সাবিত্রীবাই ও ফাতিমা শেখ আমাদের প্রথম শিক্ষিকা। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াইয়ের প্রতীক তাঁরা। ঊনবিংশ শতকের সামগ্রিক শিক্ষা বিস্তার আন্দোলনে তাঁরা অনন্য, ব্যতিক্রমী। মূলধারার ইতিহাসে নামজাদা সব সমাজ সংস্কারকদের শিক্ষা আন্দোলন যখন উচ্চবর্ণের লছমন রেখার গণ্ডিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন দলিত সমাজের মেয়েদের মাঝে আধুনিক শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলেছেন সাবিত্রীবাই ফুলে ও ফাতিমা শেখ। ১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারি সাবিত্রী ও ৯ জানুয়ারি ফাতিমা জন্মগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের সমস্তরকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আক্রমণ মোকাবিলা করে তাঁরা মহারষ্ট্রের পুণে শহর ও তার আসপাশে সাফল্যের সাথে গড়ে তুলেছিলেন মেয়েদের জন্য একের পর এক আধুনিক স্কুল। পড়ানো ছাড়াও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী জোগাড় করার কাজটা করতেন ফাতিমা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একেকটা পরিবারের লোকজনকে ধের্য্য ধরে বোঝাতেন মেয়েদের পড়াশোনা করার গুরুত্ব। নারীমুক্তি ও ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে ফাতিমা শেখ এবং সাবিত্রীবাই হয়ে উঠেছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা।
সাবিত্রীবাই ফুলে ছিলেন ভারতের প্রথম নারীবাদী সমাজ-বিপ্লবী। পিতৃতান্ত্রিক লছমনরেখা অতিক্রম করে লেখাপড়া শেখা, শিক্ষকতার ট্রেনিং নিয়ে মেয়েদের জন্য আধুনিক স্কুল খোলা, মাথা তুলে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে মেয়েদের নিজস্ব গণসংগঠন গড়ে তোলা, ব্রাহ্মণ্যবাদী বিবাহ প্রথাকে চ্যালেঞ্জ জানানো, ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবাদের তথাকথিত অবৈধ সন্তানদের জন্য সেফ হোম তৈরি করা ও বিধবাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধর্মঘট সংগঠিত করা, সমস্ত ধরনের পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও ঐতিহ্যকে সমাজে ও নিজের জীবনে চ্যালেঞ্জ জানানো — ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে এইসব তিনি করে গেছেন সারাটা জীবন ধরে, সমস্ত রকম প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করে। তাঁর কাছে শিক্ষা আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বহু কবিতায় বহুবার তিনি এই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে আহ্বান রেখেছেন, “ইংরেজি শেখো জাতের বিনাশ করতে”, অথবা বলছেন, “জাগো, ওঠো এবং শিক্ষিত হও, নিজেকে মুক্ত কর — ঐতিহ্য প্রথা গুঁড়িয়ে দাও”। তাঁদের শিক্ষণ পদ্ধতির মূল কথা ছিল স্বায়ত্ততা অর্জন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোটা তাঁর কাছে ছিল জাতের বিনাশ ও নারীমুক্তি আন্দোলনের হাতিয়ার। জাতের বিনাশ ঘটানোর আহ্বান তিনিই প্রথম রেখেছিলেন এবং জাতব্যবস্থার অবসানের প্রশ্নকে নারীমুক্তির প্রশ্নের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন। তাঁর সারা জীবনের সমস্ত কার্যকলাপে এই মৌলিক দিশা প্রকাশ পেয়েছে। সারা জীবন তিনি প্রত্যক্ষ এক্টিভিজমে যুক্ত ছিলেন। জাতব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তৃণমূল স্তরে সংগঠন গড়ার কাজ করেছেন তিনি। আবার, সত্যসোধক সম্মেলনে সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিগতকে রাজনৈতিক, আর মানবমুক্তির লড়াইকে ব্যক্তিগত করে তোলার যে কল্পনাতীত দৃঢ়তা সাবিত্রীবাইয়ের যাপনে দেখা যায় তা যে কোনও যুগের বিপ্লবীর কাছে অনুকরণের বিষয় হয়ে থাকবে। গণআন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে জীবনের শুরুতে গৃহত্যাগ করে পথে এসে দাঁড়াতে ভয় পাননি। তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ফাতিমা শেখ ও তাঁর দাদা উসমান শেখ। তেমনি মহামারি আক্রান্ত মানুষের সেবায় সর্বস্ব দিয়ে মৃত্যুবরণও করেছেন সাবিত্রী। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার রোষে ভিনজাতের প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল যখন মব-লিঞ্চ হয়ে যাচ্ছিল তখন সেই উন্মত্ত ভিড়ের মাঝে একাই ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই যুগলকে অনার কিলিঙের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আবার, পুণে শহরের ব্রাহ্মণদের সর্বাত্মক প্রতিরোধকে মোকাবিলা করে পুরোহিতবিহীন ‘সত্যসোধক বিবাহ’ সম্পন্ন করেছেন আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে। ব্রাহ্মণ বিধবা ও তাঁদের সন্তানদের জন্য সেফ হোম যেমন বানিয়েছেন, তেমনই এরকম এক ‘অবৈধ’ অনাথ সন্তানকে নিজেরা অফিসিয়ালি দত্তকও নিয়েছেন। তাঁর এই সন্তানের বিবাহও দিয়েছেন সত্যসোধক পথে এবং বিবাহের পূর্বেই হবু পুত্রবধুকে বাড়িতে এনে রেখেছেন বর-কনের পারস্পরিক সম্মতি যাচাই করে নিতে। জ্যোতিবার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের লোকাচার নিজের হাতে সম্পন্ন করেছেন ব্রাহ্মণ্য পরিবারতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। ভারতের বর্তমান বাস্তবতাতে সাবিত্রী ও ফাতিমাদের জীবন ও সংগ্রামের কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত অভিঘাত নিয়ে হাজির হয়।
দুই শতক পেরিয়ে আজ ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র নতুন করে নৃশংস চেহারা নিচ্ছে ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। পিতৃতান্ত্রিক শক্তিগুলির কাছে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার হাতিয়ার হলো ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি’। এদের নেতৃত্বে ‘সম্মান’ ও ‘সংস্কার’এর নামে মেয়েদের হত্যা করা হচ্ছে, পণের জন্য হত্যা করা হচ্ছে, গৃহহিংসা ও ধর্ষণ প্রকাশ্যেই উৎসাহিত হচ্ছে, দেবদাসী প্রথা মহিমান্বিত হচ্ছে। শিক্ষা, বিয়ে, চাকরি বা জীবনে বাঁচার ক্ষেত্রেও মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও সিদ্ধান্তকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এই শক্তিগুলি। মেয়েদের নিজেদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার বা নাগরিক হওয়ার অধিকার দাবি করলে এই শক্তিগুলির ‘ধর্মবোধ’ হুমকির মুখে পড়ে এবং এই আহত মেকী ধর্ম-বোধকে নারীর উপর হিংসার কারণ হিসাবে দেখানো হয়।
১৪৬টি দেশের মধ্যে লিঙ্গবৈষম্যের বিশ্বতালিকায় ভারত এখন ১৩৫ নম্বরে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে, যেখানে, বিজেপি ক্ষমতায় আসীন, সেখানে আইন পরিবর্তন করে মেয়েদের নিজেদের জীবনযাপনের অধিকার বিলুপ্ত করা হচ্ছে এবং ন্যায্যতা পাচ্ছে মনুস্মৃতি। মনুর এই বিধান অনুযায়ী, দলিত ও নারীদের সর্বদা পরাধীন থাকতে হবে। তাই বিজেপির অধীনে থাকা সরকারেরা যখন বাবা আশারাম, রামরহিমের মতো প্রমাণিত ধর্ষক এবং বিলকিস বানোর গণধর্ষক বিজেপি নেতাদের সুরক্ষা দেয়, সাজা মকুব করে, নির্বাচনী প্রচারে এদের আশীর্বাদ ও সহযোগীতা চায়, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না, বরং এই আচরণই বিজেপি-আরএসএসের মতো শক্তিদের জন্য স্বাভাবিক। এই সরকার একদিকে স্কুল-কলেজে মাথায় স্কার্ফ পরা মুসলিম মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তাদের পড়াশোনার অধিকার কেড়ে নেয়, অন্যদিকে বিলকিস বানোর ধর্ষকদেরকে ‘সংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ’ আখ্যা দিয়ে জেল থেকে মুক্তি দেয়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, আদালতে গার্হস্থ হিংসার অমীমাংশিত কেসের ঘটনা ৪ লক্ষের বেশি। ২০২০ সালে ভারতে ধর্ষকদের সাজা