা চালিত। এবং কুখ্যাত নুরেমবার্গ আইনের মতো নির্দিষ্ট নিশানায় আনা আইন জার্মান ইহুদিদের বহু অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের আইনগতভাবে ও সামাজিকভাবে দুর্বল অবস্থায় ফেলে দিয়ে জার্মান রাষ্ট্র ও হানাদার স্কোয়াড পরিচালিত নৃশংস আক্রমণ ও গণহত্যার শিকার বানিয়েছিল। এদেশেও আমরা একইরকম পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া গড়ে উঠতে দেখতে পাচ্ছি যা বেশ কয়েকটি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইন এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়কে নিশানা বানাচ্ছে তাঁদের জীবিকা (যেমন গবাদি পশুর ব্যবসা এবং মাংসের দোকানের ওপর নিষেধাজ্ঞা), ধর্মীয় স্বাধীনতা (ধর্মান্তরকরণ, মসজিদ ভেঙে ফেলা, হিজাব নিষিদ্ধকরণ, অন্য ধর্মে বিবাহকে অপরাধ হিসেবে চহ্নতকরণ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড, সর্বজনীন স্থানে প্রার্থনার উপর নিষেধাজ্ঞা), থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব (সিএএ স্পষ্টভাবে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য করে) ও অস্তিত্বের মৌলিক নিরাপত্তা (মুসলিমদের ঘরবাড়ি বুলডোজিং, মব-লিঞ্চিং, স্থানীয় মাত্রায় সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনার মধ্যে গণহত্যার উন্মুক্ত আহ্বান) সহ সমস্ত অধিকারের ওপর আক্রমণ চালিয়ে।

১৩) উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও, এখনও সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের অধীনে থেকে যাওয়া একটি পূর্ব-উপনিবেশ দেশের ফ্যাসিবাদ অনিবার্যভাবেই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ফ্যাসিবাদের তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হবে। বিশেষত আমাদের দেশের জনগণ বিশ্বপুঁজির দ্বারা এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত দেশীয় বিলিয়নেয়ার পুঁজিপতিদের দ্বারা অনবরত লুণ্ঠিত হচ্ছে। তাই এদেশে, ইউরোপের ফ্যাসিবাদের অভিজ্ঞতার বিপরীতে, যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে জাতির প্রধান অধিকারী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে তাদেরও কিন্তু বাস্তবে কোনও অর্থনৈতিক লাভের আশাই নেই। পরিবর্তে তাদের প্রতিদিন গিলতে হবে জাতির অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসাবে দেগে দেওয়া জনগণের ওপর চলা ক্রমবর্ধমান জিঘাংসার বীভৎসতা। তদুপরি, ফ্যাসিবাদের বর্তমান পর্যায়টি বিশ্বব্যাপী নব্য উদারনীতিবাদের প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হয়েছে যেখানে পুঁজি আক্রমণাত্মক এবং একের পর এক সঙ্কটের সম্মুখীন, যেখানে শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যা কিছু অর্জিত হয়েছিল সে সবই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং জনসাধারণের এক্তিয়ারে যেটুকু সম্পদ বেঁচেবর্তে ছিল সেগুলিও দখল করে নেওয়া হচ্ছে বেসরকারিকরণ, জমিগ্রাস ও পরিবেশ ধ্বংসের ব্যাপক বিধ্বংসী অভিযান চালিয়ে। এই ধরণের বিধ্বংসী অভিযান মোদীর ফ্যাসিবাদী শাসনের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র হয়ে ওঠে, যে শাসন এইসব বিধ্বংসী প্রক্রিয়াগুলিকে আরও জোরালো গতি দেয়। এবং এই অভিযান মোদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় স্তরে আন্তর্জাতিক বিরোধিতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও অসম্ভব করে তোলে। ২০০২ সালের গণহত্যার পরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদী আন্তর্জাতিক ময়দানে যৎসামান্য যেটুকু নিন্দার সম্মুখীন হয়েছিল তা এখন বদলে গেছে আন্তর্জাতিক ক্ষমতাতন্ত্র দ্বারা সহযোগিতা ও বৈধতা প্রদানের পথে।

