শহীদ কমরেড বকুল (অমল) সেন স্মৃতি অবিনশ্বর হোক
Comrade Bakul

১৯৭২ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের কোনও একটা দিনে আমাকে লালবাজার থেকে কোর্টে নিয়ে এসেছে। শিয়ালদহ কোর্ট লকআপের দোতালায় বকুলের সাথে দেখা হল। হাতের আঙুলের নখ দেখে বুঝলাম অকথ্য অত্যাচার হয়েছে ওর উপরে। আমরা কেস পার্টনার ছিলাম না, ঘটনা চক্রে আরও কয়েকটা তারিখ পড়ার পর আমরা দু’জনেই জামিনে ছাড়া পাই।

বহুদিন দেখা নেই বা দেখা করার তাগিদও ছিল না। একদিন আচমকা টিটাগড় স্টেশনে দেখা হল। জানালো ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসাবে ঢুকেছে। দল ভেঙে গেছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর ফের দেখা। রূপার মাধ্যমে আবার নতুন করে পার্টির সাথে যোগাযোগ হল।

অমল দ্রুত ২৮ জুলাই গোষ্ঠীর সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিল। নিজের বাসস্থান বেলঘরিয়ায় রাজনৈতিক কাজ শুরু করেছে। কয়েক মাসের মধ্যেই পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিনোদ মিশ্রের দেহরক্ষী হিসাবে কেন্দ্রীয় কাজে নিযুক্ত হল। পার্টির কাজ আন্তরিকভাবেই নিয়েছিল। পার্টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। পার্টির ভিতরে শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের সুত্রপাত হয়েছে। কমরেডরা নিজ নিজ কাঠামোয় রাজনৈতিক পর্যালোচনা ও মতামত রাখছেন। এই সময় অমলের মতামত দেওয়ার মতো কোনও সংগঠনিক কাঠামো ছিল না। ভিএম যেখানে যেতেন সঙ্গে থাকতো, মিটিংয়ের বাইরেই পাহাড়ায় থাকতে হোত। এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল। মাঝে ভোজপুরে গেছিল। সেখানকার অবস্থা দেখে উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে যায়।

গোপনীয়তার কারণে কে কোথায় যাচ্ছেন জানার রীতি ছিল না। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছিল। অমল ‘মা’কে জানিয়ে শিলিগুড়ি গেল। ঘটনার বিবরণ কাগজে প্রকাশিত হওয়ার পরই মাসীমা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।

সপ্তাখানেক পর সন্ধ্যার সময় রোজকারের মতো মাসীমা বারান্দায় বসে তাঁর সমবয়সীদের সামনে গীতা পাঠ করছেন। মাসীমার নজর পড়লো আমাদের দিকে। যারা বসে পাঠ শুনছিলেন তাদের তিনি চলে যেতে বলেন। মাসীমা আমাদের সামনে দুটো শব্দ প্রকাশ করলেন “নেই” আমি জানতাম এটাই ঘটবে। দ্বিতীয় কথা “তোমরা তাড়াতাড়ি চলে যাও”। অরিন্দম সেন আর আমি পা চালিয়ে হাটছি। স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম সন্তানহারা মায়ের শব্দহীন বুকফাটা আর্তনাদ। এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, অমলের বাড়ির সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ হতে হতে এক সময় আর থাকে না।

প্রায় ২০ বছর পর ৭ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে ভিএম অমলের মা-এর সাথে দেখা করতে আসেন। মাসীমা অশক্ত শরীরে ভিএম’এর মুখোমুখি। এতোদিন বাদে এলেন? আপনারা সবাই ভালো আছেন? রূপার সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল, ওর কুশল সংবাদ নিলেন। আমরা ৬ জন ছিলাম সবাইকে চা দিতে বলেন। এবার নিজের কথা শুরু করলেন।

আপনারা ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, ঘুরছেন শুধু আমার ছেলেটাই নেই। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে, ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। অমলের কথা লিখতে গিয়ে মাসীমার কথাই লিখে ফেললাম। কত মাসীমারা তাদের প্রিয় সন্তানকে এভাবে হারিয়েছেন। এইসব স্নেহশীল মায়েদের দৃঢ়তা, সচেতনতা কমিউনিস্ট আন্দোলনে বড় সম্পদ হয়েই আছে। এক কঠিন রূঢ় বাস্তব রাজনৈতিক প্রশ্নের সম্মুখীন সাধারণ সম্পাদক। শহীদের মা প্রশ্ন করছেন। ভিএম নতমস্তকে মাসীমার কথা শুনছেন ও অনুধাবন করার চেষ্টা করছেন।

ভিএম খুব ধীরস্থির ও বিনয়ের সাথে মাসীমার কাছে সেই দিনের ঘটনা তুলে ধরেন। শেষে মাসীমা বলে ওঠেন, “হ্যাঁ আমি একজন শহীদ বিপ্লবীর মা, আমি গর্বিত’’। এক বিরল ঘটনার সাক্ষী হলাম।

পার্টি শুদ্ধিকরণের মধ্য দিয়ে গণসংগঠন ও আন্দোলনের দিকে ঝুঁকছে সেই সময় বড়পথু জোতে ঘটে গেল এই ভয়ঙ্কর ঘটনা। সকালে প্রথমেই অমলের পেটে গুলি লাগে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সিআরপি স্মোকবম্ব ছুঁড়ছে, চালায় আগুন ধরেছে। খুন্তি, শাবল হাতের কাছে যা পেয়েছে তা দিয়ে মাটির দেওয়াল ভেঙে পাশের ঘরে সব কমরেডরা আশ্রয় নিয়েছেন। সিআরপি’র ঘেরাওয়ের মুখে সবাই আটকে পড়েছেন। অমল মনস্থির করে ফেলেছে পার্টি নেতৃত্বকে বাঁচাতেই হবে। যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। অমল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এক সিআরপি’র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাইফেল কেড়ে নিয়ে ফায়ারিং শুরু করে দেয়, বাহিনীর তিনজনের মৃত্যু হয় ও কয়েকজন আহত হয়। এই সুযোগে আহত অবস্থায় ভিএম ও নিমু সিং হামাগুড়ি দিয়ে বাহিনীর নাগালের বাইরে চলে যায়। তপন চক্রবর্তী ও রতন সেন গ্রেপ্তার হলেন। সিআরপি কমাণ্ডার অমলকে স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁজরা করে দিল। বীরের মতো নিজের জীবন পার্টিকে উৎসর্গ করে শহীদ হল বকুল (অমল) সেন ২ জানুয়ারি ১৯৭৯। অমলের মৃত্যু আজও নাড়া দিয়ে যায়। 

কমরেড বকুল (অমল) লাল সেলাম।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-1