দেওয়া হয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ। অভিযোগ জানাতেই পারেননি এমন মহিলাদের সংখ্যা অসংখ্য। অন্যদিকে, ইউনিয়ন বাজেট ২০২১’র প্রস্তাবনার সময় দেখা গেলো, বিজেপি সরকার মেয়ে শিশুদের শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাজেটের থেকে ৯৯ শতাংশ তহবিল ছেঁটে ফেলেছে। উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের জন্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করা বা বৃত্তি বাড়ানোর বদলে ‘নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রকে বেসরকারী ও পশ্চাদপদ সংস্থাগুলির হাতে তুলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। যার ফলে, গরিব, খেটে খাওয়া, নিপীড়িত অংশের মেয়েরা পড়াশোনার প্রাঙ্গন থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হবে এবং সম্পূর্ণ শিক্ষাদানই হয়ে পড়বে নারী-শুদ্র-সংখ্যালঘু বিদ্বেষী ভাবধারার শিকার। সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রচলিত মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বৃত্তি, যার সাহায্যে বহু মুসলিম ও সংখ্যালঘু মেয়েরা উচ্চশিক্ষা করার সুযোগ ও সুবিধা পেত, সেটিকে বিনা আলোচনায় বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতে ১০০ জনে ৩০ জনের বেশি নারী আজও নিরক্ষর। মাত্র ৪১ শতাংশ ছাত্রীই মাত্র ১০ বছর ও তারও কম বছর স্কুলে টিঁকে থাকতে পারছে। কোভিডের পর কত সংখ্যক ছাত্রী যে স্কুল-ছাড়া হয়েছে তার হিসাব পাওয়া দুষ্কর। ভারতের সমগ্র শ্রমশক্তিতে মেয়েদের যোগদান এখনও ২০ শতাংশ ছুঁতে পারেনি। এবং এর সিংহভাগটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে বেতন বৈষম্য প্রকট।
বর্তমান ভারতে, নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতার সামগ্রিক এই সংকটের মধ্যে, বিজেপির মহিলানেত্রী সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুর হিন্দুদের বাড়িতে ধারালো অস্ত্র রাখার এবং হিন্দুদের ‘শত্রু’দের শিরচ্ছেদ করার জন্য উস্কানিমূলক প্রচার চালাচ্ছে। এরা হিন্দু এবং মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রাচীর তৈরি করতে চায়। এই বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদের, চিনে নিতে হবে বিভাজনের মাধ্যমে নারীকে বন্দী করার ফ্যাসিবাদী কৌশলকে। এই লড়াইয়ে আমাদের পাথেয় সাবিত্রী ও ফাতিমার বিপ্লবী বন্ধুত্বের ঐতিহ্য। এই দুই নারীকে স্মরণ করা আবশ্যক, যারা প্রায় দুশো বছর আগে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দৃষ্টান্ত কায়েম করে, জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মহিলাদের শিক্ষা ও সমতার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন।
আসুন আমরা ৩ জানুয়ারী ২০২৩ সাবিত্রীবাইয়ের জন্মদিন থেকে ৯ জানুয়ারী ২০২৩ ফাতিমা শেখের জন্মদিন পর্যন্ত একটি প্রচারাভিযান চালিয়ে এই দুই ভারতীয় নারীর বিপ্লবী উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাই, পিতৃতন্ত্র ও মনুবাদের দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রামকে তীব্র করি এবং শিক্ষা ও সমতার অধিকার দাবি করি।
জাত-ধর্মে ভাগ হব না! শিক্ষা ও সাম্যের জন্য লড়ে যাব!
আমাদের দাবিগুলি হল,
(১) কেজি থেকে পিজি পর্যন্ত মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা চাই।
(২) প্রতিটি পঞ্চায়েতে একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং প্রতিটি ব্লকে একটি কলেজ তৈরি করতে হবে যাতে দেশের প্রতিটি মেয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
(৩) শিক্ষার বেসরকারীকরণ বন্ধ কর।
(৪) সমস্ত মেয়ের কর্মসংস্থান চাই।
(৫) স্কুল পাঠ্যক্রমে সাবিত্রীবাই ফুলে ও ফাতিমা শেখের জীবনসংগ্রাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।