১৪) ফ্যাসিবাদ কোন এক অভ্যন্তরীণ শত্রু খাড়া করে সেই শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যাপক উন্মাদনা জাগিয়ে তোলে; তাদের রাষ্ট্র, জাতি, সভ্যতা, সংস্কৃতি এমনকি জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যেরও সাধারণ শত্রু হিসেবে খাড়া করে এই উন্মাদনা জাগানো হয়। সেই লক্ষ্যে নিজেদেরকে একইসাথে ‘লাঞ্ছিত ও আক্রান্ত’ হিসেবে, আবার ‘গর্বিত ও প্রভুত্বকারী’ হিসেবে দাবি করে হট্টগোল ফেলে দেওয়া হয়। ক্রমাগত এক অতীত স্বর্ণযুগের কিংবদন্তী ও এক ভবিষ্যৎ স্বর্গসুখের আকাশকুসুম ফেরি করে চলা হয়। আজকের ভারতে এগুলো খুব সুপরিকল্পিত দক্ষতায় ঘটাতে দেখতে পাচ্ছি আমরা। সংঘ পরিবার মিথ্যা ইতিহাসকে প্রোমোট করে চলে বৈদিক যুগকে জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখর হিসাবে নিরন্তর মহিমান্বিত করে তুলতে এবং ভারতকে একটি সাংবিধানিক সাধারণতন্ত্রের বদলে ‘সভ্যতার সত্তা’ হিসাবে বেশি প্রজেক্ট করে। এবং ভারতকে শুধু আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্যন্তই নয়, এমনকি পশ্চিমে আফগানিস্তান, দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা, উত্তরে তিব্বত, নেপাল ও ভুটান এবং পূর্বে মায়ানমার পর্যন্ত প্রসারিত এক ‘অখণ্ড ভারতে’ রূপান্তরিত করা এবং মোদীর ভাষায় যা ‘বিশ্বগুরু’ সেই সুপার পাওয়ার বানানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। হিটলার ফ্যাসিবাদকে ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রের’ মডেল হিসাবে উপস্থাপন করার জন্য সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয় আবেদনকে ব্যবহার করে নিয়েছিলেন। আরএসএস এবং বিজেপি স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার মহান আবেদনকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদকে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার একটি নতুন স্তর হিসাবে উপস্থাপন করছে। বিজেপির ‘আত্মনির্ভর ভারত’ বাগাড়ম্বরটিতে অবশ্য কোনও স্বদেশী অন্তর্বস্তু নেই, এটা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র নামে ভারতকে বিশ্বপুঁজির কাছে ভাড়া খাটাতে চায় মাত্র।

১৫) একইভাবে এরা উপনিবেশ-বিরোধী বাচনকে কর্পোরেট আধিপত্য বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয় বরং ভারতের নিজস্ব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। ইসলাম-ভীতির বর্তমান বিশ্বের আবহের সাথে জুড়ে দিয়ে হিন্দুদের মনে মিথ্যা আতঙ্ক তৈরি করা হয় যে মুসলিম জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, অভিবাসন এবং অনুপ্রবেশের ফলে হিন্দুরা ভারতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। জার্মানির নাৎসি মডেল চেয়েছিল জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে, একটি জাতিগত সুখস্বপ্ন চাগিয়ে দিতে। তা করতে তারা দ্বিমুখি পদ্ধতি নিয়েছিল। একদিকে জিনগতভাবে রোগাক্রান্ত আর প্রতিবন্ধী তকমা দেওয়া মানুষ থেকে জার্মান জাতির নিষ্কৃতির লক্ষ্যে সুব্যবস্থিত গণহত্যা, গণনির্বীজকরণ ও ইউথানাশিয়ার (ব্যথাহীন মৃত্যু) মাধ্যমে কিছু জাতিকে একেবারে মুছে ফেলা এবং অন্যদিকে জার্মান জাতির তথাকথিত ‘জীনগত উন্নয়ন’ ঘটাতে এমনকি মানব প্রজনন প্রকৌশল (ইউজেনিক) প্রণয়ন। আজ ভারতেও অনুরূপ পরিকল্পিত গণহত্যা সংগঠিত করার, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানানোর ও নির্বীজকরণের রাষ্ট্র-অনুমোদীত আহ্বান নিয়মিত শোনা যাচ্ছে এবং এগুলো যে শীঘ্রই বাস্তবে পরিণত হতে পারে সেরকম ভয়ানক সংকেতও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মোদীর অধীনে ভারত নাৎসি জার্মানি ছাড়াও ইসরায়েলি মডেল থেকেও বহু কিছু নিচ্ছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নীতি ইসরায়েলের সামরিক মতবাদ এবং নজরদারি কৌশলগুলিকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে অনুকরণ করে এবং হিন্দুত্ব মতবাদ ইসরায়েলের ইহুদিবাদী আগ্রাসনের নীতির সাথে ঘনিষ্ঠ আদর্শগত সাদৃশ্য প্রদর্শন করে। ইসরায়েল যেমন তার ফিলিস্তিন-বিরোধী নীতির প্রতিটি সমালোচনার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য ইহুদি-বিদ্বেষের পুরনো ইতিহাসকে টেনে আনে, তেমনি মোদী শাসন এবং আরএসএস ‘হিন্দুফোবিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেছে এবং সংঘ-ব্রিগেডের হিন্দু আধিপত্যবাদী প্রচারণার যেকোনও বিরোধিতাকে দমন করতে হিন্দু-বিদ্বেষের অভিযোগ আনতে শুরু করেছে।

১৬) ভয় এবং ঘৃণা, শিকার এবং শিকারির এই সমন্বয়কে ঘিরে জনমত তৈরি করার এক ব্যাপক বিস্তৃত কৌশল অনুসরণ করে সংঘ-বিজেপি বাহিনী। একদম শুরু থেকেই মোদী নিজেকে প্রতিষ্ঠা-বিরোধী ধর্মযোদ্ধা হিসাবে বিপণন করে এসেছেন, বঞ্চনা ও নিপীড়নে আরও অবনতির মুখে পড়া দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের বিশাল অংশের মধ্যে এক ক্ষোভের অনুভূতি জাগিয়ে। ভারতে দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনের সাথে বর্তমান স্থিতাবস্থার সমস্ত মন্দ দিককে তিনি অত্যন্ত চতুরতার সাথে যুক্ত করতে পেরেছেন, এবং আরও এগিয়ে, এই দীর্ঘ শাসনকে দুর্নীতি ও রাজবংশের রাজনীতির সাথে একাকার করে দেখিয়েছেন। ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’এর আহ্বান এই প্রতিষ্ঠা-বিরোধী মেজাজে ধরা দেয় এবং, এমনকি কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করার পরেও, তিনি লুটিয়েন দিল্লীর বিরুদ্ধে তাঁর কটাক্ষ বজায় রাখতে পারেন। যদিও তাঁর অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলি ক্রমশই জুমলা বা বাগাড়ম্বর হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠাতন্ত্রের চরিত্র নির্লজ্জ সাঁটগাঁট পুঁজিবাদ ও সংঘের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য রোপে ক্রমাগত স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে, তথাপি সমস্ত শ্রেণী ও স্তরের জনগণের এক উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও তাঁর এই প্রতিষ্ঠা-বিরোধী আবেদনে রোমাঞ্চিত।

১৭) ভায়োলেন্সে রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকারকে বেসরকারী ও বিচার বহির্ভূত ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর হাতে তুলে দিতে সংঘ-বিজেপির স্ট্র্যাটেজির কেন্দ্রে রয়েছে নেতার এই আবেদন। ইসলামোফোবিয়াকে, যা ভারতীয় মুসলমানদের এক ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসাবে ক্রমাগত অপরায়নে ফ্যাসিবাদীদের ইন্ধন জোগায়, আরও শক্তিশালী ও দৃঢ়বদ্ধ করার চেষ্টা চলে সংঘ পরিবারের নতুন-আবিষ্কৃত কৌশল ‘সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং’এর মাধ্যমে। বিভিন্ন রাজ্যে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সামাজিক জোট গড়ে সংঘ ‘পিছড়ে বর্গ’র ভেক ধারণ করে নিজেদের মনুবাদী চেহারা মুখোশের আড়ালে নিয়ে যায়। ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট থেকে আসা একজন প্রধানমন্ত্রী, বা দলিত ও আদিবাসী পৃষ্ঠভূমি থেকে আসা রাষ্ট্রপতিরা আরএসএস-এর ব্রাহ্মণ্যবাদী অন্তর্বস্তুকে আড়াল করার লক্ষ্যে আজকের বিজেপির প্রচারের প্রধান ঘুঁটি হয়ে উঠেছে। সংঘ-বিজেপির বয়ান সদাসর্বদা সংবিধান, সুপ্রিম কোর্ট, আধুনিক ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং বুদ্ধিজীবীদের, বিশেষত একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের সমালোচক ধারাগুলিকে পশ্চিমা-প্রভাবিত এবং উচ্চকোটিবাদী বলে সমালোচনা করে আর নরেন্দ্র মোদী ও তার শাসনকে প্রতিষ্ঠা-বিরোধী চ্যালেঞ্জার হিসাবে প্রজেক্ট করে। ওরা বেশিরভাগ বিরোধী দলকে বংশ ও পরিবার-পরিচালিত উদ্যোগ হিসাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করে, কিন্তু মোদী সরকারের বিপুল ব্যায়ের নিজস্ব মডেলটা প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের সাম্রাজ্যের আদলেই তৈরি করা হচ্ছে যেখানে তাঁর ক্ষমতার কার্যকালকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে নিরন্তর দাম্ভিক নির্মাণ চলছে একের পর এক স্মারকের — নতুন পার্লামেন্ট ভবন থেকে শুরু করে একগুচ্ছ মূর্তি আর মন্দির।

১৮) ভারতের শাসনব্যবস্থার মডেলের মধ্যে থেকে যাওয়া ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দুর্বলতার মধ্য থেকেও ভারতীয় ফ্যাসিবাদ শক্তি আহরণ করে। ভগৎ সিং ঔপনিবেশিক যুগের সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তার কথা জোরের সাথে তুলে ধরেছিলেন। তিনি জনপ্রিয় ভাষায় বলেছিলেন যে, স্বাধীনতার অর্থ কখনই সাদা ইংরেজদের হাত থেকে বাদামী সাহেবদের হাতে ক্ষমতা যাওয়া হতে পারে না। ১৯৮০’র দশকের শেষভাগ থেকে বিজেপির চমকপ্রদ উত্থানের আগে কংগ্রেসের দীর্ঘায়িত শাসন ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্বলতার বিষয়টিকে সুরাহা করেনি, বিপরীতে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করার সাংবিধানিক বিধানটি ব্যবহার করেছিলেন গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্থগিত রাখার উদ্দেশ্যে।

১৯) জরুরি অবস্থা স্বৈরাচারী শাসনের একটি ছাঁদ সরবরাহ করেছে যা মোদী সরকার তার ফ্যাসিবাদী সাধনায় নিখুঁত করে গড়ে তুলছে। এই ছাঁদ ভারতের বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা তথা আধিপত্য বিস্তারকারী কার্যনির্বাহী বিভাগের কাছে তার আত্মসমর্পণ করার প্রবণতাকে দেখিয়ে দিয়েছে। এই লীড অনুসরণ করে মোদী সরকার বিচারব্যবস্থার উপর সুব্যবস্থিতভাবে তার থাবা জোরালো করেছে এবং সমস্ত স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ ও সংবিধানের চরম উল্লঙ্ঘনে বিচার বিভাগীয় অনুমোদন হাসিল করেছে। জরুরি অবস্থার সময়েও সংবাদ স্বাধীনতার চেতনা যথেষ্ট মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছিল, এবং সংবাদ মাধ্যমকে অনুগত রাখতে স্বৈরাচারী শাসককে প্রেস সেন্সরশিপ আরোপ করতে হয়েছিল। এরফলে অবশ্য জনরোষ আরোই বৃদ্ধি পেয়েছিল। আজ শাসকের অনুগত কর্পোরেট স্যাঙাতদের পূর্ণ সমর্থনে — যারা আজকের মূলধারার মিডিয়ার বৃহৎ অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলিকে — মোদী সরকার ও আরএসএস মিডিয়ার মৌলিক চরিত্রকেই বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং মিডিয়াকে সংকুচিত করে যেখানে এনে ফেলেছে তাকে জনপ্রিয় ভাষায় বলে ‘গোদি মিডিয়া’ বা ল্যাপডগ/এমবেডেড মিডিয়া। আর যেসব সাংবাদিক নিজেদের যথাযথভাবে কর্তব্য করে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়, এমনকি হত্যাও করা হয়।

২০) দেশের সামনে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ থ্রেটের ধূয়ো তুলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্ট কর্তৃক ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭১ সালের নির্বাচনে জেতা পদকে বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করাকেই, যে রায় সুপ্রিম কোর্ট দ্বারাও বহাল ছিল, এই থ্রেটের সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। সেই সময় সরকারের সাথে দেশকে একাকার করার যুক্তি এবং সেই যুক্তিতে সরকার-বিরোধিতাকে দেশবিরোধী কাজ হিসেবে চিহ্নিত করাটাই ছিল জরুরি অবস্থার মূল কথা। জরুরি অবস্থা জারি করার সাথে সাথে প্রায় সমস্ত বিশিষ্ট বিরোধী নেতাকে এইভাবে জেলে পাঠানো হয়েছিল এবং নীতি প্রণয়ন ও তার প্রয়োগের মাধ্যমে অবাধে দেশ পরিচালনার জন্য সরকারকে সুযোগ করে দিতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা স্থগিত করা হয়েছিল। মোদী সরকার সেই যুক্তি ও ব্যাখ্যাকে প্রসারিত করেছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ইসলামোফোবিয়ার হাতিয়ার শানিয়ে। এখন মোদী সরকারের বিরোধিতা মানে তা একইসাথে ভারত-বিরোধী ও হিন্দু-বিরোধী হিসাবে ব্যাখ্যা হচ্ছে, আর কঠোর আইন, মিথ্যা মামলা, গালাগাল বাহিনী ও লিঞ্চিং স্কোয়াডে সুসজ্জিত সংঘব্রিগেড যে কোনও বিরোধিতাকে নিস্তব্ধ করে দিতে এক পূর্ণাঙ্গ মেসিনারি তৈরি করেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি নজরদারি ব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণ সহজতর করে এবং এই প্রযুক্তি ভিন্নমত পোষণকারী ও মানবাধিকার রক্ষকদের মিথ্যা দোষারোপ করার পাশাপাশি দরিদ্র ও প্রান্তিকদের সম্পদের নাগাল থেকে বাদ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়।

২১) জরুরি অবস্থা-পরবর্তী সময়ে মন্ডল কমিশনের সুপারিশের আংশিক প্রয়োগ এবং পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের কিছুটা সম্প্রসারণ প্রত্যক্ষ করা যায়। কিন্তু ১৯৯০’র দশকের গোড়ার দিকে নব্য-উদারনীতির কাঠামো গ্রহণের ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আবার বাড়তে শুরু করে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ক্রমাগত ক্ষয়ের শিকার হয়। জমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ জোরপূর্বক অধিগ্রহণ এবং আদিবাসী ও কৃষকদের বাস্তুচ্যুত করা ও মাওবাদী তকমা দিয়ে অত্যাচার চালানো ওড়িশা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ডের মতো সম্পদ-সমৃদ্ধ অঞ্চলে দৈনন্দিন বিষয় হয়ে ওঠে। মোদী শাসন এই নয়া-উদারনীতিকে আক্রমণাত্মক আগ্রাসনের এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছে যার ফলে ব্যাপক বিস্থাপন ও অভূতপূর্ব মাত্রার বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্রমশ গভীর হওয়া আর্থিক দুরবস্থা ও অনিশ্চয়তায় জনগণ যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেও সংঘ বাহিনী জনগণের মরিয়া অবস্থাকেই হাতিয়ার বানিয়ে তাদের ক্ষোভকে সর্বগ্রাসী বিদ্বেষ অভিযানে ভাসিয়ে নিয়ে বিপথে চালিত করে। সংঘের প্রচারণা সমাজের গভীরে প্রোথিত নিয়তিবাদ ও অস্পষ্টতাবাদকে সুনিপুণভাবে ব্যবহার করে যাতে সমস্ত দুর্দশার জন্য জনগণ বর্তমান সরকার বাদে আর সবকিছুকেই দায়ি ও দোষারোপ করতে থাকে, আর কল্পিত এক হুমকির মুখে হিন্দু পরিচিতি রক্ষা করা ও হিন্দু আধিপত্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে মোদী সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে তুলে ধরে যার সামনে অন্য সব ইস্যু তুচ্ছ হয়ে যায়।

২২) ফ্যাসিবাদী বিপর্যয় ও ধ্বংসের এই আবর্ত থেকে ভারতকে বাঁচানো আজ বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই কর্তব্য অবশ্যই সকল ধারার গণতান্ত্রিক শক্তি ও আদর্শের মধ্যে যতটা সম্ভব ব্যাপকতম ঐক্য ও সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। সংবিধান ও স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার রক্ষা করার এবং দেশ ও দেশের সম্পদ ও অবকাঠামোকে সরাসরি কর্পোরেট গ্রাসে চলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর আহ্বান হিসেবে ভারতে এই ঐক্য জনপ্রিয়ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সংবিধানকে সুরক্ষিত করতে এবং বেসরকারীকরণকে প্রতিহত করতে এক শক্তিশালী আন্দোলন উঠে এসেছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং কৃষি অর্থনীতি কর্পোরেট কোম্পানিগুলির কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে মোদী সরকারের চালের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় রূপে ও অভূতপূর্ব মাত্রায় এই একতা ও সংকল্প প্রতিফলিত হয়েছে। যে সাহসের সাথে নাগরিক সমাজের কর্মীরা ফ্যাসিবাদী শাসনের নিপীড়ন মোকাবিলা করছে আর যে ঐক্য ও দৃঢ়তা চলমান আন্দোলনগুলি প্রদর্শন করছে, বিপ্লবী কমিউনিস্টদেরকে সেই সাহস ও দৃঢ়তা একসাথে জুড়ে দেশের বিরোধীপক্ষকে শক্তি জোগানোর কাজ করতে হবে এবং সমস্ত ফ্রন্টে প্রতিরোধ জোরদার করতে হবে। নাগরিক সমাজ ও জনগণের আন্দোলনের তুলনায় বুর্জোয়া বিরোধীরা ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখে সাধারণত অনেকাংশে দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছে, বিশেষত অর্থলোভ এবং ব্ল্যাকমেল ও প্রতিহিংসার ভয়ের কারণে। ভারতের রাজনীতির মানচিত্রের বৈচিত্র্য এবং জটিলতা, কংগ্রেসের ক্রমাগত পতন, সর্বভারতীয় উপস্থিতি নিয়ে অন্য কোনও শক্তিশালী দলের উঠে না আসা — এইসবই বর্তমান সন্ধিক্ষণে বিজেপির জন্য সর্বভারতীয় স্তরে সহজ ময়দান যোগাচ্ছে। বিজেপি অবশ্যই বর্তমান পর্বের সবচেয়ে প্রাধান্যকারী দল, কিন্তু তারা যে মোটেই নির্বাচনে অজেয় বা অপ্রতিরোধ্য নয় তা বেশ কয়েকটি রাজ্যেই দেখা গেছে। আসন্ন নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপিকে দুর্বল করতে এবং মোদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সর্বভারতীয় স্তরে এবং প্রধান প্রধান রাজ্যগুলিতে একটি গতিশীল ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বিরোধীপক্ষ গঠন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ভারত যখন ১৯৭৭ সালে স্বৈরাচারী ইন্দিরা শাসনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল তখন জরুরি অবস্থা অলরেডি প্রত্যাহৃত হয়েছে। আর এখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার মধ্যে। ফলত ১৯৭৭’র তুলনায় ২০২৪ হবে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

২৩) এ’কথাও আমাদের হিসাবে রাখতে হবে যে বর্তমানে ভারতে যে বিরোধী ঐক্য গড়ে উঠছে তা এখনও কোনও সাধারণ ফ্যাসি-বিরোধী চেতনা বা প্রতিশ্রুতি দ্বারা নির্ধারিত নয়। যদিও বর্তমান শাসন আরএসএস’এর সংগঠনজাল থেকেই তার মূল শক্তি আহরণ করেছে তবু অনেক বিরোধী দল আরএসএস’এর বিরোধিতা করতে এবং এর বিবিধ ঘৃণা, মিথ্যা ও সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর অভিযানকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত নয়। অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে নয়া উদার আর্থিক নীতিমালা ও মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে এক বিস্তৃত ঐকমত্য রয়েছে। ভিন্ন মত পোষণকারী নাগরিক ও জনআন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থিতভাবে কঠোর আইন প্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় দমন ও নিপীড়ণের প্রশ্নটিও বিরোধী ঐক্যের এজেণ্ডায় দৃষ্টিকটুভাবে উপেক্ষিত থেকে যায়। বিরোধী দলগুলির যততা সম্ভব সার্বিক ঐক্যকে স্বাগত জানানো, সহযোগিতা করা এবং যোগদান করার সাথে সাথে কমিউনিস্টদের অবশ্যই রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত স্বাধীনতা সম্পূর্ণত বজায় রাখতে ও প্রয়োগ করতে হবে যাতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ও কার্যকর প্রতিরোধ জারি রাখা যায়।

২৪) আমাদের তাই এ’কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে কেবল মোদী সরকারকে ভোটে হারিয়েই ফ্যাসিবাদকে নির্ধারকভাবে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সংঘ বাহিনী ইতিমধ্যে যথেষ্ট ক্ষমতা অর্জন করেছে, একটি দুটি নির্বাচনে পরাস্ত হওয়াকে তারা ঠিক হজম করে নিতে পারবে। যা প্রয়োজন তা হল ফ্যাসিবাদের মতাদর্শ ও রাজনীতির এক জোরদার প্রত্যাখ্যান গড়ে তোলা যা একে আরেকবার ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজের প্রান্তে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে। যদিও নরেন্দ্র মোদী স্পষ্টতই এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছেন, বর্তমানে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপির ভোটও অনেকাংশে তিনিই ধরে রেখেছেন, এবং মোদী পার্সোনালিটি কাল্ট সংঘের আস্তাবলের অন্যান্য নেতাদের খাটো করে দিয়েছে, তথাপি এটাও লক্ষ্যণীয় যে সংঘ কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সব পর্বেই নেতৃত্বের এক লম্বা সারি যোগান দিয়ে গেছে। অবিচল গণতন্ত্র ও আমূল সামাজিক রূপান্তরের অগ্রবাহিনী হিসাবে কমিউনিস্টদের তাই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের উপযুক্ত জবাব দিতে এক দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বাত্মক প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আম্বেদকর সংবিধানকে একটি অগণতান্ত্রিক মাটির ওপর গণতন্ত্রের প্রলেপ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি জাতবর্ণ ব্যবস্থাকে আধুনিক ভারতের সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং সামাজিক সাম্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য এর সম্পূর্ণ বিনাশের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই কারণেই তিনি হিন্দুরাষ্ট্রকে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে বর্ণনা করেছিলেন যা থেকে ভারতকে রক্ষা করতে হবে। ভারতের নিপীড়নমূলক সামাজিক কাঠামোর মধ্যে নিহিত সবচেয়ে পশ্চাদপদ ধারণা, পশ্চাদপদ দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুশীলনগুলি, বিশেষত গভীরে প্রবিষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণপ্রথা ও পিতৃতন্ত্র ফ্যাসিবাদী আক্রমণে নিরন্তর ইন্ধন যুগিয়ে চলে এবং এই গণতন্ত্র-বিরোধী পরিবেশে তারা নতুন শক্তি ও বৈধতা লাভ করে। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে কমিউনিস্টদের অবশ্যই ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিটি প্রগতিশীল এবং পরিবর্তনকামী ধারাকে, বিশেষ করে জাতবর্ণ-বিরোধী ও পিতৃতন্ত্র-বিরোধী শক্তিশালী সংগ্রামগুলিকে, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং ভারতীয় সমাজ ও ইতিহাসে সাম্য, যুক্তি ও বহুত্বের অনুসন্ধান করতে হবে।

২৫) ফ্যাসিবাদকে যদি এক বিরাট বিপর্যয়ের গাড্ডা হিসাবে দেখা হয়, যে গাড্ডায় ভারত পড়েছে, তাহলে অবশ্যই সেই গাড্ডা থেকে উদ্ধার করা এবং বিপর্যয়, ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পুনর্গঠন করা উভয়ই ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধের লক্ষ্য হতে হবে। ভারতের জাতি-নির্মাণ প্রক্রিয়ার দুর্বলতা ও অসঙ্গতি, সামন্তবাদী অবশেষ ও ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার এবং সাম্রাজ্যবাদী নক্সার সঙ্গে ভারতের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আপোশ ও যোগসাজশ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ক্ষমতা দখল করতে এবং হিন্দুত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে পুনঃসংজ্ঞায়িত ও ভারতের শাসন ব্যবস্থাকে পুনর্নির্মিত করতে সক্ষম করে তুলেছে। আইনের শাসনের মূল বিষয়গুলি ইতিমধ্যেই একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে এবং এই ফ্যাসিবাদী শাসনের দীর্ঘায়িতকরণ এবং আরও গভীর শেকড় বিস্তার আধুনিক ভারতের সাংবিধানিক দিশা ও কাঠামোকেই বিপথগামী করবে। ফ্যাসিবাদের কবল থেকে ভারতকে উদ্ধার করতে এবং ভারতীয় জনগণের সমস্ত অংশের পূর্ণ সামাজিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করে শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ভারতকে পুনর্গঠনের এক দীর্ঘ, ব্যাপকবিস্তৃত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিরোধের জন্য বিপ্লবী কমিউনিস্টদের অবশ্যই প্রস্তুত হতে হবে। সংবিধান বাঁচানোর শ্লোগানকে একটি প্রতিরক্ষামূলক স্লোগান বা স্থিতাবস্থার সমর্থন হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। এই শ্লোগানের অর্থ হল সংবিধানের প্রস্তাবনায় দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলিকে বাস্তবায়িত করা। সেখানে ভারতকে একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং সমস্ত নাগরিককে স্বাধীনতা, সাম্য ও সংহতি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিসরে ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যখন ফ্যাসিবাদ ভারতকে ধ্বংস করার এবং আমাদের পিছন দিকে ঠেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী বিজয়ী প্রতিরোধ প্রজাতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করবে, জনগণের শক্তি ও উদ্যমকে অবারিত করে দেবে এবং ভারতকে বদলে দেবে এক অবিচল গণতন্ত্র তথা জনগণের ব্যাপকবিস্তৃত অধিকারের ঘাঁটিতে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-1